শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫৫ অপরাহ্ন

ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা

-গুলশান আখতার*



ভূমিকা
ব্যবসা-বাণিজ্য বর্তমানে বহুল পরিচিত শব্দ। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন। আর এ অর্থ উপার্জনের অন্যতম বৈধ পন্থা হল, ব্যবসা-বাণিজ্য। বর্তমান বিশ্বে পশ্চিমা দেশগুলোর ন্যায় মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে অবৈধ পন্থায়। ব্যবসা-বাণিজ্যে সূদ, ঘুষ, জুয়া, লটারী, ধোঁকাবাজী, প্রতারণা, মজুদদারী ইত্যাদির ব্যাপক প্রভাব লক্ষণীয়। কিন্তু ইসলামই একমাত্র শাশ্বত, সর্বজনীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যাতে রয়েছে মানব জীবনের প্রতিটি বিষয়ের নিখুঁত ও স্বচ্ছ দিক নির্দেশনা। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈধ-অবৈধ দু’টি পন্থা বিরাজমান হলেও ইসলাম সকল প্রকার অবৈধ পন্থা পরিহার করে সম্পূর্ণ বৈধ পন্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য করার নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত তার কতিপয় দিক উপস্থাপন করা হয়েছে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিচিতি
আধুনিক নীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামী নীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। এর মৌলিক ও প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করা দুষ্কর। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে কারবার, পেশা, বৃত্তি ইত্যাদি নির্দেশ করে। যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হল- Business, Commerce, Treade, Commercial activity, Occupationইত্যাদি।[১]

ব্যবসা-বাণিজ্যকে সাধারণ ও ব্যাপক দু’ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হয়। সাধারণ অর্থে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে পণ্য সামগ্রির ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কার্যকলাপকে ব্যবসা-বাণিজ্য বলে। এ অর্থে ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে, লাভের আশায় কমমূল্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে অধিক মূল্যে বিক্রয় করার কাজকে বুঝায়। আর ব্যাপক অর্থে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে ও অভাব পূরণের নিমিত্তে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে তা মানুষের ব্যবহারপযোগী করত ভোগ ব্যবহারের জন্য পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত যাবতীয় বৈধ কর্মপ্রচেষ্টাকে ব্যবসা-বাণিজ্য বলে অভিহিত করা হয়। এ দিক থেকে পণ্যদ্রব্যের উৎপাদন, ক্রয়, বিক্রয় এবং এসবের সহায়ক যাবতীয় কার্যাবলী ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত।[২]

ব্যবসা-বাণিজ্যের আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে- تجارة। আর تجارة এর সমর্থবোধক শব্দ হিসাবে بيع ও شراء শব্দদ্বয় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। تجارة শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- উপকার বা কল্যাণের জন্য লেনদেন করা।[৩] অতএব শারঈ দৃষ্টিতে ব্যবসা-বাণিজ্য হল- কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমে লেনদেন বা ক্রয়-বিক্রয় পরিচালিত হওয়া এমন সব দ্রব্য, যা বাতিল ও হারাম নয় বরং বৈধ পন্থায় পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাকেই تجارة বা ব্যবসা-বাণিজ্য বলে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের ইসলামী রূপরেখা
মিথ্যা শপথ না করা।

মিথ্যা শপথ করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যাবে না। এতে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পণ্য ক্রয়ের প্রকৃত অধিকার হতে বঞ্চিত হয়। ব্যবসায়ীগণ সাধারণত মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রির জন্য গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। অথচ মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করলে বকরত নষ্ট হয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যে এ ধরনের নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত মিথ্যা শপথ করা হারাম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, اَلْحَلِفُ مُنَفِّقَةٌ لِلسِّلْعَةِ مُمْحِقَةٌ لِلْبَرَكَةِ ‘মিথ্যা শপথের দ্বারা পণ্য সামগ্রী বিক্রি হয়ে যায় বটে কিন্তু এতে বরকত বা কল্যাণ ধ্বংস হয়ে যায়’।[৪] আবুযার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,

ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ قَالَ فَقَرَأَهَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسل ثَلَاثَ مِرَارٍ. قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ رضى الله عنه خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ

‘ক্বিয়ামাতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তিন শ্রেণীর লোকের সাথে কথা বলবেন না, তাদের প্রতি করুণার দৃষ্টি দিবেন না, তাদের পরিশুদ্ধও করবেন না; বরং তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আবুযার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তারা কারা? তারা তো ব্যর্থ হল, তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, অনুগ্রহ করে প্রকাশকারী এবং মিথ্যা কসমের মাধ্যমে মাল বিক্রয়কারী’।[৫]

ফটকা কারবার না করা।

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় ফটকা কারবার বৈধ নয়। ফটকা কারবারের বিশেষ পদ্ধতি হচ্ছে অগ্রিম বিক্রয়। বিক্রেতার অধীনে পণ্য না থাকলেও উৎসাহী ক্রেতার নিকট পণ্য বিক্রয় করে। পরবর্তীতে পণ্যের দাম কমে গেলে সে পণ্য ক্রয় করে তার গ্রাহককে মাল সরবরাহ করে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ধরণের ব্যবসাকে নিষেধ করে বলেন, مَنِ ابْتَاعَ طَعَامًا فَلَا يَبِعْهُ حَتَّى يَقْبِضَهُ ‘কেউ খাদ্য কিনলে তা পুরোপুরি হস্তগত করার আগে যেন বিক্রয় না করে’।[৬]

মজুদদারী না করা।

নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, তা মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যই হোক অথবা পশু-পাখির খাদ্য হোক, ক্রয় করে তা মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বাজারজাত না করে আটকে রাখাকে মজুদদারী (احتكار) বলে।[৭] অর্থাৎ, অধিক লাভের আশায় ব্যবসায়ীগণ কম মূল্যে বিপুল পরিমাণে পণ্য ক্রয় করে সঞ্চয় করে রাখে। বাজারে পণ্য কমে গেলে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য তীব্রগতিতে বৃদ্ধির কারণে জনগণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ব্যবসায়ীরা এ সময় নিজেদের ইচ্ছামত মূল্য নির্ধারণ করে। ক্রেতারা এ সময় বেশি মূল্য দিয়ে পণ্য খরিদ করে সর্বস্বান্ত হয়। অথচ ইসলামী বাণিজ্যনীতিতে এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় অপরাধ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ ‘পণ্য দ্রব্য আটক করে তা অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী নিঃসন্দেহে অপরাধী’।[৮] তিনি আরও বলেন,لَا يَحْتَكِرُ إِلَّا خَاطِئٌ ‘অপরাধী লোক ব্যতীত কেউ গুদামজাত করে না’।[৯]

ভেজাল না দেয়া।

খাঁটি ও বিশুদ্ধ জিনিসের মধ্যে কিছু নকল দ্রব্য অপমিশ্রিত করা, যা মূলগতভাবে খাঁটি নয় তাকেই ভেজাল বলে। একে আরবীতে اَلْغَشَّي বলা হয়।[১০] উদাহরণস্বরূপ, খাঁটি সরিষার তেলের সাথে পামওয়েল বা সয়াবিন মিশ্রিত করা, খাঁটি দুধের সাথে পানি বা গুঁড়া দুধ মিশ্রিত করা, হলুদের সাথে ইটের গুঁড়া মিশ্রিত করা ইত্যাদি। এক কথায় যা খাঁটি বা মৌলিক নয় বরং দোষত্রুটি যুক্ত তাই ভেজাল। ইসলামে ব্যবসা হালাল কিন্তু ব্যবসায়ে সত্য গোপন করা হালাল নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَہۡلَ الۡکِتٰبِ لِمَ تَلۡبِسُوۡنَ الۡحَقَّ بِالۡبَاطِلِ وَ تَکۡتُمُوۡنَ الۡحَقَّ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

‘হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিলিয়ে নিচ্ছ? এবং সত্যকে গোপন করছ অথচ তোমরা তা অবগত আছ’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ৭১)।

উক্ত আয়াতে মিথ্যার দ্বারা সকল ভেজালকে বুঝানো হয়েছে। মূলত ভেজাল একটি প্রবঞ্চনামূলক ব্যবসা। ভেজালে ব্যবসায়ীরা সাময়িকভাবে বেশি লাভবান হয়। আর এজন্য দুধের সঙ্গে পানি, অকটেনের সঙ্গে পেট্রোল, শুকনা মরিচের সাথে ভিজা মরিচ ইত্যাদি বিক্রি করে সাময়িকভাবে বেশি লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে ব্যবসাতে কোন উন্নতি হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ধরণের ব্যবসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رضى الله عنه أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيْهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلًا فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّى

আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা খাদ্যবস্তুর একটি স্তূপের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি স্তূপের ভিতরে তাঁর হাতে ভিজা অনুভব করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! এটা কী? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! বৃষ্টির পানিতে এগুলো ভিজে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ভিজাগুলোকে স্তূপের উপরে কেন রাখলে না, যাতে লোকেরা তা দেখতে পায়? যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে, আমার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।[১১] অধিকাংশ আহলে ইলম বলেন, এটা অপসন্দনীয় এবং হারাম।[১২]

উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্ভেজাল ও খাঁটি ব্যবসা করার শিক্ষা দিয়েছেন। বর্তমান যুগেও খাদ্যের সঙ্গে বিভিন্ন রকম রং ও ভেজাল (ফরমালিন) মিশিয়ে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য করছে, যা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আধুনিক যুগের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, ভেজালযুক্ত খাবারের কারণে চর্ম রোগ, পেটের পীড়া, হৃদরোগ ও ক্যান্সারসহ জটিল রোগ হয়। এমনকি ভেজালযুক্ত খাবারের কারণে অকাল মৃত্যুর শিকার হয়।[১৩]

সূদ বর্জন করা।

সূদ (سود) হচ্ছে ফারসী ও উর্দূ শব্দ। সূদ শব্দটির আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে ربا। অনেক সময় বাংলাতে সূদকে কুসীদ বলা হয়।[১৪] একই শ্রেণীভুক্ত মালের লেনদেনকালে কোন পক্ষ চুক্তি মোতাবেক অপর পক্ষের নিকট হতে যে বর্ধিত অংশ গ্রহণ করে তাকে সূদ বলে।[১৫] অতএব রিবা বলতে সরল ও চক্রবৃদ্ধিহারে সূদকে বুঝায়।[১৬] ইসলামে সূদভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য করা হারাম। তবে বৈধ পন্থায় ব্যবসা করা হালাল। জাহেলী আরবে সূদ ও মুনাফাকে একই রকম মনে করা হত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, قَالُوۡۤا اِنَّمَا الۡبَیۡعُ مِثۡلُ الرِّبٰوا وَ اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ‘তারা বলে ব্যবসা তো সূদের মত। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সূদকে হারাম করেছেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)।

জাহেলী যুগে সূদের প্রচলন থাকায় মহাজনী প্রথা চালু ছিল। ধনীরা গরীবদেরকে ঋণ দিত, যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করত, ততক্ষণ পর্যন্ত ঋণ ও সূদের টাকা বাড়তে থাকত।[১৭] অবশেষে আসল সূদ পরিশোধ করতে না পারলে ঋণ গ্রহীতাদের যাবতীয় সম্পদ, স্ত্রী, কন্যা, দাস-দাসী মহাজনদের হাতে চলে যেত। মানবতা ছিল ভূলুণ্ঠিত। এ প্রকারের সূদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَاۡکُلُوا الرِّبٰۤوا اَضۡعَافًا مُّضٰعَفَۃً ‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ খেও না’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৩০)।

জাহেলী যুগের এ সূদ প্রথাকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষিদ্ধ করেন এবং সমাজে তিনি সূদের পরিবর্তে সূদমুক্ত ঋণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূদদাতা, গ্রহীতা, লেখক ও সাক্ষীদাতার পরিণাম সম্পর্কে বলেন,

عَنْ جَابِرٍ رضى الله عنه قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم آكِلَ الرِّبَا وَمُوْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ وَقَالَ هُمْ سَوَاءٌ

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সূদগ্রহীতা, সূদদাতা, সূদের লেখক এবং সূদী লেনদেনের সাক্ষীদ্বয়ের উপর লা‘নত করেছেন এবং তিনি বলেছেন, (পাপের দিক দিয়ে) তারা সমান অপরাধী।[১৮]

সূদ ব্যক্তিগত বা ব্যাংক যে পর্যায়ে হোক না কেন তা হারাম। বর্তমানে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে তা যদি সূদমুক্ত না হয়, তাহলে তার দলীল লেখাও হারাম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে সূদ বাতিল ও মূলধন সংগ্রহের ব্যাপারে ঘোষণা করে বলেন,

أَلَا إِنَّ كُلَّ رِبًا مِنْ رِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوْعٌ لَكُمْ رُءُوْسُ أَمْوَالِكُمْ لَا تَظْلِمُوْنَ وَلَا تُظْلَمُوْنَ

‘জাহেলী যুগের সমস্ত সূদ বাতিল করা হল। তোমরা তোমাদের মূলধন সংগ্রহ করবে। তোমরা কারো প্রতি যুল্ম করবে না এবং অন্য কেউ যেন তোমাদের উপর যুল্ম না করে’।[১৯] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপরিউক্ত হাদীছসমূহ ব্যবসানীতি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* চতুর্থ বর্ষ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. Robert Herbst, Dictionary of commercial Financial and legal terms (Switzerland : Tranglegal Hd, September, 1996), p-139; Jerry m. Rosenbery, Dictionary of Business and Management (Newyork; A wiley inter-science publication, 2nd edition, 1983), p-76.
[২]. D.M. Walker, The oxford companion to law (U.S.A : Clarendon press, 1980), p-162.
[৩]. ইবনু মানযূর, লিসানুল আরব, ২য় খণ্ড (বৈরূত : দারুল ইহইয়াইত তুরাছিল ‘আরাবী, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৬), পৃ. ১৯: Edward, Edward william, Lane Arabic-English Lexicon, Part-14 (London : 14 Henrich Street, 1960), p-297.
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৮৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৬; আবূ দাঊদ, হা/৩৩৩৫; মিশকাত, হা/২৭৯৪।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬; আবূ দাঊদ, হা/৪০৮৭; মিশকাত, হা/২৭৯৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৩৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৫; আবূ দাঊদ, হা/৩৪৯৭।
[৭]. ড. ওয়াহবাতুয যুহাইলী, ফিক্বহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাহুতুহ (পাকিস্তান : আল-মাকতাবাতু হাক্কানিয়া, তা.বি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৮৩-৫৮৪; বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ১ম খণ্ড, ১ম ভাগ, পৃ. ৪৫৩।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫।
[১০]. আল-মাওরিদ, আরবী-ইংরেজী ডিকশনারী, পৃ. ৮০০; লুইস মা‘লুফ, আল-মুনজিদ ফিল লুগাত, পৃ. ৫৫২।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০২; তিরমিযী, হা/১৩১৫; মিশকাত, হা/২৮৬০।
[১২]. তিরমিযী, হা/১৩১৫, সনদ ছহীহ।
[১৩]. দৈনিক ভোরের কাগজ, ৯ম বর্ষ, ১৩২ সংখ্যা, ২রা জুলাই, ২০০০, ঢাকা।
[১৪]. ফজলুর রহমান আশরাফী, সুদ ও ইসলামী ব্যাংকিং (ঢাকা : মাহিন পাবলিকেশন্স, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৮), পৃ. ৪৪।
[১৫]. ইফাবা গবেষণা পরিষদ সম্পাদিত, বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, ১ম খণ্ড, ১ম ভাগ (ঢাকা : ই. ফা. বা গবেষণা পরিষদ, ১৯৯৫), পৃ. ৪৩৭; ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু , ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৬৮।
[১৬]. সৈয়দ নওয়াব হায়দার নকী, অনু : মাহবুব উল আলম, “রিবা বিলুপ্ত : নীতি পদ্ধতি নির্ধারণ” ইসলামী ব্যাংকিং পত্রিকা, ৪র্থ বর্ষ, ডিসেম্বর ১৯৯৭, পৃ. ১৬।
[১৭]. শিবলী নোমানী, সিরাতুন নবী, ২য় খণ্ড, বাংলা সংস্করণ (ঢাকা : দি তাজ পাবলিকেশন্স হাউজ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯৮), পৃ. ৫৮৬।
[১৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৯৮; মিশকাত, হা/২৮০৭।
[১৯]. আবূ দাঊদ, হা/৩৩৩৪; ইবনু মাজাহ, হা/৩০৫৫, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: নারী সমাজ
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৬ষ্ঠ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন

ফেসবুক পেজ