মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৩ অপরাহ্ন

রাসূলুল্লাহ(ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যক্তি জীবন

-মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদক : আব্দুল বিন খোরশেদ*


কেন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করব?
মানবজাতির মধ্যে একমাত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনই পূর্ণাঙ্গ।
স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ইলম ও হিকমাহ শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে মনোনীত করেছেন এবং মানব জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আল্লাহর দৃষ্টিতে অঙ্কিত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বরকতময় জীবনচরিত সম্পর্কে আমাদের অবগত হওয়া যরূরী। নিঃসন্দেহে তা আমাদের জীবনের জন্য আলোকবর্তিকা ও উম্মাহর মুক্তির সনদ।

আল্লাহর আদেশের আনুগত্য
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর প্রদর্শিত পথের অনুসরণই মূলত আল্লাহর অনুসরণ। মহান আল্লাহ বলেন, لَقَدۡ کَانَ لَکُمۡ فِیۡ رَسُوۡلِ اللّٰہِ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ لِّمَنۡ کَانَ یَرۡجُوا اللّٰہَ وَ الۡیَوۡمَ الۡاٰخِرَ وَ ذَکَرَ اللّٰہَ کَثِیۡرًا ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’ (সূরা আল-আহযাব : ২১)। তিনি আরো বলেন, فَلۡیَحۡذَرِ الَّذِیۡنَ یُخَالِفُوۡنَ عَنۡ اَمۡرِہٖۤ اَنۡ تُصِیۡبَہُمۡ فِتۡنَۃٌ اَوۡ یُصِیۡبَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ‘অতএব যারা তাঁর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা যেন তাদের ওপর বিপর্যয় নেমে আসা অথবা যন্ত্রণাদায়ক আযাব পৌঁছার ভয় করে’ (সূরা আন-নূর : ৬৩)।

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নিষ্পাপ হওয়ার ঘোষণা
আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে হেফাযত করেছেন এবং সকল ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত রেখেছেন। যদি তিনি কোন ভুল করতেন, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে নিষ্পাপ হওয়ার স্বীকৃতি দেয়া হত না। যার ব্যাপারে নির্ভুল হওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে, তাঁকেই তো কেবল অনুসরণ করা যায়। লোকেরা তাঁর জীবনচরিত পাঠ করবে এবং তাঁর পথের পরিচয় অনুসন্ধান করবে।

তাঁর জীবনীতে উত্তম শিক্ষা রয়েছে
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনী অধ্যয়নের মধ্যেই রয়েছে বড় শিক্ষা। ঈমান ও তাওহীদ অথবা চরিত্র ও পথনির্দেশনা সংক্রান্ত, দাওয়াতের ক্ষেত্রে তার ধৈর্য এবং বাতিল ফের্কার সাথে তার দ্বন্দ সংক্রান্ত আলোচনা পাঠের মধ্যে মূল্যবান শিক্ষা রয়েছে।

সাহায্য ও সফলতার পূর্বশর্ত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ
যদি আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা, কাজ ও জীবনচরিত অনুসরণ না করি এবং একমাত্র তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের মধ্যেই নিজেকে ক্ষান্ত না রাখি, তাহলে আমরা কখনোই সাহায্যপ্রাপ্ত ও সফলতা লাভ করতে পারব না।

প্রতিটি বিষয়ে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই উত্তম আদর্শ
মহান আল্লাহ কি পুরুষদের মধ্য হতে নবী করেননি? নবীদের মধ্য হতে স্বামী করেননি? নবীদের মধ্য হতে ভাই করেননি? নবীদের মধ্য হতে সত্যবাদী করেননি? নবীদের মধ্য হতে বিচারক করেননি? নবীদের মধ্য হতে সেনাপতি করেননি? আর মহানবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসকল ক্ষেত্রে আমাদের জন্য কি উত্তম আদর্শ ছিলেন না?

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণের জন্য তার সীরাত সম্পর্কে জ্ঞান থাকা যরূরী
রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণের সময় আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে কিভাবে আপনি তাঁর পথের অনুসরণ করবেন? জানতে হবে কিভাবে আপনি তাঁর সুন্নাতকে অনুসরণ করবেন? কিভাবে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনার জন্য উত্তম আদর্শ হবেন? এসব বাস্তবায়নের জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনচরিত এবং অবস্থাভেদে মানুষের সাথে তাঁর আচরণবিধি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যরূরী।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অনুসরণের বিভিন্ন দিক
গবেষকগণ ও যুগশ্রেষ্ঠ সকল গ্রহণীয় ব্যক্তিগণ এ ব্যাপারে একমত যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সীরাত সকল উত্তম আদর্শের সূতিকাগার।

(ক) তিনি উত্তম চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম আদর্শ

মহান আল্লাহ বলেন, وَ اِنَّکَ لَعَلٰی خُلُقٍ عَظِیۡمٍ ‘আর অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের উপর অধিষ্ঠিত’ (সূরা আল-ক্বালাম : ৪)। তাঁর চরিত্র-নৈতিকতা ছিল হুবহু কুরআন।[১] তিনি কুরআনের সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হতেন এবং কুরআনের অসন্তুষ্টিতে অসন্তুষ্ট হতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো অশ্লীল ও কটুভাষী ছিলেন না, অশ্লীল ব্যবহারও করেননি।[২] তিনি কখনো বাজারে গিয়ে হট্টগোল করতেন না এবং অন্যায়ের দ্বারা অন্যায়ের প্রতিশোধ নেননি। বরং তিনি উদার মন নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন।[৩]

ছাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াইহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, مَا رَأَيْتُ أَحَدًا أَحْسَنَ خُلُقًا مِنْ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়ে নৈতিকতায় উত্তম কাউকে দেখিনি’।[৪] আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

وَاللهِ لَقَدْ خَدَمْتُهُ تِسْعَ سِنِيْنَ مَا عَلِمْتُهُ قَالَ لِشَيْءٍ صَنَعْتُهُ لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا؟ أَوْ لِشَيْءٍ تَرَكْتُهُ هَلَّا فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا

‘আল্লাহর শপথ! আমি নয় বছর তার সেবায় ছিলাম, কিন্তু আমার জানা নেই, কোন কাজ আমি করেছি আর সে ব্যাপারে তিনি বলেছেন, তুমি এরূপ কেন করলে? কিংবা আমি কোন কাজ করিনি, সে ব্যাপারে তিনি বলেছেন, কেন অমুক অমুক কাজ করলে না’?[৫] অন্যত্র আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ خُلُقًا فَأَرْسَلَنِيْ يَوْمًا لِحَاجَةٍ فَقُلْتُ وَاللهِ لَا أَذْهَبُ وَفِيْ نَفْسِيْ أَنْ أَذْهَبَ لِمَا أَمَرَنِيْ بِهِ نَبِيُّ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَخَرَجْتُ حَتَّى أَمُرَّ عَلَى صِبْيَانٍ وَهُمْ يَلْعَبُوْنَ فِي السُّوْقِ فَإِذَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَدْ قَبَضَ بِقَفَايَ مِنْ وَرَائِيْ قَالَ فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ وَهُوَ يَضْحَكُ فَقَالَ يَا أُنَيْسُ أَذَهَبْتَ حَيْثُ أَمَرْتُكَ؟ قَالَ قُلْتُ نَعَمْ أَنَا أَذْهَبُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم

‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবচেয়ে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। একদা তিনি আমাকে একটি কাজে যাওয়ার আদেশ করলেন, তখন আমি বললাম, আল্লাহর শপথ! আমি যাব না; কিন্তু আমার মনে এ বিশ্বাস ছিল, যে কাজে আমাকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ দিয়েছেন আমি সে কাজে যাব। অতঃপর আমি বের হয়ে ছেলেদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলাম। তারা বাজারে খেলাধূলায় লিপ্ত ছিল। হঠাৎ করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পিছন থেকে এসে আমার ঘাড় ধরলেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি তার প্রতি দৃষ্টি দিলাম তখন তিনি হাসছিলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, হে উনায়স! তুমি কি সেখানে গিয়েছিলে যেখানে তোমাকে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলাম? তিনি বলেন, আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! অবশ্যই আমি যাচ্ছি।[৬]

(খ) সহনশীলতা ও ক্ষমার দিক দিয়ে উত্তম আদর্শ

মহান আল্লাহ বলেন, فَبِمَا رَحۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ لِنۡتَ لَہُمۡ وَ لَوۡ کُنۡتَ فَظًّا غَلِیۡظَ الۡقَلۡبِ لَانۡفَضُّوۡا مِنۡ حَوۡلِکَ ‘অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণে আপনি তাদের জন্য ন¤্র হয়েছিলেন। আর যদি আপনি কঠোর স্বভাবের, কঠিন হৃদয়সম্পন্ন হতেন, তবে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)। আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

كُنْتُ أَمْشِىْ مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَعَلَيْهِ بُرْدٌ نَجْرَانِىٌّ غَلِيْظُ الْحَاشِيَةِ فَأَدْرَكَهُ أَعْرَابِىٌّ فَجَذَبَهُ جَذْبَةً شَدِيْدَةً حَتَّى نَظَرْتُ إِلَى صَفْحَةِ عَاتِقِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ أَثَّرَتْ بِهِ حَاشِيَةُ الرِّدَاءِ مِنْ شِدَّةِ جَذْبَتِهِ ثُمَّ قَالَ مُرْ لِىْ مِنْ مَالِ اللهِ الَّذِىْ عِنْدَكَ. فَالْتَفَتَ إِلَيْهِ فَضَحِكَ ثُمَّ أَمَرَ لَهُ بِعَطَاءٍ 

‘আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে পথে চলছিলাম। তখন তিনি নাজরানে প্রস্তুত মোটা পাড়ের চাদর পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে খুব জোরে টেনে দিল। অবশেষে আমি দেখলাম, জোরে টানার কারণে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্কন্ধে চাদরের পাড়ের দাগ বসে গেছে। অতঃপর বেদুঈন বলল, ‘আল্লাহর যে সম্পদ আপনার নিকট আছে তা হতে আমাকে কিছু দেয়ার আদেশ দিন। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলেন, আর তাকে কিছু দেয়ার আদেশ দিলেন’।[৭]

(গ) লজ্জাশীলতায় উত্তম আদর্শ

আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَشَدَّ حَيَاءً مِنَ الْعَذْرَاءِ فِيْ خِدْرِهَا فَإِذَا رَأَى شَيْئًا يَكْرَهُهُ عَرَفْنَاهُ فِيْ وَجْهِهِ‏ ‘পর্দার অন্তরালের কুমারীদের চেয়েও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি তাঁর কাছে অপসন্দনীয় কিছু দেখতেন, তখন আমরা তাঁর চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতাম’।[৮]
(ঘ) দয়া ও অনুকম্পায় উত্তম আদর্শ

মহান আল্লাহ বলেন, وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا رَحۡمَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ‘আর আমরা তো আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসাবেই প্রেরণ করেছি’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭)। আবুযার গিফারী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَيْلَةً فَقَرَأَ بِآيَةٍ حَتَّى أَصْبَحَ يَرْكَعُ بِهَا وَيَسْجُدُ بِهَا (اِنۡ تُعَذِّبۡہُمۡ فَاِنَّہُمۡ عِبَادُکَ وَ اِنۡ تَغۡفِرۡ لَہُمۡ فَاِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ) فَلَمَّا أَصْبَحَ قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَا زِلْتَ تَقْرَأُ هَذِهِ الْآيَةَ حَتَّى أَصْبَحْتَ تَرْكَعُ بِهَا وَتَسْجُدُ بِهَا قَالَ إِنِّىْ سَأَلْتُ رَبِّىْ عَزَّ وَجَلَّ الشَّفَاعَةَ لِأُمَّتِىْ فَأَعْطَانِيْهَا وَهِىَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ لِمَنْ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ عَزَّ وَجَلَّ شَيْئًا

‘এক রাতে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছালাত আদায় করছিলেন। তিনি একটি আয়াত বারবার তেলাওয়াত করছিলেন। এমনকি ভোর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলে তা দিয়েই রুকূ‘ এবং সিজদা করার মাধ্যমে ছালাত শেষ করলেন। আয়াতটি হল, اِنۡ تُعَذِّبۡہُمۡ فَاِنَّہُمۡ عِبَادُکَ وَ اِنۡ تَغۡفِرۡ لَہُمۡ فَاِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন তবে তারা আপনারই বান্দা, আর তাদেরকে যদি ক্ষমা করেন, তবে নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ১১৮)। সকাল হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি একটি আয়াতই ভোর পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেন এবং এর মাধ্যমেই ছালাত শেষ করলেন, কারণ কী? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমি আমার রবের কাছে আমার উম্মতের জন্য শাফা‘আতের অনুমতি কামনা করছিলাম এবং আমাকে তা দেয়া হল। যে ব্যক্তি শিরক থেকে মুক্ত থাকবে, সে আমার শাফা‘আত লাভ করবে’।[৯] মালিক বিন হুয়াইরিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فِىْ نَفَرٍ مِنْ قَوْمِىْ فَأَقَمْنَا عِنْدَهُ عِشْرِيْنَ لَيْلَةً وَكَانَ رَحِيْمًا رَفِيْقًا فَلَمَّا رَأَى شَوْقَنَا إِلَى أَهَالِينَا قَالَ ارْجِعُوْا فَكُوْنُوْا فِيْهِمْ وَعَلِّمُوْهُمْ وَصَلُّوْا فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ وَلْيَؤُمَّكُمْ أَكْبَرُكُمْ

‘আমি আমার গোত্রের কয়েকজন লোকের সঙ্গে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এলাম এবং আমরা তাঁর নিকট বিশ রাত অবস্থান করলাম। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অত্যন্ত দয়ালু ও বন্ধু বৎসল ছিলেন। তিনি যখন আমাদের মধ্যে নিজ পরিজনের নিকট ফিরে যাওয়ার আগ্রহ লক্ষ্য করলেন, তখন তিনি আমাদের বললেন, তোমরা পরিজনের নিকট ফিরে যাও এবং তাদের সাথে বসবাস কর, আর তাদের দ্বীন শিক্ষা দিবে এবং ছালাত আদায় করবে। যখন ছালাত উপস্থিত হয়, তখন তোমাদের কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বয়সে বড় সে ইমামতী করবে।[১০]

(ঙ) অঙ্গীকার রক্ষার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ

আয়েশা ছিদ্দীকা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত,

مَا غِرْتُ عَلَى أَحَدٍ مِنْ نِسَاءِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم مَا غِرْتُ عَلَى خَدِيْجَةَ وَمَا رَأَيْتُهَا وَلَكِنْ كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يُكْثِرُ ذِكْرَهَا وَرُبَّمَا ذَبَحَ الشَّاةَ ثُمَّ يُقَطِّعُهَا أَعْضَاءً ثُمَّ يَبْعَثُهَا فِىْ صَدَائِقِ خَدِيْجَةَ فَرُبَّمَا قُلْتُ لَهُ كَأَنَّهُ لَمْ يَكُنْ فِى الدُّنْيَا امْرَأَةٌ إِلَّا خَدِيْجَةُ فَيَقُوْلُ إِنَّهَا كَانَتْ وَكَانَتْ وَكَانَ لِىْ مِنْهَا وَلَدٌ 

‘আমি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অন্য কোন স্ত্রীর প্রতি এতটুকু ঈর্ষা করিনি যতটুকু খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর প্রতি করেছি। অথচ আমি তাঁকে দেখিনি। কিন্তু নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর কথা বেশি সময় আলোচনা করতেন। কোন কোন সময় বকরী যব্হ করে গোশতের পরিমাণ বিবেচনায় হাড়-গোশতকে ছোট ছোট টুকরা করে হলেও খাদীজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর বান্ধবীদের ঘরে পৌঁছে দিতেন। আমি কোন সময় ঈর্ষা ভরে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতাম, মনে হয় খাদীজা ছাড়া দুনিয়াতে যেন আর কোন নারী নেই। উত্তরে তিনি বলতেন, হ্যাঁ। তিনি এমন ছিলেন, এমন ছিলেন, তাঁর গর্ভে আমার সন্তানাদি জন্মেছিল’।[১১]

(চ) বিনয়-নম্রতার ক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ

মহান আল্লাহ তাঁর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, وَ اخۡفِضۡ جَنَاحَکَ لِمَنِ اتَّبَعَکَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ‘আর মুমিনদের মধ্যে যারা আপনার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি আপনি আপনার বাহুকে অবনত করুন’ (সূরা আশ-শু‘আরা ২১৫)। অর্থাৎ হে নবী! আপনি তাদের জন্য নরম ও দয়াশীল হবেন। আল্লাহ এখানে ‘বিনয়-নম্র’ ও ‘দয়াশীল’ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশেষত দরিদ্র মুমিন ও অপরাপর মুসলিমদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাস্তায় বাচ্চাদের মাঝ দিয়ে গমনের সময় তাদের সাথে সালাম বিনিময় করতেন।[১২] ছোট বাচ্চারা তার হাত ধরত। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরতেন।[১৩] তিনি নিজে হাতে জুতা মেরামত করতেন, নিজ হাতে কাপড়ে তালি দিতেন।[১৪] নিজ হাতে বকরীর দুধ দুহাতেন।[১৫] তিনি হত-দরিদ্র গরীব অসহায়দের সাথে চলাফেরা করতেন।[১৬] তিনি বিধবা ও ইয়াতীমদের প্রয়োজন পূরণ করতেন।[১৭] তাঁকে অতি সামান্য বিষয়ে ডাকা হলেও তিনি তাতে সাড়া দিতেন। তিনি অসুস্থের সেবা করতেন। জানাযায় শরীক হতেন। গাধার উপর আরোহণ করতেন। গোলামের দাওয়াতেও শামীল হতেন।[১৮]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

* এম. এ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র : 
[১]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৪৬।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৭৫৯, ৬০২৯; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২১।
[৩]. তিরমিযী, হা/২০১৬, সনদ ছহীহ।
[৪]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব, হা/৬৫৭৮; সনদ হাসান, ইবনু হাজার আল-‘আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ৬ষ্ট খণ্ড, পৃ. ৫৭৫।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৬৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩০৯।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১০; আবূ দাঊদ, হা/৪৭৭৩; মিশকাত, হা/৫৮০২।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৪৯; ছহীহ মুসলিম, হা/১০৫৭।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৬১০২; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩২০; মিশকাত, হা/৫৮১৩।
[৯]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৩৬৬, সনদ হাসান।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৬৭৪।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৩৫।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৬২৪৭; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৬৮।
[১৩]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১১৫৩০; মিশকাত, হা/৫৮০৯, সনদ ছহীহ।
[১৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪২২৮, সনদ ছহীহ।
[১৫]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৫৬৬২, সনদ ছহীহ।
[১৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪১৩।
[১৭]. নাসাঈ, হা/১৪১৪, সনদ ছহীহ।
[১৮]. মাদারিজুস সালেকীন, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩২৮।




প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা নবী-রাসূল
নববী আদর্শ (৪র্থ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৯ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৩য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৫ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৬ তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৬ষ্ঠ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৩তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৮তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৭তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ