রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পারিবারিক জীবন
-মূল : শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ
-অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*
(১২তম কিস্তি)
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের থেকে পৃথক থাকার নীতি গ্রহণ করেছিলেন; যেমন স্ত্রীদের অতিরিক্ত ভরণপোষণ চাওয়া ও মধুপানের ঘটনায় নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একমাস যাবৎ স্ত্রীদের থেকে পৃথক ছিলেন
ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, সম্ভবত উপরিউক্ত বিষয়গুলোই ছিল স্ত্রীদের থেকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পৃথক হওয়ার কারণ। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মহৎ চরিত্র, প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ও অধিক ক্ষমাকারী ছিলেন বলেই স্ত্রীদের পক্ষ থেকে এমন ঘটনা বারংবার সংঘটিত হওয়ার পরেও তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন।
ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা তিনি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আমিরুল মুমিনীন! নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর স্ত্রীগণের মধ্যে থেকে সেই দু’জন মহিলা কারা ছিলেন যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘তোমাদের দু’জনের হৃদয় অন্যায় প্রবণ হয়েছে মনে করে তোমরা যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আস, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন’ (সূরা আত তাহরীম : ৪)। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে ইবনু আব্বাস! এটাতো তোমার জন্য আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হচ্ছে (তুমি এত বিলম্বে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কেন?)। অতঃপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পুরো হাদীছটি বর্ণনা করলেন।
তিনি বললেন, তারা দু’জন ছিল হাফছাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ও আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)। এরপর তিনি ঘটনার বিবরণ দিতে লাগলেন। তিনি বললেন, আমরা কুরায়শ বংশের লোকেরা (জাহিলিয়্যাত যুগে) আমাদের স্ত্রীদের উপর প্রভুত্ব করে চলতাম। যখন আমরা মদীনায় এলাম, তখন এমন লোকদের দেখতে পেলাম যাদের উপর তাদের স্ত্রীরা প্রভাব বিস্তার করছিল। এমনি পরিবেশে আমাদের নারীরা তাদের (মদীনাবাসীদের) নারীদের অভ্যাস রপ্ত করতে শুরু করে দেয়। তিনি বলেন, সে সময় মদীনার উচ্চভূমির অধিবাসী বনু উমাইয়াহ ইবনু যায়দের বংশধরদের মধ্যে আমার বসতবাটি ছিল। এরপর একদিন আমি আমার স্ত্রীর উপর রাগান্বিত হলাম। সে আমার কথার প্রত্যুত্তর করতে লাগল। আমি আমার সঙ্গে তার প্রত্যুত্তর করাকে খুবই অপ্রিয় মনে করলাম।
সে বলল, আপনার সঙ্গে আমার কথার প্রত্যুত্তর করাকে অপসন্দ করছেন কেন? আল্লাহর কসম নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তো তার সঙ্গে কথার প্রত্যুত্তর করে থাকে। এমনকি তাদের কেউ কেউ তাকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। তখন আমি রওয়ানা করে (আমার মেয়ে) হাফছার কাছে চলে এলাম। এরপর আমি তাকে বললাম, তুমি কি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর সঙ্গে প্রত্যুত্তর কর? সে বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, তোমাদের মধ্যে কি কেউ তাকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে? সে বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তোমাদের যে কেউ এরূপ আচরণ করে সে আসলেই দুর্ভাগা ও ক্ষতিগ্রস্ত তোমাদের মধ্যে কি কেউ বিপদমুক্ত ও নিরাপদ হতে পারে যদি আল্লাহ তাঁর রাসূলের ক্রোধের কারণে ক্রুদ্ধ হন। এরূপ হলে তো তার ধ্বংস অনিবার্য? তুমি কখনো রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে তার কথার প্রত্যুত্তরে লিপ্ত হয়ো না এবং তঁর কাছে কোন কিছু দাবী করবে না, তোমার মনে যা চায় তা আমার কাছে চাইবে। তোমার সতীন তোমার চাইতে অধিকতর সুন্দরী এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট তোমার তুলনায় অধিকতর প্রিয়পাত্রী। সে যেন তোমাকে ধোঁকায় পতিত না করে ফেলে। এর দ্বারা ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বুঝাতে চেয়েছেন।
তিনি বলেন, আমার একজন আনছারী প্রতিবেশী ছিলেন। আমরা দুই বন্ধু পালাক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে (তাঁর মজলিসে) যেতাম। একদিন তিনি উপস্থিত থাকতেন, অপরদিন আমি উপস্থিত হতাম। এভাবে তিনি আমাকে অহী ও অন্যান্য বিষয়ে খবর দিতেন, আমিও অনুরূপ খবর তাকে পৌঁছাতাম। সে সময় আমরা বেশ করে আলোচনা করছিলাম যে, গাস্সানী বাদশাহ নাকি আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ঘোড়ার ক্ষুরে নাল লাগাচ্ছে। একদিন আমার বন্ধু রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে গেলেন এবং এশার সময় (রাত্রিকালে) আমার কাছে (ফিরে) এলেন। তিনি এসে আমার ঘরের দরজা খটখটালেন এবং আমাকে ডাকলেন। আমি তাঁর ডাক শুনে তাঁর কাছে ছুটে এলাম। তিনি বললেন, একটা বিরাট কাণ্ড ঘটে গেছে। আমি বললাম, সে কী? গাস্সানীরা তাহলে এসে গেছে না-কি? তিনি বললেন, না, তারা আসেনি বরং ব্যাপার তার চাইতেও সাংঘাতিক ও দীর্ঘতর।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার সহধর্মিণীদের ত্বালাক্ব দিয়েছেন। তখন আমি বললাম, হাফছাহ হতাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি পূর্ব থেকেই ধারণা পোষণ করে আসছিলাম যে, এমন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এরপর আমি ফজরের ছালাত আদায় করে প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় পরিধান করলাম। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সরাসরি হাফছার কাছে উপস্থিত হলাম। তখন সে কাঁদছিল। আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি তোমাদেরকে ত্বালাক্ব দিয়েছেন? সে (শ্বাসরুদ্ধ করে) বলল, আমি জানি না। তবে তিনি তার ঐ বালাখানায় নির্জনবাস করছেন।
তখন আমি তার কৃষ্ণাঙ্গ খাদিমের কাছে বললাম, ওমরের (প্রবেশের) জন্য অনুমতি প্রার্থনা কর। এরপর সে ভিতরে প্রবেশ করল এবং পরক্ষণেই বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকাল। এরপর সে বলল, আমি তাঁর কাছে আপনার কথা উত্থাপন করেছি কিন্তু তিনি নীরব আছেন (কিছুই বলছেন না)। অতঃপর আমি চলে এলাম এবং মিম্বারের কাছে এসে বসে পড়লাম। তখন আমি দেখতে পেলাম সেখানে একদল লোক বসা আছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি খানিকটা বসলাম। এরপর আমার মনের প্রবল আকাক্সক্ষা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করল। তখন আমি সে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটির কাছে চলে এলাম এবং তাকে বললাম, ওমরের জন্য ভিতরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে এস। সে ভেতরে প্রবেশ করল এবং বেরিয়ে এসে আমাকে বলল, আমি আপনার বিষয়টি তার সামনে উত্থাপন করেছি কিন্তু তিনি নীরব আছেন।
আমি যখন পিছনে ফিরে চললাম অমনি সে কৃষ্ণাঙ্গ যুবকটি আমাকে ডাক দিয়ে বলল, আপনি প্রবেশ করুন; তিনি আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। আমি ভিতরে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম দিলাম। আমি দেখতে পেলাম, তিনি খেজুর পাতার তৈরি একটি চাটাইয়ের উপর হেলান দিয়ে আরাম করছেন, যা তার পাজরে চাটাইয়ের দাগ বসিয়ে দিয়েছে। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি কি আপনার সহধর্মিণীগণকে ত্বালাক্ব দিয়েছেন? তিনি তার মাথা উচিয়ে আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং বললেন, না। আমি বললাম, আল্লাহু আকবার। হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি বিষয়টি ভেবে দেখুন; আমরা যখন মদীনায় এলাম তখন দেখতে পেলাম, এখানকার পুরুষ লোকদের উপর তাদের স্ত্রীরা প্রভুত্ব বিস্তার করে আসছে।
এতে তাদের দেখাদেখি আমাদের স্ত্রীরাও তাদের অভ্যাস রপ্ত করতে শুরু করে দিয়েছে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর প্রতি রাগান্বিত হলাম। অমনি সে আমার কথার প্রত্যুত্তর শুরু করে দিল। আমি তার প্রত্যুত্তর করাকে খুবই খারাপ মনে করলাম। সে বলে ফেলল, আপনার সঙ্গে প্রত্যুত্তর করাকে আপনি এত খারাপ মনে করছেন কেন? আল্লাহর কসম! নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর স্ত্রীগণও তো তার কথার প্রত্যুত্তর করে থাকে, এমনকি তাদের কেউ কেউ তাকে সারা দিন রাত বিচ্ছিন্ন করে রাখে। আমি বললাম, তাদের মধ্যে কেউ এমন আচরণ করলে সে হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে থেকে কারো উপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাগান্বিত হওয়ার কারণে যদি আল্লাহ ক্রুদ্ধ হয়ে যান, তাহলে তার পতন ও ধ্বংস অনিবার্য।
তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃদু স্বরে হেসে উঠলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি হাফছার কাছে গিয়ে তাকে বলে দিয়েছি যে, তোমার সতীন সৌন্দর্যে তোমার তুলনায় অগ্রগামী এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর কাছে তোমার চেয়ে অধিকতর আদরিণী- তা যেন তোমাকে ধোঁকার জালে আবদ্ধ করতে না পারে। এতে আবার তিনি মুচকি হাসি দিলেন। অতঃপর তাকে হাসতে দেখে আমি সেখানে বসে পরলাম। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি আপনার সঙ্গে একান্তে আলাপ করতে চাই। তিনি বললেন, হ্যাঁ, করতে পার। অতঃপর আমি তাঁর সাথে কথা বলতে লাগলাম; এমনকি তাঁর চেহারা থেকে ক্রধের ভাব দূর হয়ে গেল। তিনি এমনভাবে হাসতে লাগলেন, যাতে তার দাঁত প্রকাশ পাচ্ছিল। আর মানুষদের মাঝে তিনি ছিলেন উত্তম চেহারার অধিকারী। অতঃপর আমি বসলাম এবং মাথা উঠিয়ে তার কোঠার (এদিক ওদিক) তাকিয়ে দেখলাম। আল্লাহর কসম! আমি সেখানে তিনটি চামড়া ব্যতীত নয়ন জুড়ানো তেমন কিছু দেখতে পাইনি।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন যেন তিনি আপনার উম্মতকে প্রাচুর্য দান করেন। পারসিক ও রোমকদের তো বৈষয়িক সুখ-সমৃদ্ধ দান করা হয়েছে অথচ তারা আল্লাহর ইবাদত (আনুগত্য) করে না। তখন তিনি সোজা হয়ে বসলেন এবং বললেন, হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি সন্দেহের জালে আচ্ছন্ন আছ? আসলে তারা তো এমন সম্প্রদায় যাদের পার্থিব জীবনে ক্ষণিকের তরে সুখ-সমৃদ্ধি দান করা হয়েছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
তিনি তার সহধর্মিণীগণের আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে কসম করেছিলেন যে, দীর্ঘ একমাস তাদের সঙ্গে একত্রে অতিবাহিত করবেন না। শেষাবধি আল্লাহ তাকে এ আচরণের জন্য তিরষ্কার করেন।[১]
আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের সাথে ঈলা করলেন। এ সময় তাঁর পা মচকে গিয়েছিল। তখন তিনি উপরের কামরায় ঊনত্রিশ রাত অবস্থান করেন। এরপর তিনি নেমে আসলে ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি তো এক মাসের জন্য ঈলা করেছিলেন। তিনি বললেন, মাস ঊনত্রিশ দিনেও হয়ে থাকে।[২]
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে (آلَى) -এর অর্থ হল, ‘তিনি এমর্মে শপথ করেছেন যে, স্ত্রীদের নিকটে একমাস যাবৎ প্রবেশ করবেন না’। এটি ফিকহী পরিভাষায় প্রচলিত ঈলার বিধানের মধ্যে পরে না এবং এক্ষেত্রে ঈলার হুকুমও প্রযোজ্য হবে না। শাব্দিক অর্থে ঈলা হল, ‘কোন বিষয়ে শপথ করা’। কিন্তু এটি ফিক্বহী পরিভাষায় স্ত্রীর সাথে সহবাস থেকে বিরত থাকার শপথ করাকে বুঝায়।[৩]
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক স্ত্রীদের থেকে পৃথক হওয়ার ঘটনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল- পৃথক হওয়ার নীতি বৈবাহিক সমস্যা সমাধানের অন্যতম একটি পদ্ধতি।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এই নীতিটি প্রয়োগ করেছিলেন। যেমন তিনি প্রচণ্ড ক্রোধের কারণে স্ত্রীদের নিকটে একমাস যাবৎ গমন করবেন না মর্মে শপথ করেছিলেন। কেননা কাউকে পরিত্যাগ করা অর্থা হল, তাকে পরিপূর্ণ মানসিক শাস্তি দেয়া। এটি স্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি। এই পৃথক করে দেয়া বিছানা থেকে পৃথক করে দেয়ার মাধ্যমে হতে পারে, যা সবচেয়ে বড় শাস্তি; অথবা বাড়ির বাইরে অবস্থান করার মাধ্যমে হতে পারে। স্ত্রীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে ত্যাগ করে বাড়ির বাইরে অবস্থান করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
হাদীছের শিক্ষা
১). স্বামীর অনুমতি ছাড়াই পিতা-মাতা কন্যার নিকটে গমন করতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে পারে, বিশেষত কন্যার বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে।
২). কথার মাধ্যমে অভিভাবক তার কন্যা ও ঘনিষ্টজনকে স্বামীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আদব শিক্ষা দিতে পারে।
৩). স্ত্রীদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা, তাদের (অন্যায়) সম্বোধনকে উপেক্ষা করে চলা এবং আল্লাহর হক্ব ব্যতীত বান্দার হক্বের ব্যাপারে তাদের অন্যায়কে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা।
৪). নারীদের উপর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ নিন্দনীয়। কেননা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের মধ্যে নিজের কওমের জীবনাদর্শ ছেড়ে আনছারীদের জীবনাদর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
৫). কারো কাছে অনুমতি গ্রহণ করে প্রবেশ করা শরী‘আত নির্দেশিত, যদিও সে একা হয়; অন্যথা তাকে অপসন্দনীয় অবস্থায় দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৬). যখন কোন ব্যক্তি তার সঙ্গিনীকে বিষণ্ণ অবস্থায় দেখবে তখন তার জন্য মুস্তাহাব হল- তার সাথে এমন কথা বলা যা তার থেকে বিষণ্ণতাকে দূর করে দেয়। তার অন্তরকে শান্ত করে। যেমন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন, ‘অবশ্যই আমি এমন কথা বলব, যা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হাসিয়ে ছাড়বে’।[৪]
ছেলে-মেয়েদের সাথে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আচরণ
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর পরিবারের কাছে সর্বোত্তম লোক ছিলেন, পরিবারের সাথে ছিল তাঁর সুসম্পর্কের গভীর বন্ধন। ছেলে-মেয়েদেরকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উত্তমভাবে লালনপালন ও পরিবারের সাথে সুন্দর আচরণ থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে লাভ করেছিলেন
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তিনজন পুত্র সন্তান ছিল; কাসিম, আব্দুল্লাহ ও ইবরাহীম। তাইয়িব ও তাহির নামে আরো দু’জনের নাম পাওয়া যায়। তবে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, এদু’টি আব্দুল্লাহর উপনাম ছিল।[৫] পুত্র সন্তানদের সবাই শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে।
কাসিম : মক্কায় মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল দু’বছর এক মাস। এই নামেই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুনিয়াত লাভ করেন। কাসিমের মা ছিলেন খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) ।
আব্দুল্লাহ : নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়ত লাভের পর জন্মগ্রহণ করে। সে মক্কায় মৃত্যুবরণ করে। সেও খাদিজা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর গর্ভে জন্মলাভ করেছিল।
ইবরাহীম : তার মা ছিল মারিয়া ক্বিবতিয়া। সে ৮ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসে মদীনায় জন্মগ্রহণ করে এবং ১০ম হিজরীতে মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুকালে তার সাত মাস অথবা আট মাস বয়স হয়েছিল।
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাগণ
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা চারজন কন্যা সন্তান দান করেছিলেন। তারা হল- যয়নব, রুক্বাইয়াহ, উম্মে কুলছূম ও ফাতেমা। এরা সকলেই একই মা খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদের (রাযিয়াল্লাহু আনহা) গর্ভ থেকে জন্মলাভ করে।
যয়নব (রাযিয়াল্লাহু আনহা) : সে ছিল নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাদের মধ্যে প্রথমা। তাকে আবুল ‘আছ ইবনু রাবী‘ বিবাহ করেন।
রুক্বাইয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) : সে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাদের মধ্যে দ্বিতীয়া। ইসলামের পূর্ব যুগে তাকে ওতবাহ ইবনু আবী লাহাব বিয়ে করে। (ইসলামের যুগে এসে) সে তাকে ত্বালাক্ব দেয়। এরপর তাকে ওছমান ইবনু ‘আফ্ফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিবাহ করেন এবং তার সাথে হাবশার ভূমিতে হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বদর যুদ্ধের প্রস্তুতিকালে যয়নব অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ওছমান ইবনু ‘আফ্ফান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে রেখে যান। অতঃপর রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদরের প্রান্তরে অবস্থানকালে সে মৃত্যুবরণ করে।
উম্মে কুলছূম (রাযিয়াল্লাহু আনহা) : সে ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাদের মধ্যে তৃতীয়া। ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাকে রুক্বাইয়্যাহর মৃত্যুর পর বিবাহ করেন এবং সে তার কাছে থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) : সে ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সর্বকনিষ্ঠ ও সর্বাধিক আদরের কন্যা। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একচল্লিশ বছর বয়সকালে সে জন্মগ্রহণ করে এবং তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পর মৃত্যুবরণ করে। তাকে আলী ইবনু আবী তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বিবাহ করেন।
সকল সন্তানের জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তম নাম চয়ন করেছিলেন
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সন্তান-সন্ততির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাদের সকলের সুন্দর সুন্দর নাম ছিল। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্দর নাম রাখার প্রতি উৎসাহ দিতেন এবং মন্দ নাম পরিবর্তন করে দিতেন। সুফইয়ান ছাওরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘পিতার উপর সন্তানের হক্ব হল- তিনি সন্তানের উত্তম নাম রাখবেন, প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বিবাহ দিবেন, তাকে হজ্জ করাবেন এবং তাকে উত্তম আদব শিক্ষা দিবেন’।[৬]
নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জন্মের দিনেই স্বীয় পুত্র ইবরাহীমের নাম রেখেছিলেন
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وُلِدَ لِي اللَّيْلَةَ غُلَامٌ فَسَمَّيْتُهُ بِاسْمِ أَبِيْ إِبْرَاهِيْمَ.
আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, রাত্রে আমার একটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, আমি তার নাম আমার পিতা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর নামে রাখি।[৭]
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৪৬৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭৯।
[২]. ছহীহ বুখারী, হা/১৯১১।
[৩]. ইমাম নববী, শরহে ছহীহ মুসলিম, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৮৮।
[৪]. ইবনু হাজার, ফাৎহুল বারী, ৯ম খণ্ড, পৃ. ২৯১।
[৫]. ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘দ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০১।
[৬]. ইবনে আবিদ দুনিয়া, কিতাবুল ঈয়াল, পৃ. ১৭১।
[৭]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৩১৫।