ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ
-আব্দুল্লাহ আল-মামুন*
কোন একদিন, কোন এক জায়গায় খুব আনমনা অবস্থায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। প্রচ- মানুষের ভিড়ে হঠাৎই হৃদয়ে বারবার একটি শব্দ ধাক্কা দিল। সেটা হল বর্তমানে খুব আলোচিত ও নিন্দিত শব্দ ‘ধর্ষণ’। কয়েক বছর পূর্বে পত্রিকার হকাররা পত্রিকা বিক্রয় করত দিনের সেরা খবরটি ঘোষণা করে। আর বর্তমান সময়ে সেই ঘোষণার বড়সড় একটি বিষয় হল ধর্ষণ! এই ধরুন… সুবর্ণ চরে গণধর্ষণ, এখানে ধর্ষণ, সেখানে ধর্ষণ, ঘরে ধর্ষণ, বাইরে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের আসামী গ্রেফতার বিচার নেই, ধর্ষণের পর হত্যা ইত্যাদি বিষয়গুলোই এখন খবরের ভাষা। হ্যাঁ! বলছিলাম আমাদের বাংলাদেশেরই গল্প। এমন কোন দিন নেই যেদিন পত্র-পত্রিকার পৃষ্ঠাগুলোতে ধর্ষণের খবর আসে না। যা দেখে ও পড়ে সাধারণ মানুষ যথারীতি আঁতকে উঠে। শরীরে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন নির্বিকার হয়ে যায়। এগুলো কিছু প্রকাশিত, এতদ্ব্যতীত আরো কত ধর্ষণের খবর যে অজানা থেকে যায়, যা দেখার কেউ নেই। তাই ধর্ষণ হল সাম্প্রতিক সময়ের একটি অন্যতম উদ্বেগজনক ও আলোচিত বিষয়। এটি একটি বিকৃত রুচির সামাজিক ব্যাধি।
ধর্ষণ হল যৌনতার একধরনের বিকৃত উপস্থাপন, এটি বর্তমানে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত ধর্ষণ একধরণের যৌন আক্রমণ। সাধারণত একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোন ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ; অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমেই সংঘটিত হতে পারে। এমনকি অনুমতি প্রদানে অক্ষম (যেমন কোন অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী, কিংবা অপ্রাপ্ত বসয়স্ক) এরকম কোন ব্যক্তির সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত।
ধর্ষণ বা বলাৎকারকে বিভিন্নভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা যায়। যেমন ঠিক কোন্ পরিস্থিতিতে তা হচ্ছে বা যিনি ভিক্টিম (নির্যাতিত) তার বৈশিষ্ট্য কী ছিল? যে অপরাধী তার পরিচয় বা বৈশিষ্ট্য কী? এই সবের উপর ধর্ষণের নানাবিধ শ্রেণীবিন্যাস করা হয়।
‘ডেট ধর্ষণ’ (Date Rape) হল অত্যন্ত প্রচলিত একটি ধষর্ণের প্রকার। এটি এমন এক ধরণের ধর্ষণ, যেখানে ধর্ষিতা ধর্ষক বা অপরাধীকে পূর্ব থেকে চিনে এবং এ ধর্ষণ সাধারণত নিজ গৃহে হয় না। ডেটিং ধর্ষণ দুই প্রকার। (ক) Acquaintance rape অর্থাৎ ধর্ষক ও ধর্ষিতা একে অপরকে চিনে ও কোন ড্রাগের ব্যবহার করা হয় না। (খ) Drug facilitated sexual assault অর্থাৎ যা ডেটিং রেপের মত, যেখানে শিকারকে ধর্ষক ইচ্ছে করে ড্রাগ দিয়ে অচেতন বা তার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে বলাৎকার করা হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য ধর্ষিতা ধর্ষণের পূর্বে সম্মতি দেয়ার পরিস্থিতিতে থাকে না। গভীর প্রেম ভালবাসার একটি চূড়ান্ত ফলাফল হল এই ডেট ধর্ষণ।
কয়েকজন মিলে (ন্যূনতম তিনজন) একজনের উপর চড়াও হয়ে যদি ধর্ষণ করা হয় তবে তাকে ‘গণধর্ষণ’ বলে। এটা প্রায় সমগ্র বিশ্বেই দেখা যায়। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই ধরনের ধর্ষণে যারা জড়িত থাকে তারা প্রায় সবাই যুবক বয়সের এবং প্রায় সবাই বেকার। গণধর্ষণে সাধরণত মাদক ব্যবহার করা হয়, সাধারণত রাত্রিবেলায় গণধর্ষণ করা হয়। গবেষণায় বলছে, যারা দল বেধে ধর্ষণ করে, তাদের মদ্যপান বা মাদকদ্রব্য গ্রহণের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত থাকে। মানুষ কতটা পশুত্বকে বরণ করে নিলে এ ধরণের কাজে লিপ্ত হতে পারে ভাবুন তো! যৌন ক্ষুধা মেটানোর জন্য গণহারে একজন নারীকে লালসার শিকার বানায়।
শিশু ধর্ষণ শিশুর যৌন নির্যাতনেরই একটি অংশ। যদি কোন শিশুর দ্বারা (সচরাচর দেখা যায় বয়সে বড় অথবা নির্যাতিতের তুলনায় শক্তিশালী) অথবা কিশোর দ্বারা (যার যৌন বয়ঃসন্ধি চলছে) কাজটা করা হয়, তাহলে একে বলা হয় শিশুর প্রতি শিশুর যৌন নির্যাতন। যদি আপন কারো দ্বারা এই ঘৃণকাজটি করা হয়, তবে একে বলা হয় অজাচার। দেখা গেছে এর জন্য নির্যাতিত শিশু মনস্তাত্ত্বিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। যদি কোন শিশু তার পারিবারিক সদস্য নয়, কিন্তু এমন কারো দ্বারা ধর্ষিতা হয়, যার উপর সে নির্ভর করে। যেমন : দেখাশোনা করে এরকম কাজের লোক, স্কুল শিক্ষক, চিকিৎসক ইত্যাদি তাহলেও শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য অজাচার বৃত্তির মতই প্রকট ঝুঁকিতে পড়ে। শিশু ধর্ষণ করা কি শুধুই বিকৃতকাম, না-কি কুসংস্কারও? শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন চালানোর একটা বড় কারণ বিকৃত মানসিকতা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় পিডোফিলিয়া। মনোবিজ্ঞানে পিডোফিলিয়া মানসিক বিকৃতি বলেই স্বীকৃত। কলকাতার যৌন হেনস্থার ব্যাপার শিশুদের সচেতন করে তোলার কাজ করে সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘দীক্ষা’। তার প্রধান পারমিতা ব্যানার্জীর কথায়, ‘কোনও একটি কারণ তো নয়, অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে পিডোফিলিয়া নিশ্চিত ভাবেই মানসিক বিকৃতি’।
গবেষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান হারে শিশুদের যৌন লালসার শিকার বানানোর পিছনে রয়েছে কুসংস্কারও। বহু মাত্রার মানুষরা এই কুসংস্কারে বিশ্বাস করে থাকে যে, শিশু বা কুমারীদের সাথে যৌন সম্পর্ক করলে যৌন রোগ নিরাময় হয়ে যাবে। অন্তত দেড়শ’ পাতার ছাপা ‘বটতলার বই’ নামে পরিচিত তথাকথিত বাংলা অশ্লীল সাহিত্যেও এই কুসংস্কার উল্লেখ আছে যে, কন্যা শিশু অথবা কুমারী নারীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে নানা যৌন রোগ নিরাময় হয়।
অশ্লীলতার বস্তাপচা এসব কুসংস্কারকে লালন করে ঘরে ঘরে আজ বড় মানুষগুলো কর্তৃক অনায়াসে শিশু ধর্ষণ পালিত হচ্ছে। শুধুই কুসংস্কার নয় বরং পশ্চিমা সংস্কৃতি টালিউড, বলিউডের নায়িকাদের পোশাকও এর জন্য দায়ী বলা যায়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, চলতি বছর শুধু জানুয়ারী মাসে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ এবং ৫টি ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত ৩রা ফেব্রুয়ারী রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি জানায়, ২০১৮ সালে ৯৪২ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে। লিখিত বক্তব্যে মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, ২০১৮ সালে ১৮২ জন নারী গণধর্ষণ, ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৬৯৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
সুধী পাঠক! বাংলাদেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখলে যে কারোরই আঁতকে উঠার কথা। ভীষণ কষ্ট পাওয়ার কথা। সুস্থ মনের মানুষও আজ ধর্ষণের পরিসংখ্যানের খাবর পেয়ে যথারীতি অসুস্থ হতে বাধ্য। ধর্ষণের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান শব্দটি আজ বড়ই বেমানান। দিনে দিনে এমন হারে ধর্ষণ বাড়ছে যেন তা গণনা যোগ্য নয়। পত্র-পত্রিকার ১০ থেকে ২০ টা কলাম তো থাকছেই সাথে সাথে থাকছে গোপনে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনা। বর্তমানে ধর্ষণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলেছে।
গত ৭ জুলাই ২০১৯ ‘মানুষের জন্য ফাউ-েশন’ নামে একটি সংস্থা তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ বছরের ৬ মাসে প্রায় ৪০০ শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে ৩৫৬ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছিল বলে জানিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে মারা গিয়েছিল ২২ জন এবং বাকিরা ছিল আহত। ২০১৮ সাল পেরিয়ে ২০১৯ এর ৬ মাস যেতে না যেতেই পূর্বের রেকর্ড ভাঙ্গে এই ধর্ষণ।
ধর্ষণের পিছনে মৌলিক কিছু কারণ রয়েছে। যেমন নগ্নতা, যৌন আকাক্সক্ষা, বেহায়াপনা, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশের দেয়ালের নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবি সম্বলিত উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, ব্লু-ফিল্ম, চলচ্চিত্রে খলনায়ক কর্তৃক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ ও প্রদর্শন, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, টুয়েনটি প্লাস চ্যানেলে নীল ছবি প্রদর্শন ইত্যাদি।
একাকীত্ববোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব থাকলে ধর্ষণের আকাক্সক্ষা বৃদ্ধি পায়। কোন প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি বিয়ের পূর্বে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটি বা ছেলেটির এই ‘না কো’ সহ্য না করতে পেরে একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অথবা অন্য কোথাও তার জৈবিক চাহিদা পূর্ণ করে। ধর্ষণের আরেকটি অন্যতম কারণ হল- আইনের প্রতি মানুষের ভয় কম বা নেই।
সুধী পাঠক! মানুষের অবস্থা এমন যে, সে সফলদের অনুকরণ ও অনুসরণ করতে চায়। সফল ব্যক্তিবর্গ বা সমাজ প্রতিষ্ঠান যে পথে হেঁটে সফলতা অর্জন করেছে সে পথে তাদের টানে দুর্নিবার আকর্ষণে। পাশ্চাত্যের বস্তুগত উন্নতি দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমাদের। ফলে তাদের পর্যায়ে যেতে অনুসরণ অনুকরণ করছি পাশ্চাত্যকে। আগপিছ না ভেবে ডিরেক্ট কপি পেস্ট করেছি পাশ্চাত্যের জীবনবোধ, দর্শন, রাষ্ট্র সমাজ পরিচালনা পদ্ধতি। পাশ্চাত্য যা বলেছে, যেটা করতে বলেছে আসমানী অহীর মত মাথা পেতে নিয়েছে বাকী বিশ্ব। যারা মেনে নিতে চায়নি তাদেরকে বল প্রয়োগ করে মানিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
নারীদের প্রতি সহিংসতার বিশেষ করে যৌন সহিংসতা ধর্ষণ কীভাবে বন্ধ করা যায়? এই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমা প্রভুদের শরণাপন্ন হয়েছি আমরা। উত্তর দিতে গিয়ে তারা বলল, পুরুষের আধিপত্য মনোভাব দূর করতে হবে, নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে, নারী-পুরুষের সাথে বন্ধুত্বসুলভ মেলামেশার ব্যবস্থা করতে হবে বেশি বেশি, পতিতালয় খুলতে হবে বেশি বেশি। এহেন পরিস্থিেিত পাশ্চাত্য সফলতার রেশ ধরে আমরা তাদের ফর্মুলাও গ্রহণ করতে ছাড়িনি। পাশ্চাত্য নারীমুক্তি যতগুলো তরীকা বাতলে দিয়েছে সেগুলো কোন সময়েই কোন স্থানেই নারীদের মুক্তি দিতে পারেনি। বরং যে দেশ যতবেশি তাদের তরীকায় আমল করেছে সে দেশে নারীরা ততবেশি নির্যাতিতা ধর্ষিতা হয়েছে।
বাংলাদেশ কি এখন তার নিকট ইতিহাসের মধ্যে সবচাইতে বেশি সেক্যুলার না? সবচাইতে বেশি পাশ্চাত্যের অনুসরণ করছে না? চেতনা, ফ্রি সেক্স, পতিতা গমনের সুবিধা, লিটনের ফ্ল্যাট, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা, পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তনের চেষ্টা, বস্তুগত উন্নয়ন, ব্রীজ, রাস্তাঘাট স্মরণকালের ইতিহাসের মধ্যে সবচাইতে বেশি হচ্ছে না? কিন্তু তারপরও কেন এত ধর্ষণ হচ্ছে? দুই আড়াই বছরের শিশুও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পায় না? ধর্ষণ হচ্ছে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধারাও।
পাশ্চাত্যের সফলতার জয়জয়কার অনুসরণ করে কেন আজ আমাদের এই বেহাল দশা? আমরা তাহলে কেন পাশ্চাত্যের জীবন দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তুলব না? কেনইবা তাদের এই মাতব্বরি মেনে নিব? কোন দুঃখে আমরা এরকম ফেলটুস এক সভ্যতার অনুসরণ করব?
অশ্লীল সিনেমায় আজ ইন্টারনেট সাইটগুলো পরিপূর্ণ। এমন কোন পর্ণ সাইট নেই যেখানে সার্চ দিলে ঐসব বস্তাপচা সংস্কৃতির ছোঁয়া পাওয়া যাবে না। ঘরের ছোট্ট শিশুটি আজ সেই সাইটগুলোর নিয়মিত দর্শক। বলিউড, হলিউডের ব্যবসাবান্ধব বেহায়া সিনেমাগুলোকে আজ আমরা বিনোদনের হাতিয়ার হিসাবে কবুল করেছি। সকল উপাত্তগুলো অনুসরণ করে নিজের ভিতরের পশুত্ব ভাবকে জাগিয়ে তোলে ধর্ষণের মত অত্যন্ত ভয়াবহ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে রাস্তাঘাটের সেই পাগলিটাও আজ অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পাওয়া যায়। হিংস্র জৈবিক চাহিদার কাছে ছোট্ট শিশুগুলোও রেহাই পায় না। সমকামিতায় লিপ্ত হয়ে নিজের চাহিদা মিটাচ্ছে। এমনকি নিজের প্রবৃত্তিকে মেটানোর জন্য আজ জন্তু জানোয়ারকেও ছাড় দিচ্ছে না।
ধর্ষণের আরেকটি হাতিয়ার হল পোশাক। পশ্চিমাদের সফলতার অনুসরণ করতে গিয়ে আজ আমরা তাদের পোশাকের অনুসরণ করে থাকি। সমাজ আজ এমন পোশাকেই আচ্ছন্ন। পোশাক দেখে যেন চোখ সরানোই মুশকিল। রাস্তাঘাটে সেই পোশাকে স্বীয় শরীর প্রদর্শন করে বেড়ায়। মনে হয় কোন এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যে যত পারে ছোট আর ফাটাফুটা পোশাক পরায় ব্যস্ত। উদ্দেশ্য বিপরীত লিঙ্গকে উৎসাহ প্রদান করা। রাস্তাঘাটে একজন মেয়ের পোশাক যেমন শালীনতাহীন ঠিক তেমনি পুরুষের পোশাকও নোংরা অমার্জিত। নারীর পোশাকের বাহারে পুরুষ আজ আটকে পড়েছে। রাস্তার ঐ ললনাকে দেখে বাড়িতে এসে তার কাম প্রবৃত্তি মেটায় বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে। ফলে নীরব ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী। অন্যথা যাদের ক্ষমতার দাপট রয়েছে তারা তাদের লালসা মেটায় ঐ নোংরা পোশাক পরিহিত ললনাকে দিয়েই। ফলে ধর্ষিত হচ্ছে নারী; ধর্ষক নামে স্বীকৃতি পাচ্ছে ঐ ধর্ষক।
আজ সহশিক্ষার প্রকোপ অনেক হারে বেড়েই চলেছে। সহশিক্ষার বিস্তারে সমাজও আজ নতজানু। একজন ছেলে আরেকজন মেয়ের পাশে, পিছনে, সামনে বসে ক্লাস করছে। যতই ছূফী মনের মানুষই হোক না কেন খারাপ দিকে নযর পড়েই। ফলে ধীরে ধীরে ঐসব বন্ধু-বান্ধবীর সম্পর্ক প্রেম-ভালবাসায় পরিণত হচ্ছে। উক্ত পরিস্থিতির শেষ ধাপ হল ধর্ষণ। একজন বন্ধু তার বান্ধবীকে বাসায় ডেকে তার সাথে যৌন মিলন করে ভিডিও করে রাখে। পরবর্তীতে ঐ ভিডিও দেখিয়ে ব্লাকমেইল করে পর্যায়ক্রমে গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এই সহশিক্ষা ব্যবস্থা ‘শিক্ষা সফর’ নামক অনুষ্ঠানে গিয়ে সহপাঠী ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধুর সাথে মেলামেশা করছে। যেখানে ইসলাম সম্পূর্ণভাবে মাহরাম ব্যক্তি ছাড়া ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করে।
পুরুষের লালসার করাল গ্রাস থেকে সমাজের নারীরা আজও মুক্ত নয়। শিক্ষক ধর্ষণ করছে ছাত্রীকে, ছাত্র ধর্ষণ করছে ছাত্রীকে, বাড়ির মালিক ধর্ষণ করছে কাজের মেয়েকে। এমনকি এই হিংস্র জৈবিক চাহিদা মেটানোর জন্য সমকামিতায় যুক্ত হচ্ছে অনেকেই। এখানেও জোরপূর্বক বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই চাহিদা পূরণের বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে। ফলে সেটাকেও নির্দ্বিধায় ধর্ষণ বলা যায়।
আসলে মানুষের দেহকে একটা কম্পিউটারের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কম্পিউটার নিজ থেকে কোন কাজ করতে পারে না। তাকে বাইরে থেকে একটা প্রোগ্রাম সেট করে দিলে, সে সেই অনুসারে কাজ করেতে থাকে। মানুষও প্রতিনিয়ত স্বীয় ইন্দ্রিয় দ্বারা সেই সব প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে থাকে এবং তার ব্রেইনে সেগুলো সেট করে থাকে এবং তার ভিতর থেকে নৈতিকতা দিয়ে সেটা যাচাই-বাছাই করে কখনও সেটার বাস্তবায়ন করে, কখনও বা বর্জন করে। আধুনিককালে মানুষকে বিকৃত যৌনাকাক্সক্ষা সৃষ্টি করার মূলে রয়েছে মিডিয়া। এই মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ম্যাসেজ মানুষের ব্রেইনে ঢুকে এবং শরীর সে অনুসারে পরিচালিত হয়। যৌন আকর্ষণের ক্ষেত্রে এই ধরনের মেসেজগুলোকে ‘ফ্যান্টাসি’ নামে ডাকা যেতে পারে। অর্থাৎ বাইরে থেকে কোন উপায়ে তার ব্রেইনে ফ্যান্টাসি ক্রিয়েট করা হয় এবং সেই ফ্যান্টাসি থেকেই সে পরিচালিত হয়।
সমাজে শুধু নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করা বৈধ। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক রীতি ভেঙ্গে স্ত্রী ছাড়াও অন্য নারী, প্রেমিকা, অন্যের স্ত্রী, ইনসেস্ট, সমলিঙ্গ, ধর্ষণ, পশুকাম, টাইপের ফ্যান্টাসি তৈরি করা হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে মিডিয়া দ্বারা। বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে একটা বিজ্ঞাপন দেখায়, যেখানে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে হাসপাতালের নার্স হিসাবে কল্পনা করে, আর স্ত্রী তার স্বামীকে প্লাম্বার হিসাবে কল্পনা করে।
তবে মিডিয়ার মাধ্যমে বহুদূরের একটা সংস্কৃতি খুব কাছে চলে আসছে। হাজার হাজার কিলোমিটার পার হয়ে সকল বাধা বিচ্ছিন্ন করে মানুষের বেড রুমে চলে আসছে, কম্পিউটারে চলে আসছে, চলে আসছে হাতের সেলফোনে। অথচ যে দেশগুলো এইসব কালচার প্রচলন করছে সে ব্যাপারে মানুষ খুবই কম জেনে থাকে। যেমন ধরুন ইউরোপের অনেক দেশেই ভেড়ার সাথে ফ্যান্টাসি করে। ভেড়ার সাথে পশুকাম করা তাদের সৌখীনতা। আবার আমেরিকার অনেক অঙ্গরাজ্যে বাবা-মেয়ে, মা-ছেলের মাঝে শারীরিক সম্পর্ক বৈধ। এটা তাদের জন্য একটা ফ্যান্টাসি। এগুলো যখন মিডিয়ার মাধ্যমে আসছে আর এ দেশের মানুষের মনে বসে যাচ্ছে, তখন সেটা অবশ্যই অপরাধ। আবার আমাদের পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘বৌদিবাজি’ নামে একটা শব্দ বহুল প্রচলিত আছে। এটা তাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক, অনেকটাই সমাজ সওয়া। যার কারণে তার ‘উমা বৌদি, ঝুমা বৌদি’ নামক সিরিয়াল তৈরি করছে, টিআরপিও প্রচুর পাচ্ছে। কিন্তু সেই ফ্যান্টাসিটা ডিশ লাইনের মাধ্যমে যখন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে চলে আসছে, তখন ঘটছে বিপত্তি। কারণ বাংলাদেশের সমাজে ভাবী (পশ্চিমবঙ্গের ভাষায় বৌদি) সম্পর্কে এতদিন ভিন্নরকম ধারণা ছিল।
এখন কথা হল, এই অযাচিত ফ্যান্টাসি বন্ধের উপায় কী? বা বন্ধ করবেই বা কে? হাজারো আইন করে এসব বন্ধ করা যাবে না। উল্টো অনেক ব্যবহারের ফলে অনৈতিক ফ্যান্টাসিগুলো আইনের অনুমোদন পেয়ে বসবে। এই ফ্যান্টাসি দমনের মূল হাতিয়ার হচ্ছে নৈতিকতা চর্চা, যার মূল আসে ধর্ম থেকে। ধর্মের মাধ্যমেই নৈতিকতা চর্চা হয়। যেসব দেশের টিভি চ্যানেল বৌদিবাজি আর ঘরভাঙ্গা শেখায় সেগুলো দ্রুত বন্ধ করা যরূরী এবং এ ব্যাপারে কঠোর আইন প্রয়োগ ও তা বাস্তবায়ন করা আশু দরকার।
খেয়াল রাখতে হবে যে, মানুষ প্রতিনিয়ত টিভি, ইন্টারনেট বা পরিবেশ থেকে যৌনতা দেখে ‘যৌন উন্মাদ’ এ পরিণত হচ্ছে। তার মাথায় সারাদিন ফ্যান্টাসি ঘুরঘুর করছে। সর্বক্ষণ উপায় খুঁজছে কিভাবে ঠা-া হওয়া যায়। তাই ছোট বাচ্চা দেখলে সেখানেই প্রয়োগ করার চেষ্টা করছে, বাচ্চা চিৎকার করলে করা হচ্ছে হত্যা। সংবাদের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ভরে যাচ্ছে ধর্ষণের পর হত্যা। এইতো স্বাধীন দেশের নাগরিকের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। হায়রে স্বাধীনতা!
পাশাপাশি এই বিদেশি টিভি চ্যানেগুলোর কারণেই পরিবারে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি, বৃহৎ পরিবার ভেঙ্গে ক্ষুদ্র পরিবার তৈরি হচ্ছে। এতে শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ধর্ষণের মত জঘন্যকর্মের শিকার হচ্ছে।
তবে শুধু মিডিয়া আর নেট দুনিয়ার দোষ দিলেও হবে না। অনৈতিক কার্যকলাপকে যে প্রটোকল দিবে সেই ‘নৈতিকতা’ চর্চাও কিন্তু সমাজে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকগুলোতে নৈতিকতা বা ধর্মচর্চা তুলে সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হচ্ছে। ফলে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা চর্চা প্রায় উঠেই গেছে। পাশাপাশি মসজিদ-মাদরাসা, ওয়াজ-মাহফিলগুলোতেও নৈতিকতা চর্চা উঠে গেছে। আজকাল ইউটিউবে অনেক মুসলিম বক্তার ওয়াজ শুনলে গা শিউরে উঠে। কোন্ গায়িকা কেমন গান গাইল, কোন্ নায়ক কিভাবে নাচল, কোন্ ব্যক্তি কিভাবে সিগারেট খায়, কোন্ নায়িকা ব্রেস্ট ইম্প্যান্ট করল, এগুলোই হয়ে গেছে তাদের ওয়াজের বিষয়। শুধু হাসায় আর কাঁদায় কিংবা প্রতিপক্ষকে দমন করে। ধর্মীয় আলোচনা বা নৈতিকতা থেকে তারা চলে গেছে বহুদূরে।
কবি আসাদ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়’! এখন পরিস্থিতি এরকম দাঁড়িয়েছে যে, অজস্র অসংখ্য প্রশ্ন তিরের ফলার মত ধেঁয়ে আসছে, কিন্তু উত্তর কেবল মৌন। নীরবতা। কতশত ব্যাকুল আকুল প্রশ্ন সমাজের মানুষদের। এত শিশু ধর্ষণ, নারী নির্যাতন এবং কিইবা তার প্রতিকার? তাইতো জনৈক লেখক যর্থাথই বলেছেন,
‘মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেই জবাব তার
সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার,
শুধু খবরদার বলে কি মানুষের মনের জাগা প্রশ্ন, শঙ্কা, আকুলতা স্তদ্ধ করে দেয়া যাবে? অতএব আপনার উত্তর আপনার নিজের কাছেই বিদ্যমান। বিশেষ করে সমাজের সবচেয়ে বড় ক্যান্সার হল ধর্ষণ, সমাজ ধ্বংসের অশনিসংকেতও ধর্ষণ। সমাজ ব্যবস্থা, সরকার, দেশ, বিশ্ব কিংবা সময়ের হাতে প্রতিবিধানের ভার তুলে দিয়ে নিশ্চেষ্ট বসে থাকা হবে আত্মঘাতী।
* অধ্যায়নরত, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।
Share this: