রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয়
-হাসিবুর রহমান বুখারী*
(শেষ কিস্তি)
আমাদের করণীয়
যখন কাফির ও মুশরিকরা পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্রের জাল বুনার উদ্দেশ্যে কেউ ইসলাম সম্পর্কে অথবা কুরআন সম্পর্কে অথবা নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্পর্কে আপত্তিকর, অবমাননাকর, কুৎসিত ও কদর্য মন্তব্য করতেই আছে, তখন প্রশ্ন উঠা খুবই স্বাভাবিক যে, এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কী? দ্বীন ও ঈমান বাঁচানোর জন্য আমাদের ভূমিকাটা কিরূপ হবে?
(১) আমাদের প্রথম দায়িত্ব হল, দ্বীন ইসলামকে শক্তহাতে আঁকড়ে ধরা, ইসলামের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা অঙ্গীকার করে বলেছেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَنۡصُرُوا اللّٰہَ یَنۡصُرۡکُمۡ وَ یُثَبِّتۡ اَقۡدَامَکُمۡ
‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহর (দ্বীনের) সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদসমূহ দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত রাখবেন’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৭)।
আজ আমরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য রাস্তা অবরোধ করছি, কিন্তু নিজের ঈমানের সত্যতা ও গভীরতা সম্পর্কে মোটেও চিন্তিত নই। এজন্যই আমাদের এই দুর্দশা। অন্যদিকে ছাহাবীদের জীবনী দেখুন, তাঁরা আল্লাহর দ্বীনকে সুউচ্চ ও বিজয়ী করেছিলেন, পরিবর্তে আল্লাহ তাঁদেরকে বিজয়ী করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللّٰہُ مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন যে, তাঁকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীনকে) সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাশক্তিমান, চরম পরাক্রমশালী’ (সূরা আল-হজ্জ : ৪০)।
অতএব যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিমজ্জিত না হব, ইসলামের শাশ্বত বাণীকে পৃথিবীর প্রত্যেক প্রান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা না করব, ততক্ষণ পর্যন্ত না আমাদেরকে সাহায্য করা হবে, না আমাদের উপর থেকে নির্যাতন ও নিপীড়নের কালো মেঘমালা দূরীভূত করা হবে, আর না আমাদের দু‘আ ক্ববুল করা হবে। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেন,
وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوْفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوْشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُوْنَهُ فَلَا يُسْتَجَابُ لَكُمْ
‘সেই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! নিশ্চয় তোমরা সৎকাজের জন্য আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করবে। তা না হলে আল্লাহ তা‘আলা শীঘ্রই তোমাদের উপর তার শাস্তি অবতীর্ণ করবেন। তোমরা তখন তার নিকট দু‘আ করলেও তিনি তোমাদের সেই দু‘আ গ্রহণ করবেন না’ (তিরমিযী, হা/২১৬৯; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৮৬৮)।
(২) দ্বিতীয় দায়িত্ব হল, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও বিজ্ঞতার সাথে প্রতিবাদ করা। সোস্যাল মিডিয়া, দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সংবাদ মাধ্যম (ঢ়ৎবংং সবফরধ) ও গণমাধ্যম (সধংং সবফরধ) ব্যবহার করা। থানায় থানায় কটূক্তিকারীর নামে মামলা-মোকাদ্দমা এবং এফআইআর দায়ের করা। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভা করা, পথ অবরোধ না করা। মোড়ে মোড়ে, রাস্তা-ঘাটে, দোকানপাটে অমুসলিম ভাইদের মধ্যে নবী (ﷺ)-এর জীবনরচিত সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ বা লিফলেট বিতরণ করা। আমরা এমন করতে পারলে খুবই সম্ভব যে, তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত হবে। কেননা তারা তো রাসূল (ﷺ)-এর মহান চরিত্র সম্পর্কে অবগত নয় বলেই এমন করতে পারছে।
(৩) তৃতীয় করণীয় হল, আবেগপ্রবণ হয়ে এমন কোন পদক্ষেপ না নেয়া, যার ফলে নিজের ক্ষতি হতে পারে অথবা ইসলামের শত্রুরা যেন ইসলামের বিরুদ্ধে মুখ খুলার সুযোগ না পায়। কেননা কাফির মুশরিকরা তো এটাই চায় যে, সাধারণ মুসলিমরা আবেগপ্রবণ হয়ে এমন কিছু করুক, যাতে পরবর্তীতে ঐ অজুহাতে তারা মুসলিমদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে, তাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে পারে, কারাগারে বন্দী করতে পারে, ঘরবাড়ী ধ্বংস করতে পারে। সুতরাং উস্কানিমূলক ভাষণে প্রভাবিত হওয়া যাবে না। আইন হাতে তুলা যাবে না, বরং আইন বিশারদদের কাছে পরামর্শ নিতে হবে।
(৪) চতুর্থ করণীয় হল, ইসলামের শত্রুদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্য তাদের পণ্য সামগ্রী বর্জন করা। এটি কতটা কার্যকারী পদক্ষেপ আমরা খুব সহজেই তা অনুভব করতে পারি। বিশ্বের একাধিক মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বিশেষ করে সঊদী আরব, কাতার, আরব আমিরশাহি, কুয়েত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, বাহরাইন এ নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে এবং আরব বিশ্ব সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়। বিশেষ করে কুয়েতের দোকানপাটে যখন ভারতীয় পণ্য বিক্রি বন্ধ করা হয়ে, তখন তারা বাধ্য হয়ে নূপুর শর্মা ও নবীন কুমার জিন্দালকে দল থেকে সাসপেন্ড করে।
(৫) পঞ্চম করণীয় হল, ধৈর্যধারণ করা। কেননা নবীগণকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। বরং সৃষ্টিকুলের সর্বোত্তম মানব, স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-কেও এরূপ কুৎসিত ও কদর্য মন্তব্য শুনতে হয়েছে। যা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনার পূর্বেও অনেক রাসূলকেই ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা হয়েছিল, পরিণামে তারা যা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত, তা বিদ্রুপকারীদেরকে পরিবেষ্টন করেছিল’ (সূরা আল-আম্বিয়া : ৪১)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনার পূর্বেও অনেক রাসূলকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা হয়েছে। সুতরাং যারা কুফরী করেছিল তাদেরকে কিছু অবকাশ দিয়েছিলাম, তারপর তাদেরকে পাকড়াও করেছিলাম; অতএব কেমন ছিল আমার শাস্তি! (সূরা আর-রা‘দ : ৩২)।
ইতিহাস সাক্ষী যুগে যুগে কালে কালে যারাই আল্লাহর নবীদের শানে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে, বেয়াদবী করেছে, তাদের কেউ টিকে নেই। ফিরাঊন, নমরূদ, আবূ জাহাল, আবূ লাহাব ও তার স্ত্রী সকলেরই অপমৃত্যু হয়েছে। সুতরাং আমাদের কাজ হল, একটু ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর ফায়সালা অবশ্যই আসবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনার পূর্বেও অনেক রাসূলকে অবশ্যই মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলা ও ক্লেশ দেয়া সত্ত্বেও তাদের নিকট আমার সাহায্য না আসা পর্যন্ত তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আল্লাহর (প্রতিশ্রুত) বাক্যকে পরিবর্তন করার মত কেউ নেই’ (সূরা আল-আন‘আম : ৩৪)।
(৬) ষষ্ঠ করণীয় হল, নিজেদেরকে শিরকমুক্ত করা। এটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শিরকমুক্ত না হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য, সহযোগিতা, নিরাপত্তা কখনোই আসবে না। আজ গোটা বিশ্বে মুসলিম সংখ্যা খুব একটা কম নয়, কিন্তু শিরকমুক্ত মুসলিমের সংখ্যা সত্যি খুবই কম। আর অধঃপতন বা ধ্বংসের এটিই মূল কারণ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ اُولٰٓئِکَ لَہُمُ الۡاَمۡنُ وَ ہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ
‘যারা ঈমান আনয়ন করেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলুম অর্থাৎ শিরক দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত (দুনিয়া ও আখিরাতে)’ (সূরা আল-আন‘আম : ৮২)।
রাসূল (ﷺ) সম্পর্কে কটূক্তিকারীর বিধান ও আমাদের করণীয়
(ক) রাসূল (ﷺ) স্বীয় যুগে তাঁর সম্পর্কে কটূক্তিকারী কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাবীর ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
مَنْ لِكَعْبِ بْنِ الْأَشْرَفِ فَإِنَّهُ قَدْ آذَى اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَامَ مُحَمَّدُ بْنُ مَسْلَمَةَ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَتُحِبُّ أَنْ أَقْتُلَهُ قَالَ نَعَمْ
‘কা‘ব বিন আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে প্রস্তুত আছ? কেননা সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি কি চান যে, আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, হ্যাঁ।.... অতঃপর তিনি কা‘ব বিন আশরাফের দুধ ভাই আবূ নায়লাকে সঙ্গে করে রাতের বেলা তার নিকটে গেলেন। কা‘ব তাদেরকে দুর্গের মধ্যে ডেকে নিল এবং সে নিজে উপরতলা থেকে নিচে নেমে আসার জন্য প্রস্তুত হল। তখন তার স্ত্রী বলল, এ সময় তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, এই তো মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং আমার ভাই আবূ নায়লা এসেছে। তখন কা‘বের স্ত্রী বলল, আমি তো এমনই একটি ডাক শুনতে পাচ্ছি, যা থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে বলে মনে হচ্ছে। কা‘ব বিন আশরাফ বলল, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং দুধ ভাই আবূ নায়লা (অপরিচিত কোন লোক নয়) ভদ্র মানুষকে রাতের বেলা বর্শা বিদ্ধ করার জন্য ডাকলেও তার যাওয়া উচিত।...অতঃপর কা‘ব চাদর নিয়ে নিচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আজকের মত এত উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি। কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধি ব্যবহারকারী মহিলা আছে। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দিবেন কি? সে বলল, হ্যাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি তাকে কাবু করে ধরে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা তাকে হত্যা কর। তারা তাকে হত্যা করল। এরপর নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে এ খবর দিলেন।[১]
(খ) বনু কুরায়যা গোত্রের একজন কবি ও নেতা ছিল। যে বিভিন্ন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে বিদ্রƒপাত্মক কথা প্রচার করত। এমনকি সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের স্ত্রী-কন্যাদের সম্পর্কেও কুৎসিত অশালীন উদ্ভট কথা রচনা করত। এ সকল কর্মকা-ে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে অবশেষে তৃতীয় হিজরীর রবীউল আওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহকে নির্দেশ দেন তাকে হত্যা করার এবং সে আদেশ মতে তাকে হত্যা করা হয়।[২]
(গ) আবূ রাফি‘ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু আবুল হুক্বাঈক্বের হত্যার ব্যাপারে অপর একটি হাদীছে এসেছে, বারাআ ইবনু ‘আযিব (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আতীককে আমীর বানিয়ে তার নেতৃত্বে কয়েকজন আনছার ছাহাবীকে ইহুদী আবূ রাফি‘র (হত্যার) উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। আবূ রাফি‘ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে কষ্ট দিত এবং এ ব্যাপারে লোকদেরকে সাহায্য করত। অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَدَخَلَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللهِ بْنُ عَتِيْكٍ بَيْتَهُ لَيْلًا وَهُوَ نَائِمٌ فَقَتَلَهُ ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আতীক (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) রাতের বেলা তার ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে হত্যা করেন’।[৩]
(ঘ) আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘কোন এক অন্ধ ব্যক্তির একটি দাসী ছিল। সে নবী করীম (ﷺ)-এর শানে বেয়াদবীসূচক কথাবার্তা বলত। অন্ধ ব্যক্তিটি তাকে এরূপ করতে নিষেধ করতেন, কিন্তু সে তা মানত না। সে ব্যক্তি তাকে ধমকাত, তবুও সে তা থেকে বিরত হত না। এমতাবস্থায় এক রাতে যখন ঐ দাসী নবী করীম (ﷺ)-এর শানে অমর্যাদাকর কথাবার্তা বলতে থাকে, তখন ঐ অন্ধ ব্যক্তি একটি ছুরি নিয়ে তার পেটে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেন, যার ফলে ঐ দাসী মারা যায়। এ সময় তার এক ছেলে তার পায়ের উপর এসে পড়ে, আর সে যেখানে বসে ছিল, সে স্থানটি রক্তাক্ত হয়ে যায়। পরদিন সকালে... নবী (ﷺ) এ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমিই তাকে হত্যা করেছি। কারণ সে আপনার সম্পর্কে কটূক্তি ও গালি-গালাজ করত। আমি তাকে এরূপ করতে নিষেধ করতাম ও ধমকাতাম। কিন্তু সে তার প্রতি কর্ণপাত করত না। ঐ দাসী থেকে আমার দু’টি সন্তান আছে, যারা মনি-মুক্তা সদৃশ এবং সেও আমার খুব প্রিয় ছিল। কিন্তু গত রাতে সে যখন পুনরায় আপনার সম্পর্কে কটূক্তি ও গাল-মন্দ করতে থাকে, তখন আমি আমার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি এবং ছুরি দিয়ে তার পেটে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে তাকে হত্যা করি। তখন নবী করীম (ﷺ) বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক যে, ঐ দাসীর রক্ত ক্ষতিপূরণের অযোগ্য বা মূল্যহীন’।[৪]
(ঙ) রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে কদাচারী, দুরাচারী, ধর্মত্যাগী তথা মুরতাদদের শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। যেমন মুছ‘আব ইবনু সা‘দ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করে বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকলকে নিরাপত্তা দান করেন, কিন্তু চারজন পুরুষ এবং দু’জন নারী ব্যতীত। তিনি তাদের সম্পর্কে বলেন, তাদেরকে যেখানেই পাবে হত্যা করবে, যদিও তারা কা‘বার পর্দা ধরে থাকে। তারা হল, ইকরিমা ইবনু আবূ জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনু খাতাল, মিক্বয়াস ইবনু সুবাবাহ, আব্দুল্লাহ ইবনু সা‘দ ইবনু আবূ সারাহ। আব্দুল্লাহ ইবনু খাতালকে কা‘বার গিলাফের সাথে লটকে থাকা অবস্থায় পাওয়া গেল এবং তাকে হত্যা করার জন্য দুই ব্যক্তি ছুটে গেলেন। একজন হলেন সাঈদ ইবনু হুরায়স, অন্যজন আম্মার ইবনু ইয়াসির (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। সাঈদ ছিলেন জওয়ান, তিনি আগে গিয়ে তাকে হত্যা করলেন। আর মিক্বয়াস ইবনু সুবাবাহকে লোকেরা বাজারে পেল এবং তারা তাকে হত্যা করল।...আর ইকরিমা ইবনু আবূ জাহল এবং আব্দুল্লাহ ইবনু আবূ সারাহ পরবর্তীতে তাওবাহ করে এবং রাসূল (ﷺ)-এর হাতে বাই‘আত গ্রহণ করে পুনরায় মুসলিম হয়ে যায়। ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যায়...’।[৫]
উপরিউক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নবী করীম (ﷺ)-এর নামে ব্যঙ্গাত্মক বা কটূক্তিমূলক কথা বললে তার শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। উক্ত গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তিদের ইসলামী শরী‘আহ অনুযায়ী মুসলিম শাসকের নির্দেশে হত্যা করা অপরিহার্য। কিন্তু ইসলামী শাসকের অনুমতি ব্যতীত কোন পাপের শাস্তি স্বরূপ কাউকে হত্যা করা নিষিদ্ধ। যেমন সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি সহ অন্যান্য আলেম বলেন, ‘হদ্দ (মৃত্যুদণ্ড, সাজা, শাস্তি) প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি মুসলিম ইমাম, সুলতান, শাসক অথবা তার স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধির উপর নির্ভরশীল। সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তির বাতাবরণ অপ্রতিহত রাখার জন্য মুসলিম শাসক ও তাঁর প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কারোর জন্য ‘হদ্দ’ ক্বায়িম করা অনুমোদিত নয়। কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সমাজের জন্য হদ্দ ক্বায়িম করা জায়েয নয়। কারণ এর ফলে যে বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ, অস্থিরতা, অরাজকতা, নৈরাজ্য ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কোন ব্যক্তি বা সমাজের নেই।[৬]
যদি রাষ্ট্রের সরকার তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বিলম্ব করে, তাহলে মুসলিম জনগণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। আর যদি রাষ্ট্রপক্ষ তাদের শাস্তির বিষয়ে গড়িমসি করে, তাহলে ন্যায়ানুগভাবে সরকারকে একাজে বাধ্য করতে পারে। আর এ গুরু দায়িত্ব পালন করবেন সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনগণ। আর এটাই মূলত ঈমানের দাবী। কিন্তু কোনভাবেই আইন হাতে তুলে নেয়া যাবে না, সরকারী বা জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট করা যাবে না। যেহেতু আমাদের দেশে ইসলামী শাসক নেই, তাই ব্যক্তিগতভাবে বা সামাজিকভাবে হদ্দ তথা মৃত্যুদণ্ড, সাজা, শাস্তি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর নয়। এক্ষেত্রে গুনাহগার ব্যক্তি দুনিয়াবী তুচ্ছ শাস্তি থেকে পরিত্রাণ পেলেও কিন্তু পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে তাওবাহ ব্যতীত রক্ষা পাবে না।
* মুর্শিদাবাদ, ভারত।
তথ্যসূত্র :
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/২৫১০, ৩০৩১, ৩০৩২, ৪০৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮০১; আবূ দাঊদ, হা/২৭৬৮।
[২]. বাংলা বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৪/৪৪ পৃ., ৪০৩৭ নং হাদীছের টীকা দ্র.।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৩০২২, ৩০২৩, ৪০৩৮, ৪০৩৯, ৪০৪০।
[৪]. আবূ দাঊদ, হা/৪৩৬১; নাসাঈ, হা/৪০৭০, সনদ ছহীহ।
[৫]. নাসাঈ, হা/৪০৬৭-৬৮; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১৭২৩।
[৬]. ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২২/৫-১০; কিতাবুল উম্ম, ৬/১৫৪; আল-কাফি ইবনে কুদামাহ, ৩/২৩৪; কুয়েতী ফিক্বহ বিশ্বকোষ, ৫/২৮০; তাফসীরে কুরতুবী, ২/২৫৬; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ৯/৩০৩; লিক্বাউল-বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-৩১।