বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩১ অপরাহ্ন

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যক্তি জীবন

-মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ

- অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*



[নব্য জাহেলিয়াতের হিংস্র থাবায় ইসলামের সৌন্দর্য বিলুপ্তির পথে। ইসলামের চিরন্তন জীবনাদর্শ মানুষ আজ ভুলতে বসেছে। কোন ক্ষেত্রেই ইসলামের লেশমাত্র পাওয়া দুষ্কর। ব্যক্তিগতভাবে মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত। পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয় যেন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ইসলামের উপস্থিতি আজ শূন্যের কোঠায়। উক্ত ভয়াবহ পরিস্থিতিতে মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের সৌন্দর্য ও আদর্শ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমেই যার পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনাচরণ ও আচরণবিধি সকলেরই জানা কর্তব্য। সঊদী আরবের প্রখ্যাত সালাফী বিদ্বান শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ (রাহিমাহুল্লাহ) খাবারে অবস্থিত ‘মসজিদে ওমর ইবনু আব্দুল আযীয’-এ রামাযান মাসে তারাবীহ ছালাতের পর নিয়মিত দারস প্রদান করতেন। পরবর্তীতে উক্ত দারস ‘কাইফা আমালাহুম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’ বা ‘মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আচরণবিধি’ শিরোনামে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়। বৃহৎ কলেবরের উক্ত গ্রন্থটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু অধ্যায় ‘মাসিক আল-ইখলাছ’-এর পাঠকদের উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হল-সম্পাদক]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন উত্তম আদর্শ
মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا. ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এই আয়াতটি ঐ বিষয়ের উপর বড় দলীল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমস্ত কথা, কাজ ও অবস্থা আনুগত্য ও অনুসরণের যোগ্য’।[১]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে গোটা জগদ্বাসীর জন্য রহমত ও মানবজাতির হেদায়াতের জন্য প্রেরণ করেছেন। যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে এবং যমীনে দাম্ভিকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বেড়ায় না, তাদের জন্য তিনি উত্তম আদর্শ।

اَلْقُدْوَةُ বা ‘উত্তম আদর্শ’ দ্বারা উদ্দেশ্য
اَلْقُدْوَةُ অর্থ হচ্ছে, যাকে অনুসরণ করা হয়। যেমন কোন ব্যক্তির পথ ও পদাঙ্ককে যখন মানুষ অনুসরণ করে, সেই ব্যক্তির ব্যাপারে বলা হয়, فُلَانٌ قُدْوَةٌ ‘অমুক ব্যক্তি আদর্শ’।

বর্তমানে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণ করা মুসলিমদের জন্য খুবই যরূরী। বিশেষ করে বর্তমান যুগে যখন ইসলামের শত্রুরা বিভিন্ন সন্দেহ-সংশয় ও ভ্রান্ত মতবাদ ছড়ানোর মাধ্যমে মানুষকে দ্বীন থেকে বিমুখ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

এই গ্রন্থে আমরা বিশুদ্ধ হাদীছের আলোকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইমাম, বিচারক, সংশোধনকারী, শিক্ষক, মুরব্বী, স্বামী, পিতা, পৃষ্ঠপোষক, নেতা ও কর্মজীবী ইত্যাদি হওয়ার দিক দিয়ে তাঁর অনন্য ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ। কেননা তিনি ছিলেন উত্তম আদর্শের মূর্তপ্রতীক, যার কথা ও কাজকে প্রতিটি মুসলিমের অনুসরণ অনুকরণ করা যরূরী।

(হে রাসূল!) আপনিও তাঁদের পথ অনুসরণ করুন
আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের পথকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ ہَدَی اللّٰہُ فَبِہُدٰىہُمُ اقۡتَدِہۡ ‘এরা এমন ছিল, যাদেরকে আল্লাহ পথ প্রদর্শন করেছিলেন। অতএব আপনিও তাদের পথ অনুসরণ করুন’ (সূরা আল-আন‘আম : ৯০)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে اقْتَدِ অর্থ হচ্ছে, ‘আপনি অনুসরণ করুন’। এই নির্দেশ যখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উপর ছিল, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে তাঁর উম্মতের উপর তার প্রবর্তিত শরী‘আত ও নির্দেশনা মান্য করা যরূরী।[২]

শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, নবীদের কাহিনীর মধ্যে মুমিনদের জন্য উপদেশ রয়েছে। কেননা তাঁরা দ্বীনের জন্য সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পরও কখনোই নিরাশ হননি। তাঁরা জানতেন যে, তাঁদেরকে তাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তির দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। আর প্রত্যেক পরীক্ষার শেষ পরিণতি উত্তমই হয়। এর দ্বারা পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। পাপাচারী ব্যক্তি তওবাহ করার সুযোগ পায় এবং মুমিনদের ঈমান আরো শক্তিশালী হয়। এতে নবীদের অনুসরণ করা বৈধ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।[৩]

আল্লাহ প্রেরিত নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে যে বিষয়গুলো অনুসরণের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে :
নবীদের কাহিনী থেকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের শক্তি সঞ্চয় করা
আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের মহান বৈশিষ্ট্য নবীদের জীবনে ফুটে উঠেছিল। যেমন তাঁরা মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইবাদতগুযার ও বিনয়ী ছিলেন। এর প্রমাণ মেলে মহান আল্লাহর নীচের বাণীতে। মহান আল্লাহ বলেন, وَ اذۡکُرۡ عِبٰدَنَاۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ اُولِی الۡاَیۡدِیۡ وَ الۡاَبۡصَارِ ‘স্মরণ করুন, হাত ও চোখের অধিকারী আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূবের কথা’ (সূরা ছোয়াদ : ৪৫)। আতা‘ আল-খুরাসানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, اُولِی الۡاَیۡدِیۡ وَ الۡاَبۡصَارِ -এর অর্থ হল, ‘ইবাদতের শক্তি ও আল্লাহর আদেশ-নিষেধের জ্ঞান’। এর অর্থ সম্পর্কে ক্বাতাদাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘হে আল্লাহ! ইবাদতের শক্তি এবং দ্বীনের বিচক্ষণতা দান করুন’।[৪]

নবীগণের ইবাদতের বর্ণনার অসংখ্য দলীল রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রমাণ নিম্নরূপ:
(ক) ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ভাষায় মহান আল্লাহ বলেন, رَبِّ اجۡعَلۡنِیۡ مُقِیۡمَ الصَّلٰوۃِ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِیۡ رَبَّنَا وَ تَقَبَّلۡ دُعَآءِ ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ছালাত কায়েমকারী করুন এবং আমার সন্তানদের মধ্যে থেকেও। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের দু‘আ কবুল করুন’ (সূরা ইবরাহীম : ৪০)।

(খ) ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ کَانَ یَاۡمُرُ اَہۡلَہٗ بِالصَّلٰوۃِ وَ الزَّکٰوۃِ وَ کَانَ عِنۡدَ رَبِّہٖ مَرۡضِیًّا ‘তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে ছালাত ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি তাঁর পালনকর্তার কাছে পসন্দনীয় ছিলেন’ (সূরা মারইয়াম : ৫৫)।

(গ) ইবরাহীম, ইসহাক্ব ও ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ جَعَلۡنٰہُمۡ اَئِمَّۃً یَّہۡدُوۡنَ بِاَمۡرِنَا وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡہِمۡ فِعۡلَ الۡخَیۡرٰتِ وَ اِقَامَ الصَّلٰوۃِ وَ اِیۡتَآءَ الزَّکٰوۃِ وَ کَانُوۡا لَنَا عٰبِدِیۡنَ ‘আমি তাঁদেরকে নেতা করলাম। তাঁরা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করতেন। আমি তাঁদের প্রতি অহী নাযিল করলাম সৎকর্ম করার, ছালাত কায়েম করার এবং যাকাত দান করার। তাঁরা আমার ইবাদতে ব্যাপৃত ছিল’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৭৩)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। তাঁকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, وَ مِنَ الَّیۡلِ فَاسۡجُدۡ لَہٗ وَ سَبِّحۡہُ لَیۡلًا طَوِیۡلًا ‘আর রাতের একাংশে তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হও এবং দীর্ঘ রাত ধরে তাঁর তাসবীহ পাঠ কর’ (সূরা আদ-দাহর : ২৬)। মহান আল্লাহ বলেন, فَاعۡبُدۡہُ وَ اصۡطَبِرۡ لِعِبَادَتِہٖ ہَلۡ تَعۡلَمُ لَہٗ سَمِیًّا ‘সুতরাং তাঁর ইবাদাত কর এবং তাঁরই ইবাদাতে ধৈর্যশীল থাক। তুমি কি তাঁর সমতুল্য কাউকে জান?’ (সূরা মারইয়াম : ৬৫)। মহান আল্লাহ বলেন, وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَہَجَّدۡ بِہٖ نَافِلَۃً لَّکَ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَکَ رَبُّکَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ আদায় কর তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে। আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন’ (সূরা বানী ইসরাঈল : ৭৯)।

তাঁরা আল্লাহর ইবাদতে শক্তিশালী হওয়ার পাশিপাশি অধিকহারে যিকিরকারী, দু‘আকারী ও বিনয়-নম্র ছিলেন।
তাঁরা সব সময় বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করতেন। তাঁরা তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য রবের কাছে বিনয়ী ও ভীত-সন্ত্রস্ত হতেন। তাঁরা রবের জন্য দীর্ঘ ক্বিয়াম ক্বিরায়াতসহ অধিকহারে ইবাদতের সাথে তাঁদের দু‘আকে অব্যাহত রাখতেন।

নবী-রাসূলগণ তাঁদের প্রয়োজন পূরণের জন্য তাঁদের রবের নিকট নিজেদের মুখাপেক্ষিতা ও তীব্র আকাক্সক্ষা তুলে ধরে কতটা বিনয়ীভাবে প্রার্থনা করতেন তার বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর স্মরণ করুন আইয়ূবের কথা, যখন তিনি তাঁর রবকে আহ্বান করে বলেছিলেন, আমি দুঃখ-কষ্টে পতিত হয়েছি। আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম। আর তার যত দুঃখ-কষ্ট ছিল তা দূর করে দিলাম এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে দিয়ে দিলাম। আর তাদের সাথে তাদের মত আরো তাকে দিলাম; আমার পক্ষ থেকে রহমত এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৩-৮৪)।

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ করুন যুন-নূনের কথা, যখন তিনি রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না। তারপর তিনি অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিলেন, ‘আপনি ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র’। অতঃপর আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। আর স্মরণ করুন যাকারিয়ার কথা, যখন তিনি তার রবকে আহ্বান করে বলেছিলেন, হে আমার রব! আমাকে একা রাখবেন না, আপনি তো শ্রেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী। অতঃপর আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দান করেছিলাম ইয়াহইয়া আর তার জন্য তার স্ত্রীকে উপযোগী করেছিলাম। তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করতেন। আর আমাকে আশা ও ভীতি সহকারে ডাকতেন। আর তারা ছিলেন আমার নিকট বিনয়ী’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৮৭-৯০)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর অত্যধিক শরণাপন্ন বান্দা ছিলেন। বিপদের সময়ে তিনি আল্লাহর কাছে বেশি বেশি বিনয়-ন¤্রতার সাথে দু‘আ করতেন। বদরের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের ও সকল মুসলিমের জন্য মিনতির সাথে দীর্ঘ দু‘আ করেন। যেমন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্বিবলামুখী হয়ে দু’হাত উত্তোলন করে আল্লাহর দরবারে দু‘আ করলেন,

اَللّٰهُمَّ أَنْجِزْ لِيْ مَا وَعَدْتَنِيْ اللّٰهُمَّ آتِ مَا وَعَدْتَنِيْ اللّٰهُمَّ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ مِنْ أَهْلِ الْإِسْلَامِ لَا تُعْبَدْ فِي الْأَرْضِ

‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যে ওয়াদা দিয়েছিলেন আমার জন্য তা পূরণ করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে যা প্রদানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রদান করুন। হে আল্লাহ! যদি মুসলিমদের এই ক্ষুদ্র সেনাদলকে ধ্বংস করে দেন, তাহলে পৃথিবীতে আপনার ইবাদত করার মত আর কেউ থাকবে না’।

তিনি এমনিভাবে দু’হাত উঁচু করে ক্বিবলামুখী হয়ে তার পালনকর্তার কাছে অনর্গল উচ্চৈঃস্বরে দু‘আ করছিলেন। এক পর্যায়ে তাঁর কাঁধ থেকে চাঁদর পড়ে গেল। এরপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এসে চারদটি তাঁর কাঁধে তুলে দিলেন। তারপর তাঁর পিছন দিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহর নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনার এতটুকু দু‘আই যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা আপনার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছেন, তা অচিরেই পূর্ণ করবেন’।[৫]

আল্লাহর যিকিরের সময় তাদের একাগ্রতা ও ক্রন্দন
সূরা মারইয়ামের মধ্যে নবীদের প্রশংসা করে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এরাই সে সব নবী, যারা আদম সন্তানের মধ্য থেকে যাদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং যাদের আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম এবং ইবরাহীম ও ইসরাইলের বংশোদ্ভূত ও যাদের আমি পথ প্রদর্শন করেছিলাম এবং মনোনীত করেছিলাম। যখন তাদের কাছে পরম করুণাময়ের আয়াতসমূহ পাঠ করা হত, তারা কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে পড়ত’ (সূরা মারইয়াম : ৫৮)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আল্লাহকে ভয় করতেন। যেমন তিনি বলেন, وَاللهِ إِنِّيْ لَأَرْجُوْ أَنْ أَكُوْنَ أَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَعْلَمَكُمْ بِمَا أَتَّقِي ‘আল্লাহর শপথ! আমার আশা, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে সর্বাধিক ভয় করি এবং আমি সর্বাধিক অবগত ঐ বিষয় সম্পর্কে, যা থেকে আমার বিরত থাকা আবশ্যক’।[৬] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেন, يَا مُقَلِّبَ القُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَى دِيْنِكَ ‘হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন’।[৭]

আল্লাহ সম্পর্কে ইলমের মাধ্যমে নবীদের পথের অনুসরণ করা
আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাসের ইলমের উত্তরাধিকারী করেছেন। তাঁরাই ছিলেন আল্লাহর ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত। বান্দা তার রবের ব্যাপারে যত জানবে, ততই সে সম্মান, একাগ্রতা, ইবাদত, ভয়, ভালবাসা ও একনিষ্ঠতার সাথে তাঁর দিকে সমর্পিত হবে।

ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য ব্যতীত দুনিয়া ও আখেরাতে কোথাও সফলতা ও সৌভাগ্য অর্জনের কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যম ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা, অপবিত্র বস্তু থেকে পবিত্র বস্তুকে পার্থক্য করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়া তাঁদের আদর্শ ও আনিত বিধানকে বাদ দিয়ে ভাল আমল, কথা ও চরিত্র লাভ করা সম্ভব নয়। সুতরাং তাঁর কথা, কাজ, আখলাক্ব ও হেদায়াত দিয়ে উম্মতের সকল কথা, আমল ও আখলাক্বসমূহকে ওযন করা হবে। তাদের অনুসরণের ভিত্তিতেই পথভ্রষ্টদের থেকে সুপথপ্রাপ্তদেরকে আলাদা করা হবে।

বান্দার যত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তার চেয়ে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হেদায়াত সম্পর্কে জানা ও তাঁর অনুসরণের প্রয়োজন সর্বাধিক। তাঁদের অনুসরণের প্রয়োজন, শরীরের জন্য রূহের প্রয়োজনের মতই। আলোর জন্য চোখের এবং জীবনের জন্য রূহের প্রয়োজনের মতই বান্দার জন্য নবী রাসূলগণের শরণাপন্ন হওয়া অতীব যরূরী। যখন আপনি তাদের হেদায়াত থেকে বিচ্যুত হবেন, তখন তা আপনার অন্তরকে নষ্ট করে ফেলবে। তখন আপনার অন্তরের অবস্থা হবে ঠিক পানি থেকে উঠিয়ে ডাঙ্গায় রাখা মাছের মত। শুধু তাই নয়, বরং তার অবস্থা এর চেয়েও অধিক ভয়াবহ হবে। জীবন্ত ও সতেজ আত্মার অধিকারী ব্যতীত অন্য কেউ এ মহান সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম নয়। যাদের অন্তর মৃত, তারা এ বিষয়টি অনুভবই করতে পারে না।

যেহেতু দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের সফলতা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বরকতময় জীবনী এবং তাঁর সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন ও তা বাস্তবায়নের উপর নির্ভরশীল, তাই প্রত্যেক নাজাত ও সৌভাগ্যকামী লোকের জন্য যরূরী হল, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র সীরাত, তাঁর সুন্নাত সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। যাতে করে সে জাহেল ও জাহিলিয়্যাতের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর পবিত্র অনুসারী ও সাথীদের কাতারে শামিল হতে পারে। কিছু লোক এমন রয়েছে যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পবিত্র জীবনী, তাঁর সুন্নাত ও হেদায়াতের আলো থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত, কেউ বা তা থেকে খুব সামান্য গ্রহণ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে। একমাত্র আল্লাহর হাতেই সকল অনুগ্রহ ও নে‘মত, তিনি যাকে ইচ্ছা তা প্রদান করেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা অফুরন্ত কল্যাণের মালিক।[৮]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


* এম. এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. তাফসীরে ইবনু কাছীর, ৬ষ্ট খণ্ড, পৃ. ৩৫০।
[২]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ২য় খণ্ড, ১৯০ পৃ.।
[৩]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজ‘মূঊল ফাতাওয়া, ১৫তম খণ্ড, পৃ. ১৭৮।
[৪]. ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজ‘মূঊল ফাতাওয়া, ১৯তম খণ্ড, পৃ. ১৭০।
[৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৬৩।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১১০।
[৭]. তিরমিযী, হা/২১৪০।
[৮]. ইবনুল ক্বাইয়্যিম, যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬৯।




প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা
নববী আদর্শ (১১তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৪তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১২তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৯ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১০ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৫ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৩তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৫তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৪র্থ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ