রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যক্তি জীবন
-মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আহমাদ আব্দুল্লাহ শাকিল*
(৩য় কিস্তি)
(চ) বীরত্বের ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
আলী ইবনু আবি তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
لَمَّا حَضَرَ الْبَأْسُ يَوْمَ بَدْرٍ اتَّقَيْنَا بِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَكَانَ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ مَا كَانَ أَوْ لَمْ يَكُنْ أَحَدٌ أَقْرَبَ إِلَى الْمُشْرِكِيْنَ مِنْهُ
‘বদর যুদ্ধের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নিরাপত্তা দিচ্ছিলাম। সেদিন তাঁর মত আর কাউকে সাহসী দেখা যায়নি। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে আর কেউ মুশরিকদের এত নিকটবর্তী হয়নি’।[১] ছহীহ মুসলিমে বারা ইবনু ‘আযিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,
كُنَّا وَاللهِ إِذَا احْمَرَّ الْبَأْسُ نَتَّقِى بِهِ وَإِنَّ الشُّجَاعَ مِنَّا لَلَّذِىْ يُحَاذِى بِهِ يَعْنِى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم
‘আল্লাহর কসম! যুদ্ধের-উত্তেজনা যখন ঘোরতর হয়ে উঠল, তখন আমরা তার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতাম। নিশ্চয় আমাদের মাঝে বীরপুরুষ তিনিই যিনি যুদ্ধে তাঁর অর্থাৎ নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সামনে দাঁড়াতে সাহসী হত’।[২] আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَحْسَنَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَشْجَعَ النَّاسِ وَلَقَدْ فَزِعَ أَهْلُ الْمَدِيْنَةِ ذَاتَ لَيْلَةٍ فَانْطَلَقَ نَاسٌ قِبَلَ الصَّوْتِ فَتَلَقَّاهُمْ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم رَاجِعًا وَقَدْ سَبَقَهُمْ إِلَى الصَّوْتِ وَهُوَ عَلَى فَرَسٍ لِأَبِى طَلْحَةَ عُرْىٍ فِىْ عُنُقِهِ السَّيْفُ وَهُوَ يَقُوْلُ لَمْ تُرَاعُوْا لَمْ تُرَاعُوْا قَالَ وَجَدْنَاهُ بَحْرًا أَوْ إِنَّهُ لَبَحْرٌ قَالَ وَكَانَ فَرَسًا يُبَطَّأُ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকল মানুষের মধ্যে অতি সুন্দর, অতি দানশীল এবং শ্রেষ্ঠ বীর ছিলেন। কোন এক রাতে মদীনাবাসীরা ঘাবড়ে পড়েছিল। যেদিক থেকে শব্দ আসছিল, লোকেরা সেদিকে ছুটে চলল। পথে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয় ও তখন তিনি ফিরে আসছিলেন। কারণ শব্দের দিকে প্রথম তিনিই ছুটে গিয়েছিলেন। তখন তিনি আবূ ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর জীনবিহীন ঘোড়ায় আরোহিত ছিলেন। তার কাঁধে তরবারি ছিল। তিনি বলছিলেন, তোমরা ভীত হয়ো না, তোমরা ভীত হয়ো না। তিনি আরো বললেন, আমি এ ঘোড়াকে পেয়েছি সমুদ্রের মত অথবা বললেন, এটাতো সমুদ্র। অথচ ইতিপূর্বে এটি ছিল ধীর গতির একটি ঘোড়া’।[৩] উল্লেখ্য, এখানে ধীরগতি সম্পন্ন অচল ঘোড়ার হঠাৎ সমুদ্রের মত ক্ষিপ্রগতির হয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিশেষ মু‘জেযার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
(ছ) দানশীলতা ও বদান্যতায় উত্তম আদর্শ
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُوْنُ فِىْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ وَكَانَ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ فَلَرَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ
‘আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রামাযানে তিনি আরো অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রামাযানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তাঁর সাথে দেখা করতেন এবং তারা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রহমতের বায়ু অপেক্ষাও অধিক দানশীল ছিলেন’।[৪] জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, مَا سُئِلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم عَنْ شَىْءٍ قَطُّ فَقَالَ لَا ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট কোন জিনিস চাওয়া হলে, তিনি কখনো ‘না’ বলেননি’।[৫] আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,
مَا سُئِلَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْإِسْلَامِ شَيْئًا إِلَّا أَعْطَاهُ قَالَ فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَأَعْطَاهُ غَنَمًا بَيْنَ جَبَلَيْنِ فَرَجَعَ إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ أَسْلِمُوْا فَإِنَّ مُحَمَّدًا يُعْطِى عَطَاءً لَا يَخْشَى الْفَاقَةَ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করার পর কেউ কিছু চাইলে তিনি অবশ্যই তা দিয়ে দিতেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এল। তিনি তাকে এত বেশি ছাগল দিলেন, যাতে দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান পূর্ণ হয়ে গেল। তারপর সে ব্যক্তি তার সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে তাদের বলল, হে আমার জাতি ভাইয়েরা! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কেননা মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (এত বেশি) দান করেন যে, তিনি ‘ক্ষুধার্ত’ থাকার (অভাবগ্রস্ত হওয়ার) ভয় করেন না।[৬]
(জ) আল্লাহভীতির ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
মুর্তারাফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّى وَفِىْ صَدْرِهِ أَزِيْزٌ كَأَزِيْزِ الرَّحَى مِنَ الْبُكَاءِ صلى الله عليه وسلم ‘আমি দেখেছি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাত আদায় করছিলেন এবং সে সময় তাঁর বুক থেকে যাঁতা পেষার আওয়াজের ন্যায় কান্নার আওয়াজ হচ্ছিল’।[৭] ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, شَيَّبَتْنِىْ هُوْدٌ وَالْوَاقِعَةُ وَالْمُرْسَلَاتُ وَ (عَمَّ يَتَسَاءَلُوْنَ) وَ (إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ) ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি তো বৃদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি জবাবে বলেন, সূরা হূদ, ওয়াক্বি‘আহ, ওয়াল মুরসালাত, আম্মা ইয়াতাসাআলুন ও ওয়াইযাশ-শামসু কুব্বিরাত আমাকে বৃদ্ধ করে দিয়েছে’।[৮]
(ঝ) দুনিয়াবিমুখতা ও দুনিয়া অর্জনে সতর্ক থাকার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
একদা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে গমন করলেন। এ সময় তিনি একটা চাটাইয়ের উপর শুয়ে ছিলেন। চাটাই এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাঝে আর কিছুই ছিল না। তাঁর মাথার নীচে ছিল খেজুরের ছালভর্তি চামড়ার একটি বালিশ এবং পায়ের কাছে ছিল সল্ম বৃক্ষের পাতার একটি স্তুূপ ও মাথার উপর লটকানো ছিল চামড়ার একটি মশক। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এক পার্শ্বে চাটাইয়ের দাগ দেখে কেঁদে ফেললে তিনি বললেন, তুমি কেন কাঁদছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কিসরা ও কায়ছার পার্থিব ভোগ-বিলাসের মধ্যে ডুবে আছে, অথচ আপনি আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তারা দুনিয়া লাভ করুক, আর আমরা আখিরাত লাভ করি।[৯]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ছাহাবীদেরকে দুনিয়াবিমুখতা ও আখেরাতমুখিতার প্রতি উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলেন, সেসময় একটি পুরাতন জিন বিশিষ্ট বাহনের উপর আরোহণ করেছিলেন। আনাস বিন মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (উটের পিঠে) একটি পুরাতন জিন ও পালানে উপবিষ্ট অবস্থায় হজ্জ করেন। তাঁর পরিধানে ছিল একটি চাদর যার মূল্য চার দিরহাম বা তারও কম। অতঃপর তিনি বলেন, হে আল্লাহ! এ এমন হজ্জ, যাতে কোন প্রদর্শনেচ্ছা বা প্রচারেচ্ছা নেই।[১০]
(ঞ) আল্লাহর এককত্বের ওপর পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে অটল থাকার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, বারা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি তাকে বললেন,
يَا أَبَا عُمَارَةَ وَلَّيْتُمْ يَوْمَ حُنَيْنٍ؟ قَالَ لَا وَاللهِ مَا وَلَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم وَلَكِنْ وَلَّى سَرَعَانُ النَّاسِ فَلَقِيَهُمْ هَوَازِنُ بِالنَّبْلِ وَالنَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَلَى بَغْلَتِهِ البَيْضَاءِ وَأَبُوْ سُفْيَانَ بْنُ الحَارِثِ آخِذٌ بِلِجَامِهَا وَالنَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبْ أَنَا ابْنُ عَبْدِ المُطَّلِبْ
‘হে আবূ ‘উমারাহ! আপনারা হুনায়নের দিন পলায়ন করেছিলেন? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, না। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো পলায়ন করেননি বরং অতি উৎসাহী অগ্রবর্তী কতিপয় ব্যক্তি হাওয়াযিনদের তীর নিক্ষেপের ফলে পালিয়ে ছিলেন। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাদা খচ্চরটির উপর উপবিষ্ট ছিলেন এবং আবূ সুফিয়ান ইবনু হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এর লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, আমি মিথ্যা নবী নই, আমি ‘আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর’।[১১]
(ট) বেশি বেশি তাওবাহ-ইস্তিগফার করার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ :
আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, وَاللهِ إِنِّيْ لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ فِي اليَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِيْنَ مَرَّةً ‘আল্লাহর শপথ! আমি প্রতিদিন আল্লাহর কাছে সত্তরবারেরও অধিক ইস্তিগফার ও তাওবাহ করে থাকি’।[১২]
(ঠ) ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন উত্তম আদর্শ :
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ نَبِيَّ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُوْمُ مِنَ اللَّيْلِ حَتَّى تَتَفَطَّرَ قَدَمَاهُ فَقَالَتْ عَائِشَةُ لِمَ تَصْنَعُ هَذَا يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَقَدْ غَفَرَ اللهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ؟ قَالَ أَفَلَا أُحِبُّ أَنْ أَكُوْنَ عَبْدًا شَكُوْرًا
‘আল্লাহর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে এত অধিক ছালাত আদায় করতেন যে, তাঁর পদযুগল ফেটে যেত। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আল্লাহ তো আপনার আগের ও পরের ত্রুটিসমূহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? তবু আপনি কেন তা করছেন? তিনি বললেন, আমি কি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া পসন্দ করব না?’[১৩]
‘আত্বা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমি এবং ‘উবাইদ ইবনু ‘উমাইর আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকটে প্রবেশ করলে তিনি ‘উবাইদ ইবনু ‘উমাইরকে বললেন, এতদিন পরে সময় হল তোমার আমার সাথে সাক্ষাৎ করার? সে বলল, আমি প্রথম বারে যেভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, আজও সেভাবেই উত্তর দিচ্ছি, (কথায় আছে) ‘বিলম্বে সাক্ষাৎ কর, ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে’। রাবী বলেন, তিনি বললেন, তোমার এসব দুর্বোধ্য সব কথা ছাড় তো? ইবনু ‘উমাইর বলল, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যে বিষয়টি আপনার সবচেয়ে আশ্চর্যজনক লেগেছে সে সম্পর্কে কিছু বলুন। রাবী বলেন, তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন অতঃপর বললেন, এক রাতে তিনি আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি আমাকে ছাড় দাও, আজকের রাতে আমার প্রভুর ইবাদতে কাটিয়ে দিতে চাই। আমি বললাম, আল্লাহর শপথ আমি আপনার নৈকট্য চাই, আপনাকে খুশী করে এমন সব বিষয়কে আমি পসন্দ করি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওযূ করে ছালাতে দাঁড়ালেন। তিনি বলেন, তিনি অবিরত কাঁদতে লাগলেন এমনকি তার কোল ভিজে গেল। তিনি বলেন, আবার তিনি কাঁদতেই থাকলেন এমনকি তাঁর দাড়ি ভিজে গেল। আয়েশা বলেন, আবার তিনি কাঁদতেই থাকলেন এমনকি (অশ্রু) যমীনকে সিক্ত করল। অতঃপর বিলাল (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আসলেন এবং আযান দিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন, আপনার পূর্বের ও পরের সকল গুনাহ তো ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে? তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? যারা কুরআন তেলাওয়াত করে অথচ তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না তাদেরকে ভৎর্সনা করে আজকের রাতে এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে… ’ শেষ পর্যন্ত (সূরা আলে ইমরান ১০৯)।[১৪]
রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিভিন্ন ইবাদত বেশি বেশি করার নির্দেশনা দিতেন। তিনি এ মাসে বেশি বেশি ছাদাক্বাহ, ইহসান, কুরআন তেলাওয়াত, ছালাত, যিকির ও ই‘তিকাফ করতেন। এ মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশি বেশি নফল ইবাদত করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একাধারে (এত অধিক) ছিয়াম পালন করতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর ছিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। (আবার কখনো এত বেশী) ছিয়াম পালন না করা অবস্থায় একাধারে কাটাতেন যে, আমরা বলাবলি করতাম, তিনি আর (নফল) ছিয়াম পালন করবেন না। আমি আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রামাযান ব্যতীত কোন পুরা মাসের ছিয়াম পালন করতে দেখিনি এবং শা‘বান মাসের চেয়ে কোন মাসে অধিক (নফল) ছিয়াম পালন করতে দেখিনি।[১৫] অন্য আরেকটি হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ছিয়ামের প্রতি বেশি খেয়াল রাখতেন।[১৬]
(ণ) কুরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তারতীলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। তাঁর তেলাওয়াতে খুব দ্রুততা ও তাড়াহুড়া ছিল না। বরং তিনি প্রতিটি হরফ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তেন। প্রতিটি আয়াত ভেঙ্গে ভেঙ্গে আলাদা করে পড়তেন। তিনি মাদের হরফের স্থানে মাদ (টেনে) পড়তেন। হাদীছে এসেছে, আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ‘কিরাআত’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ‘কিরাআত’ কেমন ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, কোন কোন ক্ষেত্রে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দীর্ঘ করতেন। এরপর তিনি ‘বিসমিল্লা-হির রহমা-নির রহীম’ তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং তিনি বললেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘বিসমিল্লাহ’ ‘আর রহমান’, ‘আর রহীম’ পড়ার সময় দীর্ঘায়িত করতেন।[১৭]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বিরাআতের শুরুতে অভিশপ্ত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন, أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ ‘অভিশপ্ত শাইত্বান থেকে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। আবার কখনো পড়তেন, اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ ‘হে আল্লাহ! আমি বিতাড়িত শয়তানের শয়তানী, তার অশ্লীল কবিতা এবং তার অহংকার হতে আপনার নিকট আশ্রয় চাই’।[১৮] উল্লেখ্য, তিনি নাজাসাত বা নাপাকী অবস্থা ছাড়া দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে ও ওযূ অবস্থায় অথবা ওযূ ছাড়া সর্বাবস্থায় কুরআন তেলাওয়াত করতেন।[১৯]
(ত) আল্লাহর যিকিরের ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহর যিকির করতেন। তিনি সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির করতেন। তিনি দাঁড়ানো অবস্থায়, বসা অবস্থায়, চলা অবস্থায়, আরোহী অবস্থায় এবং আরোহণ করতে ও অবতরণ করতে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকির করতেন।
(থ) ছালাত, ছিয়াম ও বিবাহ-শাদীর বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণের দিকে আহ্বান
আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তিন জনের একটি দল নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীদের বাড়িতে আসল। যখন তাঁদেরকে এ সম্পর্কে জানানো হল, তখন তারা ইবাদতের পরিমাণ কম মনে করল এবং বলল, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে আমাদের তুলনা হতে পারে না। কারণ, তার আগের ও পরের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। এমন সময় তাদের মধ্য হতে একজন বলল, আমি সারা জীবন রাতভর ছালাত আদায় করতে থাকব। অপর একজন বলল, আমি সবসময় ছিয়াম পালন করব এবং কখনো বাদ দেব না। অপরজন বলল, আমি নারী সংসর্গ ত্যাগ করব, কখনও বিয়ে করব না। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নিকট এসে বললেন, ‘তোমরা কি ঐ সব লোক, যারা এমন এমন কথাবার্তা বলেছ? আল্লাহর কসম! আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে বেশি ভয় করি এবং তোমাদের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি অনুগত; অথচ আমি ছিয়াম পালন করি, আবার তা থেকে বিরতও থাকি। ছালাত আদায় করি এবং নিদ্রা যাই ও মেয়েদেরকে বিয়েও করি। সুতরাং যারা আমার সুন্নাতের প্রতি বিরাগ পোষণ করবে, তারা আমার দলভুক্ত নয়’।[২০]
ইবনু হাজার ‘আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي এর অর্থ হল, ‘যে ব্যক্তি আমার (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পথ ছেড়ে দিয়ে অন্যের পথ ধরে সে আমার দলভুক্ত নয়’। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একনিষ্ট তরীকা হল, সে মাঝে মাঝে ছিয়াম ছেড়ে দিবে, যাতে পরবর্তীতে ছিয়াম রাখার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। সে ঘুমাবে, যাতে রাত্রি জাগরণ করার শক্তি সঞ্চয় করতে পারে। প্রবৃত্তির দমন ও আত্মার পরিশুদ্ধি ও বংশ বিস্তারের জন্য সে বিবাহ করবে। হাদীছে আমাদের পূর্ববর্তীদের আমলের ধারাবাহিক অবস্থার বর্ণনা এবং তাদের ধৈর্যের সাথে আমলের কথা ফুটে উঠেছে। কিন্তু কেউ যদি ভাল কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে এবং লোক দেখানো মনোভাব থেকে মুক্ত থেকে সেই ভাল কাজটি প্রকাশের প্রয়োজন অনুভব করে, তাহলে এটা নিষেধ নয়।[২১]
(দ) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন হজ্জ পালনের ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
ইসলামের ইবাদতসমূহের মধ্যে হজ্জ হচ্ছে সর্বোত্তম, যার মধ্যে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ধৈর্যের সাথে আনুগত্য করার কথা ফুটে উঠে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হজ্জের বিধিবিধান পালনের ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণের নির্দেশ প্রদান করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لِتَأْخُذُوْا مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّيْ لَا أَدْرِيْ لَعَلِّي لَا أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِيْ هَذِهِ ‘আমার নিকট থেকে তোমরা হজ্জের নিয়ম-কানুন শিখে নাও। কারণ আমি জানি না এই হজ্জের পর আমি আর হজ্জ করতে পারব কিনা’।[২২]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ মানে শুধু তাঁর নৈতিক গুণাবলীর অনুসরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা নয় বরং তা তাঁর সকল আমলের মধ্যে পরিব্যপ্ত। এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিক-নির্দেশনাই পূর্ণাঙ্গ, যা প্রতিটি মুসলিমের জন্য অনুসরণযোগ্য।
(ধ) রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন আহার গ্রহণের ক্ষেত্রে উত্তম আর্দশ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সামনে পরিবেশন করা খাবার ও পানীয় কখন ফেরত দিতেন না আবার কোন (খাবার) না থাকলে, তার জন্য জুড়াজুড়িও করতেন না। তাঁর নিকটে পবিত্র যেকোন খাবার আসলে, তা তিনি খেতেন। তিনি কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতেন না। তাঁর রুচি হলে খেতেন; না হলে ছেড়ে দিতেন।[২৩]
আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি একবার ‘উরওয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উদ্দেশ্যে বললেন, ভাগ্নে! আমরা নতুন চাঁদ দেখতাম, আবার নতুন চাঁদ দেখতাম। এভাবে দু’মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন ঘরেই আগুন জ্বালানো হত না।[২৪] যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে খাবার উপস্থিত করা হত, তিনি ‘বিসমিল্লাহ’ বলে শুরু করতেন। যখন খাবার গ্রহণ শেষ করতেন, বলতেন,
اَللَّهُمَّ أَطْعَمْتَ وَأَسْقَيْتَ وَأَغْنَيْتَ وَأَقْنَيْتَ وَهَدَيْتَ وَأَحْيَيْتَ فَلَكَ الْحَمْدُ عَلَى مَا أَعْطَيْتَ
‘হে আল্লাহ! আপনি খাইয়েছেন, আপনি পান করিয়েছেন, আপনি আমাকে অমুখাপেক্ষী করেছেন, আমাকে সম্পদশালী করেছেন, আপনি আমাকে হেদায়াত দান করেছেন, আপনি আমাকে জীবন দান করেছেন। সর্বোপরি আপনি আমাকে যা দান করেছেন তার জন্য আপনার প্রশংসা জ্ঞাপন করছি’।[২৫]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কোন সম্প্রদায়ের কাছে আহার করতেন, তখন তাদের জন্য দু‘আ করতেন।[২৬] তিনি সামর্থানুযায়ী আহার করতেন। অভাবগ্রস্ত হলে ছবর করতেন। এমনকি কখনো কখনো তিনি ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর পর্যন্ত বাঁধতেন। তিনি ছোট বা বড়, স্বাধীন বা দাস, আরাবী কিংবা মুহাজির কারো দাওয়াতকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন না।[২৭]
(ন) ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঘুমানোর প্রয়োজন হলে তিনি ডান কাঁধে ঘুমাতেন। আল্লাহর যিকির করতেন, তখন পেট খানাপিনায় পূর্ণ থাকত না। হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, যখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুমানোর ইচ্ছা করতেন, সে সময় তিনি নিজের (ডান) হাত মাথার নীচে রেখে বলতেন, اَللَّهُمَّ قِنِيْ عَذَابَكَ يَوْمَ تَجْمَعُ عِبَادَكَ أَوْ تَبْعَثُ عِبَادَكَ ‘হে আল্লাহ! যেদিন আপনি আপনার বান্দাদেরকে একত্রিত করবেন অথবা পুনর্জীবিত করনে সেদিন আমাকে আপনার আযাব হতে হিফাযতে রাখবেন’।[২৮] তিনি ভোরে মোরগের ডাক শুনে জেগে যেতেন অতঃপর আল্লাহর হামদ ও তাকবীর পাঠ করতেন। তাঁর মহিমা জ্ঞাপন ও তাঁর কাছে দু‘আ করতেন। এরপর মিসওয়াক ও ওযূ করে রবের সামনে ছালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। রবের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ভীতসন্ত্রস্ত ও আশাবাদী হয়ে তাঁর প্রশংসার সাথে দীর্ঘ মুনাজাতে দাঁড়িয়ে যেতেন। তিনি কখনো বিছানায় ঘুমাতেন, কখনো বা চাটাইয়ে ঘুমাতেন, কখনো যমীনে বা খাটে ঘুমাতেন।[২৯]
(প) কথা-বার্তা, চুপ থাকা ও হাসি-কান্নার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কথা বলতেন, তখন ধীরে ধীরে স্পষ্টভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলতেন। তিনি কথাবার্তায় এমন তাড়াহুড়া করতেন না, যাতে শ্রোতারা তা আত্মস্থ করতে না পারে। কথার মাঝখানে তিনি বিচ্ছিন্নতা ঘটাতেন না। সর্বোপরি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিক-নির্দেশনা ছিল পূর্ণাঙ্গ। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন সালাম দিতেন, তিনবার সালাম দিতেন। আর যখন কোন কথা বলতেন তখন তা তিনবার বলতেন।[৩০]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক বেশি সময় ধরে চুপ থাকতেন। তিনি অপ্রয়োজনীয় কোন কথা বলতেন না। তিনি ‘জাওয়ামি‘উল কালাম’ তথা বাগ্মী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য মধ্যম ধরনের হত, খুব লম্বা নয়, আবার দীর্ঘও নয়। তিনি খুৎবায় অপ্রয়োজনীয় বিষয় এড়িয়ে যেতেন। তাঁর কাছে সঠিক বলে বিবেচিত হলেই কেবল তিনি সে কথা বলতেন। তিনি কোন কিছু অপসন্দ করলে, তাঁর চেহারায় তা ফুটে উঠত। তাঁর মুখ থেকে সবসময় মুচকি হাসি ফুটে উঠত। তাঁর হাসিতে কখনো সামান্য দাঁত দেখা যেত। তিনি হাসি দেয়ার স্থানে হাসতেন। অনুরূপভাবে আশ্চর্য ও দুর্লভ বস্তু দেখে আশ্চর্য হতেন।[৩১]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কান্না তাঁর হাসির মতই ছিল। তিনি বিলাপ ও উচ্চৈঃস্বরে কান্নাকাটি করতেন না, যেভাবে অট্টহাসি হাসতেন না। বরং তাঁর কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। কান্নার কারণে তাঁর বুক থেকে গুঞ্জন শব্দ শুনা যেত। তাঁর অশ্রু বিসর্জন কখনো মাইয়াতের রহমত স্বরূপ হত আবার কখনো উম্মাতের উপর ভয় ও দয়া থেকে হত। আবার বা কখনো তিনি আল্লাহর ভয়ে কাঁদতেন। কখনো রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআন তেলাওয়াত শুনে কাঁদতেন। এটা ছিল তাঁর আকাক্সক্ষা, ভালবাসা ও সম্মান জ্ঞাপন এবং আল্লাহভীতির কান্না। যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পুত্র ইবরাহীম মারা গেল, তখন তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল এবং রহমত লাভের আশায় ক্রন্দন করেছিলেন। তিনি তাঁর এক কন্যার মৃতদেহ দেখেও কেঁদেছিলেন।[৩২]
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) সূরা আন-নিসা তেলাওয়াত করলে, তিনি কেঁদেছিলেন।[৩৩] উছমান ইবনু মাযঊন (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর মৃত্যুতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেঁদেছিলেন। একবার সূর্য গ্রহণ লাগলে তিনি কেঁদেছিলেন এবং সূর্যগ্রহণের ছালাত পড়েছিলেন। সেই ছালাতে তিনি ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর জনৈকা কন্যার কবরের পাশে বসে কেঁদেছিলেন। তিনি কখনো কখনো রাতের ছালাতেও কান্না করতেন।[৩৪]
* এম. এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১০৫৪, সনদ ছহীহ।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৭৬।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/২৯০৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০৭।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০৮।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৩৪; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১১।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১২।
[৭]. আবূ দাঊদ, হা/৯০৪, সনদ ছহীহ।
[৮]. তিরমিযী, হা/৩২৯৭, সনদ ছহীহ।
[৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭৯।
[১০]. ইবনু মাজাহ, হা/২৮৯০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৬১৭।
[১১]. ইবনু মাজাহ, হা/২৮৯০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৬১৭।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩০৭।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৩৭।
[১৪]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬২০; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৬৮।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯৬৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫৬।
[১৬]. তিরমিযী, হা/৭৪৫; নাসাঈ, হা/২৩৬১; ইবনু মাজাহ, হা/১৭৩৯, সনদ ছহীহ।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৪৬।
[১৮]. আবূ দাঊদ, হা/৭৭৫; তিরমিযী, হা/২৪২; ইবনু মাজাহ, হা/৮০৭; নাসাঈ, হা/৮৯৯, সনদ ছহীহ।
[১৯]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮২।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪০১।
[২১]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০৬।
[২২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২৯৭।
[২৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৫৬৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২০৬৪।
[২৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৬৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৭২।
[২৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৬৫৯৫; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৪৭৬৮।
[২৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২০৪২।
[২৭]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৭।
[২৮]. তিরমিযী, হা/৩৩৯৮, সনদ ছহীহ।
[২৯]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৫।
[৩০]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৪।
[৩১]. যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮২।
[৩২]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১২৭২।
[৩৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৫৮২; ছহীহ মুসলিম, হা/৮০০।
[৩৪]. যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৩।