বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৮ অপরাহ্ন

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পারিবারিক জীবন

-আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*


(১৬তম কিস্তি) 
[সেপ্টেম্বর ২০২১ সংখ্যার পর]

নবী (ﷺ) নাতী-নাতনীদেরকে কিছু পঠিতব্য দু‘আ শিক্ষা দিতেন

হাসান ইবনু আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, বিতরের ছালাতে পাঠের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে কিছু কালেমা শিখিয়েছেন,

اَللّٰهُمَّ اهْدِنِيْ فِيْمَنْ هَدَيْتَ وَعَافِنِيْ فِيْمَنْ عَافَيْتَ وَتَوَلَّنِيْ فِيْمَنْ تَوَلَّيْتَ وَبَارِكْ لِيْ فِيْمَا أَعْطَيْتَ وَقِنِيْ شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِيْ وَلَا يُقْضَى عَلَيْكَ وَإِنَّهُ لاَ يَذِلُّ مَنْ وَالَيْتَ تَبَارَكْتَ رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ

‘হে আল্লাহ! যাদের আপনি হিদায়াত করেছেন তাদের সাথে আমাকেও হিদায়াত করুন, যাদের আপনি অকল্যাণ থেকে দূরে রেখেছেন তাদের সাথে আমাকেও অকল্যাণ থেকে দূরে রাখুন, যাদের আপনি আপনার অভিভাবকত্বে রেখেছেন তাদের সাথে আমাকেও আপনার অভিভাবকত্বে রাখুন। আপনি যা দিয়েছেন তাতে আপনি বরকত দিন। আপনি আমার তাক্বদীরে যা রেখেছেন এর অসুবিধা থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আপনিই তো ফয়সালা দেন, আপনার বিপরীত তো ফয়সালা দিতে কেউ পারে না । আপনি যার বন্ধু তাকে তো লাঞ্ছিত করতে পারবে না কেউ। হে আমার রব! আপনি তো বরকতময় এবং সুমহান’।[১]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নাতীদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতেন

قَالَ أَبُوْ بَكْرَةَ : رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ عَلَى الْمِنْبَرِ وَالْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ إِلَى جَنْبِهِ، وَهْوَ يُقْبِلُ عَلَى النَّاسِ مَرَّةً وَعَلَيْهِ أُخْرَى وَيَقُوْلُ : إِنَّ ابْنِىْ هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيْمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ

আবূ বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এমন অবস্থায় মিম্বারের উপর দেখলাম যে, তাঁর পাশে রয়েছে হাসান ইবনু আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)। আর নবী (ﷺ) কখনো লোকদের প্রতি তাকাচ্ছেন, আবার কখনো হাসানের দিকে তাকিয়ে বলছেন, আমার এ পুত্র নেতা এবং সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা মুসলিমদের দু‘টি বিবদমান বড় দলের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিবেন।[২]

عن بُرَيْدَةَ قَالَ خَطَبَنَا رَسُوْلُ اللهِ ﷺ فَأَقْبَلَ الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا عَلَيْهِمَا قَمِيْصَانِ أَحْمَرَانِ يَعْثُرَانِ وَيَقُوْمَانِ فَنَزَلَ فَأَخَذَهُمَا فَصَعِدَ بِهِمَا الْمِنْبَرَ ثُمَّ قَالَ صَدَقَ اللهُ (اِنَّمَاۤ  اَمۡوَالُکُمۡ وَ اَوۡلَادُکُمۡ  فِتۡنَۃٌ) رَأَيْتُ هَذَيْنِ فَلَمْ أَصْبِرْ  ثُمَّ أَخَذَ فِى الْخُطْبَةِ

বুরায়দা ইবনু হাসীব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের সামনে খুত্ববা দানকালে হাসান এবং হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) লাল ডোরা বিশিষ্ট জামা পরিধান করে সেখানে আসার সময় (অল্প বয়স্ক হওয়ায়) পিছলিয়ে পড়ে যান। নবী করীম (ﷺ) খুত্ববা বন্ধ করে মিম্বর হতে অবতরণ করে তাঁদেরকে নিয়ে পুনরায় মিম্বরে আরোহণ করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা সত্য বলেছেন, ‘তোমাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদি ফিতনাস্বরূপ’ (সূরা আত-তাগাবূন : ১৫)। আমি উভয়কে পড়ে যেতে দেখে সহ্য করতে পারিনি। অতঃপর তিনি খুত্ববা দেয়া শুরু করেন।[৩]

এখানে (يعثران) অর্থাৎ (হাসান ও হুসাইন) তারা হাঁটতে গিয়ে ছোট শিশু হওয়ার দরূন একবার ডানে, একবার বামে ঝুকে দুর্বলভাবে হাঁটছিল। অতঃপর নবী (ﷺ) তাদেরকে কোলে তুলে নিলেন। এটি ছিল আল্লাহর দেয়া পরিপূর্ণ রহমতের বহিপ্রকাশ।[৪]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّمَاۤ  اَمۡوَالُکُمۡ وَ اَوۡلَادُکُمۡ  فِتۡنَۃٌ ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ’ (সূরা আত-তাগাবুন : ১৫)। অর্থাৎ (সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি) অন্তরকে আল্লাহর আনুগত্য থেকে ব্যস্ত করে ফেলে। উক্ত হাদীছের লক্ষনীয় বিষয় হল, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খুত্ববা বন্ধ করে নাতীদের জন্য অবতরণ করা ছিল পরীক্ষা স্বরূপ। সন্তান-সন্ততির ভালোবাসা তাকে সেদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। সন্তান-সন্ততির ফিতনার অনেক স্তর রয়েছে। এর মধ্যে উপরিউক্তটি ছিল সবচেয়ে ছোট ফিতনা। এই ফিতনা কখনো এর চেয়ে বড় স্তরের দিকে ধাবিত করলে তা থেকে সতর্ক থাকা যরূরী।[৫] উক্ত হাদীছে নাতীদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দয়া ও ভালোবাসার বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

নবী (ﷺ) নাতীদের কাউকে কাউকে ছালাতের অবস্থায়ও কোলে নিতেন

عَنْ أَبِيْ قَتَادَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ ﷺ يَؤُمُّ النَّاسَ وَأُمَامَةُ بِنْتُ أَبِى الْعَاصِ عَلٰى عَاتِقِهِ فَإِذَا رَكَعَ وَضَعَهَا وَإِذَا رَفَعَ مِنَ السُّجُوْدِ أَعَادَهَا

আবূ ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে লোকদের ইমামতি করতে দেখেছি, অথচ তখন আবুল ‘আছের কন্যা (স্বীয় কন্যা যয়নাবের গর্ভজাত মেয়ে) উমামা তার কাঁধের উপর ছিল। তিনি যখন রুকূ‘ করতেন তাকে নামিয়ে দিতেন, যখন সিজদা হতে মাথা তুলতেন তখন পুনরায় উঠিয়ে নিতেন।[৬]

কখনো কখনো তিনি নাতীদেরকে ছালাতের মাঝেই বহন করতেন

শাদ্দাদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক এশার ছালাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের দিকে বেরিয়ে আসলেন। তখন তিনি হাসান অথবা হুসায়ন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বহন করে আনছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সামনে অগ্রসর হয়ে তাকে রেখে দিলেন। তারপর ছালাতের জন্য তাকবীর বললেন ও ছালাত আদায় করলেন। ছালাতের মধ্যে একটি সিজদা লম্বা করলেন। (হাদীছের অন্যতম রাবী আব্দুল্লাহ বলেন), আমার পিতা (শাদ্দাদ) বলেন, আমি আমার মাথা উঠালাম এবং দেখলাম, ঐ ছেলেটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিঠের উপর রয়েছেন। আর তিনি সিজদারত। তারপর আমি আমার সিজদায় গেলাম। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছালাত শেষ করলে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি আপনার ছালাতের মধ্যে একটি সিজদা এত লম্বা করলেন, যাতে আমরা ধারণা করলাম, হয়তো কোন ব্যাপার ঘটে থাকবে। অথবা আপনার উপর অহী নাযিল হচ্ছিল। তিনি বললেন, এর কোনটাই ঘটেনি। বরং আমার এ সন্তান আমাকে সওয়ারী বানিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠতে অপসন্দ করলাম, যেন সে তার কাজ সমাধা করতে পারে।[৭]

নবী (ﷺ)-এর পিঠের উপর হাসান ও হুসাইন লাফ-ঝাপ করলেও তিনি রাগ করতেন না

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا نُصَلِّى مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ الْعِشَاءَ فَإِذَا سَجَدَ وَثَبَ الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ عَلَى ظَهْرِهِ فَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ أَخَذَهُمَا بِيَدِهِ مِنْ خَلْفِهِ أَخْذًا رَفِيْقًا وَيَضَعُهُمَا عَلَى الأَرْضِ فَإِذَا عَادَ عَادَا حَتَّى قَضَى صَلَاتَهُ أَقْعَدَهُمَا عَلَى فَخِذَيْهِ -قَالَ- فَقُمْتُ إِلَيْهِ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَرُدُّهُمَا. فَبَرَقَتْ بَرْقَةٌ فَقَالَ لَهُمَا الْحَقَا بِأُمِّكُمَا. قَالَ فَمَكَثَ ضَوْءُهَا حَتَّى دَخَلَا عَلَى أُمِّهِمَا

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিছনে এশার ছালাত আদায় করছিলাম। অতঃপর তিনি সিজদায় গেলে হাসান ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তাঁর পিঠে চড়ে বসল। যখন তিনি মাথা উঠালেন, তখন তাদেরকে পিছন থেকে মৃদুভাবে ধরে যমীনের উপর বসিয়ে দিলেন। তিনি আবার সিজদায় গেলে তারা দু’জন পুনরায় উনার পিঠে উঠে বসে। এরপর তিনি ছালাত শেষ করে তাদেরকে স্বীয় উরুর উপর বসালেন। রাবী বলেন, আমি তাঁর দিকে দাঁড়িয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি কি তাদেরকে ফিরিয়ে দিই। অতঃপর (আকাশে) বিদ্যুৎ চমকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের মায়ের কাছে তোমরা ফিরে যাও’। রাবী বলেন, এরপর হাসান ও হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তাদের মায়ের কাছে প্রবেশ করা পর্যন্ত বিদ্যুতের আলো চমকাচ্ছিল।[৮]

আবূ বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছালাত আদায় করছিলেন। যখন তিনি সিজদায় গেলেন তখন হাসান তাঁর পিঠ ও ঘাড়ের উপর চড়ে বসল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে মৃদুভাবে সরিয়ে দিলেন যাতে সে মাটিতে পড়ে না যায়। রাবী বলেন, তিনি একাজ কয়েকবার করলেন। অতঃপর যখন তিনি ছালাত শেষ করলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা আপনাকে হাসানের সাথে এমন কিছু করতে দেখলাম যা আগে দেখিনি। নবী (ﷺ) বললেন, নিশ্চয় সে আমার কাছে দুনিয়ার সুগন্ধিময় ফুল। আমার এ পুত্র নেতা এবং সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা মুসলিমদের দু’টি বিরোধমান বড় দলের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিবেন।[৯]

হাদীছের শিক্ষা : উক্ত হাদীছের মধ্যে বাচ্চাদের  জন্য মসজিদে প্রবেশের দলীল রয়েছে। অতঃপর (جَنِّبُوا مَسَاجِدَكُمْ صِبْيَانَكُمْ وَمَجَانِينَكُمْ) ‘তোমরা তোমাদের মসজিদসমূহকে শিশু, পাগল থেকে হেফাযত করো।’ মর্মে বর্ণিত হাদীছ যঈফ। হাদীছটি ইবনু মাজাহ (হা/৭৫০) ওয়াছিলাহ ইবনে আসক্বা‘ থেকে বর্ণনা করেছেন। শায়খ আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) যঈফুল জামে‘ (হা/২৬৩৬)-এর মধ্যে হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন।

অতঃপর নাতী-নাতনীদের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সম্পর্কের ভিত্তিই ছিল দয়া ও ভালোবাসার উপর। আর ছোট শিশু তার পিতা-মাতার ভালোবাসা ও আদর-স্নেহের প্রতি খাদ্য ও পানির মতোই মুখাপেক্ষী থাকে। এছাড়া স্নেহ-ভালোবাসার রসদ একটি শিশুর সুষম ব্যক্তিত্ব গড়ার জন্য খুব যরূরী।

নবী (ﷺ) তাঁর নাতীদেরকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: خَرَجْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ فِيْ طَائِفَةٍ مِنَ النَّهَارِ، لَا يُكَلِّمُنِيْ وَلَا أُكَلِّمُهُ، حَتَّى جَاءَ سُوْقَ بَنِيْ قَيْنُقَاعَ، ثُمَّ انْصَرَفَ، حَتَّى أَتَى خِبَاءَ فَاطِمَةَ فَقَالَ: أَثَمَّ لُكَعُ؟ أَثَمَّ لُكَعُ؟ يَعْنِيْ حَسَنًا فَظَنَنَّا أَنَّهُ إِنَّمَا تَحْبِسُهُ أُمُّهُ لِأَنْ تُغَسِّلَهُ وَتُلْبِسَهُ سِخَابًا، فَلَمْ يَلْبَثْ أَنْ جَاءَ يَسْعَى، حَتَّى اعْتَنَقَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا صَاحِبَهُ، فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أُحِبُّهُ، فَأَحِبَّهُ وَأَحْبِبْ مَنْ يُحِبُّهُ. قَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ فَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبَّ إِلَىَّ مِنَ الْحَسَنِ بْنِ عَلِىٍّ بَعْدَ مَا قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ مَا قَالَ

আবূ হুরায়রাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, দিনের এক প্রহরে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে রওনা হলাম। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি এবং আমিও তার সঙ্গে কথা বলছিলাম না। অবশেষে বানু কাইনুকা‘-এর বাজারে পৌঁছলেন, তারপর তিনি ফিরে চললেন এবং ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর গৃহে প্রবেশ করলেন। অতঃপর বললেন, এখানে কি শিশু আছে, এখানে কি শিশু আছে, অর্থাৎ হাসান। আমরা অনুমান করলাম যে, তার মা তাকে ধরে রেখেছেন গোসল করানো এবং সুগন্ধি মালা পরানোর জন্য। কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরেই হাসান দৌড়ে চলে এলেন এবং তারা পরস্পরকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হে আল্লাহ! আমি তাকে পসন্দ করি, তুমিও তাকে পসন্দ কর, আর পসন্দ কর সেই ব্যক্তিকে যে তাকে পসন্দ করে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একথা বলার পর থেকে হাসান ইবনু আলীর চেয়ে কেউ আমার কাছে অধিক প্রিয় হয়নি।[১০]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, (جَاءَ يَسْعَى، حَتَّى اعْتَنَقَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا صَاحِبَهُ) ‘হাসান দৌড়ে চলে এলেন এবং তারা পরস্পরকে গলায় জড়িয়ে ধরলেন’-এর মধ্যে শিক্ষা হল : শিশুদের প্রতি দয়া ও অনুকম্পা স্বরূপ স্নেহ-ভালোবাসা দেখানো ও তাদের সাথে কৌতুক করা মুস্তাহাব। এছাড়া শিশুদের সাথে বিনয়ী আচরণ প্রভৃতি কাজও মুস্তাহাব।

উক্ত হাদীছের আরো শিক্ষা হল : শিশুদেরকে হাড় বা সুগন্ধি মালা বা এজাতীয় অন্য কিছু সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য পরিধান করানো মুস্তাহাব। এছাড়া বিশেষত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা মুস্তাহাব।[১১]

নবী (ﷺ)-এর নাতীদ্বয় ছিলেন তাঁর কাছে দু’টি সুগন্ধিময় ফুল

إِنَّ الحَسَنَ وَالحُسَيْنَ هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنَ الدُّنْيَا

‘নিশ্চয় হাসান ও হুসাইন তারা দু’জন এই পৃথিবীতে আমার দু’টি সুগন্ধিময় ফুল’।[১২] এর ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা হাসান ও হুসাইনের দ্বারা আমাকে সম্মানিত করেছেন এবং আমার কাছে তাদেরকে প্রিয় করেছেন। কেননা ফুলের মত সন্তানদেরও ঘ্রাণ শোঁকা হয় এবং চুম্বন করা হয়। এবং (مِنَ الدُّنْيَا)-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তারা দুনিয়াবী সুগন্ধির অংশ।[১৩]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নাতীদেরকে চুম্বন করতেন এবং বুকে জড়িয়ে নিতেন

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَبَّلَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ الْحَسَنَ بْنَ عَلِىٍّ وَعِنْدَهُ الأَقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ التَّمِيْمِىُّ جَالِسًا. فَقَالَ الأَقْرَعُ إِنَّ لِىْ عَشَرَةً مِنَ الْوَلَدِ مَا قَبَّلْتُ مِنْهُمْ أَحَدًا. فَنَظَرَ إِلَيْهِ رَسُولُ ﷺ ثُمَّ قَالَ : مَنْ لَا يَرْحَمُ لَا يُرْحَمُ

আবূ হুরায়রাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা হাসান ইবনু আলীকে চুম্বন করেন। সে সময় তাঁর নিকটে আক্বরা‘ ইবনু হাবিস আত-তামীমী উপবিষ্ট ছিলেন। আক্বরা‘ ইবনু হাবিস বললেন, আমার দশটি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোন দিন চুম্বন দেইনি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দিকে তাকালেন, অতঃপর বললেন, যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না’।[১৪] এখানে নবী (ﷺ)-এর আক্বরা ইবনু হাবিসের কথার প্রত্যুত্তরের মধ্যে ইঙ্গিত হল, নিশ্চয় সন্তানকে চুম্বন করা ভালোবাসা ও দয়া থেকে হয়; এভাবে আলিঙ্গন, ঘ্রাণ শোঁকা ও কোলাকুলির বিষয়টিও ভালোবাসা থেকে হয়।[১৫]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. তিরমিযী, হা/৪৬৪; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, ইরওয়াউল গালীল, হা/৪২৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭০৪; মিশকাত, হা/৬১৩৫।
[৩]. আবূ দাউদ, হা/১১০৯; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[৪]. হাশিয়াতু সিন্দী আলান নাসাঈ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০৮।
[৫]. ইবনে হাজার, ফাতহুল বারী, ১১তম খণ্ড, পৃ. ২৫৪; সংক্ষিপ্তসারে।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১৬, ৫৯৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৫৪৩; মিশকাত, হা/৯৮৪।
[৭]. নাসাঈ, হা/১১৪১; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৬৬৯; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩৩২৫।
[৯]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৯৯৪; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, ছামারুল মুস্তাতাব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৫৭।
[১০]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪২১।
[১১]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ১৯৩।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৫৩; তিরমিযী, হা/৩৭৭০।
[১৩]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪২৭।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১৮।
[১৫]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৪৩০।




প্রসঙ্গসমূহ »: নবী-রাসূল
নববী আদর্শ (৪র্থ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৮তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৪তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৭তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১২তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৩তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৯ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ