শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৩ পূর্বাহ্ন

রাসূলুল্লাহ  (ﷺ)-এর পারিবারিক জীবন

-আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ*


(১৩তম কিস্তি)

ছেলে-মেয়েদের সাথে নবী করীম করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আচরণবিধি

নবী করীম করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চারজন কন্যা সন্তান লাভ করেছিলেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে কন্যারাই কেবল বেঁচে ছিল। পুত্র সন্তানের সবাই শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে। নবী করীম করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের প্রতি উদার ছিলেন, তাদেরকে প্রচণ্ড স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। এতে অধিক কন্যা সন্তান লাভকারী পিতার জন্য শিক্ষা রয়েছে। তার জন্য যরূরী হল, অধিক সন্তান লাভের কারণে আনন্দিত হওয়া, মহান আল্লাহ যে কন্যা সন্তান দান করেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করা এবং তাদেরকে উত্তমভাবে লালন-পালন ও শিষ্টাচার শিখানোর ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنِ ابْتُلِيَ مِنَ الْبَنَاتِ بِشَيْءٍ فَأَحْسَنَ إِلَيْهِنَّ كُنَّ لَهُ سِتْرًا مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি কন্যা সন্তান লালন-পালনের পরীক্ষায় নিপতিত হয় আর তাদের সঙ্গে সে সদাচরণ করে, তার জন্য এরা জাহান্নামের পর্দা হবে’।[১] এখানে (الابتلاء)-এর অর্থ হল, পরীক্ষা করা। অর্থাৎ ‘যাকে কন্যা সন্তান দান করার মাধ্যমে পরীক্ষা করা হবে; যাতে লক্ষ্য করা হয় যে, সে কী করছে, সে তাদের সাথে ভালো আচরণ করছে, না-কি খারাপ আচরণ করছে? যে ব্যক্তি তাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে, তারা ক্বিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তির জন্য জাহান্নাম থেকে অন্তরায় হবে। অর্থাৎ আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে কন্যাদের সাথে ভালো আচরণের প্রতিদান হিসাবে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবেন; কেননা কন্যা সন্তান দুর্বল, সে অতিরিক্ত আদর যত্নের দাবী রাখে।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সকল কন্যাকে উত্তম ব্যক্তির সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যয়নবকে আবুল ‘আছ ইবনু রাবী‘ আল-কুরাশীর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন, যে ছিল তার খালা হালা বিনতে খুয়াইলিদের পুত্র। মাল সম্পদ, আমানতদারিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মক্কার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল। ইসলামের কারণে যয়নব বিনতে রাসূলিল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও আবুল ‘আছ ইবনে রাবী‘-এর মাঝে বিচ্ছিন্নতা ঘটে। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ বিচ্ছিন্নতা চাননি বলে কন্যা ইসলামের উপর এবং জামাতা শিরকের উপর থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে বিবাহ ঠিক রেখেছিলেন। একারণে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় হিজরত করলেও কন্যা তার স্বামীর সাথে মক্কায় থেকে যায়, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হননি। অতঃপর যখন কুরাইশরা বদরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তখন তাতে আবুল ‘আছ ইবনে রাবী‘ও শরীক হয় এবং তাকে বন্দী করা হয়।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিবাহ দেয়ার ক্ষেত্রে কন্যাদের সাথে পরামর্শ করতেন

‘আত্বা ইবনু আবি রিবাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফাতেমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমার নিকটে গমন করে বললেন, ‘আলী তোমাকে স্মরণ করেছে’। ফাতেমা চুপ করে রইলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বের হলেন এবং তাকে বিবাহ দিলেন।[২]

এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় কন্যা ফাতেমার চুপ থাকাকে বিবাহের প্রতি তার সম্মতির লক্ষণ হিসাবে গ্রহণ করলেন। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘কুমারী নারীকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ে দিতে পারবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কেমন করে তার অনুমতি নেয়া হবে। তিনি বললেন, তার চুপ থাকাটাই হচ্ছে তার অনুমতি’।[৩] কন্যা তার পিতার ঘরে আমানত স্বরূপ। কোন অভিভাবকের জন্য বৈধ নয় যে, সে এমন কোন পুরুষের সাথে তাকে বিবাহ দিবে যাকে সে পসন্দ করে না।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের মাত্রাতিরিক্ত মোহরানা নির্ধারণ করতেন না

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব অল্প মোহর নির্ধারণ করে তাঁর কন্যাদের বিবাহ দিয়েছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, আমি ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে বিবাহ করার পর বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। তিনি বললেন, তাকে কিছু দাও। আমি বললাম, আমার কাছে কিছু নেই। তিনি বললেন, তোমার হাতমী লৌহ বর্মটি কোথায়? আমি বললাম, তা আমার নিকট রয়েছে। তিনি বললেন, তাঁকে তাই দাও।[৪]

এই ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সর্বকনিষ্ঠা কন্যা ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর বিবাহের মোহরানা, যিনি জান্নাতে নারীদের সর্দার হবেন; শুধু একটি হাতমী লৌহ বর্ম। এখানে (الحطمية) দ্বারা আব্দুল কায়েস গোত্রের দিকে সম্বোধন করা হয়েছে, যাদেরকে হাতমাহ ইবনু মুহারিব বলা হত, যারা বর্ম তৈরির কাজ করত। কারো মতে, হাতামিয়্যাহ হল, যা তরবারীকে টুকরা টুকরা করে ফেলে অর্থাৎ ভেঙ্গে ফেলে।[৫]

আজকের যুগে কিছু মানুষ অতিরিক্ত মোহরানা নির্ধারণ নিয়ে যে বাড়াবাড়ি করে তা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পথ নয়। যদি নারীর জন্য মাত্রাতিরিক্ত মোহরানা নির্ধারণ গৌরবের বিষয় হত, সেক্ষেত্রে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেশি অগ্রগামী হতেন।

কন্যার জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাজ-সরঞ্জাম প্রদান

আলী ইবনু আবি তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাকে ফাতেমার সাথে বিবাহ দিলেন; তখন তাঁর সাথে একটি গালিচা, খেজুরের ছালে পরিপূর্ণ চামড়ার বালিশ, দু’টি জাঁতাকল, একটি মশক ও দু’টি (বাটখারার) পাল্লা পাঠিয়েছিলেন।[৬] এখানে (الخميلة) অর্থ হল, মখমল বা গালিচা। এটি প্রত্যেক ঐ কাপড়কে বলা হয়, যাতে যেকোন ধরণের গালিচা থাকে।[৭]

হাদীছের শিক্ষা

বিবাহের কাজে সহজতাকে পসন্দ করা; যাতে সবাই বিবাহ করতে সক্ষম হয়। এর কারণে স্বামী বা স্ত্রীর কেউ যেন তাদের সাধ্যের বাইরে বৈবাহিক জীবন সাজাতে গিয়ে কষ্টে না পড়ে। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবদম্পতি আলী ও ফাতেমার জন্য আয়েশা ছিদ্দীক্বা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর বাড়ির পিছনে জিবরীল দরজার সামনা-সামনি বাম দিকে একটি ঘর নির্মাণ করেছিলেন, যাতে ছোট একটি দরজা ছিল যা দিয়ে তিনি তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখতেন। হাদীছের আরো শিক্ষা হল, নববধুর পিতার জন্য উচিত হবে বৈবাহিক খরচে অংশীদার হওয়া। তিনি একথা বলবেন না যে, সব খরচ স্বামীর উপর। বর্তমানকালের অধিকাংশ স্বামী সদ্য পড়াশোনা শেষ করা যুবক, নতুন চাকুরীজীবী, বেতন অতি সামান্য। পিতা অধিকাংশ সময় অবসরপ্রাপ্ত চাকুরীজীবী অথবা অতি সামান্য ব্যবসায়ী ইত্যাদি। (এমন পরিস্থিতিতে) পিতার জন্য তার কন্যার জামাইকে সহযোগিতা করা যরূরী, যদিও তা আসবাব পত্র বা রান্না-বান্নার সরঞ্জাম দিয়ে হয়; যেমনটা আমরা আলোচ্য হাদীছে লক্ষ্য করলাম।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাদের বিবাহের ওয়ালীমাও ছিল অতি সামান্য

বুরায়দাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফাতেমাকে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘অবশ্যই নববধুর জন্য ওয়ালীমা হতে হবে’। অতঃপর সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমার কাছে একটি মেষ আছে। অন্যজন বললেন, আমার কাছে ভুট্টার উমুক উমুক বস্তু আছে।[৮]

ওয়ালীমা হল এমন খাবার যা বিবাহের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শব্দটি (ولم) থেকে উদ্গত হয়েছে, শব্দটি বহুবচন; কেননা এখানে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে শামিল।[৯] জমহূর আলেমের মতে, ওয়ালীমা করা মুস্তাহাব।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাহর অনুসরণে বিবাহের ওয়ালীমা সহবাসের পরে হওয়া উত্তম। তবে সহবাস হওয়ার পূর্বে অথবা বিবাহের সময় কিংবা আরো পরে ওয়ালীমা করাতেও কোন সমস্যা নেই। এ বিষয়টি নিয়ে শরী‘আতে প্রশস্ততা রয়েছে, এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকার প্রচলিত রীতি অনুসরণ করাই অধিক উত্তম; যেহেতু এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে নির্দিষ্ট সময়ে (ওয়ালীমা) আদায়ের ক্ষেত্রে এমন কোন দলীল পাওয়া যায় না যা একে ওয়াজিব বা মুস্তাহাব করতে পারে।

বিবাহের সময়ে ফাতেমা ও আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর জন্য নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দু‘আ

অতঃপর যখন বাসর রাত আসল। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)- কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার সাথে সাক্ষাৎ না করে কিছু করো না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পানি আনতে বললেন, তা দ্বারা ওযূ করলেন। এরপর বাকী পানি আলীর উপর ছিটিয়ে দিলেন এবং বললেন, (اَللّٰهُمَّ بَارِكْ فِيْهِمَا وَبَارِكْ لَهُمَا فِيْ بِنَائِهِمَا) ‘হে আল্লাহ! তাদের উভয়েরই মাঝে বরকত দাও, তাদের জন্য বাসরে বরকত দাও’।[১০]

অন্য হাদীছে এসেছে, স্বামী স্ত্রীর জন্য বরকতের দু‘আ করা মুস্তাহাব। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুর রহমান ইবনু আওফের জন্য দু‘আ করে বলেছিলেন, (بَارَكَ اللهُ لَكَ) ‘আল্লাহ তোমার এ বিবাহে বরকত দান করুন’।[১১]

বিবাহের পরেও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক কন্যাদের খোঁজ-খবর রাখা

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যাদের যত্ন নেয়া বিবাহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না, বিবাহের পরেও তাদের খোঁজ খবর নেয়া অব্যাহত ছিল। কোন ব্যস্ততাই তাঁকে (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের খোঁজ খবর নেয়া থেকে বিমুখ করতে পারত না। এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও তাদের নিয়ে চিন্তা করতেন। যখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরাইশ ও তাদের নেতাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য বদরের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার ইচ্ছা করলেন, তখন রুকাইয়্যাহ অসুস্থ ছিল। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যার জামাই ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখলেন, যাতে সে মদীনায় থেকে স্ত্রীর সেবা-শুশ্রুষা করতে পারে। বদর যুদ্ধের গণীমতে তার ভাগ রাখা হয়েছিল এবং ক্বিয়ামতের দিন তিনি এর (যুদ্ধে অংশগ্রহণের) প্রতিদানও পাবেন।

বদরের যুদ্ধে ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর অনুুপস্থিত থাকাকে যারা কটাক্ষ করে, তাদের উদ্দেশ্যে ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বদর যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন; কেননা আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কন্যা ছিলেন তাঁর স্ত্রী আর তিনি ছিলেন পীড়িত। তখন নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, ‘বদর যুদ্ধে যোগদানকারীর সমপরিমাণ ছওয়াব ও (গণীমাতের) অংশ তুমি পাবে।[১২]

কন্যা-জামাইয়ের সামান্য মনমালিন্যের মধ্যে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হস্তক্ষেপ করতেন না

সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর গৃহে এলেন, কিন্তু আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ঘরে পেলেন না। তিনি ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার চাচাত ভাই কোথায়? তিনি বললেন, আমার ও তাঁর মধ্যে বাদানুবাদ হওয়ায় তিনি আমার সাথে রাগ করে বাইরে চলে গেছেন। আমার নিকট দুপুরের বিশ্রামও করেননি। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে বললেন, দেখ তো সে কোথায়? সে ব্যক্তি খুঁজে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তিনি মসজিদে শুয়ে আছেন। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এলেন, তখন আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। তাঁর শরীরের এক পাশের চাদর পড়ে গিয়েছে এবং তাঁর শরীরে মাটি লেগেছে। আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর শরীরের মাটি ঝেড়ে দিতে দিতে বললেন, উঠ, হে আবূ তুরাব! উঠ, হে আবূ তুরাব! [১৩]

ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই হাদীছের শিক্ষাগুলোর মধ্যে একটি হল, ... জামাইয়ের সাথে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোমল আচরণ করা এবং তার ক্রোধকে প্রশমিত করার চেষ্টা করা।[১৪]

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় মেয়ে ফাতিমার কাছে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পরস্পর দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যা জানতে চাননি, তার কাছে এমন কোন বর্ণনাও শুনতে চাননি যা থেকে তাদের মধ্যকার ক্রোধের কারণ জানা যাবে বরং তিনি পুরো বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের সমস্যার মধ্যে পরিবার হস্তক্ষেপ করে বিষয়টিকে আরো জটিল করে তোলে। আরো লক্ষণীয় যে, এখান থেকে নবী করীম চরিত্রের মহত্ত্ব ফুটে উঠে; কেননা তিনি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকটে গমন করে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন, তার শরীর থেকে মাটি ঝেড়ে দেয়ার মাধ্যমে তাকে খুশী করার চেষ্টা করেছেন এবং তাকে রসিকতামাখা উক্ত (আবূ তুরাব) উপাধী দ্বারা সম্বোধন করেছেন, যাতে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে স্বীয় মেয়ের উচ্চ মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও তিনি জামাইকে মেয়ের উপরে রাগ করার কারণে দোষারোপ করেননি, এমনকি আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে দ্বিতীয়বার এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাটুকুও করেননি, যা ছিল তাঁর হিকমাহ বা কৌশল।

এখান থেকে শিক্ষা হল, জামাইদের সাথে কোমল আচরণ করা, তাদের পরস্পর রাগ প্রশমিত করা এবং তাদের মাঝে পরস্পর হৃদ্যতা বজায় রাখার জন্য তাদেরকে দোষারোপ করা ছেড়ে দেয়া মুস্তাহাব।

ইবনু বাত্তাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি রাগের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমস্যা হলে সম্মানিত লোকেরা কাউকে দোষারোপ না করে বাড়ির বাইরে চলে যান। খুব সম্ভব আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাগের অবস্থায় বাড়ির বাইরে গিয়েছিলেন এই ভয়ে যে, এমন পরিস্থিতিতে তাঁর দ্বারা এমন কাজ সংঘটিত হতে পারে যা ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মত ঘনিষ্টজনের মর্যাদার সাথে যায় না। এজন্য তিনি বিষয়টি এমনভাবে সমাপ্তি টানলেন, যাতে উভয়ের থেকে রাগের উত্তেজনা দূর হয়ে যায়।[১৫]

এই হাদীছের আরো শিক্ষা হল, বাদানুবাদের তীব্রতা বুঝে স্বামীর জন্য বাড়ি ত্যাগ করা উত্তম, কারণ এক সাথে অবস্থানের কারণে কখনো কখনো পারিবারিক সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পারে। যেমন এমন পরিস্থিতিতে বাড়ি ত্যাগ করার কারণে স্বামীর ভুল থেকে আত্ম উপলব্ধি ঘটতে পারে, যা উভয়ের এক সাথে অবস্থানের দ্বারা সম্ভব হতো না।

(রাগের অবস্থায়) ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) স্বামীর বাড়ি থেকে বের না হয়ে সেখানেই অবস্থান করছিলেন, যা সমস্যার সমাধানকে সহজ করে দিয়েছিল; যা পিতার বাড়িতে চলে গেলে সম্ভব হতো না।

পরিবারের উপর আবশ্যক হল, স্বামী-স্ত্রীকে দিক-নির্দেশনা দেয়া, উপদেশ দেয়া, স্ত্রীকে স্বামীর আচরণে ধৈর্যধারণ করা ও স্বামীর সাথে উত্তম আচরণ করার ব্যাপারে উপদেশ দানে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখা।

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন এক কন্যা তাকে দেখতে আসলে তিনি তাকে সুন্দরভাবে অভ্যর্থনা ও সম্মান জানান

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উঠা-বসা, আচার-অভ্যাস ও চালচলনের সাথে তার কন্যা ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর অপেক্ষা বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ আমি আর কাউকে দেখিনি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আরও বলেন, ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) যখনই নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট আসতেন তিনি তখনই তার নিকট উঠে যেতেন, তাকে চুমু দিতেন এবং নিজের স্থানে বসাতেন। আর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার ঘরে গেলে তিনিও নিজের জায়গা হতে উঠে তাকে (পিতাকে) চুমা দিতেন এবং নিজের জায়গায় বসাতেন।[১৬]

আবূ দাউদের বর্ণনায় এসেছে, فَأَخَذَ بِيَدِهَا وَقَبَّلَهَا ‘অতঃপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার হাত ধরে চুমু খেতেন’।[১৭] এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমার সম্মানার্থে তার হাত ধরেছিলেন।

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চলার ভঙ্গিতে চলতে চলতে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আমাদের নিকট আগমন করলেন। তাঁকে দেখে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমার স্নেহের কন্যাকে মোবারকবাদ। অতঃপর তাঁকে তার ডানপাশে অথবা বামপাশে বসালেন।[১৮]

এই হাদীছ থেকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর মর্যাদা ও গভীর মমত্ববোধের কথা ফুটে উঠে এবং ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সাথে দেখা হলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভ্যার্থনা জানানোর বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

(সুধী পাঠক!) এই নির্মল অনুভূতির ব্যাপারে কঠোর হৃদয়ের লোকগুলো কি বলবেন? যারা ধারণা করে যে, সন্তান-সন্ততি লালন-পালনের ক্ষেত্রে, বিশেষত কন্যাদের সাথে কঠোরতারোপ ও তাদের সাথে গোমড়া মুখে কথা বলা পুরুষত্বের পরিচায়ক?!

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদেরকে দুনিয়াতে অল্পে তুষ্টি হওয়া ও ছাদাক্বাহ প্রদানের প্রতি উৎসাহ দিতেন

আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট এসে দরজায় পর্দা ঝুলানো দেখতে পেয়ে তিনি ভিতরে ঢুকলেন না। বর্ণনাকারী বলেন, অধিকাংশ সময় তিনি ভিতরে ঢুকেই সর্বপ্রথম ফাতিমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। এ সময় আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এসে ফাতিমাকে চিন্তিত দেখে বললেন, তোমার কী হয়েছে? তিনি বললেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার নিকট আসতে চেয়েও আসেননি। অতঃপর আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর নিকট গিয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি ফাতিমার নিকট গিয়েও প্রবেশ না করায় এটা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, দুনিয়াদারী ও চাকচিক্যতার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, আমি তার দরজায় (প্রাণীর) চিত্রাঙ্কন করা পর্দা ঝুলানো দেখতে পেয়েছি। একথা শুনে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বক্তব্য বর্ণনা করলেন। ফাতেমা বললেন, আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলুন, তিনি আমাকে এটাকে কি করতে আদেশ দেন? (আলীর বর্ণনা শুনে) তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তাকে (ফাতিমাকে) বল, তা (পর্দাটি) যেন অমুক গোত্রে পাঠিয়ে দেয়, যাদের এতে প্রয়োজন রয়েছে।[১৯]

মুলহিব (রাহিমাহুল্লাহ) ও অন্যান্য বিদ্বান বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুনিয়াবী কল্যাণ লাভে তাড়াহুড়া করাকে যেভাবে নিজের জন্য অপসন্দ করতেন, তাঁর মেয়ের জন্যও সেভাবেই অপসন্দ করতেন, যা শুধু দরজায় (ছবিযুক্ত) পর্দা টাঙ্গানোকে হারাম বলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর দৃষ্টান্ত হল, যখন ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে কাজের লোক চেয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম কিছুর কথা বলে দিব না? অতঃপর তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতিমাকে ঘুমের সময়ে পঠিতব্য কিছু যিকির শিখিয়ে দিলেন।[২০]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কন্যাদের দুনিয়াবী ও পরকালীন বিষয়ে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতেন

আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, একবার গম পেষার যাঁতা ঘুরানোর কারণে ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর হাতে ফোস্কা পড়ে গেল। তখন তিনি একটি খাদিম চেয়ে নেয়ার উদ্দেশে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এলেন। কিন্তু তিনি তাঁকে পেলেন না। তখন তিনি আসার উদ্দেশ্যটি আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট ব্যক্ত করে গেলেন। এরপর তিনি যখন গৃহে ফিরলেন তখন আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) এ বিষয়টি তাঁকে জানালেন। তারপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের কাছে এমন সময় আগমন করলেন যখন আমরা বিছানায় বিশ্রাম গ্রহণ করছি। তখন আমি উঠতে চাইলে তিনি বললেন, নিজ স্থানেই অবস্থান কর। তারপর আমাদের মাঝখানেই তিনি এমনিভাবে বসে গেলেন যে, আমি তার দু’ পায়ের শীতল স্পর্শ আমার বুকে অনুভব করলাম। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল বলে দেব না, যা তোমাদের জন্য একটি খাদিমের চেয়েও অনেক অধিক উত্তম। যখন তোমরা শয্যা গ্রহণ করতে যাবে, তখন তোমরা আল্লাহু আকবার ৩৪ বার, সুবহানাল্লাহ ৩৩ বার, আলহামদু লিল্লাহ ৩৩ বার পড়বে। এটা তোমাদের জন্য একটি খাদিমের চেয়েও অনেক অধিক কল্যাণকর।[২১]

মেয়ে-জামাইকে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর খাদেম না দেয়ার কারণ হল, তিনি আহলে ছুফফাহর অসহায় দরিদ্রদের সহযোগিতা করার ইচ্ছা করেছিলেন এবং নিজের পরিবারের মধ্যে ধৈর্যধারণ দেখতে চেয়েছিলেন, যাতে তাদের জন্য অধিক ছওয়াব রয়েছে।

হাদীছের শিক্ষা : এতে জামাই ও কন্যার প্রতি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গভীর স্নেহ ও মমত্ববোধের  প্রকাশ এবং তাদের সাথে দূরত্ব ভেঙ্গে একান্তে সাক্ষাতের দ্বারা অটুট বন্ধনের প্রকাশ ঘটেছে, যে কারণে তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে স্বস্থান থেকে উঠানোর মাধ্যমে কষ্টে ফেললেন না, বরং তাদেরকে শয়ন অবস্থায় থাকার নির্দেশ দিলেন। তিনি জামাই-মেয়ের মাঝে তার পা-কে ঢুকিয়ে বসলেন। তিনি (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের খাদেম চাওয়ার প্রেক্ষিতে তাদেরকে শিখিয়ে দিলেন তাদের এমন পরিস্থিতিতে খাদেমের চেয়ে কোন যিকির পাঠ উত্তম। এটি ছিল ‘উপস্থিত ব্যক্তির দাবীর বিপরীতে অন্য কিছু প্রদান করা’ মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত, যা নির্দেশ করে যে, তলবকৃত বস্তুর চেয়ে পরকালের পাথেয় অর্জন করা, দুনিয়াবী কষ্টের উপর ধৈর্যধারণ করা ও প্রবঞ্চনার ঘর থেকে দূরে থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।[২২]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-কে একটি দু‘আ শিখিয়ে দিলেন যা তিনি খাদেমের পরিবর্তে পাঠ করবেন।

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে একজন খাদিমের জন্য আবেদন করলেন। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি বল,

اَللّٰهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ وَرَبَّ الأَرْضِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَىْءٍ فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى وَمُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيْلِ وَالْفُرْقَانِ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَىْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ اَللّٰهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَىْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُوْنَكَ شَىْءٌ اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ 

‘হে আল্লাহ! আপনি আকাশমণ্ডলী, যমীন ও মহান আরশের রব। আমাদের রব ও সব কিছুর পালনকর্তা। আপনি শস্য ও বীজের সৃষ্টিকর্তা, আপনি তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনের অবতীর্ণকারী। আমি আপনার নিকট সকল বিষয়ের খারাবী হতে আশ্রয় চাই। আপনিই একমাত্র সব বিষয়ের পরিচর্যাকারী। হে আল্লাহ! আপনিই শুরু, আপনার আগে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই এবং আপনিই শেষ, আপনার পরে কোন কিছু নেই। আপনিই প্রকাশ, আপনার ঊর্ধ্বে কেউ নেই। আপনিই বাতিন, আপনার অগোচরে কিছু নেই। আমাদের ঋণকে আদায় করে দিন এবং অভাব থেকে আমাদেরকে সচ্ছলতা দিন’।[২৩]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


* এম.ফিল গবেষক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৯৯৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৬২৯।
[২]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাক্বাত, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২০; মুরসাল, সনদ ছহীহ।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১৩৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪১৯।
[৪]. আবূ দাউদ, হা/২১২৫; নাসাঈ, হা/৩৩৭৫, সনদ ছহীহ।
[৫]. আন-নিহায়া, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৯৪।
[৬]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮২১, সনদ ছহীহ; ছহীহ আত-তারগীব, হা/৩৩০১।
[৭]. আন-নিহায়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৫৩।
[৮]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২২৫২৬, সনদ হাসান; আদাবুয যিফাফ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৩।
[৯]. লিসানুল আরাব, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৬৪৩।
[১০]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/১১৫৩, সনদ হাসান; আদাবুয যিফাফ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১০১।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৫১৫৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪২৭, হাদীছটি আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত।
[১২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৩০।
[১৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪০৯; আবূ তুরাব ছিল আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উপাধী।
[১৪]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩৬।
[১৫]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১০ম খণ্ড, পৃ. ৫৮৮।
[১৬]. তিরমিযী, হা/৩৮৭২, সনদ ছহীহ।
[১৭]. আবূ দাউদ, হা/৫২১৭, সনদ ছহীহ।
[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৬২৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৫০।
[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/২৬১৩; আবূ দাউদ, হা/৪১৪৯।
[২০]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২২৯।
[২১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৩১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭২৭।
[২২]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১২৪।
[২৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭১৩; আবূ দাঊদ, হা/৫০৫১; তিরমিযী, হা/৩৪৮১; ইবনু মাজাহ, হা/৩৮৭৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: জীবন কথা নবী-রাসূল
নববী আদর্শ (১৮তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১২তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৭ম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৮ম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৫তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৩তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৯তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২য় পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (২০তম পর্ব) - আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (৪র্থ পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ
নববী আদর্শ (১৪তম পর্ব) - অনুবাদ : আব্দুল্লাহ বিন খোরশেদ

ফেসবুক পেজ