মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৮ অপরাহ্ন

করোনা ভাইরাস

-আব্দুল্লাহ আল-মামুন *


ভূমিকা :

গত দুই মাসের সবচেয়ে বড় আলোচিত শব্দ ‘করোনা ভাইরাস’। মানুষের মনস্পটে ধুক ধুক করে চলতে থাকে করোনার লেলিহান বিস্ফোরণ। শ্বাস-প্রশ্বাসের অর্ধেকটায় উচ্চারিত হয় ‘করোনা’। মা ছেলেকে বকা দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলল, ‘বাবু এটা কর না’। কিন্তু মহোদয়ের কর্ণকুহরে শব্দটি প্রবেশ করেছে। কিন্তু মনের গহ্বরে ভাইরাসের সেই ভয়াবহতা বিরাজ করছে। অবস্থা এমন যে, ‘করোনা’ শব্দটি ব্যবহার করা বড় দায়।

‘ভাইরাস’ ল্যাটিন ভাষা হতে গৃহীত একটি শব্দ। এর অর্থ হল বিষ। আদিকালে রোগ সৃষ্টিকারী যে কোন বিষাক্ত পদার্থকে ‘ভাইরাস’ বলা হত। বর্তমান কালে ভাইরাস বলতে এক প্রকার অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তুকে বোঝায়। ভাইরাসকে জীবাণু না বলে বস্তু বলা হয়। কারণ জীবদেহ ডিএনএ, আরএলএ এবং ও নিউফ্লিক এসিড দিয়ে গঠিত তাই ভাইরাস অকোষয়ী।[১] ভাইরাস হল এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব। যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। যারা জীবিত কোষের ভিতরেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে। ভাইরাস জীব হিসাবে বিবেচিত হবে কিনা এ নিয়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীদের মধ্যেও দ্বিমত আছে। কিছু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে। এদের ব্যাক্টেরিওফাজ (Bacteriophage) বলা হয়। হল্যান্ডের প্রাণ রসায়নবিদ এডলফ মেয়ার (১৮৮৬) তামাক গাছের মোজাইক নামক ভাইরাস রোগ নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন। স্থানীয়ভাবে রোগটি বাস্ট, রাস্ট বা স্মাট নামে পরিচিত ছিল। কারো মাঝে যেন বিভ্রান্তি সৃষ্টি না হয় সেজন্য মেয়ার একে ‘টোবাকো মোজাইক’ (TMV) নামে আখ্যায়িত করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে চিলিতে এ টিস বাউডেন, এন ডবলু পিরি প বার্নাল উভয়ই টি এম ভি (TMV) হতে প্রোটিন ও নিউক্লিক এ্যাসিডের সমন্বয়ে গঠিত এক প্রকার তরল স্পটিকময় পদার্থ উৎপন্ন করতে সক্ষম হোন। ফ্রয়েংকাল-কনরোট ও অন্যান্য গবেষকগণ ১৯৫৬ সালে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের নিউক্লিক এ্যাসিডকে প্রোটিন হতে পৃথক করেন এবং প্রমাণ করেন যে, নিউক্লিক এ্যাসিডই ভাইরাস রোগের বাহক। জীব ও জড় পরিবেশ উভয়ই ভাইরাসের আবাস। সাধারণত এদের আকার ১০হস থেকে ৩০০হস পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কিছু ভাইরাস এর চেয়ে বড় হতে পারে।[২] ভাইরাসের আদি-আন্ত জানার জন্য আমাদের একটি ইপিসডের প্রয়োজন হবে। তবে আমাদের আলোচিত বিষয়ের দিকে লক্ষ রেখে ভাইরাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরী। নচেৎ আলোচিত বিষয়ের পূর্ণতা লাভ (সম্ভবত) সম্ভব হবে না।

‘করোনা ভাইরাস’ শব্দটি বর্তমানে রীতিমত আঁতকে উঠার মত। এটি নতুন কোন বিষয় নয়। ১৯৬০ সালে প্রথমবারের মত ‘করোনা ভাইরাস’ আবিস্কার হয়। তবে কিভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি তা জানা সম্ভব হয়নি। করোনা শব্দের অর্থ ‘জ্যোতির্বলয়’। সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মির মত হওয়ায় ভাইরাসটির নামকরণ হয়েছে ‘করোনা ভাইরাস’।[৩]

সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোমের (সার্স) সংক্রমণে ২০০২-০৩ সালে চীনসহ পৃথিবীর নানা দেশে ৮০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল (চীনে ৩৯৪ জন)।[৪] তার পিছনেও ছিল ‘করোনা ভাইরাস’। বিশেষজ্ঞরা এখন নিশ্চিত যে, নতুন আতঙ্কের কথিত এই চীনা ভাইরাসটি সাবেক করোনা ভাইরাসেরই নতুন সংস্করণ।[৫] বহুল আলোচিত আর কথিত এই ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওডি।[৬] ভাইরাসটি একটি প্রজাতির শুধু নয়, এর আছে অনেক রকম প্রজাতি। আশার বিষয় হল- বহু প্রজাতির ডিব্বার ভেতর কেবল অতি নগণ্য ৭টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ধ্বংস রাজ্যের বৃহদাকার স্তুপ হতে বেঁচে গেছে মানব জাতি। অন্যথা প্রতিটি প্রজাতি যদি একই সাথে আঘাত হানত, তাহলে পরিস্থিতি কতটা নাজুক আর বর্বর হত তা কল্পনা করা যায়? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট’; অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।

গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে সংবাদমাধ্যম মুক্ত, সেখানে প্রাকৃতিক হোক, মানবসৃষ্ট হোক, কোন ঘটনা ঘটলে সব ঘটনা পুরোপুরি জানা খুবই কঠিন। অমর্ত্য সেন তাঁর দুর্ভিক্ষ বিষয়ে বিখ্যাত গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সময় চীনে দুর্ভিক্ষে কত লোক মারা গেছে। তা বাইরের দুনিয়ার মানুষের কাছে অজানা রয়েই গেছে। তবে আগের সেই পরিস্থিতি এখন নেই। তথ্য সম্পূর্ণরূপে চাপা দেয়া এখন সম্ভব নয়। তবে সঠিক তথ্য দেরিতে জানলে লাভ নেই। ২০০৩ সালের সেই ‘সার্স’ ভাইরাসের মৃত্যের লীলা প্রথম দিকে চীন সরকার জানতে দেয়নি।[৭] অতীতের ‘সার্স’ ভাইরাস সম্পর্কে চীনা স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ চীনা কর্মকর্তাগণ জনগণের কাছ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের তথ্য গোপন না রাখলে তার বিস্তার হয়তোবা রোধ করা সম্ভব হত। কিন্তু তারা সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি। যদিও বহুপ্রচলিত আজকের এই ভাইরাসের সাথে ঘটে যাওয়া ‘সার্স’ ভাইরাসের মধ্যে অতিব গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বিদ্যমান। তবুও হতে পারে চীন এই ভাইরাস নিয়েও গোপনীয়তা অবলম্বন করতে বাকি রাখেনি।

করোনা ভাইরাসের সূচনা :

মধ্য চীনের ‘উহান’ শহর থেকে এই রোগের সূচনা। ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মত একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব সংস্থাকে সতর্ক করে। গত ১ জানুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের ‘সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি) বলেছিল, উহানের সামুদ্রিক খাবারের একটি বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই দিনই বাজারটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ডব্লিউএইচও গত ৯ জানুয়ারী জানায় উহানে যে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সেটি একটি নোবেল ভাইরাস। এটি এবং সিভিয়ার অ্যাকুইটি রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) একই পরিবারভুক্ত।[৮] গত ১১ জানুয়ারী চীনে এই ভাইরাসের সংক্রমণে প্রথম একজন মারা যায়। গত ১৭ জানুয়ারী ‘উহানে’ এই ভাইরাসে আক্রান্ত আরেকজন মারা যায়। গত ২০ জানুয়ারী চীনে তৃতীয় আরেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।[৯] সর্বশেষ ৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০-এর তথ্য মতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬১ জনে গিয়ে পৌঁছেছে।[১০] এই ধারাবাহিকতায় চীন ছাড়িয়ে বিশ্বের বহু দেশে এই ভাইরাসের পদচারণার মাত্রা ক্রমন্বয়ে লাগামহীন অবস্থায় বেড়েই চলেছে। চীনের বাইরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত দেশগুলো হল- অস্ট্রেলিয়া, কম্বোডিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, নেপাল, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালি, রাশিয়া, সুইডেন, স্পেন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।[১১]

করোনা ভাইরাসের উৎস :

করোনা ভাইরাসের উৎস কিভাবে শুরু হয়েছিল তা এখনও নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সম্ভবত কোন প্রাণী এর উৎস ছিল। প্রাণী থেকেই ভাইরাসটি কোন মানুষের দেহে ঢুকেছে এবং তারপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। এর আগে ‘সার্স’ ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রথমে বাদুড় এবং পরে গন্ধগোকুল থেকে মানুষের দেহে ঢোকার নজির রয়েছে। আর ‘মার্স’ ভাইরাস ছড়িয়েছিল ‘উঠ’ থেকে। যা একটি (মার্স) করোনার পরিবারভুক্ত ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে ‘উহান’ শহরে সামুদ্রিক একটি খাবারের কথা বলা হচ্ছে। শহরটির একটি বাজারে গিয়েছিল এমন ব্যক্তিদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ ঘটেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই বাজারটিতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী বেচাকেনা হতো। কিন্তু সামুদ্রিক প্রাণী যেমন ‘বেলুগা’ জাতীয় তিমি করোনা ভাইরাস বহন করতে পারে। তবে উহানের এই বাজারে মুরগি, বাদুড়, খরগোশ, এবং সাপ বিক্রি হত।[১২]

করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় :

সহজেই একজনের থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়ায় এই ভাইরাস। যেমন- ১. শারীরিক ঘনিষ্ঠতা, এমনকি করমর্দন থেকে এই রোগ ছড়াতে পারে ২. রোগী বা তার জিনিস ধরার পর ভালো করে হাত না ধুয়ে চোখ, মুখ, নাকে হাত দিলে এই রোগ ছড়াতে পারে ৩. হাঁচি-কাশি থেকেও এই রোগ ছড়াতে পারে।[১৩]

কতটা ভয়ংকর এই করোনা ভাইরাস

প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৬৬৫ জনে দাঁড়িয়েছে। যা ২০০৩ সালের প্রাণঘাতী সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোমের (সার্স) ভাইরাসে মৃতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যাও বেড়ে ৬৮ হাজার ছাড়িয়েছে।[১৪] মরণ এ ব্যাধিতে শুধু হুবেই প্রদেশেরই ২৭ হাজারের বেশি নাগরিক আক্রান্ত। আর চীনের অন্যান্য প্রদেশ ও বিশ্ব মিলে এ ভাইরাস ছড়িয়ে ৩৭ হাজারের বেশি মানবদেহে। যার অধিকাংশ চীনা। ফলে সময় যত ঘনিয়ে আসছে চিন ততই ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এ যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে বেইজিং। শুধু যে মানুষের দেহে তা নয়, এর প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতেও। কার্যত এখন অচল চীন। দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন জানিয়েছে, শনিবার পর্যন্ত নতুন করে ৮৭ জনের মৃত্যুর খবর পেয়েছে, যাদের সবাই হুবেই প্রদেশের। সেই সাথে ৩ হাজার ৩ শত ৯৯ জন নতুন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে।[১৫]

মূলত এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠা-া লাগার মত করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তবে এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু ঘটারও আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত আক্রান্তদের দুই শতাংশ মারা গেছেন, হয়তো আরও মৃত্যু হতে পারে। তাছাড়া এমন মৃত্যুও হয়ে থাকতে পারে যা চিহ্নিত হয়নি। তাই এ ভাইরাস ঠিক কতটা ভয়ংকর, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এক দশক আগে সার্স (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরণের করোনা ভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। আর একটি ভাইরাসজনিত রোগ ছিল মিডল ইস্টার্ন রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স। ২০১২ সালে এতে মৃত্যু হয় ৮৫৮ জনের।[১৬]

করোনা ভাইরাস : প্রতিকার ও সতর্কতা

বলা বাহুল্য এসব ভাইরাসের ধ্বংসলীলা থেকে পরিত্রাণ খুঁজে বের করতে হবে। এটি কোন রাজনৈতিক ডামাডোল না, যা এস্পার ওস্পার করে দু’টি বলি আউড়ে দিলাম আর সমাধান হয়ে গেল। রোগজীবাণু বা ভাইরাস ব্যাংকের টাকার ন্যায়। ব্যাংকের টাকার যেমন কোন জাত ধর্ম আর বর্ণ নেই ঠিক তেমনই এই ভাইরাস সংক্রমণকারী রোগগুলোর রং বর্ণ জাত নেই। এরা নিতান্তই অসম্প্রদায়িক আর ধর্মনিরপেক্ষ। দলনিরপেক্ষ বললে তো কোন ক্রমেই ভুল হবে না। এরা কোন প্রকার স্বাচিপ বা ড্যাব বোঝে না। ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নতুন হওয়াতে এখনই এর কোন প্রকার টিকা বা ভেনিসকারী প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যে মানুষকে নিয়মিত হাত পরিস্কার করে ধোঁয়া নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছে। হাঁচি বা কাশির সময় নাক মুখ ঢেকে রাখা এবং ঠা-া বা ফ্লু আক্রান্ত মানুষ হতে সম্ভবপর দূরে থাকারও পরামর্শ দিয়েছে।[১৭]

এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত দুর্যোগ প্রতিরোধ করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন এজেন্সির সমন্বিত শক্তিশালী ইউনিটের পরামর্শ প্রয়োজন। যেহেতু চীনের বহু অঞ্চলে বাংলাদেশের অনেক মানুষের বসবাস। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার তাদের বাঁচাতে যুগপোযোগী এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের স্বীয় দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে। যা প্রসংশার দাবি রাখে। তাদের থেকে এই ভাইরাস যেন আমাদের দেহে প্রবেশ করে মৃত্যুর মত ভয়ানক পরিবেশের সাথে সাক্ষাৎ না হতে হয় সেটা খেয়াল রাখা যরূরী। সাবধানের কোন বিকল্প নেই। অবিলম্বে সরকারকে আরো কার্যকরী ব্যবস্থা জোরালো করার অনুরোধ জানাচ্ছি। ইতিমধ্যে চীনা সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হুবেই প্রদেশের উহান এবং পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে।[১৮]

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর উম্মতকে একটি বিষয়ে প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই সতর্ক করেছেন। অত্যন্ত মজার বিষয় হল- জেনে হোক আর না জেনেই হোক চীনা সরকার সেই দেড় হাযার বছর আগের রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত বাণীকে বর্তমানে অনুসরণ করছে। রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন,

إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُوْنِ بِأَرْضٍ فَلَا تَدْخُلُوْهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلَا تَخْرُجُوْا مِنْهَا

‘যখন তোমরা কোন অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোন, তখন সে এলাকাই প্রবেশ করো না। আর যদি তোমরা যেখানে অবস্থান কর, সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না’।[১৯] সুতরাং আপনি যত বড়ই প-িত আর মহাজ্ঞানের সর্বোচ্চ অধিকারী হন না কেন আপনাকে ফিরে আসতে হল রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীর নিকট।

স্থায়ী শাস্তি আসার পূর্বেই যালিমদের প্রতি সাময়িক শাস্তি

চীনে ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাস বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তবে এর মধ্যেই আশ্চর্য খবর পাওয়া গেছে, উইঘুর মুসলিমরা করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত রয়েছেন। অথচ তাদের যে পরিবেশে রাখা হয়েছে, তাতে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা ছিল বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কতা জারি করেছে, তার মধ্যে চীনের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল উইঘুর বন্দি শিবির। জিনঝিয়াং প্রদেশে বিভিন্ন বন্দি শিবিরে উইঘুর মুসলিমদের রাখা হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতির মধ্যে। সেখানে উইঘুর মেয়েদের জোর করে বন্ধ্যা করে দেয়া হচ্ছে। কোন ধরণের ধর্মীয় আচারবিধি পালন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুর মুসলিমের দিন কাটছে। সে কারণে করোনা ভাইরাস আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছিল। উইঘুর বন্দিশিবিরে করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত প্রসঙ্গ নিয়ে মার্কিন সংবাদ মাধ্যম একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, ‘উইঘুর মুসলিমরা করোনা গ্রাস থেকে অনেকটাই রেহাই পাচ্ছেন। তার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, তারা হালাল খাদ্য খেয়ে থাকেন, যা তাদেরকে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ রাখছে’।[২০]

বর্তমানের ভাইরাসটি নিয়ে অনেকেই তাদের ব্যক্তিগত মন্তব্য করেছেন বিভিন্নভাবে। চীনের সরকার অনেক দিন ধরে সে দেশে ভূমিষ্ট হওয়া উইঘুর মুসলিমদের স্বীয় মাতৃভূমিতে ঠাঁই না দেয়ার পায়তারা করছে। বহু কলা কৌশল আর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়ে বিভিন্নভাবে তাদের উপর অত্যাচারের কঠিন বিষস্বাদ আস্বাদনে বাধ্য করছে। সেই দৃশ্যের পটভূমি দেখে বিশ্ব নন্দিত দেশসমূহ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি দর্শকের সারি থেকে বাদ পড়েনি মুসলিম দেশসমূহ। মানব ইতিহাসের বর্বরচিত যুলুম করেই চলেছে। হতে পারে আল্লাহ তা‘আলার গযব হিসাবে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে চীনসহ উইঘুর মুসলিমের নির্যাতনে চুপ থাকা দেশগুলোর উপর। আল্লাহর প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। তার আক্রশ হাজারটি পারমাণবিক বোমাকেও হার মানায়। সন্দেহের অবকাশ রাখে না এই মহামারি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ لَا تَحۡسَبَنَّ اللّٰہَ غَافِلًا عَمَّا یَعۡمَلُ الظّٰلِمُوۡنَ اِنَّمَا یُؤَخِّرُہُمۡ لِیَوۡمٍ تَشۡخَصُ فِیۡہِ الۡاَبۡصَارُ ‘আর তোমরা ভেবো না যে অন্যায়কারীরা যা করে আল্লাহ সে সম্বন্ধে বেখেয়াল। তিনি শুধু তাদের অবকাশ দিচ্ছেন’ (সূরা ইবরাহীম : ৪২)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ مَکَرُوۡا وَ مَکَرَ اللّٰہُ وَ اللّٰہُ خَیۡرُ الۡمٰکِرِیۡنَ ‘আর তারা চক্রান্ত করেছিল, আল্লাহও পরিকল্পনা করেছিল। আল্লাহ পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে সর্বোত্তম’ (সূরা আলে ইমরান : ৫৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَ مَا کَانَ رَبُّکَ نَسِیًّا ‘আপনার রব কোন কিছুই ভুলে যান না’ (সূরা মারইয়াম : ৬৪)। আল্লাহ তা‘আলা হয়তো সাময়িকভাবে আমাদের ছাড় দিয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করার তাওফীক্ব দিয়েছেন কিন্তু চূড়ান্তভাবে কোন ক্রমেই ছেড়ে দেননি। যালেমকে দুনিয়াতেই আল্লাহ তা‘আলা শায়েস্তা করেন, আখেরাতের মহাশাস্তি তো আছেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوۡا نِعۡمَۃَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ جَآءَتۡکُمۡ جُنُوۡدٌ فَاَرۡسَلۡنَا عَلَیۡہِمۡ رِیۡحًا وَّ جُنُوۡدًا لَّمۡ تَرَوۡہَا ؕ وَ کَانَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرًا

‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তোমাদের উপরে সৈন্যদল এসে পড়েছিল, তখন আমরা তাদের বিরূদ্ধে পাঠালাম এক ঝড়-ঝাঞ্ঝা, আর এক বাহিনী যা তোমরা দেখতে পাওনি।আর তোমরা যা করছিলে সে-সম্বন্ধে আল্লাহ সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা আল-আহযাব : ৯)। সুতরাং আল্লাহর ফায়ছালা অত্যন্ত সূক্ষ্ম। আল্লাহর শাস্তি মাযলূমদের হয়ে যালিমদের উপর বর্তানোই স্বাভাবিক। তা হয়তো কখনো বাতাসের সাহায্যে, নতুবা মহামারি আকারেও আসতে পারে।

আল্লাহ তা‘আলা কখন কোন্ অবস্থায় কিভাবে কার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন সেটা তিনি ছাড়া কেউ জানেন না। যদি এগুলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে গযব হয়ে থাকে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মাফ করুন। কেননা সেই সময় আমরাও নীরব থাকতে পিছপা হয়নি। সুতরাং আমাদেরও ইস্তেগফার পড়া উচিত। এই মহামারীর অদৃশ্য ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্য আমরা সর্বদা স্বাস্থ্য গবেষক ও স্বাস্থ্যবোদ্ধাদের সচেতনতামূলক পরামর্শ পুঙ্খানুপঙ্খুরূপে অনুসরণ করব। সেই সাথে আল্লাহর কাছে বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করব। আল্লাহ যেন এই মহা বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করেন এবং চীনা মুসলিমসহ পৃথিবীর সকল মানুষদের এই মহামারী থেকে রক্ষা করেন। সাথে সাথে কর জোড়ে মিনতি করব এই বলে যে, ‘হে আল্লাহ! আপনি সকল যড়যন্ত্রকারীর ভয়ংকর চক্ষু হতে আপনার বান্দাদের রক্ষা করুন। এই ধ্বংসস্তূপ কা- হতে শিক্ষা অর্জন করে সামনের দিনসহ বর্তমান দিনগুলোতে সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার থেকে বিরত রাখুন। আর যারা অবুঝ এবং নির্যাতনকারী তাদের বোঝার তাওফীক্ব দান কর- আমীন!

* অধ্যয়নরত, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।

[১]. ড. মুহাম্মদ আবুল হাসান, উচ্চ মাধ্যমিক জীববিজ্ঞান, প্রথম পত্র (জুন ২০১৩ খ্রি.), পৃ. ১১৩-১২০।

[২]. উইকেপিডিয়া।

[৩]. দৈনিক প্রথম আলো, সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২০, পৃ. ০৮।

[৪]. দৈনিক প্রথম আলো, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২০, পৃ. ১০।

[৫]. দৈনিক প্রথম আলো, বুধবার, ২২ জানুয়ারি ২০২০, পৃ. ১০।

[৬]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃ. ১২।

[৭]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২০, পৃ. ১১।

[৮]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি, পৃ. ১২।

[৯]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃ. ১২।

[১০]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃ. ১২।

[১১]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, পৃ. ১২।

[১২]. বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ জানুয়ারি ২০২০, অনলাইন ভার্সন।

[১৩]. ‘কতোটা ক্ষতিকর করোনা ভাইরাস’ প্রতিদিন বাংলাদেশ, ২৬ জানুয়ারী, ২০২০।

[১৪]. দ্য ডেইলি স্টার, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০, পৃ. ১।

[১৫]. ‘করোনা ভাইরাস : চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮১৩’ কর্পোরেট সংবাদ, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০।

[১৬]. বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ জানুয়ারি ২০২০, অনলাইন ভার্সন।

[১৭]. বাংলা ট্রিবিউন, ২৩ জানুয়ারি ২০২০, অনলাইন ভার্সন।

[১৮]. দৈনিক প্রথম আলো, মঙ্গলবাল, ০৪ ফেব্রুয়ারি, পৃ. ১২।

[১৯]. ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২৮।

[২০]. ‘হালাল খাবারে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা উইঘুর মুসলিমদের’, দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস, রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০।




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস - এহসান বিন মুজাহির
ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
নির্যাতিত মানুষের আর্তচীৎকার ও আল্লাহর সাহায্য - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় - হাসিবুর রহমান বুখারী
করোনা ভাইরাস - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক - তানযীল আহমাদ
ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ