বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৪ অপরাহ্ন

শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা

-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*


(৭ম কিস্তি)

গৃহের অভ্যন্তরীণ পর্দা

নারীগণ শুধু বাইরেই নয়, বরং গৃহাভ্যন্তরেও পর্দা রক্ষা করে জীবন-যাপন করবেন। কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, ঘরের ভিতরে আবার কিসের পর্দা? জি, ইসলাম নারীদের এতই সম্মান-মর্যাদা দিয়েছে যে, যেকোন স্থানে যেকোন পরিস্থিতিতে যাতে করে তারা সম্মানিত হয়, নাঞ্ছিত ও অপমানিত না হয় এবং তাদের ইয্যত-সম্মান বিনষ্ট না হয়। এজন্য গৃহাভ্যন্তরেও নারীদের পর্দা মেনে চলা ফরয। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

وَ اِذَا سَاَلۡتُمُوۡہُنَّ مَتَاعًا فَسۡـَٔلُوۡہُنَّ مِنۡ وَّرَآءِ  حِجَابٍ

‘তোমরা যখন তার পত্নীদের নিকট হতে কিছু চাইবে, তখন পর্দার অন্তরাল হতে চাইবে’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৩)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে, যখন মহিলা কোন বেগানা পুরুষের সাথে কথা বলবে, তখন তাদের মাঝে দরজা বা কাপড়ের অন্তরায় থাকবে। আর এটা হচ্ছে নারীর জন্য ঘরের ভিতর কথা বলার নিয়ম। আর ঘরের বাইরে নারীর পর্দার বিবরণ তো পূর্বেই সূরা আন-নূর ও সূরা আল-আহযাবে গত হয়েছে। আর তা হচ্ছে জিলবাবের শর্তসমূহের পরিপূর্ণ অনুসরণ। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

فَآيَةُ الْجَلَابِيْبِ فِي الْأَرْدِيَةِ عِنْدَ الْبُرُوْزِ مِنْ الْمَسَاكِنِ وَآيَةُ الْحِجَابِ عِنْدَ الْمُخَاطَبَةِ فِي الْمَسَاكِن

‘বাসস্থান হতে বাইরে যেতে জিলাবের আয়াত পালন করতে হবে এবং ঘরের মধ্যে কথাবার্তা বলতে গেলে হিজাবের আয়াাত মানতে হবে’।[১] আর এই নিয়ম-নীতির রহস্য আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ করেছেন। যেমন তিনি বলেছন, ذٰلِکُمۡ  اَطۡہَرُ  لِقُلُوۡبِکُمۡ  وَ قُلُوۡبِہِنَّ ‘এই বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৩)।

যদি পুরুষ নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করে এবং তার সাথে কথা বলে, এটা কখনও হৃদয়কে আকর্ষিত করে। যদিও তারা উভয়ে দৃষ্টির আড়ালে হয়। তবে ঘরের বাহিরের ব্যাপারটা ভিন্ন। কেননা তাদের দু’জনের উপস্থিতি লোক সমাগমে ফিতনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা স্থান উপযোগী বিধান দিয়েছেন। এসময় কেবল মাহরাম পুরুষদের সাথে বিনা আড়ালে কথা বলতে পারবে। এই কারণেই আল্লাহ তা‘আলা তাদের পর্দার হুকুম হতে আলাদা রেখেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,

لَا جُنَاحَ عَلَیۡہِنَّ فِیۡۤ  اٰبَآئِہِنَّ وَ لَاۤ اَبۡنَآئِہِنَّ  وَ لَاۤ  اِخۡوَانِہِنَّ وَ لَاۤ  اَبۡنَآءِ اِخۡوَانِہِنَّ وَ لَاۤ  اَبۡنَآءِ اَخَوٰتِہِنَّ وَ لَا نِسَآئِہِنَّ وَ لَا مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُنَّ ۚ وَ اتَّقِیۡنَ اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ  شَہِیۡدًا

‘নবী পত্নীদের জন্য তাদের পিতৃগণ, পুত্রগণ, ভ্রাতৃগণ, ভ্রাতষ্পুত্রগণ, ভগ্নীপুত্রগণ, সেবিকাগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের ব্যাপারে তা পালন না করা অপরাধ নয়। হে নবী-পত্নীগণ! আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ‌ সকল কিছু প্রত্যক্ষ করেন’ (সূরা আল-আহযাব : ৫৫)।

জেনে রাখো, হে মুসলিম বোন! নারীর উপর মহান আল্লাহ যে পর্দার বিধান আরোপ করেছেন তা পূর্ণতা পাবে না উল্লেখিত আবশ্যিক বিধানের সাথে কিছু অতিরিক্ত বিধান বাস্তবায়ন না করলে। কেননা পর্দা হচ্ছে নারীকে বেগানা পুরুষের থেকে দূরত্বে রাখা এবং তাদের পারস্পরিক ফিতনায় পতিত হওয়ার যাবতীয় উপকরণকে বাধাগ্রস্ত করা। আর এই বিষয়টা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনিভাবে কতিপয় ওলামায়ে কেরাম পর্দার সংজ্ঞা দিয়েছেন। পর্দা এমন শব্দ, যা ইসলামী সমাজে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত বেশ কিছু সামাজিক আইনগত বিধান রয়েছে। এর সাথে এটা সংশ্লিষ্ট বিষয় হল, নারীর কাদের সামনে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করা হালাল নয়।[২] এরই আলোকে নারী-পুরুষ উভয়ের উচিত নিম্নোক্ত বিধানগুলো মান্য করা। যথা :

(১) চক্ষুকে নিন্মগামী রাখা : এ বিষয়ে আলোচনা পূর্বে গত হয়ে গেছে।

(২) পুরুষের গোপন জায়গা আবৃত রাখা ওয়াজিব

হাদীছে এসেছে,

عَنْ بَهْزِ بْنِ حَكِيْمٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ احْفَظْ عَوْرَتَكَ إِلَّا مِنْ زَوْجَتِكَ أَوْ مَا مَلَكَتْ يَمِيْنُكَ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَفَرَأَيْتَ إِنْ كَانَ الرَّجُلُ خَالِيًا؟ قَالَ فَاللهُ أَحَقُّ أَنْ يُسْتَحْيى مِنْهُ

বাহয ইবনু হাকীম (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তুমি তোমার স্ত্রী ও দাসী ব্যতীত অন্যের সামনে নগ্ন হয়ো না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! কোন লোক একা থাকলেও কি নগ্ন হতে পারে না? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, আল্লাহকে অধিক লজ্জা করা উচিত।[৩]

পুরুষের সতর নাভি হতে হাঁটু পর্যন্ত। যেমনটি আল্লাহর নবী (ﷺ) বলেছেন, فَإِنَّمَا أَسْفَلُ مِنْ سُرَّتِهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ مِنْ عَوْرَتِهِ ‘তার (পুরুষের) নাভীর নিচ হতে হাঁটু পর্যন্ত সতর’।[৪] রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরো বলেছেন, الْفَخِذُ عَوْرَةٌ ‘উরু হচ্ছে সতর’।[৫]

(৩) পুরুষের সাথে মহিলার নির্জন বাস হারাম

অর্থাৎ মহিলা কোন পুরুষের সাথে এমন জায়গায় নির্জনে যায় যেখানে পারস্পরিক মেলামেশায় কোন বাঁধা থাকে না।[৬] এমন স্থানে গমানগমন হারাম। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস ল বলেন, নিশ্চয় তিনি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছেন,

لَا يَخْلُوَنَّ رَجُلٌ بِامْرَأَةٍ وَلَا تُسَافِرَنَّ امْرَأَةٌ إِلَّا وَمَعَهَا مَحْرَمٌ. فَقَامَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اكْتُتِبْتُ فِىْ غَزْوَةِ كَذَا وَكَذَا وَخَرَجَتِ امْرَأَتِىْ حَاجَّةً قَالَ اذْهَبْ فَحُجَّ مَعَ امْرَأَتِكَ

‘কোন পুরুষ যেন কোন নারীর সাথে নির্জনে না যায়। আর মাহরাম পুরুষ ছাড়া যেন কোন মহিলা সফর না করে। তখন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি তো ওমুক যুদ্ধে নাম লেখিয়েছি আর আমার স্ত্রী হজ্জের সফরে বের হয়েছে। তখন নবী (ﷺ) তাকে বললেন, তুমি চলে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্জ কর’।[৭] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উল্লেখিত হাদীছে যে মহিলার সাথে মাহরাম পুরুষ থাকার যে শর্ত দেয়া হয়েছে তাদ্বারা এটা প্রতীয়মাণ হয় যে, যখন মাহরাম থাকবে তখন আর তা নির্জনতা থাকবে না। আর নবী (ﷺ)-এর বাণী, وَمَعَهَا ذُو مَحْرَمٍ ‘তার (মহিলার) সাথে মাহরাম থাকবে’ শব্দাংশ দ্বারা নারী-পুরুষ উভয়ের মুহরিম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা ফিক্বহী নীতিমালায় বিদ্যমান আছে। কেননা মহিলার ছেলে, ভাই, মাতা, বোন সাথে থাকা এবং পুরুষের বোন, মেয়ে, খালা, ফুফু থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই অবস্থায় নারীর সাথে বসা যাবে। অতঃপর হাদীছটা স্বামীর ক্ষেত্রে খাছ করা যেতে পারে। কেননা যদি স্বামী মহিলার সাথে থাকে তাহলে সেও মাহরামের মত হয়ে গেল এবং এটাই অধিক বৈধ হবে। তবে বেগানা নারী-পুরুষের সাথে তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ছাড়া নির্জনে যাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। এমনিভাবে যদি তাদের সাথে বাচ্চা থাকে ২/৩ বছরের তাতেও জায়েয হবে না। কেননা বাচ্চার উপস্থিতি না থাকার নামান্তর। আর পসন্দনীয় মতানুসারে সুন্দর পুরুষের সাথে নির্জনবাস হারাম। তবে যদি পুরুষের সমাগম হয় তাহলে জায়েয। আমাদের সাথী-সঙ্গীরা বলেন, ছালাত ও অন্যান্য স্থানে যেভাবে আমরা নির্জনতাকে হারাম করেছি, এর থেকে প্রয়োজনীয় স্থানগুলো বাদ যাবে। যেমন, রাস্তায় অপরিচিত কোন নারীকে পেলে তার সাথে চলা বৈধ। বরং ক্ষেত্রবিশেষে আবশ্যিক যখন তার ব্যাপারে বিপদের আশঙ্কা না করবে। এ ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই। আর এ দলীল হল আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর ইফকের ঘটনার হাদীছ। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বজ্ঞ’।[৮]

(৪) মহিলার মাহরাম ব্যতীত সফর করা হারাম

এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ আছে। তার মধ্যে পুর্বোক্ত ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর হাদীছ উল্লেখযোগ্য। উক্ত বিধানের ক্ষেত্রে ঐ হাদীছই স্পষ্ট প্রমাণ। কাযী ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলিমগণের ঐকমত্য হল, মহিলার জন্য মাহরাম ব্যতীত হজ্জ ও উমরাহ সহ কোন ছাড়া সফর করা জায়েয নেই। তবে দারুল হরব থেকে হিজরতের ক্ষেত্রে পারবে। এ ব্যাপারে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, সে দারুল হরব থেকে দারুল ইসলামে একাকী সফর করতে পারবে’।[৯]

(৫) মেলামেশা হারাম

নারীদের সাথে অবাধ মেলামেলা হারাম। ইসলামে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কার্যক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ إِيَّاكُمْ وَالدُّخُوْلَ عَلَى النِّسَاءِ

‘উক্ববা ইবনু আমের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা নারীদের গমনাগমন হতে বেঁচে থাক’।[১০]

ইসলামে ছালাতে মহিলাদের প্রথম কাতারকে মন্দ কাতার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন,

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ خَيْرُ صُفُوْفِ الرِّجَالِ أَوَّلُهَا وَشَرُّهَا آخِرُهَا وَخَيْرُ صُفُوْفِ النِّسَاءِ آخِرُهَا وَشَرُّهَا أَوَّلُهَا

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, পুরুষের উত্তম কাতার হল প্রথম কাতার আর মন্দ কাতার হল শেষ কাতার। আর নারীদের উত্তম কাতার হল শেষ কাতার এবং মন্দ কাতার হল প্রথম কাতার।[১১] ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

إنما فضل آخر صفوف النساء الحاضرات مع الرجال لبعدهن من مخالطة الرجال ورؤيتهم وتعلق القلب بهم عند رؤية حركاتهم وسماع كلامهم ونحو ذلك

‘শেষ কাতারে নারীদের উপস্থিতির মর্যাদা হল পুরুষদের থেকে দূরে থাকার কারণে। কেননা পিছনের কাতারের নারীরা পুরুষের নড়াচড়া, তাদের দেখা, তার মাধ্যম অন্তর আকর্ষিত হওয়া এবং তাদের কথা শ্রবণ থেকে মুক্ত থাকে’।[১২] ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, لَوْ تَرَكْنَا هَذَا الْبَابَ لِلنِّسَاءِ ‘এই দরজাটি যদি আমরা নারীদের জন্য ছেড়ে দিতাম’।[১৩] শায়খ শামসুল হক আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

 (لو تركنا هذا الباب) أي باب المسجد الذي أشار إليه النبي صلى الله عليه وسلم (للنساء) لكان خيرا وأحسن لئلا تختلط النساء بالرجال في الدخول والخروج من المسجد

‘(যদি আমরা এই দরজা ছেড়ে দেই) অর্থাৎ সেই দরজা যার দিকে নবী করীম (ﷺ) ইশারা করেছেন, (নারীদের জন্য) তাহলে এটা ভাল ও সুন্দর হত, যাতে করে মসজিদে প্রবেশের ও বের হওয়ার সময় মহিলা-পুরুষ একাকার না হয়ে যায়’।[১৪] উম্মে সালামা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ إِذَا سَلَّمَ قَامَ النِّسَاءُ حِيْنَ يَقْضِى تَسْلِيْمَهُ وَهُوَ يَمْكُثُ فِىْ مَقَامِهِ يَسِيْرًا قَبْلَ أَنْ يَقُوْمَ . قَالَتْ نُرَى وَاللهُ أَعْلَمُ أَنَّ ذَلِكَ كَانَ لِكَىْ يَنْصَرِفَ النِّسَاءُ قَبْلَ أَنْ يُدْرِكَهُنَّ الرِّجَالُ 

‘নবী করীম (ﷺ) যখন সালাম ফিরাতেন তখন মহিলারা উঠে যেত। আর তিনি (ﷺ) স্বীয় স্থানে কিছু সময় অবস্থান করতেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করি (আল্লাহই ভাল জানেন) এটা তিনি এজন্য করতেন, যাতে পুরুষেরা তাদের নাগাল পাওয়ার পূর্বেই মহিলারা স্থান ত্যাগ করতে পারে’।[১৫] ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বাড়ী থেকে রাস্তায় নারী-পুরুষ অবাধে রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে উক্ত হাদীছের মধ্যে নিন্দা করা হয়েছে’।[১৬]

সুধী পাঠক! নারীদের ক্ষেত্রে পুরষদের সংস্পর্শ হতে দূরে থাকাটা সৎ লোকদের বৈশিষ্ট্য এবং পবিত্র ব্যক্তিদের আদর্শ। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বলেন,

وَ لَمَّا وَرَدَ مَآءَ مَدۡیَنَ وَجَدَ عَلَیۡہِ اُمَّۃً مِّنَ النَّاسِ یَسۡقُوۡنَ ۬۫ وَ  وَجَدَ مِنۡ دُوۡنِہِمُ امۡرَاَتَیۡنِ تَذُوۡدٰنِ ۚ قَالَ مَا خَطۡبُکُمَا ؕ قَالَتَا لَا نَسۡقِیۡ حَتّٰی یُصۡدِرَ الرِّعَآءُ ٜ وَ اَبُوۡنَا شَیۡخٌ   کَبِیۡرٌ - فَسَقٰی لَہُمَا

‘যখন সে মাদইয়ানের পানির সন্নিকটে গেল। সেখানে একদল লোককে পানি পান করানো অবস্থায় পেল। তাদের ছাড়া দু’জন নারীকে সে পেল তারা দূরে অবস্থান করছে। সে বলল, তোমাদের কী সমস্যা? তারা বলল, রাখালরা যাবৎ পশুপাল নিয়ে সরে না যায় ততক্ষণ আমরা পানি পান করাতে পারি না। আমাদের পিতা একজন বৃদ্ধ মানুষ। তখন সে তাদের পান করিয়ে দিল’ (সূরা আল-ক্বাছাছ : ২৩-২৪)।

(৬) বেগানা নারীর সাথে মুছাফাহা করা হারাম

মা‘ক্বাল ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) নবী করীম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেছেন, لَأَنْ يُطْعَنَ فِيْ رَأْسِ أَحَدِكُمْ بِمِخْيَطٍ مِنْ حَدِيْدٍ خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَمَسَّ امْرَأَةً لَا تَحِلُّ لَهُ ‘নিশ্চয় কোন পুরুষের জন্য কোন বেগানা মহিলাকে স্পর্শ করা অপেক্ষা তার মাথায় লোহার অস্ত্র দ্বারা আঘাত করা উত্তম’।[১৭] ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অত্র হাদীছে অবৈধ নারীকে স্পর্শ করার ক্ষেত্রে ধমকি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে নারীর সাথে মুছাফাহা হারাম হওয়ারও দলীল রয়েছে। কেননা সন্দেহাতীতভাবে উক্ত হাদীছে সকল প্রকার স্পর্শকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে’।[১৮]

(৭) স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর নিকট অন্য নারীর গুণাগুণ বর্ণনা করা নিষেধ

এটাও পর্দার অন্তর্ভুক্ত। ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, لَا تُبَاشِرِ الْمَرْأَةُ الْمَرْأَةَ فَتَنْعَتَهَا لِزَوْجِهَا كَأَنَّهُ يَنْظُرُ إِلَيْهَا ‘কোন নারী অন্য নারীর সাথে জড়াজড়ি করবে না। অতঃপর তার স্বামীর নিকট তার বর্ণনা দিবে না। তাহলে কল্পনায় সে তাকে দেখবে’।[১৯] আল্লামা আবূ বকর ইবনু হাবীব আল-‘আমেরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মহিলা কর্তৃক তার স্বামীর নিকট অন্য মহিলার বিবরণ বলবে না। কেননা বিবরণটা দেখার মত হয়’।[২০]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা।

তথ্যসূত্র :
[১]. ইমাম আহমাদ ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ৪৪৮।
[২]. ঊদাতুল হিজাব, পৃ. ৭১; হারকাতু তাহরীরিল মারয়াতু, পৃ. ২৬৪।
[৩]. তিরমিযী, হা/২৭৬৯; আবূ দাঊদ, হা/৪০১৭; ইবনু মাজাহ, হা/১৯০২; মিশকাত, হা/৩১১৭, সনদ হাসান।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬৭৫৬, সনদ হাসান।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৪০১৪; তিরমিযী, হা/২৭৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৫৯৭৫, সনদ হাসান।
[৬]. বুলূগুল আমানী মিন আসরারিল ফাতহির রব্বানী, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ৭৬।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪১।
[৮]. শারহু ছহীহ মুসলিম লিন নববী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০৯।
[৯]. শারহু ছহীহ মুসলিম লিন নববী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০৪; আব্দুল গনী ফাখরুদ্দীন দেহলভী আস-সুয়ূত্বী, শারহু সুনানি ইবনি মাজাহ (পুরাতন কুতুব খানা, তাবি), পৃ. ২০৮; মির‘আতুল মাফাতীহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৭১৪।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৩২; মুসলিম, হা/২১৭২; মিশকাত, হা/৩১০২।
[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৪১০; আবূ দাঊদ, হা/৬৭৮; মিশকাত, হা/১০৯২।
[১২]. শারহু ছহীহ মুসলিম লিন নববী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৫৯।
[১৩]. আবূ দাঊদ, হা/৪৬২, ৫৭১; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৫২৫৮।
[১৪]. শামসুল হক আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ শারহে সুনানি আবী দাঊদ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি.), ২য় খণ্ড, পৃ. ৯২।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৮৭৫।
[১৬]. ফাৎহুল বারী শারহে ছহীহিল বুখারী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৬।
[১৭]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৪৮৬; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২২৬; ছহীহুল জামে‘, হা/৫০৪৫।
[১৮]. আলবানী, সিলসিলা ছহীহাহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২২৫, হা/২২৬-এর আলোচনা দ্র.।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৪০-৫২৪১; মিশকাত, হা/৩০৯৯।
[২০]. আহকামুন নাযরি ইলাল মুহাররমাত, পৃ. ৪৬। 




প্রসঙ্গসমূহ »: নারী সমাজ নারীমঞ্চ
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৭ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (শেষ কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
আল-কুরআনে নারী কেন্দ্রিক আলোচনা ও শিক্ষনীয় বিষয়সমূহ - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৩য় কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (২য় কিস্তি) - তামান্না তাসনীম
প্রশ্নোত্তরে মুসলিম নারীদের ইসলাম শিক্ষা (৩য় কিস্তি) - আব্দুল গাফফার মাদানী
স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য - তামান্না তাসনীম
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্যের রূপরেখা - গুলশান আখতার
শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা (৯ম কিস্তি) - ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন

ফেসবুক পেজ