ইসলামিক প্যারেন্টিং
- তিনা খান
(৭ম কিস্তি)
নেককার-বুযুর্গদের সোহবতে নিয়ে যাওয়া
অভিভাবক সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকবে যে, কোন সত্যনিষ্ঠ আলেমের সাক্ষাৎ মিলে কী না? কোন উপলক্ষ্য তৈরি হলে সন্তানকে তাদের সোহবতে নিয়ে যাওয়া। তাদের থেকে দু‘আ নেয়া। তাদের নেক-নজর পড়লে সন্তানের জীবন হবে ধন্য। মনের অজান্তে তারা হয়ে উঠবে তাদের অনুসারী। কারণ, নেক সুহবতের অনেক মূল্য রয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর পুত্র ছালিহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আমার পিতার কাছে কোন দুনিয়াবিমুখ আলেম আসলে আমাকে উদ্বুদ্ধ করতেন, আমি যেন তাদের মত হতে পারি’।[১] আর এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, বাচ্চাদের আসল তারবিয়ত হল অসৎ বন্ধু থেকে দূরে রাখা।[২]
সন্তানকে ভালো পরিবেশে রাখুন
সন্তানের জীবনে ভালো পরিবেশের প্রভাব অপরিসীম। তাই সন্তানকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে হলে উত্তম সহাবস্থানের কোন বিকল্প নেই। কারণ, প্রবাদে আছে: ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। বনী আদম পরিবেশ দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়। একে অপরের চরিত্র খুব দ্রুত গ্রহণ করে। দেখা যায় কোন মানুষ যদি কোন প্রাণীর সাথে কিছুদিন ওঠাবসা করে, তাহল সেও তার আচার-আচরণ কিছুটা গ্রহণ করে ফেলে। এ কারণে দেখা যায় উটের রাখালদের মাঝে অহংকার-গর্ব বেশি থাকে। পক্ষান্তরে বিনয় ও নম্রতা বেশি থাকে ছাগলের রাখালদের মাঝে (ইক্বতিযাউয ছিরাতিল মুস্তাকীম)।
অভিভাবকমাত্রই সন্তানকে নেককাররূপে গড়ে তুলতে আগ্রহী হতে হবে। নেককার বানাতে হাতে-কলমে শেখাতে হবে অনেক কিছু। যেমন: একদিন সে শ্রমিকদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করল, আর প্রত্যক্ষ করল যে তারা সূর্যের প্রখর তাপে দ্বিপ্রহরে কাজ করছে। এ সময় আপনি গাড়ির এসি বা ফ্যান বন্ধ করে জিজ্ঞেস করুন: বাবা, এসব মানুষ সূর্যের উত্তাপ সহ্য করে কীভাবে কাজ করছে? তোমরা যদি তাদের স্থানে হতে তাহলে কী করতে? অতঃপর তাদের স্মরণ করিয়ে দিন আল্লাহ তা‘আলা কী পরিমাণ নে‘মত তাদের প্রতি দান করেছেন। আরও স্মরণ করিয়ে দিন সেই হাদীছের কথা, فَإِنَّ شِدَّةَ الْحَرِّ مِنْ فَيْحِ جَهَنَّمَ ‘নিশ্চয় গরমের প্রখরতার উৎস হচ্ছে জাহান্নামের উত্তাপ’।[৩]
সস্তানের সাথে চা পানের ফাঁকে হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ করুন। ভালোবাসা নিবেদন করে বোঝান তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। এমন একটি চায়ের আসর পূর্ণ দরস থেকে অনেক ফলপ্রসূ হয়। কারণ, ভালোবাসার মোড়কে দীক্ষাদান অনেক বেশি কার্যকরী হয়। এতে করে সুজলা-সুফলা হয় তার মনের উদ্যান। ভরে যায় আনন্দে তার দেহমন।
সন্তানকে দ্বীনি মজলিসে নিয়ে যান
সন্তান পিতার সান্নিধ্যে থাকলে তার মাঝে সৃষ্টি হয় পৌরুষ। চিন্তাচেতনায় হয় সে পরিপক্ক। হিম্মতে হয় পর্বতসম। আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদিন কুরাইশের মজলিসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
্রمَا لَكُمْ قَدْ طَرَحْتُمْ هَذِهِ الْأُغَيْلِمَةَ؟ لَا تَفْعَلُوْا، وَأَوْسِعُوْا لَهُمْ فِي الْمَجْلِسِ، وَأَسْمِعُوْهُمُ الْحَدِيْثَ، وَأَفْهِمُوْهُمْ إِيَّاهُ. فَإِنَّهُمْ صِغَارُ قَوْمٍ، أَوْشَكَ أَنْ يَكُوْنُوْا كِبَارَ قَوْمٍ وَقَدْ كُنْتُمْ صِغَارَ قَوْمٍ، فَأَنْتُمُ الْيَوْمَ كِبَارُ قَوْمٍগ্ধ.
‘তোমাদের কী হলো যে, এ সকল বাচ্চাদের মজলিস থেকে দূরে রেখেছো? তোমরা এমনটি করো না; বরং তাদের জন্য মজলিসে জায়গা প্রশস্ত করো, তাদের কথাগুলো শ্রবণ করাও এবং বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে দাও। কারণ, আজকে তারা যদিও ছোট, অচিরেই তারা হবে জাতির কর্ণধার। নেতৃত্বের বাগডোর আসবে তাদের হাতেই। একসময় তোমরা কি শিশু ছিলে না? অথচ এখন তোমরা হয়েছ কওমের সর্দার এবং জাতির কর্ণধার’।[৪]
ক্ষুদ্র বিষয়কে উপদেশের মাধ্যম বানাতে শিখুন
সফল মুরব্বি সামান্য বিষয়কে সন্তানের সামনে অসামান্য করে দেখাতে পারে। তুচ্ছ বস্তু থেকে দিতে পারে পরকালের অমূল্য পাথেয়। আর এভাবে সন্তানের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় ব্যাপক ক্রিয়া। আবেগ হয় স্বচ্ছ। জ্ঞান হয় তার বহতা নদীর মত। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ প হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ مَرَّ بِالسُّوْقِ دَاخِلًا مِنْ بَعْضِ الْعَالِيَةِ وَالنَّاسُ كَنَفَتَهُ فَمَرَّ بِجَدْىٍ أَسَكَّ مَيِّتٍ فَتَنَاوَلَهُ فَأَخَذَ بِأُذُنِهِ ثُمَّ قَالَ ্রأَيُّكُمْ يُحِبُّ أَنَّ هَذَا لَهُ بِدِرْهَمٍগ্ধ. فَقَالُوْا مَا نُحِبُّ أَنَّهُ لَنَا بِشَىْءٍ وَمَا نَصْنَعُ بِهِ قَالَ ্র أَتُحِبُّوْنَ أَنَّهُ لَكُمْগ্ধ. قَالُوْا وَاللهِ لَوْ كَانَ حَيًّا كَانَ عَيْبًا فِيْهِ لِأَنَّهُ أَسَكُّ فَكَيْفَ وَهُوَ مَيِّتٌ فَقَالَ ্র فَوَاللَّهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْগ্ধ.
‘একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাজারের পাশ দিয়ে গেলেন। এমতাবস্থায় যে, তাঁর দুই পাশে লোকজন ছিল। অতঃপর তিনি ছোট কানবিশিষ্ট একটি মৃত ছাগল ছানার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তার কান ধরে বললেন, তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের পরিবর্তে এটাকে নেয়া পসন্দ করবে?’ তাঁরা বললেন, আমরা কোন জিনিসের বিনিময়ে এটা নেয়া পসন্দ করব না এবং আমরা এটা নিয়ে করবই বা কি?’ তিনি বললেন, তোমরা কি পসন্দ কর যে, (বিনামূল্যে) এটা তোমাদের হোক? ’ তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম! যদি এটা জীবিত থাকত তবুও সে ছোট কানের কারণে দোষযুক্ত ছিল। এখন তো সে মৃত (সেহেতু একে কে নেবে)?’ তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট এই মৃত ছাগল ছানাটা যতটা নিকৃষ্ট, দুনিয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট’।[৫] জারীর ইবনু আব্দুল্লাহ য হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كُنَّا عِنْدَ النَّبِىِّ ﷺ إِذْ نَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ فَقَالَ ্রأَمَا إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا، لَا تُضَامُّوْنَ-أَوْ لَا تُضَاهُوْنَ-فِىْ رُؤْيَتِهِ، فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لَا تُغْلَبُوْا عَلَى صَلَاةٍ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ، وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا فَافْعَلُوْاগ্ধ .
‘এক রাতে নবী (ﷺ)-এর নিকট ছিলাম। হঠাৎ তিনি পূর্ণিমা রাতের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন! এটি যেমন দেখতে পাচ্ছ, তোমাদের প্রতিপালককেও তোমরা তেমনি দেখতে পাবে। তাঁকে দেখতে তোমরা ভিড়ের সম্মুখীন হবে না। কাজেই তোমরা যদি সূর্য উঠার পূর্বের ছালাত ও সূর্য ডুবার পূর্বের ছালাত আদায়ে সমর্থ হও, তাহলে তাই কর’।[৬]
বাহ! কী চমৎকার দৃষ্টান্ত! কতই-না সুন্দর উপস্থাপনা! কী তাঁর বাচনভঙ্গি! ছাহাবীদের সাধারণ বিষয় থেকে কত দামি ও মূল্যবান নসীহত করতেন! আমাদের মত অভিভাবকদের এমন দৃষ্টান্ত থেকে সবক গ্রহণ করা উচিত।
সন্তানের সাথে আলোচনা করুন
পারস্পরিক আলোচনা নববী সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। নবী করীম (ﷺ) প্রায়ই ছাহাবীদের সাথে সংলাপে লিপ্ত হতেন। অকাতরে শেখাতেন অনেক কিছু। তাই কর্তব্য হলো মাঝে-মধ্যেই ছেলে-মেয়েদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা। যেমন ধরুন আমার সাথে সন্তান গাড়িতে বসে আছে, আমি তাকে শোনাতে থাকি নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। তার হৃদয়ে সরবরাহ করতে থাকি নানা তথ্য-উপাত্ত। নিজেও শুনি তার আশা-আকক্সক্ষা গল্প। জীবনে ঘটে যাওয়া ঘাত-প্রতিঘাতের সাতকাহন। নববী সীরাতে এমন হাজারো ঘটনা দেদীপ্যমান। মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর নবী (ﷺ)-এ পেছনে বসা। তাকে লক্ষ্য করে নবী (ﷺ) বলেন, ‘হে মু‘আয! তুমি কি জানো বান্দার ওপর আল্লাহর হক কী?’।[৭] আরেকবার ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে বললেন, ‘হে ছেলে! আল্লাহকে হেফাযত কর, তিনি তোমাকে হেফাযত করবেন’।[৮]
গল্পে গল্পে প্যারেন্টিং শিক্ষা
পাশের ভাড়াটিয়া। এ পাড়ায় নতুন এসেছেন। পরিচিত হতে এলেন। এ ঘরের বাচ্চাগুলোকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা মনে হয়। চোখে পড়ে। ভদ্র আর শান্তশিষ্ট। এ নিয়ে তার কৌতূহলের অন্ত নেই। আশেপাশে আরও বাড়িতেও এ ক’দিনে যাওয়া হয়েছে। গিন্নিদের সাথে গল্প হয়েছে। মেজবান হাসিমুখে অভ্যর্থনা করে বসালেন। ঘরের সাজানো-গোছানো পরিবেশ দেখে, মেহমানের চোখ জুড়িয়ে গেল। চারটা ফুটফুটে বাচ্চা। তিনটা ঘর জুড়ে হুটোপুটি করছে। বেড়াল ছানার মত। তৃতীয় বাচ্চাটার বয়স তিন কি চার হবে। জড়ানো আদুরেকণ্ঠে বলে উঠল:
-আম্মু! আজ জান্নাতে ঘর বানাবে না?
তার দেখাদেখি বাকি দু’জনও বলতে শুরু করলা:
-আম্মু! আজ জান্নাতে ঘর বানাবে না?
মেহমান অবাক হলেন। এত ছোট্ট পিচ্চি এটা কী বলছে? জান্নাতে ঘর কীভাবে বানাবে? মেজবানকে প্রশ্ন করলেন:
-‘জান্নাতে ঘর বানানো’ ব্যাপারটা কী?
শুনে মেজবানের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন:
-একটু অপেক্ষা করুন! নিজের চোখেই দেখে যাবেন ব্যাপারটা! ওটা আমাদের ছানাদের ঘরোয়া খেলা!
মা হাতের কাজটা গুছিয়ে এলেন। মেহমানকে হালকা নাশতা দিলেন। তারপর কোলেরটাকে নিয়ে মেঝেতে বসে গেলেন। বড় মেয়ে আর ছোট দু’ভাই মাকে ঘিরে বসল। সবার চোখ-মুখ থেকে উৎসাহ-উদ্দীপনা ঠিকরে বেরুচ্ছে!
-এক দুই তিন! শুরু ‘জান্নাতমহল’ নির্মাণ!
তিন কচিকাঁচা একসাথে কোরাস করে সূরা ইখলাছ পড়তে শুরু করল।
পড়া শেষ হলো। একে একে দশ বার পড়া হলো।
পড়া শেষ করে সবাই সমসার হই হই করে উঠল: আলহামদুলিল্লাহ। আমরা জান্নাতে একটা প্রাসাদ বানিয়েছি।
-খুব ভালো করেছ!
-এবার বলো তো বাছারা! তোমরা এই প্রাসাদে কী রাখতে চাও?
-‘কুনূজ’। ধনভাণ্ডার রাখতে চাই, আম্মু।
-ঠিক আছে রাখো। ‘লা হাওলা ওয়া লা কুউয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
-ও আল্লাহ! কী বড় কুনূজ বানিয়েছ!
-আচ্ছা, এবার বলো তো, কাকে বেশি ভালোবাসো?
-আল্লাহকে।
-তারপর?
-আমাদের নবীজি (ﷺ)-কে।
-ক্বিয়ামতের দিন সবার কেমন লাগবে?
-ভীষণ পিপাসা লাগবে!
-আর কী লাগবে?
-নবীজির সুপারিশ লাগবে!
-তোমরা কি সেদিন সুপারিশ আর পানি পেতে চাও?
-জি চাই!
-তা হলে বলো- আল্লাহুম্মা ছাল্লী ‘আলা মুহাম্মাদ ওয়া ‘আলা আলি মুহাম্মাদ ... ইন্নাকা হামীদুম মাজীদ তথা দুরূদে ইবরাহীম পড়।
-আচ্ছা, কার কার জান্নাতে বাগান করার শখ?
-আমার! আমার আমার!
-তা হলে?
-সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ!
বাচ্চারা একে একে আরও যিকির করে গেল। একসময় শেষ হলো যিকির যিকির খেলা। এবার সবাই আগের হুটোপুটিতে ফিরে গেল ।
মেজবানের দু-চোখ কপালে। এত সুন্দর খেলার কথা তার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। তার ছেলে-মেয়েগুলো যিকির দূরের কথা ‘নবীজি’ কে সেটাও ঠিকমতো বলতে পারবে কি না ঘোরতর সন্দেহ! তাদের বাবাটাও কি! নিজেও ধর্মকর্মের ধার ধারবে না, অন্যদেরও ধর্ম পালন করতে দেবে না। তার কথা হলো, কী দরকার এসব! বুড়ো হলে তখন দেখা যাবে! এমন যার মনোভাব, তার ছেলেমেয়েরা আল্লাহ-রাসূল চিনবে কী করে!
একটি মা একটি জাতি!
মানুষটাকে দেখলেই বোঝা যায়, ধর্মকর্মের অতটা ধার ধারেন না। বিশেষ পরিচয়ের সূত্রে তার গাড়িতে উঠতে হলো। আমাদের গাড়ি কুয়ালালামপুরের বাইরে একটা গ্রামে যাচ্ছিল। আমি পথেই নেমে যাব। গাড়ির পেছনের আসনে তার দুই ছেলে। শহরের স্কুলে পড়ে। এখন বাড়ি যাচ্ছে। মায়ের কাছে। একটু পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, বাচ্চা দুটো কিছুক্ষণ পরপরই ‘আল্লাহু আকবার’ বলছে। আবার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলছে। মাঝে মাঝে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলছে। ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলছে।
প্রথম প্রথম কিছু বললাম না। তাদের আনন্দে বাগড়া দিতে মন চাইল না। দু- ভাই বেশ আনন্দ আর উৎসাহের সাথেই কাজটা করছে। মনে হলো তারা প্রতিযোগিতা করছে। কে কার আগে বলবে। কে কার চেয়ে বেশি বলবে!
শেষমেষ থাকতে না পেরে তাদের বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ওদের কচিমুখে যিকির শুনতে বেশ ভালো লাগছে! সবসময়ই এভাবে যিকির করে বুঝি?
-ঠিক সবসময় নয়। তারা আসলে নবী (ﷺ)-এর একটা সুন্নাত পালন করছে। তিনি সফরে গেলে, উঁচুতে আরোহণ করার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন। নিচে নামার সময় সুবহানাল্লাহ বলতেন। বাচ্চারাও তাই করছে।
-আপনাকে দেখে তো ধার্মিক মনে হয় না। তারা এসব শিখল কোথা থেকে?
-তাদের মায়ের কাছে!
-আপনি বড়ই সৌভাগ্যবান! এমন একজন স্ত্রী ঘরে তুলতে পেরেছেন।
-তা বলতে পারেন। আমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। অনেক বড় এক পুরস্কার। সন্তানকে দ্বীনদার হিসাবে গড়ে তুলতে তার মেহনত-মোজাহাদার কোনো শেষ নেই!
-তিনি কি বিশেষ কোন পদ্ধতি অবলম্বন করেন? এত ছোট বয়েসেই বাচ্চা দু’টো যিকিরে অভ্যস্ত হয়ে গেল?
-ওদের মা প্রতিটি কাজই সুন্নত তরীকায় করার চেষ্টা করে। ধরুন ‘বাথরুমে’ যাবে, প্রবেশ করার আগে বাচ্চাদের শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে দু’আ পড়ে। কখনো বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে, বলো তো এখন কোন্ দু’আটা পড়ব? এখন কোন্ পা দিয়ে প্রবেশ করব? বাচ্চারাও কোন কাজ করতে গেলে, প্রথমেই মাকে সে কাজের আদব ও সুন্নাত বলে যেতে হয়। না পারলে মায়ের মুখে মুখে বলে তারপর যেতে হয়। ঘুম-খাওয়া-নাওয়া স্কুলে যাওয়া সবখানেই তাদের প্রথম প্রথম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হত। এখন ওরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
বাচ্চাদের মায়ের আরেকটা সুন্দর পদ্ধতি আছে। ছোটদের মাঝে ঝগড়া-তর্ক লেগেই থাকে। খুনসুটি, মন কালাকালি হরদম হতেই থাকে। দুই ভাইয়ের কারও মুখ থেকে যদি রাগের মাথায় বেফাঁস কথা বের হয়ে যায়, তাদের মা সাথে সাথে দু’জনকেই কাছে ডাকে। শাসনের স্বরে। একটু রাগত ভঙ্গিতে।
-দু’জনই এদিকে এসো! বসো। আচ্ছা আমাকে বলো, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? শয়তানকে না আল্লাহকে?
-আম্মু! আমি আল্লাহকে বেশি ভালোবাসি!
-তুমি কি আল্লাহর বন্ধু হতে চাও, না-কি শয়তানের বন্ধু?
-আমি আল্লাহর বন্ধু হতে চাই!
-তোমার কাজে তো সেটার প্রমাণ পেলাম না। তুমি এখন যে ভাইয়াকে ‘কটু কথা’ বললে, এমন কাজ শুধু শয়তানের বন্ধুরাই করে! আল্লাহর বন্ধুরা কখনোই এমন কাজ করে না। যে এমন কাজ করে, শয়তান তার পিঠে চড়ে বসে বসে হো হো করে হাসতে থাকে! তুমি কি চাও শয়তান তোমার কাজ দেখে খুশিতে হাসুক?
-জি না, আম্মু; আমি শয়তানকে হাসাতে চাই না ।
-কী করতে চাও?
-আমি শয়তানকে কাঁদাতে চাই।
-তাহলে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
-কী কাজ আম্মু?
-ক্বিবলামুখী হয়ে, একশ’ বার ইস্তেগফার করতে হবে।
-আম্মু, একশবার পড়েছি।
-এত তাড়াতাড়ি! কিন্তু শয়তানের কান্না তো ঠিকমতো শোনা যাচ্ছে না। আরও পঞ্চাশবার পড়ে এসো।
-আম্মু, পড়েছি।
-উঁহু। শয়তানের কান্নাটা বড্ড আস্তে শোনা যাচ্ছে। আরও বিশবার পড়ে দেখো তো! তার কান্নার আওয়াজ বাড়ে কি না দেখি!
-আম্মু, পড়েছি! কান্না শোনা যাচ্ছে?
-হুঁ, তবে আরও জোরে কাঁদাতে পার কি না দেখো! দশবার পড়ে ফেলো।
-পড়েছি।
-এবার হয়েছে! শয়তান এবার হাউমাউ করে কাঁদছে!
-আম্মু! শয়তানকে আরও জোরে কাঁদাই?
-তাহলে তো খুবই ভালো! সে ভবিষ্যতে তোমার কাছে ঘেঁষার সাহস করবে না!
একটা শিশু ছোটবেলা থেকেই এভাবে আল্লাহর পসন্দ-অপসন্দ জেনে গেলে এবং সে অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার শিক্ষা পেলে, বড় হলে এমন ছেলে বাবা-মায়ের অবাধ্য হতে পারে না। কারণ, সে জানে বাবা-মায়ের সন্তুষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি।
আগের যুগের মানুষ সম্পর্কে আমরা নানা কথা শুনি। তাদের অনন্য কীর্তির কথা পড়ি। এখন সেগুলো অবিশ্বাস্য মনে হয়। একটু চিন্তা করে দেখলেই সেগুলোকে অসম্ভব মনে হবে না। তারা জন্মের আগে থেকেই একজন ‘নেককার’ মায়ের ছায়াতে ছিল। একজন ধার্মিক মায়ের কোলে বড় হয়েছিল। একজন মুত্তাকী মায়ের আঁচল ধরে পৃথিবীকে চিনেছিল। একজন পর্দানশীন মায়ের শাসনে বেড়ে উঠেছিল।
একজন মহিয়সী মায়ের কারণেই একটি শিশু সাত বছর বয়েসেই কুরআনের হাফেয হয়ে যায়। কেউ নয় বছরে হাফেয হয়ে যায়। মায়ের নিবিড় তত্ত্বাবধানের বরকতেই ইমাম শাফেয়ী (রাহিমাহুল্লাহ) মাত্র চৌদ্দ বছর বয়েসেই ‘ফাতাওয়া’ দিতে শুরু করেছিলেন। একজন ইলমপিপাসু মায়ের কারণেই, ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) মাত্র বারো বছর বয়সে প্রতিদিন বারোজন শায়খের কাছে পাঠ নিতে যেতেন!
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* মাদারটেক, ঢাকা।
তথ্যসূত্র:
[১]. তাবাক্বাতে হানাবিলা, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭২।
[২]. মাওইযাতুল মুমিনীন, পৃ. ২০৪।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৬১৫।
[৪]. খত্বীব আল-বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ (আঙ্কারা: দারু ইহইয়াইস সুন্নাহ আন-নাবাবিয়্যাহ, তাবি), পৃ. ৬৫।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৫৭; মিশকাত, হা/৫১৫৭।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৩৩।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৫৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৩০।
[৮]. তিরমিযী, হা/২৫১৬; মিশকাত, হা/৫৩০২, সনদ ছহীহ।
প্রসঙ্গসমূহ »:
নারীমঞ্চ