বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১১ অপরাহ্ন

রাসূলুল্লাহ ()-এর পারিবারিক জীবন

মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*


(৪র্থ কিস্তি)

কোন এক সফরে স্ত্রী ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি কান্না আরম্ভ করলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছিলেন

عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَجَّ بِنِسَاْئِهِ فَلَمَّا كَانَ فِيْ بَعْضِ الطَّرِيْقِ نَزَلَ رَجُلٌ فَسَاقَ بِهِنَّ فَأَسْرَعَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَذَاكَ سَوْقُكَ بِالْقَوَارِيْرِ يَعْنِي النِّسَاءَ فَبَيْنَا هُمْ يَسِيْرُوْنَ بَرَكَ بِصَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ جَمَلُهَا وَكَانَتْ مِنْ أَحْسَنِهِنَّ ظَهْرًا فَبَكَتْ. وَجَاءَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِيْنَ أُخْبِرَ بِذَلِكَ فَجَعَلَ يَمْسَحُ دُمُوْعَهَا بِيَدِهِ

ছাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের সাথে নিয়ে হজ্জ করলেন। কোন এক রাস্তায় চলছিলেন, হঠাৎ একজন ব্যক্তি পিছু নিল। সে খুব দ্রুতপদে চলছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি কাঁচপাত্রবাহী উটগুলো ধীরে ধীরে হাঁকিয়ে নিয়ে যাও, অর্থাৎ নারীদের উটগুলো। চলতি পথে হঠাৎ ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে তিনি কাঁদতে লাগলেন। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানানো হলে তিনি নিজ হাতে তার চোখের অশ্রু মুছে দেন।[১]

স্বামী কর্তৃক নিজ হাতে স্ত্রীর চোখের অশ্রু মুছে দেয়ার চেয়ে বড় সমবেদনা জ্ঞাপন আর হয় না। এর মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অনুগ্রহ ও সহানুভূতি মূল্যায়িত হয়। হাদীছের মধ্যে ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর কান্নার কারণটা ছিল অতি নগন্য। যে উটকে তিনি সবচেয়ে সুন্দর ও শক্তিশালী উট বলে জানতেন, সে উটের হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ার কারণে তিনি কেঁদে দিয়েছিলেন। এরপরও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার অনুভূতিকে অবজ্ঞার চোখে দেখেননি।

মাঝে মাঝে বিভিন্ন সমস্যা ও জটিলতার কারণে স্ত্রীর মনটা বিষন্নতায় ভড়ে যায়। এসময় সে তার মনকে হাসি-খুশি ও উৎফুল্ল করতে এমন একজনকে পাশে খুঁজে, যে তার সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। তখন সে অনুভব করে যে, এই সমস্যায় সে একা নয়, তার সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য তার সাথে আরো একজন আছে।

মাঝে মাঝে স্ত্রী পিতা-মাতা, ভাই-বোনের মতো নিকটাত্মীয়দের পাশে পেতে চায়, যারা তাকে সান্ত্বনা দিবে, তাকে ধৈর্য ধারণের নছীহত করবে, তাকে সমবেদনা জানাবে। কিন্তু এসময়ে কিছু স্বামীকে বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়। তখন সে তার স্ত্রীর উপর আরোপিত বিপদাপদ ও জটিলতাকে তোয়াক্বাই করতে চায় না। এমনকি কখনো কখনো সেই স্বামীকে তার স্ত্রীর সমস্যা ও বিপদাপদকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অবজ্ঞা করতেও দেখা যায়। হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أُحَرِّجُ حَقَّ الضَّعِيْفَيْنِ الْيَتِيْمِ وَالْمَرْأَةِ

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, হে আল্লাহ! আমি দুই দুর্বলের অর্থাৎ ইয়াতীম ও নারীর অধিকার (নস্যাৎ করা) নিষিদ্ধ করছি’।[২]

এখানে (أُحَرِّجُ) অর্থ হল, ‘আমি মানুষদের উপর ইয়াতীম ও নারীর হক্ব নষ্ট করাকে নিষিদ্ধ করছি। এ ব্যাপারে আমি তাদের উপরে কঠোরতা আরোপ করছি।’ এখানে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক আল্লাহকে সাক্ষী রাখার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, তাদের কাছে এ বিধানকে পূর্ণাঙ্গভাবে পৌঁছানো।[৩]

স্ত্রীদের প্রতি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উত্তম বৈবাহিক সম্পর্ক ও মমত্ববোধ এতো গাঢ় ছিল যে, কোন স্ত্রী তার কথার উপর উচ্চৈঃস্বরে কথা বললেও তিনি তা সহ্য করতেন

عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيْرٍ قَالَ جَاءَ أَبُوْ بَكْرٍ يَسْتَأْذِنُ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَمِعَ عَائِشَةَ وَهِيَ رَافِعَةٌ صَوْتَهَا عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَذِنَ لَهُ فَدَخَلَ فَقَالَ يَا ابْنَةَ أُمِّ رُوْمَانَ وَتَنَاوَلَهَا أَتَرْفَعِيْنَ صَوْتَكِ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ؟ قَالَ فَحَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا قَالَ فَلَمَّا خَرَجَ أَبُوْ بَكْرٍ جَعَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ لَهَا يَتَرَضَّاهَ أَلَا تَرَيْنَ أَنِّيْ قَدْ حُلْتُ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَكِ قَالَ ثُمَّ جَاءَ أَبُوْ بَكْرٍ فَاسْتَأْذَنَ عَلَيْهِ فَوَجَدَهُ يُضَاحِكُهَا قَالَ فَأَذِنَ لَهُ فَدَخَلَ فَقَالَ لَهُ أَبُوْ بَكْرٍ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَشْرِكَانِيْ فِيْ سِلْمِكُمَا كَمَا أَشْرَكْتُمَانِيْ فِيْ حَرْبِكُمَا

নু‘মান ইবনু বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আগমন করে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তখন তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর উঁচু কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলে তিনি প্রবেশ করলেন।  আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে ধরে বললেন, হে উম্মে রুম্মানের কন্যা! তুমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলছো? নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের দু’জনের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালেন। অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাগান্বিত অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়ার পর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে খুশী করার জন্য (কৌতুকের ছলে) বললেন, দেখলে তো, আমি কিভাবে তোমার ও ঐ লোকটার মাঝখানে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাম।

অতঃপর আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একদিন এসে ভেতরে আসার অনুমতি চাইলেন এবং ভিতরে ঢুকে উভয়কে হাসিখুশী অবস্থায় দেখতে পেয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকেও আপনাদের শান্তির অংশীদার বানান যেমনটি আপনারা আমাকে অংশীদার বানিয়েছিলেন আপনাদের কলহে।[৪]

কখনো কখনো নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীরা রাতের বেলায় তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। একথার প্রমাণ পাওয়া যায় নিচের ঘটনায়। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

كُنَّا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ قَوْمًا نَغْلِبُ النِّسَاءَ فَلَمَّا قَدِمْنَا الْمَدِيْنَةَ وَجَدْنَا قَوْمًا تَغْلِبُهُمْ نِسَاؤُهُمْ فَطَفِقَ نِسَاؤُنَا يَتَعَلَّمْنَ مِنْ نِسَائِهِمْ قَالَ وَكَانَ مَنْزِلِيْ فِيْ بَنِيْ أُمَيَّةَ بْنِ زَيْدٍ بِالْعَوَالِيْ فَتَغَضَّبْتُ يَوْمًا عَلَى امْرَأَتِيْ فَإِذَا هِيَ تُرَاجِعُنِيْ فَأَنْكَرْتُ أَنْ تُرَاجِعَنِيْ فَقَالَتْ مَا تُنْكِرُ أَنْ أُرَاجِعَكَ فَوَاللّٰهِ إِنَّ أَزْوَاجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيُرَاجِعْنَهُ وَتَهْجُرُهُ إِحْدَاهُنَّ الْيَوْمَ إِلَى اللَّيْلِ فَانْطَلَقْتُ فَدَخَلْتُ عَلَى حَفْصَةَ فَقُلْتُ أَتُرَاجِعِيْنَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَقَالَتْ نَعَمْ فَقُلْتُ أَتَهْجُرُهُ إِحْدَاكُنَّ الْيَوْمَ إِلَى اللَّيْلِ؟ قَالَتْ نَعَمْ

‘আমরা কুরাইশ বংশের লোকেরা (জাহিলী যুগে) আমাদের স্ত্রীদের উপর প্রভাব খাটাতাম। যখন আমরা মদীনায় এলাম তখন এমন লোকদের দেখতে পেলাম যাদের উপর তাদের স্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করছিল। এমনি পরিবেশে আমাদের নারীরা তাদের (মদিনাবাসীদের) নারীদের অভ্যাস শিখতে শুরু করে দেয়। তিনি বলেন, সে সময় মদিনার উচ্চভূমির অধিবাসী বনু উমাইয়া ইবনু যায়িদের বংশধরদের মধ্যে আমার বসতবাড়ি ছিল। এরপর একদিন আমি আমার স্ত্রীর উপর রাগান্বিত হলাম। সে আমার কথার প্রতি উত্তর করতে লাগল। আমি আমার সঙ্গে তার প্রতি উত্তর করাকে খুবই অপ্রিয় মনে করলাম। সে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথার প্রতি উত্তর করাকে অপসন্দ করছিলেন কেন? আল্লাহর কসম! নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তো তাঁর সঙ্গে কথার প্রতি উত্তর করে থাকে। এমনকি তাঁদের কেউ কেউ তাঁকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। তখন আমি রওনা করে (আমার মেয়ে) হাফছার কাছে চলে এলাম। এরপর আমি তাকে বললাম, তুমি কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে প্রতিউত্তর কর? সে বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে কি কেউ তাকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে? সে বলল, হ্যাঁ।[৫]

উপরিউক্ত হাদীছ থেকে শিক্ষা হল, নারীর সাথে বিছানায় কঠোরতা করা নিন্দনীয়। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের ব্যাপারে আনছারী মহিলাদের জীবনাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তার নিজ কওমের আদর্শ গ্রহণ করেননি।

এছাড়া স্ত্রীদের ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা, তার উপর ছবর করা এবং আল্লাহর হক্ব ব্যতীত মানুষের হক্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তাদের থেকে কোন পদস্খলন ঘটলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা যরূরী।[৬]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়ির বিভিন্ন কাজে স্ত্রীদেরকে সহযোগিতা করতেন

عَنِ الْأَسْوَدِ قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ مَا كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصْنَعُ فِيْ بَيْتِهِ؟ قَالَتْ كَانَ يَكُوْنُ فِيْ مِهْنَةِ أَهْلِهِ تَعْنِيْ خِدْمَةَ أَهْلِهِ فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلَاةُ خَرَجَ إِلَى الصَّلَاةِ

আসওয়াদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বললেন, ঘরের কাজ-কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারবর্গের সহায়তা করতেন। আর ছালাতের সময় হলে ছালাতের জন্য চলে যেতেন।[৭]

এখানে (فِيْ مِهْنَةِ أَهْلِهِ) দ্বারা উদ্দেশ্য হল, পরিবারের কল্যাণমুলক সকল কাজকর্ম ও তাদের সেবা করা।[৮]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক পরিবারের খেদমত করার ব্যাখ্যা অন্য হাদীছে নিম্নোক্তভাবে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ سُئِلْتُ مَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْمَلُ فِيْ بَيْتِهِ؟ قَالَتْ كَانَ بَشَرًا مِنَ الْبَشَرِ يَفْلِيْ ثَوْبَهُ وَيَحْلُبُ شَاتَهُ وَيَخْدُمُ نَفْسَهُ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে অবস্থানকালে কি করতেন? তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন একজন মানুষ। পোশাকের মধ্যে তিনি উকুন তালাশ করতেন, ছাগল দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই সম্পন্ন করতেন’।[৯]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,

كَانَ يَخِيْطُ ثَوْبَهُ وَيَخْصِفُ نَعْلَهُ وَيَعْمَلُ مَا يَعْمَلُ الرِّجَالُ فِيْ بُيُوْتِهِمْ

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন, জুতা মেরামত করতেন, এছাড়া সাধারণ মানুষের মতো বাড়ির অন্যান্য কাজেও শরীক হতেন।[১০]

এখানে (يَفْلِيْ ثَوْبَهُ) অর্থ হল, কাপড়ে কোন ময়লা বা অপবিত্রতা আছে কিনা সেদিকে তিনি লক্ষ্য করতেন। আর (يَخْصِفُ نَعْلَهُ) অর্থ হল, জুতা ছিদ্র করে মেরামত করতেন।[১১]

বর্তমান সময়ে অনেক স্বামী স্ত্রীদের উপর তাদের সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেয়। স্বামী তার স্ত্রীকে দুঃখ-কষ্ট ও অসুস্থতার মধ্যে দেখার পরেও তার দিকে ভ্রুক্ষেপ করতে চায়না। তাকে বাড়ির কাজে সহযোগীতাও করে না। এটা নিঃসন্দেহে উত্তম বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে পড়ে না।

তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাহনে আরোহনের ক্ষেত্রে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন

একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বাহনে আরোহন করতে চাইলেন। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

فَرَأَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُحَوِّيْ لَهَا وَرَاءَهُ بِعَبَاءَةٍ ثُمَّ يَجْلِسُ عِنْدَ بَعِيْرِهِ فَيَضَعُ رُكْبَتَهُ فَتَضَعُ صَفِيَّةُ رِجْلَهَا عَلَى رُكْبَتِهِ حَتَّى تَرْكَبَ

‘আমি দেখতে পেলাম যে, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পেছনে চাদর দিয়ে ছাফিয়্যাহকে পর্দা করছেন। উঠানামার প্রয়োজন হলে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উটের কাছে হাঁটু বাড়িয়ে বসতেন, আর ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর উপর পা রেখে উটে আরোহণ করতেন’।[১২]

এখানে দেখা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাফিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর বাহনের সামনে নিজের হাঁটু গেড়ে বসেছেন, যাতে সে তাঁর উরুতে ভর করে বাহনে আরোহন করতে পারে। সর্বোচ্চ বিনয়-নম্রতা, অনুগ্রহের আদলে গড়া উত্তম বৈবাহিক সম্পর্কের দৃষ্টান্ত এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে?!

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও সুগন্ধির বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিতেন

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাড়িতে প্রবেশকালে মেসওয়াক করতেন, যাতে কোন স্ত্রী তাঁর মুখ থেকে অনাকাঙ্খিতভাবে কোন দুর্গন্ধ না পায়। হাদীছে এসেছে,

عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ عَنْ أَبِيْهِ قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ قُلْتُ بِأَيِّ شَيْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ؟ قَالَتْ بِالسِّوَاكِ.

মিকদামের পিতা সুরায়হ (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে ঢুকে সর্বপ্রথম কোন কাজটি করতেন? তিনি বললেন, ‘সর্বপ্রথম মেসওয়াক করতেন’।[১৩]

এখানে মেসওয়াক করার হিকমাহ হল, কখনো কখনো কথা বলার সময় মুখ থেকে অনাকাঙ্খিতভাবে দুর্গন্ধ বের হতে পারে। তাই বাড়িতে প্রবেশের আগে মুখ পরিস্কার করা উত্তম বৈবাহিক সম্পর্কের অন্তর্গত।[১৪]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখনই ঘুম থেকে জাগ্রত হতেন, মুখ ও দাঁত পরিস্কার করতেন। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَرْقُدُ مِنْ لَيْلٍ وَلَا نَهَارٍ فَيَسْتَيْقِظُ إِلَّا تَسَوَّكَ قَبْلَ أَنْ يَتَوَضَّأَ.

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সূত্রে বর্ণিত। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে বা দিনে যখনই ঘুম থেকে জাগতেন, ওযূর পূর্বে মেসওয়াক করতেন।[১৫]

এখান থেকে মেসওয়াক করা মুস্তাহাব এবং খাবার গ্রহণ বা অন্য কোন কারণে মুখে দুর্গন্ধ করে রাখা অপসন্দনীয় সাব্যস্ত হয়।[১৬]

ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেসওয়াক করা পসন্দ করতেন। তিনি ছিয়াম ও ছিয়ামহীন সর্বাবস্থায় মেসওয়াক করতেন। তিনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলে মেসওয়াক করতেন, ওযূ ও ছালাতের শুরুতে মেসওয়াক করতেন, বাড়িতে প্রবেশের সময় মেসওয়াক করতেন। তিনি অধিক পাতা ও কাটাযুক্ত আরাক গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক করতেন’।[১৭]

বৈবাহিক সম্পর্ককে দৃঢ় করার জন্য মুখের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, বর্তমান সময়ে আদালতে অনেক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছিন্নের মতো ঘটনা ঘটে শুধু তাদের কোন একজনের দাঁত-মুখের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখাকে গুরুত্ব না দেয়ার কারণে।

(ইনশাআল্লাহ চলবে)


* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৬৮৬৬; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২০৫; কিলাবা বর্ণনা করেন, سَوْقُكَ بِالْقَوَارِيْرِ ‘কাঁচপাত্র সদৃশ’ শব্দ দ্বারা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহিলাদের বুঝিয়েছেন, যা তোমাদের কেউ বললে তাকে দোষারোপ করা হতো।
[২]. ইবনু মাজাহ, হা/৩৬৭৮; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১০১৫।
[৩]. হাশিয়াতু সিন্দী আলা সুনানে ইবনে মাজাহ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[৪]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৮৩৯৪; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৯০১।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৬৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭৯।
[৬]. ফাতহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৯১।
[৭]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৬।
[৮]. তারহুত তাছরীব, ৯ম খণ্ড, পৃ. ৫৩।
[৯]. আদাবুল মুফরাদ, হা/৫৪১; শামায়েলে তিরমিযী, হা/৩৪৩; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, হা/৪৯৯৬।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৯০৩; ছহীহ ইবনে হিব্বান, হা/৫৬৭৭; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, হা/৪৯৩৭।
[১১]. আন-নিহায়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০০।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/২৮৯৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৬৫।
[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৩।
[১৪]. হাশিয়াতুস সুয়ূতী আলান নাসাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০।
[১৫]. আবূ দাঊদ, হা/৫৭; আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) হাদীছটিকে ‘ছহীহ’ বলেছেন, ছহীহুল জামে‘, হা/৪৮৫৩।
[১৬]. আল-মাফহাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৬।
[১৭]. ইবনুল কাইয়্যিম, যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬৭।




প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা নবী-রাসূল
নববী আদর্শ (১৪তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৮তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৩য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৫ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৭তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১২তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৩তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৫তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ