শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৪৩ অপরাহ্ন

ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা

-গুলশান আখতার*



(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(৬) সঠিক ওযন দেয়া

ব্যবসা-বাণিজ্যের ইসলামী বিধান হল- ওযন সঠিক দিতে হবে, কম দেয়া যাবে না। ওযনে কম দিলে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অর্থ উপার্জনে মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, فَاَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَ الۡمِیۡزَانَ وَ لَا تَبۡخَسُوا النَّاسَ اَشۡیَآءَہُمۡ ‘তোমরা মাপ ও ওযন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিও না’ (সূরা আল-আ‘রাফ : ২৬)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَیۡلٌ لِّلۡمُطَفِّفِیۡنَ – الَّذِیۡنَ اِذَا اکۡتَالُوۡا عَلَی النَّاسِ یَسۡتَوۡفُوۡنَ- وَ اِذَا کَالُوۡہُمۡ اَوۡ وَّزَنُوۡہُمۡ یُخۡسِرُوۡنَ

‘মন্দ পরিণাম তাদের জন্য, যারা কম দেয়, লোকদের নিকট হতে নেয়ার সময় পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে এবং যখন তাদের জন্য ওযন করে দেয়, তখন কম দেয়’ (সূরা আল-মুত্বাফফিফীন : ১-৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় গমন করে দেখলেন যে, সেখানকার লোকজনের মাপ ত্রুটিপূর্ণ, তখন তিনি মদীনার সকল লোকদের সঠিক পরিমাপে ক্রয়-বিক্রয়ের নির্দেশ দিলেন। ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا بِعْتَ فَكِلْ وَإِذَا ابْتَعْتَ فَاكْتَلْ ‘যখন তুমি বিক্রয় করবে, তখন সঠিকভাবে মেপে দিবে। আর যখন তুমি খরিদ করবে, সঠিকভাবে মেপে নিবে’।[১]

(৭) মুনাফাখোরী না করা

কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে বাজার দর উপেক্ষা করে অধিক মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে চড়া মূল্যে বিক্রয় করাকে মুনাফাখোরী বলে। আর যে ব্যক্তি এ অসাধু নীতিতে অধিক মুনাফা লাভ করে তাকে মুনাফাখোর বলে। মুনাফাখোরীকে ইংরেজীতে ‘More profit’ বলা হয়। মুনাফাখোরী ব্যবসা ইসলামে নিষিদ্ধ। তবে ইসলামে বৈধভাবে ব্যবসা করার যেমন অধিকার রয়েছে, বৈধ মুনাফা লাভেরও তেমন অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে অপকৌশল অবলম্বন করে মুনাফা অর্জন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।[২] যেমন কোন শহরে খাদ্যশস্যের অভাব রয়েছে। এ সুযোগে শহরের বাইরে গ্রামে গিয়ে সকল খাদ্য কম দামে ক্রয় করে শহরে বেশি মূল্যে বিক্রয় করে। এরূপ লেনদেনে শহরের ভোক্তা ও গ্রামের শস্য মালিক উভয়ে প্রতারিত হয়। শহরবাসী লোকের জন্য পল্লীবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করা হারাম। এ প্রসঙ্গে ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,

نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ تُتَلَقَّى الرُّكْبَانُ وَأَنْ يَبِيْعَ حَاضِرٌ لِبَادٍ قَالَ فَقُلْتُ لاِبْنِ عَبَّاسٍ مَا قَوْلُهُ حَاضِرٌ لِبَادٍ قَالَ لَا يَكُنْ لَهُ سِمْسَارًا

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অগ্রগামী হয়ে পণ্য বহনকারী কাফেলার সাথে মিলিত হতে এবং শহরবাসীকে পল্লীবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, শহরবাসী পল্লীবাসীর পক্ষ হয়ে বিক্রি করার অর্থ কী? তিনি বললেন, সে তার দালাল হবে না’।[৩]

(৮) দামের উপর দাম না বলা

কোন ক্রেতা যদি দ্রব্য সামগ্রী ক্রয়ের জন্য দরাদরি করে, তাহলে তার উপর দাম কমিয়ে দরাদরি করা নিষেধ। এতে মানুষের আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ধরণের দরাদরি করে ক্রয় করাকে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, لَا يَبِيْعُ بَعْضُكُمْ عَلَى بَيْعِ بَعْضٍ ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন অপরের দামের উপর দাম চড়িয়ে কোন বস্তু ক্রয় না করে’।[৪]

(৯) চুক্তি লিপিবদ্ধ করা

বিক্রয় চুক্তি সম্পন্ন হয় বিক্রয়ের প্রস্তাব ও তা গ্রহণের মাধ্যমে। ব্যবসা-বাণিজ্যের চুক্তি লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন, যাতে মানুষ তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বর্ম বন্ধক রেখে অর্থ গ্রহণ করেছিলেন।[৫] পবিত্র কুরআনে এ ধরণের অনুমোদন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا تَدَایَنۡتُمۡ بِدَیۡنٍ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی فَاکۡتُبُوۡہُ ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা একে অন্যের সাথে নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮২)। পরের আয়াতে আরও বলা হয়েছে,

وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ عَلٰی سَفَرٍ وَّ لَمۡ تَجِدُوۡا کَاتِبًا فَرِہٰنٌ مَّقۡبُوۡضَۃٌ فَاِنۡ اَمِنَ بَعۡضُکُمۡ بَعۡضًا فَلۡیُؤَدِّ الَّذِی اؤۡتُمِنَ اَمَانَتَہٗ وَ لۡیَتَّقِ اللّٰہَ رَبَّہٗ وَ لَا تَکۡتُمُوا الشَّہَادَۃَ وَ مَنۡ یَّکۡتُمۡہَا فَاِنَّہٗۤ اٰثِمٌ قَلۡبُہٗ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ

‘আর তোমরা যদি সফরে থাক এবং কোন লেখক না পাও, তবে বন্ধকী বস্তু হস্তগত রাখা উচিত। যদি একে অন্যকে বিশ্বাস করে, তবে যাকে বিশ্বাস করা হয়, তার উচিত অন্যের প্রাপ্য পরিশোধ করা এবং স্বীয় পালনকর্তাকে ভয় করা! তোমরা সাক্ষ্য গোপন কর না। যে কেউ তা গোপন করবে, তার অন্তর পাপপূর্ণ হবে। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮৩)।

(১০) পারস্পরিক সম্মতি

ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কর্মকা- উভয়পক্ষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও সম্মতির ভিত্তিতে হতে হবে। এক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সম্মতি আদায় কার্যকর নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً عَنۡ تَرَاضٍ مِّنۡکُمۡ 

‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ’ (সূরা আন-নিসা : ২৯)। উল্লেখ্য, আয়াতের পারস্পরিক সন্তুষ্টির শর্তারোপ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, এই বিনিময়ে কোন প্রকার দমন-পীড়ন, ধোঁকা, প্রতারণা কিংবা ছলচাতুরী থাকবে না, যা অপর পক্ষের গোচরীভূত হলে সে অসন্তুষ্টি হয়।

(১১) পণ্যদ্রব্যের দোষ-ত্রুটি গোপন না করা

ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজী না করে বরং পণ্যদ্রব্যের যাবতীয় অন্তর্নিহিত গোপনীয় দোষ-ত্রুটি বিক্রেতার কাছে প্রকাশ করতে হবে। কেননা গোপন রেখে পণ্য দ্রব্য বিক্রি করা প্রতারণার শামিল। আর ব্যবসাতে প্রতারণা করা হারাম। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى ‘যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।[৬] হাকীম ইবনু হিযাম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

اَلْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَفْتَرِقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ فِيْ بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَذَبَا وَكَتَمَا مُحِقَ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا

‘ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্য অবকাশ থাকবে, যতক্ষণ না তাদের একজন অপরজন থেকে পৃথক হয়ে যায়। তারা যদি সততা অবলম্বন করে এবং মালের দোষ-ত্রুটি বলে দেয়, তবে তাদের বেচাকেনায় বরকত দেয়া হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, তবে উক্ত ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত মুছে দেয়া হবে’।[৭] অতএব সত্য ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা করতে হবে।

(১২) পণ্যদ্রব্য অস্তিত্বশীল ও হস্তগত হওয়া

যে ফল ও পণ্য অস্তিত্বশীল ও পরিপক্বতা লাভ করেনি এবং কৃত সামগ্রী হস্তগত হয়নি তার লেনদেন ও ব্যবসা-বাণিজ্য করা হারাম। যেমন, ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, لَا تَبِيعُوا الثَّمَرَ حَتَّى يَبْدُوَ صَلَاحُهُ ‘তোমরা ফল বিক্রি করবে না তা উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে’।[৮]

সম্প্রতি আম গাছে অস্তিত্বশীল হবার পূর্বেই অর্থাৎ মুকুল অবস্থায় বিক্রির রেওয়াজ চলছে কিংবা ফল পরিপক্ব না হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ মুকুল অবস্থায় কিংবা ফল পরিপক্ব না হবার আগেই ফলের গাছ সহ বাগান বিক্রি করা হচ্ছে, যা আদৌ শরী‘আত স্বীকৃত নয় বরং তা হারাম। কেননা মুকুল অস্তিত্বশীল নাও হতে পারে। যদিও তা অস্তিত্বশীল হয় তবুও প্রাকৃতিক দুর্যোগে তা বিনষ্টও হতে পারে। ফলে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তা হারাম। আর মুকুলের আগে বিক্রি করা তা অদৃশ্য বস্তু বিক্রয়ের শামিল, যা নিষিদ্ধ।

এছাড়া এমন কিছু ব্যবসায়ী আছে যারা মাল সামগ্রী হস্তগত হবার পূর্বেই অন্যত্র বিক্রি করে দেয়, এটি অবৈধ। ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنِ ابْتَاعَ طَعَامًا فَلَا يَبِعْهُ حَتَّى يَسْتَوْفِيَهُ ‘কেউ খাদ্যশস্য ক্রয় করলে তা হস্তগত না করা পর্যন্ত পুনরায় বিক্রি করবে না’।[৯] কাজেই শুধু শস্য নয় বরং অন্যান্য যত প্রকার দ্রব্য সামগ্রী রয়েছে তা হস্তগত না হওয়ার আগেই অন্যত্র বিক্রি করা যাবে না।

(১৩) অবৈধ পণ্যদ্রব্যের ব্যবসা নিষিদ্ধ

এমন কিছু দ্রব্য রয়েছে, যেগুলোর উৎপাদন ও বাণিজ্য করা নিষিদ্ধ। কোন জিনিস নিষিদ্ধ হবার দাবীই হল, সে জিনিস দ্বারা ব্যবসা অথবা অন্য কোন ভাবেই ফায়দা হাসিল করা যাবে না। মহান আল্লাহ বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ

‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া প্রতিমা, ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ এসব শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ কিছু নয়। অতএব এগুলো থেকে দূরে থাক’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৯০)। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন,

لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فِى الْخَمْرِ عَشَرَةً عَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَالْمَعْصُوْرَةَ لَهُ وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُوْلَةَ لَهُ وَبَائِعَهَا وَالْمُبْتَاعَةَ لَهُ وَسَاقِيَهَا وَالْمُسْتَقَاةَ لَهُ

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ সম্পর্কে দশ শ্রেণীর লোককে অভিশাপ দিয়েছেন। মদ প্রস্তুতকারক, যে মদের অর্ডার দেয়, মদ্য পানকারী, মদ বহনকারী, যার নিকট মদ বহন করে নিয়ে যাওয়া হয়, যে মদ পান করায়, মদ ব্যবসায়ী, মদের মূল্য যে ভোগ করে, মদ যে ক্রয় করে এবং যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়’।[১০]

অতএব যাবতীয় মদ, তাড়ী, ফেন্সিডিল, হিরোইন, আফিম, গাঁজা প্রভৃতি নেশা জাতীয় দ্রব্যের উৎপাদন এবং ব্যবসা করা হারাম। কেননা, এগুলোর উৎপাদন সার্বিকভাবে যেমন ঘৃণিত, তেমনি ব্যবসা করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

(১৪) চোরাচালান না করা

চোরাচালান বলতে প্রধানত শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে কোন দ্রব্য আমদানি বা রপ্তানি করাকে বুঝানো হয়।[১১] এ ধরণের ব্যবসাকে ইংরেজীতে Smuggling, Black Market বলে। আর যে ব্যক্তি চোরা কারবার করে তাকে Smuggler বলে।

সম্প্রতি দেশের প্রতিটি শহর ও গ্রামাঞ্চলে চোরাই ব্যবসার আগ্রাসন ছেয়ে গেছে। বস্তুত এ ব্যবসার ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে দেশীয় পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদা কমে গেছে। কারণ দেশীয় পণ্যের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতীয় পণ্যের মূল্য অনেক ক্ষেত্রে কম হয়ে থাকে। যেমন সম্প্রতি দেশীয় পেঁয়াজ কেজি প্রতি দুইশ’ থেকে দুইশ’ পঞ্চাশ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ কেজি প্রতি একশ’ পঞ্চাশ থেকে দুইশ’ টাকা। প্রতি কেজিতে জনগণ যদি দশ টাকা থেকে বিশ টাকা করে কম পায় বা বাঁচাতে পারে, তবে বেশি দামের দেশী পেঁয়াজ ক্রয়ের ব্যাপারে অনেকেই নারাজ। এভাবে প্রায় প্রতিটি দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য ভারতীয় পণ্যের তুলনায় বেশী। তাছাড়া যারা চোরাই কারবার করে তারা সর্বদা সরকার তথা পুলিশ, কাস্টমস অফিস, বি.জি.বি-এর প্রত্যেকের চোখে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করে। তবে যদি ধরা পড়ে, তাহলে কিছু উপঢৌকন বা সেলামী দিয়ে সরে পড়ে। আর পণ্য সামগ্রী বেশী হলে ফাঁক-ফোকড়ের সময় না পেলে সব কিছু ফেলে জীবন বাঁচায়। পরক্ষণে সুযোগ বুঝে পুলিশ অফিস বা কাস্টমস অফিসে গিয়ে কিছু ডোনেশন দিয়ে পণ্য সামগ্রী খালাশ করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে চোরাই কারবার করার দায়ে চোরাচালান আইনে জেল হাজতও খাটতে হয়।

চোরাচালান মূলত দেশদ্রোহী একটি কারবার। প্রায় সময়ই উন্নয়শীল দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর অভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশেও উৎপাদিত পণ্য দ্বারা চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এ সুযোগ নেয় এক শ্রেণীর কালোবাজারি ব্যবসায়ীরা। এ সকল কালোবাজারিরা বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে পণ্য আমদানী করতে বেশী আগ্রহী হয়। অবৈধ পথে পণ্য আমদানী না করলে ব্যবসায়ীর জন্য এতটা মুনাফা অর্জন করা সম্ভব নয়।[১২]

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন হাট-বাজার ও গ্রামঞ্চলে যে সকল চোরাই পণ্য সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের যে ধুম পড়েছে তন্মধ্যে লবন, পেঁয়াজ, গরু, মহিষ, কাপড়, সাইকেল, স্বর্ণ, লৌহ, বিভিন্ন অস্ত্র, বই, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, বিভিন্ন শ্রেণীর মসলা ও নেশা জাতীয় দ্রব্য, যেমন মদ, জুয়া, গাজা, ফেনসিডিল, হিরোইন, ইয়াবা উল্লেযোগ্য।[১৩] এ সকল পণ্য প্রায় ভারত থেকে বাংলাদেশে পাচার হয়ে আসছে। মূলত এ দেশে আদম ব্যবসার প্রচলনও কম নয়।[১৪]

পত্রিকা খুললেই উক্ত ব্যবসায়িক নৃশংসতা দৃষ্টিগোচর হয়। এছাড়া ব্যাপকহারে এদেশের নারী ও শিশু প্রতিনিয়ত পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের পতিতালয়ে। ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। যদিও চোরাচালানে মুনাফা বেশী অর্জন করা যায় কিন্তু এটা রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নৈতিকতার পরিপন্থী। এর মাধ্যমে দেশের বাজার ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়। ফলে দেশের জনসাধারণ চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কাজেই এ ধরণের রাষ্ট্র বিরোধী ও নৈতিকতা বিবর্জিত ব্যবসা পরিহার করে শরী‘আতের সুশৃঙ্খল নীতির ভিত্তিতে দেশীয় পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য করা কর্তব্য।

উপসংহার

মোটকথা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে ইসলামের উক্ত নীতিমালা অনুসরণ করেই প্রত্যেক মুসলিমকে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। কাজেই ব্যবসায়ে যুলম, ধোঁকাবাজি, জালিয়াতী, প্রতারণা, ঠকবাজী, মুনাফাখোরী কিংবা কোন নিষিদ্ধ জিনিসের ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদন, বহন ইত্যাদি যা সামাজিক ও নীতি-নৈতিকতা বিরোধী তা অবশ্যই বর্জনীয়। সুতরাং ইসলামী নীতিমালা অনুসরণ করেই ব্যবসা-বাণিজ্য করা শরী‘আতের দাবী।


* চতুর্থ বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[১]. ছহীহ বুখারী, ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়-৩৪, ‘ওযন করার পারিশ্রমিক প্রদানের দায়িত্ব বিক্রেতা বা দ্রব্য প্রদানকারীর উপর’ অনুচ্ছেদ-৫১।
[২]. Md. Sofiq Ahmed, “Morality in Trade Under the perspective of Islam”, Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, Voll-44, No-2, December, 1999, Dhaka, P-64.
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২১ শব্দ তার।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৫০, ২১৬৫, ৫১৪২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪১২, ১৫১৫, ২৫৬৩-৬৪; মিশকাত, হা/২৮৪৭।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৩৮৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৩।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০২; তিরমিযী, হা/১৩১৫; মিশকাত, হা/২৮৬০।
[৭]. নাসাঈ, হা/৪৪৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৩৪৯, সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৮৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৩৪; নাসাঈ, হা/৪৫১৯।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৫; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৯২।
[১০]. তিরমিযী, হা/১২৯৫; ইবনু মাজাহ, হা/৩৩৮১; মিশকাত, হা/২৭৭৬, সনদ ছহীহ।
[১১]. Samsad English-Bangali Dictionary, P-1064; A Harnby, Oxford Advanced Learners Dictionary (Oxford : Oxford University Press, 9th edition, 2015), P-1475.
[১২]. সাইফুল হাসান ও বদরুল বাবু, চোরাচালান ট্রানজিট, ঢাকা, সাপ্তাহিক ২০০০, ২য় বর্ষ, ৩৮ সংখ্যা, ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ঢাকা, পৃ. ৮।
[১৩]. দৈনিক ভোরের কাগজ, বর্ষ ৯, সংখ্যা, ৫৬, ১৪ ই এপ্রিল ২০০০, ঢাকা, পৃ. ৯।
[১৪]. প্রাগুক্ত, সংখ্যা, ৬৩, ২২ শে এপ্রিল, ২০০০, ঢাকা, পৃ. ৮।




ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (২য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম

ফেসবুক পেজ