বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ অপরাহ্ন

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা

-মুহাম্মদ আমীনুল ইসলাম*



দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।*একটি পরিবার কীভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে নির্বাহ করবে তা নির্ভর করে তাদের আয়, চাহিদা এবং দ্রব্যমূল্যের ওপর। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন তাদের জীবন কাটে স্বস্তিতে। অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন সাধারণ মানুষের আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দরিদ্র এবং অতিদরিদ্র পরিবারে শুরু হয় অশান্তি। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে একদিকে জনজীবনে নেমে আসে কষ্টের কালো ছায়া। অন্যদিকে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন হয় ওষ্ঠাগত। বাজারে চাল, ডাল, তেল, লবন, পেঁয়াজ, শাকসবজি থেকে শুরু করে এমন কোন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নেই, যার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে না। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে। বেতন ও মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু উল্লেখ না করলেই নয় যে, সম্প্রতি ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি কমেছে এমন ১৫টি দেশের যে তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক, সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। যদিও উক্ত তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু ভারত ও পাকিস্তানের নাম রয়েছে। ১৫টি দেশে যেমন গতিতে দারিদ্র্যতা কমেছে, বাংলাদেশে তার চেয়ে কম গতিতে কমেছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি। নিম্নআয়ের মানুষ যা আয় করছে, তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য ব্যয় করার মত অর্থ তাদের হাতে থাকছে না।

পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হয় যে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ২০১৭ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। বৃদ্ধির এই হার আগের বছরের চেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ। ২ জানুয়ারি ২০১৮ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পায় ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

গত বছর লাগামহীনভাবে দাম বাড়ার পরও চলতি বছরের শুরুতেও থেমে নেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। গত মাসের টিসিবির পণ্যমূল্যের তালিকা অনুযায়ী ১২টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে মাঝারি মানের চাল ৮.৮২, মোটা চাল ৩.০৮, খোলা সয়াবিন ১০.৮১, পাম অয়েল ৬.৯৫, আলু ২২.৭৩, চিনি ৪.৪২, লবণ ৫.২৬, ডিম ১৬, রুই মাছ ১৮.৪২, মুরগি ১৩.৩৩, মশুর ডাল ৪.৫২, রসুন ২৬.৮১, শুকনো মরিচ ৬.০৬, আদা ৪০ এবং গুঁড়ো দুধ ৫ শতাংশ।[১] দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির উক্ত ধারাবাহিকতা রামাযান মাসে যেন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব

খাদ্যদ্রব্য তথা নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি জনজীবনের গতিকে অচল ও আড়ষ্ট করে তোলে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি বাড়ছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে না মানুষের আয়। ফলে জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশির ভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। তাই সরকারকে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই শুধু নয়-কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূলে বহুবিধ কারণ রয়েছে- স্বার্থপরতা, অসাধু সমাজবিরোধী তৎপরতা, অর্থলোভী মানুষের অমানবিক আচরণ। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারণে অর্থাৎ অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে আশানুরূপ ফসল উৎপাদিত না হলে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। আবার কৃষি ও শিল্প কারখানাগুলোর উৎপাদনে সীমাবদ্ধ এবং বিদেশি মুদ্রার অভাবে পণ্যদ্রব্য চাহিদা পরিমাণ আমদানি করা সম্ভব না হলে চোরাকারবারি, মজুদদারি ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে। তারা জিনিসের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে, ফলে দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়া জনগণকে হতাশার রাজ্যে নিয়ে উপনীত করেছে।

পণ্য উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে যখন কোন  প্রকার সামঞ্জস্য না থাকে, তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয়। ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সাথে দ্রব্যমূল্য সমন্বয় সাধন করতে পারে না; সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক সংকটের। জীবন ধারণের জন্য মানুষের কিছু মৌলিক চাহিদা আছে, যা ব্যতীত সে জীবনধারণ করতে পারে না। সারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে চাহিদার পরিমাণও। সুতরাং ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো দুরুহ বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘটনাও স্বাভাবিক বলে বিবেচনার যোগ্য। পর্যালোচনার মাধ্যমে দেশের ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যেসব কারণ বেরিয়ে আসে, তা নিম্নরূপ :

১). ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট

ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ। এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বলে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে। সরকারও বিভিন্ন সময় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য এসব ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছে।

২). চাঁদাবাজি  

শিল্প মালিক, উদ্যোক্তা, উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের ওপর মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ। ব্যবসায়ী এবং উৎপাদকরা চাঁদাবাজদের প্রদত্ত চাঁদার ক্ষতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নেন। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ ভোক্তারা। আর এর বলি হন সাধারণ জনগণ।

৩). আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি

আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব অভ্যন্তরীণ বাজারেও পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অভ্যন্তরীণ বাজারে স্বাভাবিকভাবেই এর মূল্য বেড়ে যায়।

৪). সরকার কর্তৃক অতিরিক্ত করারোপ ও শুল্ক বৃদ্ধি

দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ সরকার কর্তৃক অতিরিক্ত করারোপ। তৃতীয় বিশ্বের অধিক আর্থিক সংকট কাটানোর জন্য আমদানিকৃত ও দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের উপর বিপুল পরিমাণ কর আরাপ করা হয়। এছাড়া শুল্ক বৃদ্ধির কারণেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং তদারকির ক্ষেত্রে সরকারের অমনোযোগিতা ও ব্যর্থতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি বিরাট কারণ। ফলে দ্রব্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে। আমাদের মত গরীব ও উন্নয়নশীল দেশে অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে দ্রব্যমূল্যের উপর অধিক চাপ পড়ে ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

৫). মজুদদারি  

মজুদদারির মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেউ অকারণে মজুদ করে রাখলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অথচ ইসলামে কৃতিম সংকট তৈরি করার জন্য মজুদদারি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ ‘যে ব্যক্তি (জনগণের জীবিকা সঙ্কীর্ণ করে) খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে, সে বড় অপরাধী’।[২] ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মজুদদার মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে মজুদ করে রাখে এবং তাদের (ক্রেতার) নিকট চড়া দামে বিক্রি করতে চায়। তাহলে সে ক্রেতার উপর যুলুমকারী। এজন্য শাসক মানুষের প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের নিকট মজুদকৃত জিনিস প্রকৃত মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারেন। যেমন, কারো নিকট এমন খাদ্য মজুদ আছে যার প্রয়োজন তার নেই। আর এমতাবস্থায় মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে। তবে তাকে প্রচলিত বাজার মূল্যে মানুষের কাছে তা বিক্রি করতে বাধ্য করা হবে’।[৩]

৬). দালালী

দালালি করলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় কেনার উদ্দেশ্যে নয়, বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে দালাল চক্রকে অধিক মূল্যে দর-দাম করতে দেখা যায়। ইসলামে এটাও নিষিদ্ধ। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, نُهِيْنَا أَنْ يَبِيْعَ حَاضِرٌ لِبَادٍ وَإِنْ كَانَ أَخَاهُ أَوْ أَبَاهُ ‘কোন শহরবাসী (দালাল) যেন গ্রামবাসীর পণ্য বিক্রি না করে- এ বিষয়ে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। যদিও সে ব্যক্তি তার নিজের ভাই বা পিতা হয়’।[৪]

নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর পূর্বে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।[৫] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, وَلَا تَلَقَّوُا السِّلَعَ حَتَّى يُهْبَطَ بِهَا إِلَى السُّوْقِ ‘তোমরা পণ্য ক্রয় করো না তা বাজারে হাযির না করা পর্যন্ত’।[৬]

ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইবনু আবূ আওফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ঐ ব্যক্তিকে নাজিশ (দালাল) বলেছেন, যে ব্যক্তি ক্রয়কৃত মূল্যের চেয়ে বেশী দামে ক্রয় করেছি বলবে। এক্ষেত্রে সে ঐ ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্য রাখে যে অন্যকে ধোঁকা দেয়ার জন্য পণ্যের বেশী দাম হাঁকে, অথচ তা কেনার ইচ্ছা তার নেই। এজন্য হুকুমের ক্ষেত্রে তারা উভয়েই সমান। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী নাজিশ (দালাল) সূদখোর’।[৭]

এ কারণে একজন ক্রেতা কোন জিনিসের দাম করলে তার উপর দাম না বলাই ইসলামের নির্দেশনা। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি তার মুসলমান ভাইয়ের ক্রয়-বিক্রয়ের উপর ক্রয়-বিক্রয় করবে না এবং তার ভাইয়ের দামের উপর দাম বলবে না।[৮]

৭). প্রাকৃতিক দুর্যোগ  

প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, জালোচ্ছ্বাস, খরা প্রভৃতির কারণে ফসল নষ্ট হলে বা পণ্যের স্বল্পতা দেখা দিলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কঠিন শাস্তির পূর্বে আমরা তাদের লঘু শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাব। যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা আস-সাজদাহ : ২১)। তিনি আরো বলেন, ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন ও প্রাণের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-শস্যাদি বিনষ্টের মাধ্যমে ... (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৫৫)।

মূলত মানুষের পাপের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ظَہَرَ الۡفَسَادُ فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ بِمَا کَسَبَتۡ اَیۡدِی  النَّاسِ  لِیُذِیۡقَہُمۡ بَعۡضَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا  لَعَلَّہُمۡ یَرۡجِعُوۡنَ ‘স্থলে ও সমুদ্রে সর্বত্র বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের কৃতকর্মের ফল হিসাবে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের কর্মের কিছু শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা আর-রূম : ৪১)। ফলে উক্ত পরিস্থিতিতে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী কম উৎপাদন হেতু মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।

৮). সূদ  

সূদের ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সূদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী উৎপাদন খরচের উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক, অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে পণ্যদ্রব্যের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু সূদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের উপর উপর্যুপরি সূদ যোগ করা হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চার বা তার চেয়েও বেশী সূদ যুক্ত হয়ে থাকে। ফলে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঘোড়ার পদতলে পিষ্ট হয় সাধারণ মানুষ। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই সূদের জন্য সৃষ্ট এই চড়ামূল্য দিতে হয়।[৯] অথচ ইসলামে সূদকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৭৫)।

৯). মধ্যস্বত্বভোগীদের অনৈতিক হস্তক্ষেপ

যে কোন পন্যই মধ্যস্বত্বভোগীরা অধিক লাভের আশায় কিনে রাখে বা অনৈতিক হস্তক্ষেপ করে। অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে যে মূল্যে ব্যবসায়ী ও মধ্যস্বত্বভোগীরা তা ক্রয় করে থাকে কিংবা সেখানে যে মূল্যে সে দ্রব্য বিক্রি হয়, বাজারে তা বিক্রি করে অনেক বেশি চড়া দামে। মধ্যস্বত্বভোগীদের অত্যধিক মুনাফা লাভের এ হীন মানসিকতার ফলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। অনেক সময় পাইকারী বাজারে পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে খুচরা বাজারে সেটি ২০-৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়া হয়। আবার পাইকারী বাজারে কোন পণ্যের দাম ২০ শতাংশ কমলে খুচরা বাজারে সেটি ১০ শতাংশও কমে না।[১০]  

১০). কালো টাকার দৌরাত্ম্য

কালো টাকার দৌরাত্ম্য বা প্রভাব এদেশে একটি স্বাভাবিক বা নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। এই কালো টাকার একটা নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত বলে তারা ১০০ টাকার জিনিস ৫০০ টাকায় ক্রয় করতে দ্বিধা করে না। আর সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যায়।

১১). অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়া

অতিরিক্ত পরিবহন ভাড়ার ফলেও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। কারণ দ্রব্যসামগ্রীর পরিবহন খরচ বেশি এ অজুহাতেও ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। সামান্য কোন অজুহাত বা কোন দুর্ঘটনা দেখিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা অতিরিক্ত ভাড়া দাবি করে। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ রুট মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে দৈনিক চার লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। পণ্যবাহী ট্রাকচালক ও তাদের সহকারীরা এ চাঁদাবাজির শিকার হন।[১১] ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন গত ১০ই মে ১৯ তারিখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘গাবতলী পশুর হাটে চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে গোশতের দাম কিছুটা হলেও কমবে’।[১২]

১২). আমদানীকারকদের অশুভ মানসিকতা   

আমদানীকারকরা যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিদেশ থেকে আনেন সেগুলোর কোটেশন অনেক বেশী করে দেন। আর এভাবেই ওভার ইনভয়েসিং (চালানপত্রে পণ্যের দাম বেশি দেখানো) হয়। শুল্ক হার কমিয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করতেই ওভার ইনভয়েসিং করা হয়। এই ওভার ইনভয়েসিং-এর মাধ্যমে অসাধু আমদানীকারকরা একদিকে বেশি করে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, অন্যদিকে পণ্যমূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে এ দোহাই পেড়ে বেশি দামে আমদানীকৃত পণ্য বাজারে ছাড়েন। এর ফলে স্থানীয় বাজারে জিনিসপত্রের দাম ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং পরিণতিতে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে। তাছাড়া ওভার ইনভয়েসিংয়ের কারণে আমদানির নামে পণ্যের প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায়।[১৩]  

১৩). পণ্যের স্বল্পতা

সারারণত জনগেণের চাহিদা পূরণের জন্য যতটুকু পণ্য প্রয়োজন তার তুলনায় পণ্যের স্বল্পতা দেখা দিলেই বাজারে দ্রব্যমূল্যে দাম বৃদ্ধি পায়। সেই পণ্যের স্বল্পতা নানা কারণেই হতে পারে যেমন: উৎপাদন কম হওয়া, পরিবহন খরচ ও অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পাওয়া, মজুদদারি করে রাখা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়া ইত্যাদি। অনেক সময় পণ্যের স্বল্পতা বা কতিপয় নাগরিকের পণ্য মজুদের প্রবণতার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সম্পদশালী ব্যক্তিরা বাজারে আসে এবং পণ্য ক্রয় করে জমা করে রাখে। এদিকে বাজারে পণ্যের স্বল্পতার দরুন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। চাই সে ব্যক্তি নিজের জন্য পণ্য সংগ্রহ করুক বা পরবর্তীতে চড়া দামে বিক্রির লক্ষ্যে মজুদদারির উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করুক।

১৪). ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা না থাকা

ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা হল মানুষের জন্য কল্যাণকর অর্থ ব্যবস্থা। কিন্তু এই অর্থ ব্যবস্থার যখন অভাব দেখা দেয় তখন তার প্রভাবও বাজারে গিয়ে পড়ে এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা হল- সূদ, ঘুষ, মজুদদারী বিরোধী সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অর্থ ব্যবস্থা। এছাড়াও সম্পদের যাকাত প্রদান না করা বালা-মুছীবত ও মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ। যাকাত প্রদান করলে সম্পদে বরকত বৃদ্ধি পায় এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সমাজের মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট থাকে।

১৫). পণ্যদ্রব্য বিদেশে পাচার

বেশী লাভের আশায় এক দেশের পণ্য যখন দেশীয় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলী দেখিয়ে অন্য দেশে পাচার করা হয়, তখন সে দেশে পণ্যের স্বল্পতা দেখা দেয় এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও আমাদের দেশের একশ্রেণীর মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফা অর্জনের আশায় সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী দেশে তেল, চামড়াসহ অন্যান্য দ্রব্য পাচার করে। ফলে দেশে সেসব পণ্যের ঘাটতি পড়ে এবং মূল্য বেড়ে যায়।

১৬). বিলাসিতা  

কোন একটি দেশ, জাতি বা ব্যক্তি যখন বিলাসিতায় মগ্ন হয়ে যায় কোন কারণে তাতে ভাটা পড়লে সে দেশ, জাতি ও ব্যক্তির ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। বিলাসিতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বিলাসী ব্যক্তিরা তাদের চাহিদা পূরণের জন্য যেকোন মূল্যে পণ্য কিনতে তৎপর ও উৎসাহী থাকে। এজন্য ইসলাম আমাদেরকে বিলাসিতা থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছে। কারণ বিলাসিতার কারণে পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগুলোর মধ্যে এমন দূরদর্শী লোক কেন হল না, যারা জনপদে বিপর্যয় সৃষ্টিতে বাধা দিত? তবে অল্প কিছু লোক ব্যতীত, যাদেরকে আমরা তাদের মধ্য হতে রক্ষা করেছিলাম। অথচ যালেমরা তো ভোগ-বিলাসের পিছনে পড়ে ছিল। আর তারা ছিল মহাপাপী। আর তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, সেখানকার অধিবাসীরা সৎকর্মশীল হওয়া সত্ত্বেও জনপদসমূহকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দিবেন’ (সূরা হূদ : ১১৬-১১৭)।

১৭). রাজনৈতিক অস্থিরতা

একটি দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে ক্ষমতা লোভের কারণে মত্ত হয়ে উঠে সরকারী ও বিরোধীদলগুলো, তখন সে দেশে স্থিতিশীলতা থাকে না। বিশেষ করে আমাদের মত গরীব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘন ঘন হরতাল ও ধর্মঘটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।

১৮). প্রশাসনিক দুর্নীতি

প্রশাসনের দুর্নীতি আজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছে। দেশে দেশে প্রশাসনের দুর্নীতি যেন কালো ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনিক দুর্নীতি যেমন অবৈধভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো, কালোবাজারি, মজুদদারি, চোরাকারবারি, দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়।

১৯). বিদেশী সাহায্য, মুদ্রাস্ফীতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি

গরীব ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো আজ বিদেশী সাহায্যের উপরই নির্ভরশীল। বিদেশী সাহায্য দেশে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে। আর মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে কোন পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে তার প্রভাব পড়ে এবং পণ্যের দাম বেড়ে যায়।

২০). অসুস্থ প্রতিযোগিতা

অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি হয়। আর এ প্রতিযোগিতা আজ বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের দেশে হরহামেশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একজন বিক্রেতা পাইকারি বাজারে যদি অন্য ক্রেতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয় করে তবে বিক্রয়মূল্য বাড়বেই।

২১). সরকারী কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা বৃদ্ধি

দেশের একটি ক্ষুদ্রতম অংশ ভাতা পেলেও এর ফলে ক্ষতির শিকার হয় সমাজের বৃহত্তম অংশ। সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা বৃদ্ধির মত অন্যতম কারণে দেশে দেশে বিশেষ করে আমাদের মত দেশে দ্রব্যমূল বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ যারা মহার্ঘভাতা পাচ্ছেন তারা বিলাসী জীবন-যাপনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দ্রব্যমূল্যের উপর।

২২). সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব

সরকার, প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু নীতিমালা প্রয়োগ ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হয়।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হলে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অনেকটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। কাজেই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একান্ত অপরিহার্য। অবৈধভাবে দ্রব্য পাচার রোধে ও মজুদদারি রোধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি জমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে। বাজারের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও মজুদদারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন ও উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে পণ্যের যোগান ঠিক রাখতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল, দেশের সকল মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়াগ করতে হবে। নি¤েœ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকারে কয়েকটি সুপারিশ করা হল-

১). দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে জড়িত ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে গোয়েন্দা সংস্থা ও জনগণের সহযোগিতায় শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।

২). প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জনগণের কষ্ট লাঘবের জন্য যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩). মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে অত্যধিক মুনাফা লাভের মানসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য কার্যকর নিয়ম-নীতি প্রণয়ন ও দণ্ডবিধির ব্যবস্থা করা।

৪). অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং সরকার কর্তৃক জনগণের সম্পদের হিসাব গ্রহণ করা।

৫). সকল প্রকারের চাঁদাবাজি বন্ধ করা এবং পরিবহনের খরচ কমানোর ব্যবস্থা করা।

৬). প্রতারণা ও দালালী ক্রয়-বিক্রয় যাতে না চলে সেজন্য বাজার তদারকির ব্যবস্থা করা।

৭). কোন দ্রব্যের উৎপাদন-সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে বা ঘাটতির আশংকা দেখা দিলে আমদানী উৎসাহিত করতে সরকার কর্তৃক শুল্ক কমিয়ে দেয়া এবং জনগণের মৌলিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বেশি বেশি আমদানী করা।

৮). দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির আশংকা দেখা দিলে সরকার কর্তৃক পণ্যদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করা।

৯). দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলায় জেলায় গঠিত টাস্কফোর্স জোরদার ও পণ্য সরবরাহ মনিটরিং সেল গঠন করা।

১০). দেশে কৃষিপণ্যের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিশাল মার্কেট গড়ে তুলতে হবে।

১১. রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ফসলাদি সংগ্রহ করা। যাতে উৎপাদনকারীরা ন্যায্যমূল্য পায় এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

১২). ব্যাংকগুলোতে এলসি বা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের সময়সীমা কমিয়ে এক মাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। যাতে আমদানীকারকরা মজুদের সময় না পায়।

১৩). সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা নযরদারী জোরদারে কার্যকর ভূমিকা পালন ও তদারকি করা। 

১৪). উৎপাদনকারীরা যাতে অধিক পরিমাণে পণ্য উৎপন্ন করে সেজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং উৎসাহ দেয়া।

১৫). খাদ্যশস্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় ভোগ্যপণ্য ভর্তুকী সহকারে রেশনিং পদ্ধতিতে বিতরণ করা।

১৬). রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার আওতায় ব্যাপকভাবে ভোগ্যপণ্য উৎপাদন ও বণ্টনের সুব্যবস্থা গ্রহণ করা।

১৭). অপচয় ও বিলাসিতাপূর্ণ জীবন পরিহারের ব্যবস্থা ও কার্যকর ভূমিকা পালন করা।

১৮). বর্ধিত মূল্যের জিনিস পরিহার ও অল্পে তুষ্ট থাকার মানসিকতা তৈরি করা।

১৯). অসহায় ও দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং লেনদেনে সহজ পন্থা অবলম্বন করা।

২০). নিজ নিজ ধর্মীয় জীবনযাপনে অভ্যস্ত করা। কারণ প্রত্যেক ধর্মেই ন্যায়-অন্যায় দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং অপচয় জীবন পরিহারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

২১). ইনছাফপূর্ণ ইসলামী অর্থনীতি চালু করা ও ইসলামী জীবনযাপনের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটি বৈশ্বিক সমস্যার পাশাপাশি আমাদের দেশের জন্য চরম সমস্যা। এটি আমাদের উপর মুছীবত হিসাবে আপতিত হয়েছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিকতাবোধের উজ্জীবন ঘটাতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্রকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি, বিশর ইবনুল হারিছের উক্তি ‘তুমি যখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য উদ্বিগ্ন হবে তখন মৃত্যুকে স্মরণ করবে। কারণ মৃত্যুকে স্মরণ তোমার মন থেকে মূল্যবৃদ্ধির দুঃশ্চিন্তা দূরীভূত করে দিবে’ (হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৭)। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে দায়িত্বশীলরা কার্যকর ভূমিকা পালন করুন। মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি রহমত করুন-আমীন!!



* এমএসসি, সাংবাদিক, জয়পুরহাট।

[১]. বাংলা নিউজ ২৪ (www.banglanews24.com), ১৩ জানুয়ারী ২০২১।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৫।
[৩]. ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২৮তম খণ্ড, পৃ. ৭৫।
[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৬১.; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫২৩.; নাসাঈ, হা/৪৪৯৩।
[৫]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৬৬।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/২১৬৫; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫১৭।
[৭]. ইবনু হাজার আসক্বালানী, ফাৎহুল বারী (বৈরূত : : দারুস মা‘রেফাহ, ১৩৭৯ হি.), ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৫৬।
[৮]. ইবনু মাজাহ, হা/২১৭২, সনদ ছহীহ।
[৯]. প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, সূদ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২য় সংস্করণ, ২০১০), পৃঃ ২৬-২৮।
[১০]. প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০১৯।
[১১]. প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০১৯।
[১২]. প্রথম আলো, ১০ মে ২০১৯।
[১৩]. http://envnews.org/ news /10873.html




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
করোনা ভাইরাস - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
নির্যাতিত মানুষের আর্তচীৎকার ও আল্লাহর সাহায্য - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক - তানযীল আহমাদ
ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় - হাসিবুর রহমান বুখারী
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস - এহসান বিন মুজাহির
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ