শারঈ পর্দা : একটি পর্যালোচনা
-ওবাইদুল্লাহ আল-আমীন*
(৬ষ্ঠ কিস্তি)
ষষ্ঠ শর্ত : নারীর পোশাক পুরুষের সাদৃশ্য না হওয়া
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য বিষয়ে পুরুষের বেশ ধারণকারী নারীদের প্রতি অভিশাপ দেয়া হয়েছে। সুতরাং জিলবাবের অন্যতম শর্ত হল- নারীদের জিলবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা অন্যান্য যেকোন বিষয়ে পুরুষের সাদৃশ্য না হওয়া। এ বিষয়ে প্রত্যেক ঈমানদার নারীদের সতর্ক থাকা আবশ্যক। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ لَعَنَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সে সকল পুরুষের উপর অভিশাপ করেছেন, যে পুরুষ মহিলার পোশাক পরিধান করে এবং সে সকল মহিলার উপর অভিশাপ করেছেন, যে মহিলা পুরুষের পোশাক পরিধান করে।[১]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ النَّبِيُّ ﷺ لَعَنَ اللهُ الْمُتَشَبِّهِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষের উপর অভিশাপ করেছেন এবং পুরুষের বেশ ধারণকারী মহিলাদের উপর অভিশাপ করেছেন।[২]
عَنْ عَبْدِ اللهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ثَلَاثٌ لَا يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ وَلَا يَنْظُرُ اللهُ إِلَيْهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْعَاقُّ وَالِدَيْهِ وَالْمَرْأَةُ الْمُتَرَجِّلَةُ الْمُتَشَبِّهَةُ بِالرِّجَالِ وَالدَّيُّوْثُ
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তিন ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাদের দিকে ফিরেও তাকাবেন না। (১) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (২) পুরুষের বেশ ধারণকরী নারী এবং (৩) দাইয়ূছ (যে তার পরিবারে অশ্লীলতার সুযোগ দেয়)।[৩] ইমাম ত্বাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
لا يجوز للرجال التشبه بالنساء في اللباس والزينة التي تختص بالنساء، ولا العكس
‘পুরুষের জন্য নারীদের বেশ ধারণ করা জায়েয নেই। চাই সেটা পোশাকের ক্ষেত্রে হোক কিংবা নারীদের বিশেষ সাজ-সজ্জা ক্ষেত্রে হোক। আর এর বিপরীতটাও বৈধ নয়’।[৪] শায়খ আবূ মুহাম্মাদ ইবনু হামজাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
ظاهر اللفظ الزجر عن التشبه في كل شيء لكن عرف من الأدلة الأخرى أن المراد التشبه في الزي وبعض الصفات والحركات ونحوها، لا التشبه في أصول الخير
‘অত্র হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ থেকে সব ধরনের সাদৃশ্যতা হতে বিরত থাকাকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দলীলের আলোকে বুঝা যায় যে, সাদৃশ্যতার উদ্দেশ্য হল, সাজ-সজ্জা ও আচরণে মিল থাকা। কল্যাণকর উৎসসমূহের মিল নয়’।[৫]
সুতরাং উক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহিলার জন্য পুরুষের পোশাকের সাদৃশ্যতা অবলম্বন করা জায়েয নয়। অতএব সে তাদের চাদর, লুঙ্গি ইত্যাদি পরিধান করবে না। যেমনটা বর্তমানে কিছু মুসলিম মেয়েরা করে থাকে। তারা জ্যাকেট ও প্যান্ট পরিধান করে। হাস্যকর বিষয় হল, তারা তাদের মাথার উপর পাতলা রেশমী কাপড় ফেলে রেখে মনে করে এটাই বুঝি পর্দা। বাস্তবতা হল এগুলো কোন কিছুই পর্দার অন্তর্ভুক্ত নয়।
প্রকাশ থাকে যে, পুরুষের সাথে মহিলার সাদৃশ্যতা এবং তার বিপরীতটার হারাম হওয়ার রহস্য হল, নারীর পূর্ণাঙ্গতা হচ্ছে মহান আল্লাহ কর্তৃক বিধিবদ্ধ নির্ধারিত পোশাক ধারণ করা। যাতে করে তাদের স্বকীয়তা বজায় থাকে, নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারে, ইয্যত আবৃত করতে পারে এবং তার উপযোগী মানানসই সাজ-সজ্জা গ্রহণ করতে পারে। আর পুরুষের পূর্ণতা হল, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত পোশাকে অভ্যস্ত থাকা এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়াবলীতে সন্তুষ্ট থাকা।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বিধিবদ্ধ পোশাক ও অন্যান্য বিষযের বাহিরে নারীদেরকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে যুক্ত করানো ঠিক নয়। কেননা এটা তার প্রকৃতি ও তার পূর্ণতার সংশ্লিষ্ট বিষয় হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যে কারণে স্বজাতীয় মেয়েদের নিকট তা পসন্দনীয় হয় না এবং পুরুষদের কাছেও না। কেননা এই প্রদর্শনীটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কাছে অগ্রহণযোগ্য। পরন্তু তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। যেহেতু সে তার স্বকীয়তা বিলুপ্ত করে। আর এই সময়ে তার পুরুষের সাথে যুক্ত হওয়া যেমন সম্ভব না, তেমনি তাদের অবস্থানে পৌঁছাও অসম্ভব। আর এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরুষের পোশাকের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করলে তো আর মহিলা পুরুষের ব্যক্তিত্বের সমান হতে পারবে না। আর মহিলারা পুরুষের পোশাক পরিধান করলেই যে তারা পুরুষ হয়ে যাবে এটাও কোনদিন সম্ভব না। মূলত নারীজাতির জন্য এটা একটা বড় ধ্বংসাত্মক বিষয়। কেননা অধিকাংশ পুরুষের বেশধারণকারী নারীদের স্বভাব-চরিত্র অনেকটা পুরুষের মত হয়ে যায়। এমনকি খোলামেলা চলার ক্ষেত্রে পুরুষের মত তারা আচরণ করে থাকে। আবার নারীদের কেউ কেউ তাদের দেহ পুরুষের ন্যায় প্রর্দশন করে থাকে। যা অত্যন্ত জঘন্য কাজ ও নিষিদ্ধ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রজ্ঞাবান শরী‘আত প্রবক্তার অনুগ্রহ যে, তিনি নারীদেরকে পুরুষের বেশ ধারণ করতে নিষেধ করেছেন। যেমনটি পুরুষদের নিষেধ করা হয়েছে নারীদের বেশ ধারণ করতে। যাতে উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিত্ব সংরক্ষিত থাকে এবং উভয়ের গোপনীয় জিনিসসমূহ যথাস্থনে অক্ষুণ্ণ থাকে।[৬]
সপ্তম শর্ত : কাফেরের পোশাকের সাদৃশ্য না হওয়া
শরী‘আত কর্তৃক স্বীকৃত বিষয় হল, মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য কাফেরের পোশাক কিংবা কাফেরের অন্য কোন বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য অবলম্বন করা হালাল নয়। চাই সেটা ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক বা আনন্দ-উৎসবের ক্ষেত্রে হোক অথবা তাদের বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে হোক। আর এটা ইসলামী শরী‘আতের অনেক বড় একটি বিধান। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজকাল অনেক মুসলিম এই নির্দেশিত গণ্ডি হতে বেরিয়ে গেছে। এমনকি তারা দ্বীন ও দ্বীনের দাওয়াহর বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করে। এর মূল কারণ হল, দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রবৃত্তির অনুসরণ, বর্তমান যামানার সাথে তাল মিলানো, কাফির বংশ ইউরোপের অন্ধ অনুকরণ ইত্যাদি। এগুলোই মুসলিমদের লাঞ্ছনা, তাদের দুর্বলতা এবং তাদের প্রতি বহিঃনিয়ন্ত্রণ ও ঔপনিবেশিক শক্তির আধিপত্যের কারণ। এ বিষয়ে নিম্নের প্রমাণগুলো খেয়াল করুন-
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَأَى رَسُوْلُ اللهِ ﷺ عَلَّى ثَوْبَيْنِ مُعَصْفَرَيْنِ فَقَالَ إِنَّ هَذِهِ مِنْ ثِيَابِ الْكُفَّارِ فَلَا تَلْبِسْهَا. وَفِيْ رِوَايَةٍ قُلْتُ أَغْسِلُهُمَا؟ قَالَ بَلْ اَحْرِقْهَا
আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমার পরিধানে হলুদ রঙের দু’টি কাপড় দেখে বললেন, নিশ্চয় এগুলো কাফেরদের পোশাক। অতএব তা পরিধান করো না। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি বললাম, কাপড় দু’টি কি ধুয়ে ফেলব? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, বরং জ্বালিয়ে ফেল।[৭]
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ قَالَ لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا لَا تَشَبَّهُوْا بِالْيَهُوْدِ وَلَا بِالنَّصَارَى
আমর ইবনু শু‘আইব তাঁর পিতার মাধ্যমে তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ছাড়া অন্য কোন জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। তোমরা ইহুদী এবং খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য গ্রহণ কর না।[৮]
ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, خَالِفُوا الْمُشْرِكِيْنَ ‘তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধাচরণ কর’।[৯] আবূ উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, وَخَالِفُوْا أَهْلَ الْكِتَابِ ‘তোমরা আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধাচরণ কর’।[১০]
এতদ্ব্যতীত যে ব্যক্তি এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়মের বিশদ বিবরণ ও গভীরতা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা পোষণ করে, সে যেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুছতাক্বীম মুখালাফাতা আছহাবিল জাহীম’ শীর্ষক বইটি অধ্যয়ন করে।[১১]
অষ্টম শর্ত : কোন প্রকার যশ-খ্যাতির পোশাক না হওয়া
মহিলাদের জিলবাব তথা যেকোন পোশাক-পরিচ্ছদ যেন কোন প্রকার যশ-খ্যাতি, প্রদর্শনেচ্ছা কিংবা অহংকারের পোশাক না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। হাদীছে এসেছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَنْ لَبِسَ ثَوْبَ شُهْرَةٍ فِى الدُّنْيَا أَلْبَسَهُ اللهُ ثَوْبَ مَذَلَّةٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُمَّ أَلْهَبَ فِيْهِ نَارًا
আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় খ্যাতির পোশাক পরবে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাকে অপমানের পোশাক পরাবেন। অতঃপর তাতে অগ্নি সংযোগ করাবেন’।[১২] উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় আল্লামা আবূ শামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘খ্যাতির পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং লোকেদের এমন পোশাক পরিধান করতে আদেশ করা হয়েছে, যা মানুষকে সাধারণ মানুষের পর্যায় শামিল করে এবং তাকে খ্যাতি প্রদান করে না’।[১৩] আর খ্যাতির পোশাক সেটাই, যা মানুষকে আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করে, সাধারণ মানুষের পোশাকের রংঢং ও কাঠামোর চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির, যা মানুষের মনোযোগ ও দৃষ্টি আকর্ষণ করে।[১৪] খ্যাতি অর্জনের মাধ্যম হল পোশাকের উৎকৃষ্টতা, মানহীনতা, টেকসই কিংবা দুষ্প্রাপ্যতা। শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া বলেন, ‘খ্যাতির পোশাক অপসন্দনীয়। আর তা হচ্ছে স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে উচ্চমানের বা নি¤œ মানের পোশাক। আর সালাফগণ উচ্চমানের এবং নিম্ন মানের দুই খ্যাতিকেই অপসন্দ করতেন’।[১৫]
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খ্রি.) বলেন, শায়খ আবূ ইসহাক্ব আল-ইস্পাহানী (রাহিমাহুল্লাহ) ছহীহ সনদে জাবির ইবনু আইয়ূব (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, যখন ছালত ইবনু রাশিদ (রাহিমাহুল্লাহ) মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর নিকট প্রবেশ করে, তখন তাঁর গায়ে পশমের জুব্বা, পশমের লুঙ্গি এবং মাথায় পশমের পাগড়ী ছিল। ফলে মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ) বিরক্ত হলেন এবং বললেন, আমি লক্ষ্য করি যে, কিছু লোক পশমের পোশাক পরিধান করে আর বলে যে, এগুলো ঈসা ইবনু মারইয়াম (আলাইহিস সালাম) পরিধান করতেন। অথচ আমাকে হাদীছ বলেছেন এমন ব্যক্তি যিনি নির্দোষ। আর নিশ্চয় নবী (ﷺ) কাতান, পশম, সিল্ক ইত্যাদি কাপড় পরিধান করেছেন। আর অনুসরণের ক্ষেত্রে আমাদের নবী (ﷺ)-এর সুন্নাতই সবচেয়ে বেশি উপোযোগী। উক্ত বর্ণনা দ্বারা ইবনু সীরীন (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উদ্দেশ্য হল, ঐ সকল লোক, যারা সর্বদা পশমের কাপড় পরিধান করে এবং এটাকে উত্তম মনে করে। আর নিজেদেরকে ভিন্ন কাপড় পরিধান করা হতে বিরত রাখে। অনুরূপভাবে যারা একই ডিজাইনের পোশাক অনুসন্ধান করে এবং যারা এমন চিত্রাংকন, অলংকার ও ডিজাইন সমূহ অনুসন্ধান করে, যেগুলো তাদের দৃষ্টিতে পরিত্যাগ করা অন্যায়। অথচ অন্যায় হচ্ছে কেবল ঐগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা এবং ঐগুলো থেকে বের হওয়াকে পরিত্যাগ করা।[১৬]
আল্লামা বকর ইবনু আব্দুল্লাহ আবূ যায়েদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নগরবাসী যে পোশাকে অভ্যস্ত তার বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে অথবা পোশাক দুর্লভ হওয়ার কারণে পোশাক-পরিচ্ছদ কখনো কখনো যশ-খ্যাতির বস্ত্র হিসাবে গণ্য হয়’। ইবনু আব্দিল ক্বাভী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর সাহিত্যের কবিতায় বলেন, ‘দেহের চামড়া প্রকাশকারী এবং পরিধানকারীর খ্যাতি প্রদানকারী পোশাক পরিধান মাকরূহ। তবে স্বামী ও মনিবের নিকট মাকরূহ নয়’। আস-সাফ্ফারীনি (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর ‘গদাউল আলবাব’ গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পোশাক পরিধানকারীর খ্যাতি বুঝাবে নিজ শহরবাসীর বৈশিষ্ট্যের ভিন্ন পোশাক পরিধান করলে। কেননা খ্যাতির পোশাক অনেক সময় তার পরিধানকারীকে লাঞ্ছিত করে এবং তার মূল্যবোধকে কমিয়ে দেয়। অতঃপর তিনি আব্দুল কাদির জিলানী (রাহিমাহুল্লাহ)-এর ‘আল-গুনিয়্যাহ’ গ্রন্থ হতে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। যেখানে পোশাকের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক ঐ সকল পোশাক যা মানুষের মাঝে খ্যাতি এনে দেয়, তা হতে মুক্ত থাকতে হবে। যেমন নিজ শহরে ও সম্প্রদায়ের মাঝে বের হওয়ার সময় ভিন্ন আঙ্গিকে বের হওয়া, যা তাদের স্বভাব পরিপন্থী। সুতরাং নিজ এলাকা কিংবা দেশে লোকজন যে পোশাক পরিধান করে সেই পোশাক পরিধান করা উচিত। যাতে করে তার দিকে কেউ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করতে না পারে। অন্যথা এটাই তাদেরকে পরনিন্দায় উদ্বুদ্ধ করবে। ফলে তারাও ঐ পাপের অংশীদার হয়ে যাবে’।[১৭]
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* সুপার, দারুস সুন্নাহ সালাফিয়া মাদরাসা, খালিশপুর, খুলনা।
তথ্যসূত্র :
[১]. আবূ দাঊদ, হা/৪০৯৮; মুসতাদরাক হাকিম, হা/৭৪১৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮২৯২; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৫৭৫১-৫৭৫২; মিশকাত, হা/৪৪৬৯; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/৫০৯৫।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৮৫; ইবনু মাজাহ, হা/১৯০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩১৫১; মিশকাত, হা/৪৪২৯।
[৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৬১৮০।
[৪]. আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আবুল ফাযল আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফা, ১৩৭৯ হি.), ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৩২; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুর রহীম আল-মুবারকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী বিশারহি জামিঈত তিরমিযী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, তাবি), ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৭; শামসুল হক আযীমাবাদী, ‘আওনুল মা‘বূদ শারহু সুনানি আবী দাঊদ (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৫ হি.), ১১তম খণ্ড, পৃ. ১০৫।
[৫]. ফাৎহুল বারী শারহু ছহীহিল বুখারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৩; আল-মুনাভী, ফায়যুল ক্বাদীর (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫।
[৬]. আল-মুফাছ্ছাল ফী আহকামিল মারয়াতি ওয়াল বায়তিল মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৫।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০২৭; মিশকাত, হা/৪৩২৭।
[৮]. তিরমিযী, হা/২৬৯৫; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৭৩৮০; মিশকাত, হা/৪৬৪৯; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২১৯৪; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২৭২৩। উল্লেখ্য, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, ‘তোমরা (খ্রিষ্টান) পোপদের পোশাক পরিধান করা হতে বেঁচে থাকো। কেননা যে তাদের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বা সাদৃশ্যতা গ্রহণ করে সে আমার দলভুক্ত নয়’। দ্র. : ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৩৯০৯। কিন্তু এ বর্ণনাটি যঈফ, সিলসিলা যঈফাহ, হা/৩২৩৪।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৮৯২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৯; মিশকাত, হা/৪৪২১।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৩৩৭; ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৭৯২৪; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/৬৪০৫; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১২৪৫।
[১১]. শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) ‘মুখতারাত মিন ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম’ শীর্ষক শিরোনামে উক্ত গ্রন্থের মুখতাছার রূপ সংকলন করেছেন। উক্ত গ্রন্থটিও পাঠ করা যেতে পারে।
[১২]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৬০৭; সনদ হাসান লি গাইরিহি, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/২০৮৯।
[১৩]. খিছালুল ফিতরাতি, পৃ. ১২৪।
[১৪]. আল-মুফাছছাল ফী আহকামিল মারয়াতি ওয়াল বায়তিল মুসলিম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৩৫।
[১৫]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃ. ১৩৮।
[১৬]. মুহাম্মাদ ইবনু আবী বকর ইবনু আইয়ূব ইবনু সা‘দ শামসুদ্দীন ইবনু ক্বাইয়িম আজ-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ঈবাদ (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭তম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৭-১৩৮।
[১৭]. হাদ্দুছ ছাওবি ওয়াল ইযারি ওয়া তাহরীমিল ইসবালি ওয়া লিবাসিশ শাহরারাতি, পৃ. ২৮।
প্রসঙ্গসমূহ »:
নারীমঞ্চ