বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪২ অপরাহ্ন

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পারিবারিক জীবন

-মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*


(৭ম কিস্তি)

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবারকে একনিষ্ঠচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার প্রশিক্ষণ দিতেন

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَعْتَكِفُ فِيْ كُلِّ رَمَضَانٍ وَإِذَا صَلَّى الغَدَاةَ دَخَلَ مَكَانَهُ الَّذِيْ اِعْتَكَفَ فِيْهِ قَالَ فَاسْتَأْذَنَتْهُ عَائِشَةُ أَنْ تَعْتَكِفَ فَأَذِنَ لَهَا فَضَرَبَتْ فِيْهِ قُبَّةً فَسَمِعَتْ بِهَا حَفْصَةُ فَضَرَبَتْ قُبَّةً وَسَمِعَتْ زَيْنَبُ بِهَا فَضَرَبَتْ قُبَّةً أُخْرَى فَلَمَّا انْصَرَفَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنَ الغَدَاةِ أَبْصَرَ أَرْبَعَ قِبَابٍ فَقَالَ مَا هَذَا؟ فَأُخْبِرَ خَبَرَهُنَّ فَقَالَ مَا حَمَلَهُنَّ عَلَى هَذَا؟ آلْبِرُّ؟ انْزِعُوْهَا فَلَا أَرَاهَا فَنُزِعَتْ فَلَمْ يَعْتَكِفْ فِيْ رمَضَانَ حَتَّى اعْتَكَفَ فِيْ آخِرِ العَشْرِ مِنْ شَوَّالٍ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি রামাযানে ই‘তিকাফ করতেন। ফজরের ছালাত শেষে ই‘তিকাফের নির্দিষ্ট স্থানে প্রবেশ করতেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর কাছে ই‘তিকাফ করার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) মসজিদে (নিজের জন্য) একটি তাঁবু করে নিলেন। হাফছাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তা শুনে (নিজের জন্য) একটি তাঁবু তৈরি করে নিলেন এবং যয়নাব (রাযিয়াল্লাহু আনহা)ও তা শুনে (নিজের জন্য) আর একটি তাঁবু তৈরি করে নিলেন। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফজরের ছালাত শেষে এসে চারটি তাঁবু দেখতে পেয়ে বললেন, এ কী? তাঁকে তাঁদের ব্যাপার জানান হলে তিনি বললেন, নেক আমলের প্রেরণা তাদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেনি। সব খুলে ফেলা হল। তিনি সেই রামাযানে আর ই‘তিকাফ করলেন না। পরে শাওয়াল মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করেন।[১]

এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের কর্মকে অপসন্দ করার কারণে এভাবে বলেছিলেন। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের এহেন উত্তম কাজকে অপসন্দ করেছিলেন মূলত তাদের কাজের মধ্যে খুলুছিয়্যাত না থাকার কারণে। তাঁর (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মনে হয়েছিল যে, তাঁরা এই কাজের মাধ্যমে স্রেফ তাঁর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করছে তাঁর প্রতি তাদের প্রবল ঈর্ষাবোধ থেকে।

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয় পাচ্ছিলেন যে, তাঁরা একাজ করতে গিয়ে অহংকার, বিবাদ ও ঈর্ষার মধ্যে পড়ে যেতে পারে। বিশেষত এ কাজের মাধ্যমে তাঁরা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করছিল, যা ই‘তিকাফের লক্ষ অর্জনকে ব্যহত করে’।[২]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবারকে খারাপ কাজ থেকে আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা দিতেন

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ فَقَالَ يَا عَائِشَةُ اسْتَعِيْذِيْ بِاللهِ مِنْ شَرِّ هٰذَا فَإِنَّ هٰذَا هُوَ الْغَاسِقُ إِذَا وَقَبَ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে আয়েশা! আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও এর অপকারিতা হতে। কেননা এটা হল সেই গাসেক বা অস্তগামী, যখন অন্ধকার হয়ে যায়’।[৩]

এখানে اَلْغَاسِقُ অর্থ- অন্ধকার। إِذَا وَقَبَ অর্থ- যখন অদৃশ্য হয়ে যায়। অধিকাংশ মুফাসসির গাসিক্ব-এর অর্থ রাত্রি করেছেন।[৪] উক্ত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাত্রির (অনিষ্ট) থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা সাধারণত বিপদসমূহ রাত্রিতেই বেশি ছড়িয়ে পড়ে। গাসিক্ব দ্বারা রাত্রি উদ্দেশ্য হওয়া এবং অপর হাদীছে যে চন্দ্রের কথা বলা হয়েছে, এদুয়ের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা চন্দ্র রাতেরই একটি নিদর্শন। আর রাতেই কেবল চন্দ্রকে পরিষ্কার দেখা যায়।[৫]

এই হাদীছের মধ্যে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক তাঁর স্ত্রীদেরকে তা‘লীম দেয়ার প্রতি গুরুত্বারোপের বিষয়টি ফুটে উঠে। যেমন প্রথমে নিজে হাতে কাজটি গ্রহণ করলেন, তারপর উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত করলেন, কাজে বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিলেন এবং তার কারণ বর্ণনা করলেন।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় পঠিতব্য উপকারী যিকির-আযকার শিক্ষা দিতেন

عَنْ جُوَيْرِيَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا بُكْرَةً حِيْنَ صَلَّى الصُّبْحَ وَهِيَ فِيْ مَسْجِدِهَا ثُمَّ رَجَعَ بَعْدَ أَنْ أَضْحَى وَهِيَ جَالِسَةٌ قَالَ مَا زِلْتِ عَلٰى الْحَالِ الَّتِيْ فَارَقْتُكِ عَلَيْهَا؟ قَالَتْ نَعَمْ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَدْ قُلْتُ بَعْدَكِ أَرْبَعَ كَلِمَاتٍ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ لَوْ وُزِنَتْ بِمَا قُلْتِ مُنْذُ الْيَوْمِ لَوَزَنَتْهُنَّ سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ وَرِضَاءَ نَفْسِهِ وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ

উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, একদিন খুব সকালে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর নিকট হতে বের হলেন, যখন তিনি ফজরের ছালাত আদায় করে ছালাতের স্বীয় স্থানে বসে ছিলেন। অতঃপর সূর্য খুব উপরে উঠার পর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যাবর্তন করেন, তখনো জুওয়াইরিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহা) সেখানেই বসেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেন, আমি তোমার থেকে পৃথক হওয়া পর্যন্ত তুমি কি এ অবস্থায় আছ? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তোমার পরে আমি মাত্র চারটি বাক্য তিনবার বলেছি, যদি এটাকে তুমি এ অবধি যা বলেছ তার সাথে ওযন দেয়া হয় তাহলে এ বাক্যগুলোর ওযনই বেশী হবে। বাক্যগুলো হচ্ছে, সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহি ‘আদাদা খালক্বিহি ওয়া রিযাআ নাফসিহি, ওয়া যিনাতা ‘আরশিহী ওয়া মিদাদা কালিমাতিহি। অর্থাৎ- আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করি তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর সৃষ্টির সংখ্যা পরিমাণ, তাঁর সন্তোষ পরিমাণ, তাঁর আরশের ওযন পরিমাণ ও তাঁর বাক্যসমূহের সংখ্যা পরিমাণ’।[৬]

অর্থাৎ তোমার দিনের প্রথম অংশের যিকিরসমূহের তুলনায় আমি (নবী) যে চারটি বাক্য তিনবার পাঠ করেছি তা যদি আল্লাহর নিকটে কবুল হয় তাহলে তা ঐ যিকিরসমূহের (নেকীর) বরাবর হবে।[৭]

কিছু কিছু যিকির সত্তা ও কর্মগত সকল দিক বিবেচনায় অন্যান্য যিকিরের চেয়ে উত্তম। এক্ষেত্রে সামান্য যিকিরও অধিক যিকির থেকে উত্তম হতে পারে।[৮] এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় স্ত্রীকে কোন দোষ-ত্রুটি বর্ণনা ছাড়াই আমলের দিক দিয়ে সহজ ও প্রতিদানের দিক দিয়ে ব্যাপক একটি আমলের কথা জানিয়ে দিলেন।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদেরকে ইবাদতের ক্ষেত্রে উত্তম ও সহজটি গ্রহণের নির্দেশ দিতেন

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كُنْتُ أُحِبُّ أَنْ أَدْخُلَ البَيْتَ فَأُصَلِّيَ فِيْهِ فَأَخَذَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِيْ فَأَدْخَلَنِي الحِجْرَ فَقَالَ صَلِّي فِي الحِجْرِ إِنْ أَرَدْتِ دُخُوْلَ البَيْتِ فَإِنَّمَا هُوَ قِطْعَةٌ مِّنَ البَيْتِ وَلَكِنَّ قَوْمَكِ اسْتَقْصَرُوْهُ حِيْنَ بَنَوْا الكَعْبَةَ فَأَخْرَجُوْهُ مِنَ البَيْتِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বায়তুল্লাহর ভিতর প্রবেশ করে সেখানে ছালাত আদায় করতে আমার খুব আকাঙ্খা হত। তাই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরে হিজর-এ প্রবেশ করিয়ে আমাকে বললেন, তুমি যদি বায়তুল্লাহ প্রবেশের ইচ্ছা রেখে থাক তবে এই হিজরেই ছালাত আদায় করে নাও। কেননা ওটিও বায়তুল্লাহর অংশ। কিন্তু তোমার কাওম যখন বায়তুল্লাহ পুনঃনির্মাণ করছিল তখন অর্থাভাবে এই স্থানটিকে বায়তুল্লাহর বাইরে রেখে দেয়।[৯]

উক্ত হাদীছে আমরা লক্ষ্য করি যে, কিভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় স্ত্রীর হাত ধরে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই ‘হিজর’ অংশটুকু মূল কা‘বার অন্তর্গত। কেউ যদি কা‘বার অভ্যান্তরে ছালাত আদায় করতে চায়, সে যেন হিজর-এ ছালাত আদায় করে।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় পরিবারকে ইবাদতের ক্ষেত্রে নফসের উপর কঠোরতা না করে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ دَخَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا حَبْلٌ مَمْدُوْدٌ بَيْنَ السَّارِيَتَيْنِ فَقَالَ مَا هَذَا الحَبْلُ؟ قَالُوْا هَذَا حَبْلٌ لِزَيْنَبَ فَإِذَا فَتَرَتْ تَعَلَّقَتْ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا حُلُّوْهُ لِيُصَلِّ أَحَدُكُمْ نَشَاطَهُ فَإِذَا فَتَرَ فَلْيَقْعُدْ

আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (মসজিদে) প্রবেশ করে দেখতে পেলেন যে, দু’টি স্তম্ভের মাঝে একটি রশি টাঙানো রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ রশিটি কী কাজের জন্য? লোকেরা বলল, এটি যয়নাবের রশি, তিনি (ইবাদত করতে করতে) অবসন্ন হয়ে পড়লে এটির সাথে নিজেকে বেঁধে দেন। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘না, বরং ওটা খুলে ফেল। তোমাদের কারো প্রাণবন্ত থাকা পর্যন্ত ইবাদত করা উচিত। যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন যেন সে বসে পড়ে’।[১০]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই হাদীছের মধ্যে ইবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ক্লান্তি ছাড়াই প্রাণবন্ততার সাথে ইবাদত করার প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যখন ইবাদত বন্দেগীতে অবসাদ চলে আসবে, তখন যেন অবসাদ দূর না হওয়া পর্যন্ত ইবাদত থেকে বিরতি গ্রহণ করে।[১১]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মুখে জনৈক মহিলার কথা শুনে অপসন্দ করলেন, যে সারারাত জেগে ক্বিয়াম করত, কখনো ঘুমাত না

عَنْ عُرْوَةَ بْنِ الزُّبَيْرِ أَنَّ عَائِشَةَ زَوْجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَخْبَرَتْهُ أَنَّ الْحَوْلَاءَ بِنْتَ تُوَيْتِ بْنِ حَبِيْبِ بْنِ أَسَدِ بْنِ عَبْدِ الْعُزَّى مَرَّتْ بِهَا وَعِنْدَهَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ هَذِهِ الْحَوْلَاءُ بِنْتُ تُوَيْتٍ وَزَعَمُوْا أَنَّهَا لَا تَنَامُ اللَّيْلَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا تَنَامُ اللَّيْلَ خُذُوْا مِنَ الْعَمَلِ مَا تُطِيْقُوْنَ فَوَ اللهِ لَا يَسْأَمُ اللهُ حَتَّى تَسْأَمُوْا

উরওয়াহ ইবনু যুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রী আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তাঁকে বলেছেন যে, হাওলা বিনতে তুওয়াইত ইবনু হাবীব ইবনু আসাদ ইবনু আব্দুল উযযা একদিন তার কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন তাঁর (আয়েশা) কাছে গেলেন। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, আমি বললাম, এ হল হাওলা বিনতে তুওয়াইত। লোকজন বলে থাকে যে, সে রাতে ঘুমায় না। অর্থাৎ সারারাত ইবাদাত-বন্দেগী করে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ কথায় বিস্মিত হয়ে বললেন, সে রাতেও ঘুমায় না? তোমরা নফল আমল ততটুকু কর যতটুকু তোমাদের সাধ্য আছে। আল্লাহর কসম! তিনি পুরস্কার দিতে ক্লান্ত হবেন না। বরং তোমরাই (ইবাদতে) ক্লান্ত হয়ে পড়বে।[১২]

হাদীছে বর্ণিত لَا تَنَامُ اللَّيْلَ দ্বারা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উক্ত ব্যক্তির রাতে না ঘুমান এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে নিজের নফসের উপর কঠোরতা আরোপকে অপসন্দ করেছেন।[১৩]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদেরকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সৎ আমলগুলো করার জন্য উৎসাহ দিতেন, যদিও তা পরিমাণে কম হয়

عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَبُّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল সেটিই, যা নিয়মিত করা হয়ে থাকে। যদিও তা কম হয়’।[১৪]

ক্বাসিম ইবনে মুহাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وَكَانَتْ عَائِشَةُ إِذَا عَمِلَتِ الْعَمَلَ لَزِمَتْهُ ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) যখন কোন আমল শুরু করতেন, তখন তাকে স্থায়ীভাবে করতেন’।[১৫] ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘স্থায়ীভাবে ইবাদত করা অধিক পসন্দনীয় হওয়ার দু’টি অর্থ উদ্দেশ্য। (১) কোন ব্যক্তি একটি আমল শুরু করার পর তা ছেড়ে দেয়া তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নামান্তর। (২) নিশ্চয় স্থায়ীভাবে কল্যাণ লাভের জন্য আমলটির সাথে ধারাবাহিকভাবে লেগে থাকা যরূরী। কেননা যে ব্যক্তি প্রতিদিন সময়মত কাজকে সম্পাদন করে আর যে ব্যক্তি একদিন ঠিক মত কাজ করে অন্যদিন ছেড়ে দেয় উভয়ে সমান নয়।[১৬]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদেরকে ছাদাক্বাহ ও সৎকাজে দান করার জন্য উপদেশ ও উৎসাহ দিতেন

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَهَا يَا عَائِشَةُ اسْتَتِرِيْ مِنَ النَّارِ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ فَإِنَّهَا تَسُدُّ مِنَ الْجَائِعِ مَسَدَّهَا مِنَ الشَّبْعَانِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘হে আয়েশা! একটি খেজুরের অর্ধেকের মাধ্যমে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে আড়াল কর। কেননা তা ক্ষুধার্তের জন্য পরিতৃপ্ত হওয়ার পথে সামান্য ক্ষুধা নিবারণ করবে’।[১৭]

হাদীছে بِشِقِّ تَمْرَةٍ দ্বারা একটি খেজুরের অর্ধেক বা তার সামান্য অংশের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ খেজুর বা অন্য কোন বস্তুর সামান্য পরিমান (দান করে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাক)। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে এ মর্মে উৎসাহ দিয়েছিলেন যে, সে যেন তার ও জাহান্নামের মাঝে অতি সামান্য সাদাক্বাহ ও সৎকাজ সম্পাদন করার মাধ্যমে হলেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নেয়। কেননা সামান্য ছাদাক্বাহ তার প্রদানকারীর কাছ থেকে জাহান্নামকে আড়াল করে দিবে। হাদীছে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ دَخَلَ عَلَيَّ سَائِلٌ مَرَّةً وَعِنْدِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَمَرْتُ لَهُ بِشَيْءٍ ثُمَّ دَعَوْتُ بِهِ فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَا تُرِيْدِيْنَ أَنْ لَا يَدْخُلَ بَيْتَكِ شَيْءٌ وَلَا يَخْرُجَ إِلَّا بِعِلْمِكِ قُلْتُ نَعَمْ قَالَ مَهْلًا يَا عَائِشَةُ لَا تُحْصِيْ فَيُحْصِيَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ عَلَيْكِ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বললেন, একবার আমার কাছে একজন ভিক্ষুক আসল, তখন আমার কাছে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত ছিলেন। আমি তাকে কিছু দেয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। অতঃপর তাঁকে ডেকে দেখলাম তিনি কি দিচ্ছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি কি চাও যে, তোমার ঘরে তোমার বিনা অনুমতিতে কোন কিছু না প্রবেশ করুক এবং কোন কিছু বেরও না হোক, আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আয়েশা! তুমি কখনও এরূপ করো না; তুমি কখনও হিসাব করে খরচ করবে না; নয়তো আল্লাহ তা‘আলাও তোমাকে হিসাব করে করে দেবেন।[১৮]

 اَلْإِحْصَاءُ তথা ওজনে ও সংখ্যায় কোন বস্তুর পরিমাণ জানা। অর্থাৎ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ভয়ে ছাদাক্বাহ করা থেকে বিরত থাকা নিষেধ। অতঃপর এটি বারাকাত বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বেহিসাব দান করে থাকেন, তিনি প্রতিদান দেয়ার ক্ষেত্রেও অগণিত দিয়ে থাকেন। যে ব্যক্তি জানবে যে, আল্লাহ তাকে অগণিত রিযিক্ব দান করছেন, তার জন্য হক্ব হল, হিসাব না করে দান করা।[১৯]

যখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবার একটি বকরী যব্হ করল, তখন তিনি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বললেন, ‘তার কি কিছু অবশিষ্ট রয়েছে? আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, তার একটি বাহু ছাড়া কিছুই বাকি নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,بَقِيَ كُلُّهَا غَيْرَ كَتِفِهَا ‘বাহু ছাড়া সবই বাকি আছে’।[২০] অর্থাৎ তুমি যেটা ছাদাক্বাহ করবে, সেটা অবশিষ্ট রয়েছে। আর তোমার কাছে যা উদ্বৃত্ত আছে, সেটা অবশিষ্ট নয়। মহান আল্লাহ বলেন,وَ مَا عِنۡدَ اللّٰہِ بَاقٍ مَا عِنۡدَکُمۡ یَنۡفَدُ   ‘তোমাদের কাছে যা আছে নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, কখনও তা শেষ হবে না’ (সূরা আন-নাহল : ৯৬)।

(ইনশাআল্লাহ চলবে) 

*এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৭৪।
[২]. ফাৎহুল বারী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ২৭৬।
[৩]. তিরমিযী, হা/৩৩৬৬; সনদ হাসান ছহীহ।
[৪]. বাদাঈ আল-ফাওয়াইদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৪২।
[৫]. তাফসীর ইবনু কাছীর, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৫৩৬।
[৬]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৬।
[৭]. বদরুদ্দীন আইনী, শারহু আবি দাঊদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪১৪।
[৮]. হাশিয়াতুস সুয়ূতী ওয়া সিন্দী আলা সুনানিন নাসাঈ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৭৮।
[৯]. তিরমিযী, হা/৮৭৬; আবূ দাঊদ, হা/২০২৮, সনদ হাসান ছহীহ।
[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৪।
[১১]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৩; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৫।
[১৩]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৪৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৩।
[১৫]. ছহীহ মুসলিম, হা/৭৮৩।
[১৬]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০৩।
[১৭]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩৯৮০, সনদ হাসান; ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৮৬৫।
[১৮]. আবূ দাউদ, হা/১৭০০; নাসাঈ, হা/২৫৪৯, হাদীছের শব্দ নাসাঈর, সনদ হাসান।
[১৯]. ইবনে হাজার আসক্বালানী, ফাতহুল বারী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩০০।
[২০]. তিরমিযী, হা/২৪৭০, সনদ ছহীহ।




প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা নবী-রাসূল
নববী আদর্শ (১০ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১১তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৬ তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৯তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১২তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৯ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৩য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৭তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ