সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পারিবারিক জীবন

মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*

(৯ম কিস্তি) 

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নীতি ছিল, স্ত্রীদের প্রতি ভাল ধারণা করা এবং তাদের প্রতি সন্দেহ পোষণ না করা

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَطْرُقُ أَهْلَهُ لَيْلًا وَكَانَ لَا يَدْخُلُ إِلَّا غُدْوَةً أَوْ عَشِيَّةً.

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতের বেলায় পরিবারবর্গের মধ্যে যেতেন না; বরং তিনি সকালে বা সন্ধ্যায় গৃহে প্রবেশ করতেন।[১]

এখানে (لَا يَطْرُقُ أَهْلَهُ) অর্থ হল, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর থেকে ফিরে রাতেই স্ত্রীদের নিকট গমন করতেন না। الطروق অর্থ- রাতে আগমন করা। আর রাতে আগমনকারী প্রত্যেককে طارق বলে সম্বোধন করা হয়।[২]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষদেরকে স্ত্রীদের প্রতি সন্দেহ পোষণ ও তাদের দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান করা থেকে নিষেধ করতেন :

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ نَهَى رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَطْرُقَ الرَّجُلُ أَهْلَهُ لَيْلًا يَتَخَوَّنُهُمْ أَوْ يَلْتَمِسُ عَثَرَاتِهِمْ.

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন ব্যক্তিকে রাতের বেলা অতর্কিতভাবে ঘরে ফিরে তার স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ পোষণ করতে কিংবা দোষ-ক্রটি অনুসন্ধান করতে নিষেধ করেছেন।[৩]

এখানে (يَتَخَوَّنُهُمْ) অর্থ হল, স্বামী তার স্ত্রীর থেকে খেয়ানতের সন্দেহ করে। তাদের গোপন দোষ-ত্রুটি বের করার চেষ্টা করে। সে খোঁজে বের করার চেষ্টা করে যে, তারা কোন ধরনের খেয়ানতের আশ্রয় নিয়েছে কি-না?

অতঃপর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোন ব্যক্তির দীর্ঘ সফর থেকে ফিরে আকস্মিকভাবে রাতে স্ত্রীর নিকট আগমন করাকে অপসন্দ করেছেন। তবে যার সফর কাছাকাছি কোথাও হয় এবং তার স্ত্রী আগে থেকেই তার রাতে ফিরার খবর অবগত থাকে সেক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উপরিউক্ত হাদীছে পরস্পর হৃদ্যতা ও ভালবাসা সৃষ্টির প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে, বিশেষত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে। শরী‘আত প্রণেতা প্রত্যেকের মাঝে স্বভাগতভাবে অপরজনের গোপন দোষ-ত্রুটি খুজে বের করার প্রবণতা থাকার কথা জানা সত্ত্বেও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে পরস্পর হৃদ্যতা ও ভালবাসা সৃষ্টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের একজন অপরজন হতে দোষ-ত্রুটি গোপন করে রাখতে সক্ষম হয় না, তারপরেও তিনি স্বামীকে সফর থেকে ফিরে হঠাৎ করে রাতেই স্ত্রীর নিকটে গমন করা থেকে নিষেধ করেছেন; যাতে স্বামী স্ত্রীর নিকটে অপসন্দনীয় কিছু দেখতে না পায়। অতঃপর উপরিউক্ত বিষয়টি স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্যদের মাঝেও উত্তম পন্থায় চর্চা হওয়া যরূরী।[৪] এখানে সফর থেকে ফিরে আকস্মিক রাতেই স্বামী স্ত্রীর কাছে গমন করা থেকে নিষেধ করার হিকমাহ হল, যাতে স্ত্রী স্বামীর আগমনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ جَابِرٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَدِمَ أَحَدُكُمْ لَيْلًا فَلَا يَأْتِيَنَّ أَهْلَهُ طُرُوْقًا حَتَّى تَسْتَحِدَّ الْمُغِيْبَةُ وَتَمْتَشِطَ الشَّعِثَةُ.

জাবির (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন তোমাদের কোন ব্যক্তি রাতের বেলা সফর থেকে ফিরে তখন সে যেন রাতের আগন্তুকের মত অতর্কিতভাবে পরিবারবর্গের কাছে গিয়ে উপস্থিত না হয়, যাতে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত স্বামীর স্ত্রী তার গুপ্তাঙ্গের লোম পরিষ্কার করার এবং এলোমেলো চুলবিশিষ্ট নারী তার চুল বিন্যাস করার সুযোগ পায়।[৫]

এখানে (الْمُغِيبَةُ) অর্থ হল, যে স্ত্রীর স্বামী অনুপস্থিত রয়েছে। এবং (تَسْتَحِدَّ) অর্থ হল, স্ত্রীর নাভীর নীচের লোম পরিস্কার করা। এই হুকুমটি কেবল দীর্ঘদিন যাবৎ সফরে থাকা ব্যক্তির জন্য খাছ। যেমন অন্য বর্ণনায় নি¤েœাক্ত শব্দে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,إِذَا أَطَالَ أَحَدُكُمُ الغَيْبَةَ فَلَا يَطْرُقْ أَهْلَهُ لَيْلًا ‘যখন তোমাদের মধ্যে কেউ দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকে রাতে আকস্মিকভাবে তার ঘরে প্রবেশ করা উচিত নয়’।[৬] এখানে স্বামীর অনুপস্থিত থাকার সাথে দীর্ঘদিনের সময়ের শর্ত করার দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যখন কেবল স্বামীর মধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ সফরে থাকার শর্ত পাওয়া যাবে তখনই সে ঐ রাতে স্ত্রীর নিকট গমন করতে পারবে না। এখানে উক্ত শর্ত বিদ্যমান থাকা বা না থাকার সাথে হুকুমটি আবর্তিত হবে।

অতঃপর যখন কোন ব্যক্তি স্বল্প সময়ের জন্য কোন সফরে বের হবে; অর্থাৎ সকালে সফরে বের হয়ে রাতেই ফিরল, সেক্ষেত্রে তার উপর দীর্ঘদিনের সফরে থাকা ব্যক্তির অনুরূপ হুকুম বর্তাবে না। কেননা দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকার পর হঠাৎ করে স্বামীর দ্রুত বাড়িতে আগমনের দ্বারা তাদের মধ্যে আমানতদারিতার সন্দেহ সৃষ্টি হয়। অনেক সময় দীর্ঘদিন পর সফর থেকে ফিরে দ্রুত স্ত্রীর নিকটে গমন করার কারণে স্বামী তার কাছে অপসন্দনীয় বিষয় দেখতে পায়, তা হতে পারে স্ত্রীকে কাঙ্খিত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত অবস্থায় না পাওয়া, যা তাদের মধ্যে কলহের জন্ম দেয়।[৭] আর যে ব্যক্তি আগে থেকেই তার পরিবারকে অবগত করে রাখবে যে, উমুক সময়ে সে ফিরবে, তার ক্ষেত্রে উপরিউক্ত হুকুম প্রযোজ্য হবে না।

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বৈবাহিক জীবনে স্ত্রীদের ঈর্ষাকে হিকমাহর সাথে মোকাবেলা করতেন

ঈর্ষা করা নারীদের সৃষ্টি ও স্বভাবগত একটি বৈশিষ্ট্য। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তাঁর প্রতি ঈর্ষা করতেন। আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا لَيْلًا قَالَتْ فَغِرْتُ عَلَيْهِ فَجَاءَ فَرَأَى مَا أَصْنَعُ فَقَالَ مَا لَكِ يَا عَائِشَةُ أَغِرْتِ؟ فَقُلْتُ وَمَا لِيْ؟ لَا يَغَارُ مِثْلِيْ عَلَى مِثْلِكَ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَدْ جَاءَكِ شَيْطَانُكِ قَالَتْ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمْعِيْ شَيْطَانٌ؟ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ وَمَعَكَ يَا رَسُوْلَ الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ قَالَ نَعَمْ وَلَكِنْ أَعَانَنِيْ عَلَيْهِ حَتَّى أَسْلَمَ.

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নিকট হতে বের হলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তাঁর প্রতি আমার ঈর্ষা হল। অতঃপর তিনি আসলেন এবং দেখলেন, আমি কি করছি। তিনি বললেন, হে আয়েশা! তোমার কী হয়েছে, তুমি কি ঈর্ষান্বিত হয়েছ? আমি বললাম, আপনার মত মানুষের প্রতি আমার মত নারী কি করে ঈর্ষান্বিত না হয়ে থাকতে পারে? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, নিশ্চয় তোমার শয়তান তোমার নিকট এসেছে। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার সাথে কি শয়তান আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার সাথেও কি আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু আল্লাহ আমাকে তার বিরদ্ধে সাহায্য করেছেন, ফলে আমি তা হতে নিরাপদে থাকি।[৮]

অন্য একটি ঘটনায় আমরা দেখতে পাই যে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর উপরেও ঈর্ষা চেপেছিল, যার কারণে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কোথায় যান তা দেখার জন্য তিনি তাঁর পিছু পিছু হাঁটা ধরেছিলেন। যেমন হাদীছে এসেছে,

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখন ঐ রাত আসত যে রাতে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে থাকতেন। তিনি এসে তাঁর চাদর রেখে দিতেন, জুতা খুলে পায়ের কাছে রাখতেন। পরে নিজ তহবন্দের (লুঙ্গি) একদিক বিছানায় বিছিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়তেন। অতঃপর মাত্র কিছু সময় যতক্ষণে তিনি ধারণা করতেন যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি, বিশ্রাম গ্রহণ করতেন। অতঃপর উঠে ধীরে ধীরে নিজ চাদর নিতেন এবং জুতা পরিধান করতেন। পরে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়তেন। অতঃপর কিছু সময় নিজেকে আত্মগোপন করে রাখতেন। একদিন আমি আমার জামা মাথার উপর স্থাপন করে তা দিয়ে মাথাটা ঢেকে লুঙ্গি পরিধান করে, অতঃপর তার পেছনে রওয়ানা হলাম। যেতে যেতে তিনি বাকী‘তে (কবরস্থানে) পৌঁছলেন। তথায় তিনি দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে থাকলেন। অতঃপর তিনি তিনবার হাত উঠিয়ে দু‘আ করলেন। এবার গৃহের দিকে ফিরে রওয়ানা করলে আমিও রওয়ানা হলাম। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্রুত রওয়ানা করলে আমিও দ্রুত চলতে লাগলাম। তাকে আরও দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে দেখে আমি আরও দ্রুত চলতে লাগলাম। এরপর আমরা দৌড়াতে আরম্ভ করলে আমি দৌড়িয়ে তার আগেই ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং বিলম্ব না করে শুয়ে পড়লাম।

একটু পরে তিনি গৃহে প্রবেশ করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আয়েশা! তোমার কি হল? কেন হাপিয়ে পড়েছ? আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি জবাব দিলাম- না, তেমন কিছু না। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হয় তুমি নিজে আমাকে ব্যাপারটা খুলে বলবে নতুবা মহান আল্লাহ আমাকে তা জানিয়ে দিবেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার ওপর আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক। এরপর তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তুমিই সে কালো ছায়াটি যা আমি আমার সামনে দেখছিলাম। আমি বললাম, জী হ্যাঁ। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার বুকে একটা থাপ্পড় মারলেন যাতে আমি ব্যথা পেলাম। অতঃপর বললেন, তুমি কি ধারণা করেছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার ওপর অবিচার করবেন? আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, যখনই মানুষ কোন কিছু গোপন করে, আল্লাহ তা অবশ্যই জানেন। হ্যাঁ অবশ্যই জানেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

فَإِنَّ جِبْرِيْلَ أَتَانِيْ حِيْنَ رَأَيْتِ فَنَادَانِيْ فَأَخْفَاهُ مِنْكِ فَأَجَبْتُهُ فَأَخْفَيْتُهُ مِنْكِ وَلَمْ يَكُنْ يَدْخُلُ عَلَيْكِ وَقَدْ وَضَعْتِ ثِيَابَكِ وَظَنَنْتُ أَنْ قَدْ رَقَدْتِ فَكَرِهْتُ أَنْ أُوْقِظَكِ وَخَشِيْتُ أَنْ تَسْتَوْحِشِيْ فَقَالَ إِنَّ رَبَّكَ يَأْمُرُكَ أَنْ تَأْتِيَ أَهْلَ الْبَقِيْعِ فَتَسْتَغْفِرَ لَهُمْ.

‘যখন তুমি আমাকে দেখেছ এ সময় আমার কাছে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) এসেছিলেন এবং আমাকে ডাকছিলেন। অবশ্য তা তোমার কাছে গোপন রাখা হয়েছে। আর আমিও তা গোপন রাখা বাঞ্ছনীয় মনে করে তোমার নিকট গোপন রেখেছি। যেহেতু তুমি তোমার কাপড় রেখে দিয়েছ, তাই তিনি তোমার কাছে আসেননি। আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ তাই তোমাকে জাগানো সমীচীন মনে করিনি। আর আমি আশঙ্কা করছিলাম যে, তুমি ভীত বিহ্বল হয়ে পড়বে। এরপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, আপনার প্রভু আপনার প্রতি আদেশ করছেন, বাকী‘র কবরবাসীদের নিকট গিয়ে তাদের জন্য দু‘আ ইসতিগফার করতে’।

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি তাদের জন্য কীভাবে দু‘আ করব? তিনি বললেন,

قُوْلِي السَّلَامُ عَلَى أَهْلِ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَيَرْحَمُ اللهُ الْمُسْتَقْدِمِيْنَ مِنَّا وَالْمُسْتَأْخِرِيْنَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَلَاحِقُوْنَ.

‘তুমি বল, ‘এ বাসস্থানের অধিবাসী ঈমানদার মুসলিমদের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। আমাদের মধ্য থেকে যারা আগে বিদায় গ্রহণ করেছে আর যারা পিছনে বিদায় নিয়েছে সবার প্রতি আল্লাহ দয়া করুন। আল্লাহ চাহে তো আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হব’।[৯]

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্তরে তার ব্যাপারে বিশেষ মর্যাদা থাকার কথা জানা সত্বেও অপরাপর স্ত্রীদের ব্যাপারে ঈর্ষা করতেন। এমনকি তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে যে মারা গেছে তার ব্যাপারেও ঈর্ষা করতেন। এমনকি আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলতেন,مَا غِرْتُ عَلَى امْرَأَةٍ مَا غِرْتُ عَلَى خَدِيجَةَ ‘আমি নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্য কোন সহধর্মিণীর প্রতি এতটুকু ঈর্ষা প্রকাশ করিনি, যতটুকু খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি করেছি’।[১০]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বৈবাহিক জীবনে স্ত্রীদের মধ্যে ঈর্ষা লক্ষ্য করলে হিকমাহ (কৌশল) অবলম্বন করতেন। আজকের যুগের লোকদের মত তিনি করতেন না, যারা স্ত্রীদের মধ্যে ঈর্ষা লক্ষ্য করলে ধমক দেয় এবং সে যা করছে সে সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিষেধ করে, সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে সে দম্ভ করতে থাকে, ফলে তার প্রতি স্ত্রীর ঈর্ষা ও সন্দেহ আরো বহুগুনে বেড়ে যায়। আর এহেন পরিস্থিতি স্বামীর খারাপ আচরণ ও হিকমাহ অবলম্বন না করার কারণে সৃষ্টি হয়, যে ব্যাপারে নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে তার শিক্ষা নেয়া উচিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের এ ধরণের ঈর্ষাকে কখনো মুচকি হাসির মাধ্যমে মোকাবেলা করতেন, আবার কখনো তার কমল চাহনির মাধ্যমে মোকাবেলা করতেন, আর বিষয়টি বেগতিক হলে সেই কাজের সমালোচনা করার মাধ্যমে মোকাবেলা করতেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَنَسٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِنْدَ بَعْضِ نِسَائِهِ فَأَرْسَلَتْ إِحْدَى أُمَّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ بِصَحْفَةٍ فِيْهَا طَعَامٌ فَضَرَبَتِ الَّتِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ بَيْتِهَا يَدَ الْخَادِمِ فَسَقَطَتِ الصَّحْفَةُ فَانْفَلَقَتْ فَجَمَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِلَقَ الصَّحْفَةِ ثُمَّ جَعَلَ يَجْمَعُ فِيْهَا الطَّعَامَ الَّذِيْ كَانَ فِي الصَّحْفَةِ وَيَقُوْلُ غَارَتْ أُمُّكُمْ ثُمَّ حَبَسَ الْخَادِمَ حَتَّى أُتِيَ بِصَحْفَةٍ مِنْ عِنْدِ الَّتِيْ هُوَ فِيْ بَيْتِهَا فَدَفَعَ الصَّحْفَةَ الصَحِيْحَةَ إِلَى الَّتِيْ كُسِرَتْ صَحْفَتُهَا وَأَمْسَكَ الْمَكْسُوْرَةَ فِيْ بَيْتِ الَّتِيْ كَسَرَتْ.

আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে কোন এক স্ত্রীর ঘরে ছিলেন। এমন সময় উম্মুল মুমিনীনদের অপর একজন বড় পেয়ালা প্রেরণ করেন, যাতে খাদ্য ছিল। অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যার ঘরে ছিলেন তিনি খাদেমের হাতে আঘাত হানলেন, যাতে পেয়ালা পড়ে গেল এবং টুকরা টুকরা হয়ে গেল। অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেয়ালার টুকরাগুলো একত্র করলেন, অতঃপর পেয়ালায় যে খাদ্য ছিল তা জমা করতে লাগলেন এবং বললেন, তোমাদের মাতা ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। অতঃপর তিনি খাদেমকে ততক্ষণ পর্যন্ত আটকিয়ে রাখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি যার ঘরে ছিলেন তাঁর ঘর হতে একটি ভাল পেয়ালা আনা না হল। অতঃপর ভাল পেয়ালাটি তিনি তাঁকে দিলেন, যাঁর পেয়ালা ভাঙ্গা হয়েছিল এবং ভাঙ্গাটি তাঁর জন্য রাখলেন যিনি তা ভেঙ্গে ছিলেন।[১১]

উপরিউক্ত ঘটনা থেকে পরিবারের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কমলতা প্রদর্শনের কথা ফুটে উঠে। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাত্র ভাঙ্গার কারণে স্ত্রীকে ধমক দেননি। তার প্রতি রাগও করেননি। তাকে সামান্য কথাটুকুও শুনাননি। বরং তার কাছ থেকে ওযর তালাশ করেছেন। একই সময়ে যে তাঁর স্ত্রীর পাত্র ভেঙ্গেছে তাকে অসম্মান করেননি। কেননা সেও তার নিজের অধিনস্থ থাকার মতো তার অধিনে রয়েছে।

ইবনে হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই হাদীছে ইঙ্গিত রয়েছে যে, স্ত্রীর কাছ থেকে কোন বিষয়ে ঈর্ষা প্রকাশ পেলে তা এরিয়ে চলা কর্তব্য, কেননা তখন অধিক রাগের কারণে তার বিবেক স্থবির হয়ে পরে, যার ফলে তার কাছ থেকে ঈর্ষা প্রকাশ পায়।[১২]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদেরকে কারো ব্যাপারে ক্ষতিকর অশালীন মন্তব্য করতে শুনলে নিষেধ করতেন

عَنْ عَائِشَة رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قُلْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَسْبُكِ صَفِيَّةَ كَذَا وَكَذَا تَعْنِيْ قَصِيْرَةً  فَقَالَ لَقَدْ قُلْتِ كَلِمَةً لَوْ مُزِجَ بِهَا الْبَحْرُ لَمَزَجَتْهُ.

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম, ছাফিয়্যা সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তিনি এরূপ এরূপ। অর্থাৎ তিনি বেঁটে বা খাটো। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তুমি যে কথা বললে যদি এ কথাকে সাগরের পানির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সাগরের পানির রং পরিবর্তন করে দিবে’।[১৩]

অর্থাৎ ‘এই গীবতকে যদি সমুদ্রের জলের সাথেও মিশিয়ে দেয়া হয় তারপরেও তা সমুদ্রের বিশাল জলরাশির রঙকে পরিবর্তন করে ফেলবে। সেখানে এই ছোটখাটো কাজগুলোকে যদি মিশিয়ে দেয়া হয়, (একবার ভাবুন তো!) কি অবস্থা হতে পারে?।[১৪]

নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের অবকাশ দিতেন যাতে তারা নিজেরাই পরস্পর ক্বিছাছ (প্রতিশোধ) গ্রহণ করতে পারে

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا أَنَّ نِسَاءَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كُنَّ حِزْبَيْنِ فَحِزْبٌ فِيْهِ عَائِشَةُ وَحَفْصَةُ وَصَفِيَّةُ وَسَوْدَةُ وَالحِزْبُ الآخَرُ أُمُّ سَلَمَةَ وَسَائِرُ نِسَاءِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَ المُسْلِمُوْنَ قَدْ عَلِمُوا حُبَّ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَائِشَةَ فَإِذَا كَانَتْ عِنْدَ أَحَدِهِمْ هَدِيَّةٌ يُرِيْدُ أَنْ يُهْدِيَهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخَّرَهَا حَتَّى إِذَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ بَعَثَ صَاحِبُ الهَدِيَّةِ بِهَا إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْ بَيْتِ عَائِشَةَ فَكَلَّمَ حِزْبُ أُمِّ سَلَمَةَ فَقُلْنَ لَهَا كَلِّمِيْ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُكَلِّمُ النَّاسَ فَيَقُوْلُ مَنْ أَرَادَ أَنْ يُهْدِيَ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هَدِيَّةً فَلْيُهْدِهِ إِلَيْهِ حَيْثُ كَانَ مِنْ بُيُوْتِ نِسَائِهِ فَكَلَّمَتْهُ أُمُّ سَلَمَةَ بِمَا قُلْنَ فَلَمْ يَقُلْ لَهَا شَيْئًا فَسَأَلْنَهَا فَقَالَتْ مَا قَالَ لِيْ شَيْئًا فَقُلْنَ لَهَا فَكَلِّمِيْهِ قَالَتْ فَكَلَّمَتْهُ حِيْنَ دَارَ إِلَيْهَا أَيْضًا فَلَمْ يَقُلْ لَهَا شَيْئًا فَسَأَلْنَهَا فَقَالَتْ مَا قَالَ لِيْ شَيْئًا فَقُلْنَ لَهَا كَلِّمِيْهِ حَتَّى يُكَلِّمَكِ فَدَارَ إِلَيْهَا فَكَلَّمَتْهُ فَقَالَ لَهَا لاَ تُؤْذِيْنِيْ فِيْ عَائِشَةَ فَإِنَّ الوَحْيَ لَمْ يَأْتِنِيْ وَأَنَا فِيْ ثَوْبِ امْرَأَةٍ إِلَّا عَائِشَةَ قَالَتْ فَقَالَتْ أَتُوْبُ إِلَى اللهِ مِنْ أَذَاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ثُمَّ إِنَّهُنَّ دَعَوْنَ فَاطِمَةَ بِنْتَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَرْسَلَتْ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَقُوْلُ إِنَّ نِسَاءَكَ يَنْشُدْنَكَ اللهَ العَدْلَ فِيْ بِنْتِ أَبِيْ بَكْرٍ فَكَلَّمَتْهُ فَقَالَ يَا بُنَيَّةُ أَلَا تُحِبِّينَ مَا أُحِبُّ؟ قَالَتْ بَلَى فَرَجَعَتْ إِلَيْهِنَّ فَأَخْبَرَتْهُنَّ فَقُلْنَ ارْجِعِيْ إِلَيْهِ فَأَبَتْ أَنْ تَرْجِعَ فَأَرْسَلْنَ زَيْنَبَ بِنْتَ جَحْشٍ فَأَتَتْهُ فَأَغْلَظَتْ وَقَالَتْ إِنَّ نِسَاءَكَ يَنْشُدْنَكَ اللَّهَ العَدْلَ فِي بِنْتِ ابْنِ أَبِيْ قُحَافَةَ فَرَفَعَتْ صَوْتَهَا حَتَّى تَنَاوَلَتْ عَائِشَةَ وَهِيَ قَاعِدَةٌ فَسَبَّتْهَا حَتَّى إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيَنْظُرُ إِلَى عَائِشَةَ هَلْ تَكَلَّمُ.

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। একদলে ছিলেন আয়েশা, হাফছাহ, ছাফিয়্যাহ ও সাওদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা), অপর দলে ছিলেন উম্মে সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সহ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্যান্য স্ত্রীগণ। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিশেষ ভালবাসার কথা ছাহাবীগণ জানতেন। তাই তাদের মধ্যে কেউ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট কিছু হাদিয়া পাঠাতে চাইলে তা বিলম্বিত করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর ঘরে অবস্থান করতেন, সেদিন হাদিয়া দাতা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -কে দিয়ে হাদিয়া পাঠিয়ে দিতেন। উম্মে সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর দল তা নিয়ে আলোচনা করলেন। উম্মে সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -কে তাঁরা বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে আপনি আলাপ করুন। তিনি যেন লোকদের বলে দেন যে, যারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট হাদিয়া পাঠাতে চান, তারা যেন তাঁর নিকট পাঠিয়ে দেন, যে স্ত্রীর ঘরেই তিনি থাকুন না কেন। উম্মে সালামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাদের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে কোন জবাব দিলেন না। পরে সবাই তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, তিনি আমাকে কোন জবাব দিলেন না। তখন তাঁরা তাকে বললেন, আপনি তার সঙ্গে আবার কথা বলুন। (আয়েশা) বলেন, যেদিন তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর (উম্মে সালামাহ-র) ঘরে গেলেন, সেদিন তিনি আবার তাঁর নিকট কথা তুললেন। সেদিনও তিনি তাকে কিছু বললেন না। অতঃপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তিনি বললেন, আমাকে তিনি কিছুই বলেননি। তখন তাঁরা তাঁকে বললেন, তিনি কোন জবাব না দেয়া পর্যন্ত আপনি বলতে থাকুন। নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ঘরে গেলে আবার তিনি তাঁর নিকট সে প্রসঙ্গ তুললেন। এবার তিনি তাকে বললেন, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর ব্যাপার নিয়ে আমাকে কষ্ট দিও না। মনে রেখ, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ব্যতীত আর কোন স্ত্রীর বস্ত্র তুলে থাকা অবস্থায় আমার উপর অহি নাযিল হয়নি। (আয়েশা) বলেন, এ কথা শুনে তিনি (উম্মে সালামাহ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে কষ্ট দেয়া হতে আমি আল্লাহর নিকট তওবা করছি। অতঃপর সকলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কন্যা ফাতিমাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -কে এনে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর নিকট এ কথা বলার জন্য পাঠালেন যে, আপনার স্ত্রীগণ আল্লাহর দোহাই দিয়ে আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) -এর কন্যা সম্পর্কে ইনছাফের আবেদন জানালেন। (ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)) তাঁর নিকট বিষয়টি তুলে ধরলেন। তখন তিনি বললেন, প্রিয় কন্যা! আমি যা ভালবাসি তুমি কি তাই ভালবাস না? তিনি বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। অতঃপর তাদের নিকট গিয়ে তাদেরকে (আদ্যোপান্ত) অবহিত করলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, তুমি আবার যাও। কিন্তু এবার তিনি যেতে অস্বীকার করলেন। তখন তারা যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -কে পাঠালেন। তিনি তাঁর নিকট গিয়ে কঠোর ভাষা ব্যবহার করলেন এবং বললেন, আপনার স্ত্রীগণ আল্লাহর দোহাই দিয়ে ইবনু আবূ কুহাফার (আবূ বকর) (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কন্যা সম্পর্কে ইনছাফের আবেদন জানাচ্ছেন। অতঃপর তিনি গলার স্বর উঁচু করলেন। এমনকি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -কে জড়িয়েও কিছু বললেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সেখানে বসা ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর দিকে তাকিয়ে দেখছিলেন সে কিছু বলে কিনা।[১৫] ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,

قَالَتْ عَائِشَةُ فَأَرْسَلَ أَزْوَاجُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَيْنَبَ بِنْتَ جَحْشٍ زَوْجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهِيَ الَّتِيْ كَانَتْ تُسَامِيْنِيْ مِنْهُنَّ فِي الْمَنْزِلَةِ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَمْ أَرَ امْرَأَةً قَطُّ خَيْرًا فِي الدِّيْنِ مِنْ زَيْنَبَ. وَأَتْقَى لِلهِ وَأَصْدَقَ حَدِيْثًا وَأَوْصَلَ لِلرَّحِمِ وَأَعْظَمَ صَدَقَةً وَأَشَدَّ ابْتِذَالًا لِنَفْسِهَا فِي الْعَمَلِ الَّذِيْ تَصَدَّقُ بِهِ وَتَقَرَّبُ بِهِ إِلَى اللهِ تَعَالَى مَا عَدَا سَوْرَةً مِنْ حِدَّةٍ كَانَتْ فِيْهَا تُسْرِعُ مِنْهَا الْفَيْئَةَ قَالَتْ فَاسْتَأْذَنَتْ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَعَ عَائِشَةَ فِيْ مِرْطِهَا عَلَى الْحَالَةِ الَّتِي دَخَلَتْ فَاطِمَةُ عَلَيْهَا وَهُوَ بِهَا فَأَذِنَ لَهَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَتْ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ أَزْوَاجَكَ أَرْسَلْنَنِيْ إِلَيْكَ يَسْأَلْنَكَ الْعَدْلَ فِي ابْنَةِ أَبِيْ قُحَافَةَ قَالَتْ ثُمَّ وَقَعَتْ بِيْ فَاسْتَطَالَتْ عَلَيَّ وَأَنَا أَرْقُبُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَرْقُبُ طَرْفَهُ هَلْ يَأْذَنُ لِيْ فِيْهَا قَالَتْ فَلَمْ تَبْرَحْ زَيْنَبُ حَتَّى عَرَفْتُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَكْرَهُ أَنْ أَنْتَصِرَ قَالَتْ فَلَمَّا وَقَعْتُ بِهَا لَمْ أَنْشَبْهَا حَتَّى أَنْحَيْتُ عَلَيْهَا قَالَتْ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَبَسَّمَ إِنَّهَا ابْنَةُ أَبِيْ بَكْرٍ.

আয়েশা সিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহধর্মিণীগণ তাঁর স্ত্রী যয়নব (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে তাঁর নিকট প্রেরণ করলেন। তিনিই ছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আমার সমমর্যাদার অধিকারিণী। যয়নবের চেয়ে দ্বীনদার, আল্লাহভীরু, সত্যভাষিণী, মায়াময়ী, দানশীলা এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পথে ও দান-খায়রাতের জন্য নিজেকে দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করার ন্যায় কোন নারী আমি দেখিনি। তবে তার মাঝে শুধু একটা ক্ষিপ্ততা ছিল, তবে তিনি খুব দ্রুত ঠা-াও হয়ে যেতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) -এর সাথে চাদরে ঢাকা থাকাবস্থায়ই অনুমতি দিলেন, যে অবস্থায় ফাতিমাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তার নিকট এসে ছিল। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার স্ত্রীগণ আমাকে পাঠিয়েছেন। আবূ কুহাফার কন্যার সম্বন্ধে তারা আপনার সুবিচার প্রার্থনা করেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তারপর তিনি আমার সম্পর্কে মন্তব্য করতে লাগলেন এবং বড় বড় কতক কথা শুনালেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চোখের দিকে দেখছিলাম, তিনি আমায় কিছু বলার অনুমতি দেবেন কি-না? আমি বুঝতে পারলাম যে, যয়নবের কথার জবাব দিলে তিনি কিছু মনে করবেন না। তখন আমিও তার উপর কথা বলতে লাগলাম এবং অল্প সময়ের মাঝে তাকে নিশ্চুপ করিয়ে দিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হেসে বললেন, এটা তো আবূ বকরের কন্যা।[১৬] উক্ত হাদীছে আয়েশা সিদ্দীক্বার পরিপূর্ণ বোধগম্যতা ও সুদৃঢ় বুদ্ধিমত্তার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন তিনি ঝগড়ার সময়ে ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং যরূরী প্রয়োজনের সময়ে কথার জবাব দিয়েছেন।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা হল, স্ত্রীদের পক্ষ থেকে পুরুষদের সামনে নানাবিধ ক্ষতিকর কলহ-দ্বন্দ প্রকাশ পেলে পুরুষ যথাসম্ভব তাদেরকে চুপ করানোর চেষ্টা করবে, কোনভাবেই সে তাদের কতকের প্রতি ঝুঁকে গিয়ে অন্যদের বিপক্ষে অবস্থান নিবে না।[১৭]

(ইনশাআল্লাহ চলবে)

* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

[১]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮০০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৯২৮।
[২]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ১৩তম খন্ড, পৃ. ৭১।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮০১; ছহীহ মুসলিম, হা/৭১৫।
[৪]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ৩৪১।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৪৬; ছহীহ মুসলিম, হা/৭১৫।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২৪৪।
[৭]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ৩৪০।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১৫।
[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/৯৭৪।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮১৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৫।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫২২৫।
[১২]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ৩২৫।
[১৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৬০১; তিরমিযী, হা/২৫০২; আবূ দাঊদ, হা/৪৮৭৫; আলবানী ছহীহ বলেছেন; ছহীহুল জামে‘, হা/৫১৪০।
[১৪]. আব্দুর রহমান মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, ৭ম খ-, পৃ. ১৭৭।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫৮১।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৪২।
[১৭]. ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ১ম খ-, পৃ. ২০৮।




নববী আদর্শ (৯ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১১তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১০ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৮তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৫ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৭তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৪র্থ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৯তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৬ষ্ঠ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ