ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক
-তানযীল আহমাদ*
ভূমিকা
১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। সারা বিশ্বের মযলুম শ্রমিকরা এদিনে সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, প্রতিবাদ সভা ও র্যালি বের করাসহ নানান কর্মসূচি পালন করে থাকে। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক নেতারাও সে সকল সভা-সমিতিতে জোরপূর্বক প্রবেশ করে অশিক্ষিত শ্রমিকদের করতালির আশায় তাদের পক্ষে গলা উঁচিয়ে, বুক ফুলিয়ে, হস্তদ্বয়ের বিভিন্ন প্রকার ভঙ্গিমাসহ তেজস্বী বক্তৃতামালা পেশ করে থাকে। তাদের সে সকল বক্তৃতার চুম্বুকাংশ নোট করে আমাদের অতি আপনজন সাংবাদিক ভাইয়েরা খবরের কাগজে ছাপানোর মত মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। পরেরদিন প্রভাতে খবরের কাগজে এসব অগ্নিঝরা বক্তব্য পাঠ করেই মালিকপক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ সার্বিক সুযোগ-সুবিধার নানবিধ আশ্বাসের বাণী তুলনামূলক কোমল কন্ঠে উচ্চারণ করেন। সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও অর্থ বিজ্ঞানের বিশেষ কোন জ্ঞান না থাকায় শ্রমিকদল তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে পূর্বের তুলনায় আরো বেশি শ্রম দিতে শুরু করেন। দিবসের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে শ্রমিক যখন তার বেতন-ভাতা বৃদ্ধির স্বপ্নে বিভোর থাকে তখন তাদের কষ্টার্জিত পয়সা দিয়ে মালিকপক্ষ নাইট ক্লাবে ফুর্তি করে। একদিকে ঝড়ো বৃষ্টির রাতে শ্রমিকের থাকার জায়গা হয় না, অন্যদিকে মালিকপক্ষের শ্বেতপাথরের সুরম্য অট্টালিকা আকাশ ছুঁতে থেমে থাকে না। একদিকে দরিদ্র শ্রমিকের অসহায় মা-বাবা চিকিৎসার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়, অন্যদিকে বড়লোক মালিক তার শরীরের চেক আপের জন্য প্রতি মাসে মাউন্ট এলিজাবেথ যায়। যখন অর্থাভাবে শ্রমিকের ছেলে মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, তখন মালিকের ছেলে মেয়ে পড়াশোনার জন্য আমেরিকা-ইউরোপে পাড়ি জমায়। একদিকে শ্রমিক তার মৃত মা বাবার দাফন কাফনের খরচের জন্য হিমশিম খায়, অন্যদিকে মালিক তার মৃত মা বাবার জন্য কুলখানি করতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে।
আমাদের সমাজ জীবনে এমনই উন্নতির জোয়ার বইছে। তৈলাক্ত মস্তকে তৈল মর্দনের যে সামাজিক চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত অবলোকন করে চলেছি তা কতদূর পর্যন্ত গড়াবে সেটাই আজকের চিন্তার বিষয়।
প্রেক্ষাপট
১৮৯০ সাল থেকে ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর আগে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগোতে হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবীতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। সরকারের গুণ্ডাবাহিনীর গুলিতে সেদিন ১০/১১ জন শ্রমিক নিহত হয়। পরবর্তীতে ১৮৯৯ সালে ফ্রান্সে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ‘১লা মে’-কে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়।
পুঁজিবাদের অভিশাপ
মূলত শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution) এর দিকে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দিতে সমুদ্র যাত্রা বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ খুলে দেয়। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে গীর্জার পোপ ও ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীদের মাঝে শুরু হয় আদর্শিক সংঘর্ষ। একপর্যায়ে গীর্জার অনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস পেয়ে সেখানে শিল্প বিপ্লব সংঘঠিত হয়। কৃষি ব্যবস্থা থেকে শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে যায় ইউরোপ। যে ভূমিতে একমসয় সবুজ শষ্যাদি আবাদ হত, সেখানে এখন বড় বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করল। ধ্বংস হল কুটির শিল্প। শিল্পপতিরা তাদের সমস্ত অর্থ ইনভেষ্ট করতে থাকল সেসব কারখানায়। কৃষকদের আবাদি যমীন কেড়ে নেয়া হল, কুটির শিল্পের মালিকরা সর্বস্বহারা হয়ে পড়ল। ফলে জীবিকার তাকীদে তারা শহরমুখী ও কারাখানায় কাজ করার জন্য ভীড় জমাতে শুরু করল। এই সুুযোগের সদ্ব্যবহার করল সমাজের বুর্জোয়া শ্রেণী। নামমাত্র বেতনে শ্রমিকদের গাধার মত খাটাতে শুরু করল তারা। আর করবেই না কেন? সমাজের এসকল বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশ্বাস তাদের অকুন্ঠ সমর্থক ম্যানডেভিলের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে.
‘গরীবদের থেকে কাজ নেয়ার একটিই মাত্র পথ, আর তাহল এদেরকে গরীব থাকতে দাও, এদেরকে পরনির্ভরশীল করে তোল। এদের প্রয়োজন খুব অল্প করেই পূরণ করা দরকার। আপন প্রয়োজন পূরণে এদেরকে সাবলস্বী করা চরম বোকামী’।
পুঁজিবাদের প্রখ্যাত প্রবক্তা টাউনসেন্ড উক্ত ঘৃণ্য মনোভাবটি আরো সোচ্চার করতে যেয়ে বলেন,
“ক্ষুধার কষাঘাত এমন এক মারাত্মক অস্ত্র যা বন্য হতেও অবাধ্য পশুগুলোকে শান্ত-সুবোধ বানিয়ে ফেলে। এরই সাহায্যে অবাধ্য হতে অবাধ্যতর মানুষও বাধ্য ফরমাঁবদার হয়ে ওঠে। তাই তোমরা গরীবদের থেকে যদি কাজ নিতে চাও তবে এর একমাত্র উপায় এদেরকে ‘ভুখা’ রাখ। ক্ষুধাই এমন এক আবেদনময়ী বস্তু, যা গরীব ও সর্বহারাদেরকে যে কোন রকমের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে’।[১]
শ্রমিকদের এমন করুণ দশা ও স্বল্প বেতনের অভিযোগে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বন্দ শুরু হয়। কিন্তু কথায় বলে, ‘টাকায় বাঘের চোখও মেলে’। রাজনৈতিক নেতাদের মুখ বন্ধ করার জন্য বুর্জোয়া মালিকপক্ষের কেউ কেউ রাজনীতিতে যোগদান করে আবার তাদের পকেট ভর্তি করার মাধ্যমে তাদরেকে খুশিও রাখে। এভাবে শিল্পপতিদের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। ফলে স্বভাবতই শ্রমিকদের অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে পড়ে। শিল্পায়ন ও রাজনীতির হাত ধরে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয় পুঁজিবাদ। মেহনতি মানুষের রক্তে গড়ে ওঠে শিল্পপতিদের অট্টালিকা। অবস্থা এত বেগতিক হয় যে, কোন পণ্য বেশি উৎপাদন হলে তা ধ্বংস করা হত, যেন বাজারে তার সহজলভ্যতা না হয়। যেহেতু বাজারে কোন পণ্যের সহজলভ্যতা হলে মুনাফাখোরিরা তাদের ইচ্ছামত সেটার অতিমূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন না। এজন্য একবার ব্রাজিলে প্রচুর পরিমাণে গম উৎপন্ন হল। সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু বুর্জোয়ারা পড়ে গেল চিন্তায়। কারণ এত ফসল বাজারে উঠলে তাদের মজুতদারি করেও কোন কাজ হবে না। তারা সিদ্ধান্ত নিল এগুলোকে কিভাবে নষ্ট করা যায়? এত ফসল মাটিতে পুঁতে ফেলাও সম্ভব না আবার সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়াও যাবে না। অবশেষে তারা উৎপাদিত ফসলকে পুড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। দুই লাখ পাউন্ড জ্বালানি তেল ব্যবহার করে ব্রাজিলে উৎপাদিত ফসলকে তারা পুড়িয়ে ফেলল। আরেকবার খাদ্য সংকট তৈরির জন্য তারা লিভারপুলের ২০০ নৌকা ডুবিয়ে দেয়।[২]
সোশালিজমের ব্যর্থ চেষ্টা
সাদা চামড়ার সা¤্রাজ্যবাদীরা পুঁজিবাদ সৃষ্টি করে গোটা শ্রম বাজারকে পরোক্ষভাবে করায়ত্ত করে। শ্রমিকের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। এদিকে রাশিয়ায় শ্রমিকের উপর নির্যাতন আরো বৃদ্ধি পায়। দৈনিক আঠারো ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় তাদের। যুবক ও শিশু শ্রমিকের মাঝে কোন ভেদাভেদ করা হয় না। একজন মহিলা শ্রমিককে তার গর্ভাবস্থায়ও কাজ করতে হয়। ফলে মার্কসীজম সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মার্কসীজমের মূল কথা হল, যার যার সাধ্যানুযায়ী কাজ আদায় করে নিতে হবে আর তার প্রয়োজন মাফিক তাকে অর্থ যোগান দিতে হবে। প্রথম প্রথম এই মতটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। লাল চামড়ার রাশিয়ানরা এই সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে খুব গুরুত্বের সাথে প্রচার করতে থাকে। রাশিয়ার শ্রমিকদের নিকটে কাল মার্কস হয়ে ওঠেন এক সংগ্রামী প্রতিক। পরবর্তীতে লেলিন সেই মতবাদকে আরো ব্যাপকভাবে প্রচার করতে থাকে। ফলে অর্থনৈতিক সমাজতন্ত্র রাশিয়ার সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু সমাজতন্ত্রের শিষ্যরা কখনো একথা ভাবেনি যে, কাল মার্কসের এই অর্থব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও তাদের চিরস্থায়ী কোন সমাধান হবে না। শ্রমিকদের শুধু প্রয়োজন মিটলে তারা আজীবন বংশপরম্পরায় শ্রমিকই থেকে যাবে। তাদের মালিক হওয়ার কোন সুযোগ থাকবে না। ফলে বুর্জোয়া শ্রেণী ও শ্রমিক শেণীর মাঝে যে সমস্যা তা বন্ধ হবে না। এজন্যই মনে হয় রাশিয়ায় ১৯৩৬ সালে পূর্বের আইন পরিবর্তন করে নতুন আইন পাশ করা হয়। নতুন আইনে বলা হয়, শ্রমিকের নিকট থেকে তার সাধ্যানুযায়ী কাজ আদায় করতে হবে এবং তার কাজের পরিধি ও গুণগত মান বিবেচনা করে বেতন নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু রাশিয়ান আইন প্রণেতা সোশালিজমের বোদ্ধারা টের পেয়েছেন কিনা যে, তাদের এই আইনে পুঁজিবাদেরই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কার্যত, যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে কাল মার্কস সংগ্রাম করেছেন এবং তার ভাবশিষ্য লেলিন জেল খেটেছেন সেই পুঁজিবাদের দিকেই তাদের অনুসারীরা মোড় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখানে আমরা ছোট্ট একটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি দিতে চাই, ভারতের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি বর্ণনা করেছেন, ‘আমি রাশিয়া সফরকালে লেলিনের সাথে সাক্ষাৎ হলে কথা প্রসঙ্গে তার কাছে কুরআনের নিন্মোক্ত আয়াতটি বিশ্লেষণ করি। یَسۡـَٔلُوۡنَکَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ قُلِ الۡعَفۡوَؕ ‘(হে নবী!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে তারা কি ব্যয় করবে? আপনি বলুন, প্রয়োজনাতিরিক্ত সবকিছুই’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৯)।
তখন লেলিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরো আগে যদি কুরআনের এই সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতাম, তাহলে আমাদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কোন আবশ্যক ছিল না’।[৩]
যাই হোক, শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য বিশ্বে পরপর দু’টি মতবাদ, তথা পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ তর্জন-গর্জন করলেও আধুনিককালে তাদের মতবাদের অসারতা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। এজন্যই বোধ হয় এ যুগে এসেও শ্রমিকদেরকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। পাওনা মজুরির জন্য মালিকপক্ষের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয়। বিভিন্ন দেশে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে সরকারের পোষ্যবাহিনী নানা ধরনের উপঢৌকন প্রেরণ করে থাকে। ফলে আধুনিক বিশ্বের সকল সম্পদ মোট জনসংখ্যার দশ ভাগ লোকের হাতে জিম্মি হয়ে আছে। অর্থাৎ বিশ্বের সাতশ কোটি মানুষ মাত্র দশ ভাগ লোকের নিকটে জিম্মি।
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা
শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদার ব্যাপারে ইসলাম এমন কিছু সৌন্দর্যপূর্ণ মৌলিক নীতিমালা পেশ করেছে, যা বিশ্বের কোটি কোটি মাযলূম মেহনতি শ্রমিকের সামনে আলোর দ্যুতি ছড়াবে। নিরাশার চাদরে ঢাকা খেটে খাওয়া নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের সামনে আশার প্রদীপ হয়ে থাকবে। কিন্তু ইসলামের নাম শুনলেই একশ্রেণীর লোকদের গাত্রদাহ শুরু হয়ে যায়। ইসলামের সুনির্মল, স্বচ্ছ ও কালজয়ী আদর্শের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করাই তাদের কর্মসূচি। ফলে ইসলামের শ্রমব্যবস্থা ও অর্থব্যবস্থা বাস্তবসম্মত ও জনকল্যাণমুখী হলেও তা তাদের সহ্য হয়নি, হবেও না। বঞ্চিত মানুষের পক্ষে ইসলামের যে দরদমাখা অবস্থান তা যদি তারা মেনে নিত তাহলে কতই না ভাল হত! আমরা যদি ভারতে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে সাদা চোখেই দেখতে পাব, ইসলাম আগমনের প্রাক্কালেই এখানকার দলিত সম্প্রদায় ও নি¤œশ্রেণীর দরিদ্ররাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। স্পেনে মুসলিমদেরকে শ্রমিকশ্রেণীই স্বাগত জানিয়েছিল। এমনকি মক্কায় ইসলামের সূচনালগ্নে দাস ও দরিদ্রশ্রেণীই তা গ্রহণ করেছিল। ইসলামে মানবাধিকারের সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন জা‘ফর ইবনু আবূ তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু), যখন আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশী তাঁকে নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন,
أَيُّهَا الْمَلِكُ كُنَّا قَوْمًا أَهْلَ جَاهِلِيَّةٍ نَعْبُدُ الْأَصْنَامَ وَنَأْكُلُ الْمَيْتَةَ وَنَأْتِى الْفَوَاحِشَ وَنَقْطَعُ الْأَرْحَامَ وَنُسِىءُ الْجِوَارَ يَأْكُلُ الْقَوِىُّ مِنَّا الضَّعِيْفَ فَكُنَّا عَلَى ذَلِكَ حَتَّى بَعَثَ اللهُ إِلَيْنَا رَسُوْلًا مِنَّا نَعْرِفُ نَسَبَهُ وَصِدْقَهُ وَأَمَانَتَهُ وَعَفَافَهُ فَدَعَانَا إِلَى اللهِ لِنُوَحِّدَهُ وَنَعْبُدَهُ وَنَخْلَعَ مَا كُنَّا نَعْبُدُ نَحْنُ وَآبَاؤُنَا مِنْ دُوْنِهِ مِنَ الْحِجَارَةِ وَالْأَوْثَانِ وَأَمَرَنَا بِصِدْقِ الْحَدِيْثِ وَأَدَاءِ الْأَمَانَةِ وَصِلَةِ الرَّحِمِ وَحُسْنِ الْجِوَارِ وَالْكَفِّ عَنِ الْمَحاَرِمِ وَالدِّمَاءِ وَنَهَانَا عَنِ الْفَوَاحِشِ وَقَوْلِ الزُّوْرِ وَأَكْلِ مَالِ الْيَتِيْمِ وَقَذْفِ الْمُحْصَنَةِ
‘হে বাদশাহ! আমরা ছিলাম জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত। আমরা মূর্তি পূজা করতাম, মৃত জন্তু ভক্ষণ করতাম, অশ্লীল কর্মকাণ্ডে ডুবে ছিলাম ও প্রতিবেশীর সাথে খারাপ আচরণ করতাম। আর আমাদের শক্তিশালী লোকেরা দুর্বলদেরকে বঞ্চিত করে রাখত। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নিকটে আমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করলেন- যার বংশ মর্যাদা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা এবং চারিত্রিক নিষ্কলুষতার ব্যাপারে আমরা সম্যক অবগত। তিনি আমাদেরকে আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর এককত্বের দিকে আহ্বান করেন, আমাদের পিতৃপুরুষগণ যে গাছ পূজা ও পাথর পূজা করত তা থেকে আমাদেরকে মুক্ত হতে বলেন। তিনি আমাদেরকে আদেশ করেন সত্য বলতে, আমানত রক্ষা করতে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে, প্রতিবেশীর সাথে ভাল ব্যবহার করতে। তিনি নিষেধ করেছেন হারাম কাজে লিপ্ত হতে, রক্তপাত করতে, অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়তে, মিথ্যা বলতে, ইয়াতীমের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করতে এবং নেককার নারীকে মিথ্যা অপবাদ দিতে’।[৪]
এই হাদীছ উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, ছাহাবী জা‘ফর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) একজন খ্রিষ্টান শাসকের নিকটে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিচয় তুলে ধরেছেন মানবতাবাদী হিসাবে। যিনি মানুষকে ভাল আচরণের কথা বলেন, আমানত রক্ষার সদুপদেশ দেন, সত্যের নির্দেশনা প্রদান করেন। সুতরাং তিনি তার অধিনস্তদেরও সাথে কিরূপ আচরণ করবেন তা সহজেই অনুমেয়। আসুন আমরা জেনে নেই দুনিয়ার মাযলূম মেহনতি মানুষের জন্য মানবতার নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কী বলেছেন...
১). মালিক-শ্রমিক পরস্পর ভাই ভাই
একদা আবূ যার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর এক দাসকে ভর্ৎসনা করলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে বলেন, হে আবূ যার! তুমি এমন একজন ব্যক্তি যার মাঝে এখনো জাহিলী স্বভাব বিদ্যমান। এরপর তিনি বলেন, إِنَّهُمْ إِخْوَانُكُمْ فَضَّلَكُمُ اللهُ عَلَيْهِمْ ‘নিশ্চয় তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তা‘আলা তাদের ওপরে তোমাদের কর্তৃত্ব দিয়েছেন’।[৫]
উল্লিখিত হাদীছে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্পষ্ট করে দিয়েছেন দাস, শ্রমিক বা অধস্তন কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা জাহিলী স্বভাব।
২). শ্রমিকের ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা
ছাহাবী আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দশ বছর খেদমত করেছি। কখনো তিনি আমাকে বলেননি যে, তুমি কেন এটি করলে আর কেন এটি করলে না।[৬]
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, ‘এক ব্যক্তি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে এসে বলল, আমার এক দাস রয়েছে। সে আমাকে বিরক্ত করে ও গালি দেয়। আমি কি তাকে প্রহার করতে পারব? নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, تَعْفُوْ عَنْهُ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعِيْنَ مَرَّةً ‘তুমি প্রতিদিন তাকে সত্তর বার ক্ষমা করতে থাক’।[৭]
৩). মালিক-শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান
ইসলামের সাম্যনীতি আসলেই অবাক করার মত। সেই যুগে ক্রীতদাসের যে করুণ অবস্থা বিরাজিত ছিল সে কঠোরনীতির মূলে কুঠারাঘাত করে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধ্যপন্থার সাম্যনীতি ঘোষণা করেন, إِخْوَانُكُمْ خَوَلُكُمْ جَعَلَهُمُ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيْكُمْ فَمَنْ كَانَ أَخُوْهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ. ‘তোমাদের ভাইয়েরা তোমাদের সেবক। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার অধীনে কোন সেবক রয়েছে সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে নিজে খায়, তাকে যেন সেই মানের পোশাক পরিধান করায় যা সে নিজে পরিধান করে’।[৮]
ইসলামই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যেখানে শ্রমিকদের পক্ষে এমন সমতার কথা বলা হয়েছে।
৪). শ্রমিকের নির্ধারিত বেতন ছাড়াও উৎপাদিত পণ্যের কিছু অংশ দেয়া
নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,
إِذَا جَاءَ خَادِمُ أَحَدِكُمْ بِطَعَامِهِ فَلْيُقْعِدْهُ مَعَهُ أَوْ لِيُنَاوِلْهُ مِنْهُ فَإِنَّهُ هُوَ الَّذِىْ وَلِىَ حَرَّهُ وَدُخَانَهُ
‘যখন তোমাদের খাদেম খাবার নিয়ে আসে তখন যেন সে তাকে তার সাথে বসায় অথবা তার হাতে খাবার তুলে দেয়। কেননা খাবার তৈরির যে তাপ ও ধোঁয়ার কষ্ট তা খাদেমকেই সহ্য করতে হয়েছে’।[৯]
এখানে আমরা মাওলানা আব্দুর রহীম (রাহিমাহুল্লাহ)-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেন,
‘এই হাদীস হইতে প্রমাণিত হয় যে, শ্রমিক নিজের শ্রমের সাহায্যে মালিকের কাঁচামাল বা মূলধন খাটাইয়া যাহা উৎপন্ন করিবে, তাহা হইতে তাহাকে নির্দিষ্ট হারে বেতন দেওয়ার পরও আসল মুনাফা হইতে তাহাকে কিছু না কিছু অংশ দিতে হইবে। হাদীসে উল্লিখিত ঘরের বাবুর্চি আর কারখানার শ্রমিকের মধ্যে মূলত কোন পার্থক্য নেই। একজন বাবুর্চিকে খাদ্য পাকাইবার কাজে যেভাবে মনোযোগ দিতে হয়, দেহ ও চিন্তা শক্তিকে যেভাবে নির্দিষ্ট এক কাজের জন্য নিয়োজিত করিতে হয়, কম-বেশি প্রায় তদ্রুপই কারখানার একজন মজুরকেও খাটিতে হয়। কাজেই এই হাদীস অনুসারে নির্বিশেষে সকল শ্রমিকই কারখানায় উৎপন্ন দ্রব্য হইতে অংশ পাইতে পারিবে। যে মিলে কাপড় তৈরি হয়, প্রত্যেক শ্রমিককে তাহার পরিবারবর্গের জন্য বৎসরে এক বা একাধিকবার কাপড় দেওয়া যাইতে পারে। ইহা নির্দিষ্ট বেতনের মধ্যে গণ্য হইবে না। কারণ প্রায়ই দেখা যায়, কোন মিলে শ্রমিক সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করিয়া থানকে থান কাপড় বুনে অথচ তাহার নিজের বা তাহার পরিবারের লোকদের পরিধানে হয়ত ছিন্নবস্ত্রটুকুরও অস্তিত্ব নাই। এই হাদীস অনুসারে ইসলামী সমাজে যে শ্রমনীতি কায়েম করা হইবে তাহাতে এই অবাঞ্চিত পরিস্থিতির অবকাশ থাকিতে পারিবে না’।[১০]
৫). সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে না দেয়া
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا یُکَلِّفُ اللّٰہُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَہَا ‘আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোন কিছু চাপিয়ে দেন না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৮৬)। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,وَلَا يُكَلِّفُهُ مِنَ الْعَمَلِ مَا يَغْلِبُهُ فَإِنْ كَلَّفَهُ مَا يَغْلِبُهُ فَلْيُعِنْهُ عَلَيْهِ ‘তার সাধ্যশক্তির অতীত কোন কাজের চাপ যেন তাকে না দেয়। দিলে সে কাজ সমাধা করার ব্যাপারে যেন তাকে যথাযথ সহযোগিতা করে’।[১১]
সহযোগিতার অর্থ এই নয় যে, আপনাকেই কারখানায় গিয়ে তাদের সাথে কাজ করতে হবে। এর উদ্দেশ্য হল, আপনি সেই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ দিবেন, ভাল মানের যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করবেন, শ্রমিককে পর্যাপ্ত সময় দিবেন এমনকি তাদের দৈহিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করবেন।
উপসংহার
ইসলামের এই শ্রমনীতি যদি মালিকপক্ষ মেনে চলত তাহলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, কাল মার্কস, লেলিন অথবা মাও সে তুংয়ের ভুয়া কমিউনিজমের জন্য শ্রমিকশ্রেণী এত আন্দোলন, হরতাল, অবরোধ বা ধর্মঘট করত না। তারা ইসলামের ন্যায়ানুগ শ্রমনীতি মেনে নিয়ে আরামে জীবন-যাপন করতে পারত। কিন্তু কে শোনে কার কথা। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় অক্টোপাসের মত মালিকপক্ষের অবস্থাদৃষ্টে অনেক আগে পড়া বাংলাদেশের প্রখ্যাত রম্য সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমাদের ফুড কনফারেন্সের গল্পটি মনে পড়ে গেল। গল্পটি মোটামুটি এমন....
‘সারাদেশে দুর্ভিক্ষে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষুধা আর রোগে মানুষ এবং পশুপাখির একাকার অবস্থা। রাজধানী ঢাকায় কাঙ্গালের দল ছুটে এসেছে দু’মুঠো ভাতের আশায়। ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কারণে সমাজের সাহেবগণ রাস্তায় বেরও হতে পারছিলেন না। আগে যেখানে গাউন শাড়ি পরা মহিলারা হাঁটত এখন সেখানে অর্ধ উলঙ্গ ছেঁড়া কাপড়ে পল্লীর মা মেয়ের অবস্থান। বাবুরা যেখানে আগে প্রাত্যহিক ব্যায়ামের জন্য গমনাগমন করত এখন সেখানে ভিক্ষুকের দলের প্রচণ্ড ভীর। রাজধানীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে পরিবেশবাদীরাও থেমে নেই। এর একটা বিহিত করা চাই। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে দেশের মাথামুণ্ডু টাইপের ব্যক্তিবর্গ এগিয়ে এলেন। সারাদেশে রিলিফের মাল বিতরণের জন্য সবাই একাট্টা হলেন। সে সভায় সভাপতিত্ব করলেন শেরে বাংলা। তার পাশে অন্যান্য আসন অলংকৃত করলেন বিল্লিয়ে বাংলা, কুত্তায়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা, ছাগলে বাংলা, গাধায়ে বাংলা, হাতিয়ে বাংলা, টাট্টুয়ে বাংলাসহ আরো অনেকে। একমাত্র মানুষে বাংলা সেই কনফারেন্সে অনুপস্থিত ছিল। ফলে কনফারেন্সের সর্বশেষ স্লোগান হলো- জানোয়ারে বাংলা জিন্দাবাদ, মানুষে বাংলা মুর্দাবাদ’।
* শিক্ষক, মাদরাসা দারুস সুন্নাহ, মিরপুর, ঢাকা।
তথ্যসূত্র :
[১]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃ. ৭।
[২]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃ. ৫।
[৩]. ইসলামে শ্রমিকের অধিকার, পৃ. ১৪।
[৪] . মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭৪০, সনদ হাসান।
[৫]. আবূ দাঊদ, হা/৫১৫৭, সনদ ছহীহ।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২৭৬৮।
[৭]. মুসনাদে অহমাদ, হা/৫৬৩৫, সনদ ছহীহ।
[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬৬১; আল-আদাবুল মুফরাদ, হা/১৮৯; আবূ দাঊদ, হা/৫১৫৮।
[৯] . ইবনু মাজাহ, হা/৩২৯১, সনদ হাসান ছহীহ।
[১০]. ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার, পৃ. ২৬।
[১১]. ছহীহ বুখারী, হা/৬০৫০।