মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস
-এহসান বিন মুজাহির
এনার্জি ড্রিংকস মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বর্তমানে তরুণরাই এর প্রতি বেশি আসক্ত। অনেকের এ আসক্তিটা আবার নেশায় পরিণত হয়েছে। এনার্জি ড্রিংকের প্রতি ২৫০ মিলিলিটার ক্যানে আছে ৮০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন, কোন কোন ড্রিংকে ৩০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ক্যাফেইন বিদ্যমান। চিকিৎসকরা স্বীকৃতি দিয়েছেন যে, এটি মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং এ ব্যাপারে তারা মানুষকে অনেক সতর্ক করেছেন। দীর্ঘদিন এনার্জি ড্রিংকস পান করার ফলে খাদ্যনালির ভেতরের মিউকাস মেমব্রেন নষ্ট হয়ে যায়। নাড়ির সংকোচন ও সম্প্রসারণ ক্ষমতা কমে খাদ্য থেকে পুষ্টি শুষে নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস যায়। এ ছাড়া হজমক্ষমতা কমে, বদহজম, খাদ্যে বিষক্রিয়া, গ্যাস্ট্রিক, ক্ষুধামন্দাসহ নানা অসুখ-বিসুখ দেখা দিতে পারে। হতে পারে স্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যও। অতিরিক্ত চিনির কারণে অনেকের শরীরের ওজন বেড়ে স্থুলস্বাস্থ্যে পরিণত হয়। বাড়ে শরীরের চর্বি বা কোলেস্টেরলের পরিমাণও। শরীরের ক্যালসিয়াম মলিউকুল গঠন প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। হাড় দুর্বল ও নরম হয়ে যায়। এ ছাড়া জনন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে। এসব ড্রিংকস ফরমালিনের চেয়ে কোনো অংশে কম ক্ষতিকর নয়।
কোল্ড ড্রিংকস ছিপি বা মুখ খোলা মাত্রই ফস করে কিছু গ্যাস বেরিয়ে যায়। অথচ ঐ বের হওয়া গ্যাসে কার্বনডাই অক্সাইড, খাবার সোডা বা সোডিয়াম বাই কার্বনেট থাকে। এ ছাড়া থাকে সাইট্রিক এ্যাসিড, টারটারিক এ্যাসিডসহ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য। পানীয়কে মজাদার করার জন্য স্যাকারিন, সরবিটল, ম্যাটিটল ছাড়াও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জানা যায়, ১৪০টি দেশে ২০০ ব্রান্ডের এনার্জি ড্রিংকস তৈরি হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে শিশু থেকে বয়ষ্ক সকলেই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৩৪ শতাংশ তরুণ নিয়মিত এনার্জি ড্রিংকস পান করে বলে জানা যায়। গবেষকরা বলেছেন, এসব এনার্জি ড্রিংকসে ক্ষতিকর কেমিক্যাল রয়েছে এবং এগুলো মাদকতা ও ফিলিংস তৈরিতে বেশী কাজ করে। বেশি মাত্রার ক্যাফেইন শারীরিক নানারকম ক্ষতির কারণ হয়। যেসব শিশু ও তরুণ নিয়মিত এনার্জি ড্রিংক পান করে তারা এতে আসক্ত হয়ে পড়ে। এরপর ক্রমে বেশি মাত্রায় গ্রহণ তা স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ক্যাফেইন একটি আসক্তি তৈরি করার মতো উপাদান। এটি কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রকে উদ্দীপিত করে। ফলে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, পেটের অসুখ ও হার্টের ছন্দে অনিয়ম ঘটাতে পারে।
এনার্জি কোল্ড ড্রিংকসগুলো বাজারে জনপ্রিয় পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে কোম্পানির আকষর্ণীয় বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনের পেছনে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করার মূল টার্গেটই হচ্ছে ক্রেতাদের আসক্ত করা। বিশাল অঙ্কের টাকা ব্যয় করার মধ্য দিয়ে তারা পণ্যের প্রতি ক্রেতাদের মন আকৃষ্ট করতে সক্ষমও হয়েছে। আর এ কারণেই পানীয় শিল্পে একটি দ্রুত প্রসারমান আইটেমে রূপ নিয়েছে এসব পানীয়। এনার্জি ড্রিংকস’-এর বোতলের মুখ খুললেই সবটুকু গ্যাস বের হতে পারে না। তাই ড্রিংকসগুলো পান করার সাথে সাথে দেহে একপ্রকার ক্ষতিকর কার্বনডাই অক্সাইড প্রবেশ করে। অনেক সময় মাত্রারিক্ত সোডিয়াম-বাই-কার্বনেট রক্তে মিশে ক্ষারত্বের মাত্রা বাড়িয়ে অ্যালকালোসিসের সৃষ্টি করে। আর অ্যালকালোসিস কিডনি সমস্যা, অস্থিরতা, শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধাসহ আরও অনেক রোগের জন্ম দেয়। না জানার কারণে ভ্রান্তধারণাবশত লেবু বা কমলার স্বাদ মনে করে যেসব কোল্ড ড্রিংকস পান করা হয়, সেসব কোমল পানীয় আমাদের দাঁতের এনালেলকে ক্ষয় করে দেয়। কোকাকোলা, সেভেনআপ, পেপসি, স্প্রাইট, ফান্টা, মিরিন্ডা, আরসি, টাইগারসহ আরও অন্যান্য পানীয়ের সোডিয়াম বাই কার্বনেট রক্তচাপ বাড়ায়। উচ্চ রক্তচাপ রোগীদের জন্য এগুলো খুব মারাত্মক ক্ষতির কারণ। এছাড়া যারা ব্যথানাশক, জীবাণুনাশক, রিউমেটিক আর্থ্রাইটিস, যক্ষা, ম্যালেরিয়া প্রভৃৃতি রোগে আক্রান্ত তাদের কোল্ড ড্রিংকস পান না করাই মঙ্গল। কারণ এসব পানীয় রোগের ওষুধের কার্যক্ষমতা মারাত্মভাবে হ্রাস করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় বলা হয়েছে, এনার্জি ড্রিংকসে রয়েছে প্রাণঘাতী উপাদান। কিডনি, লিভার, মস্তিষ্ক ও হার্টের জন্য খুব ক্ষতিকর। যারা নিয়মিত এসব পান করেন তারা ক্রমেই কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন। কোল্ড ড্রিংকসে বেশি মাত্রায় ক্যাফেইনের কারণে ঘনঘন পেশাব হয়। পেশাবের সাথে প্রচুর পানি ও একইভাবে হাড়ে থাকা ক্যালসিয়ামও বের হয়। এর ফলে কিডনি রোগ, লিভার, ব্রেইন ড্যামেজসহ ক্যান্সারেরও আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, অতিরিক্ত ক্যাফেইন লিভারে চর্বি জমায়। হৃদপি-ের রক্ত সরবরাহকারী ধমনিতে রক্ত চলাচল ধীর করে দেয়। বুক ধড়ফড়ানি, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, উচ্চরক্তচাপ, ঘুমের ব্যাঘাত, শরীরে অ্যাড্রেনালিন নামক হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে টানটান উত্তেজনা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। দিনের পর দিন অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণের ফলে রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত ওষুধও কাজ করে না। তাই এসব পণ্যের ক্ষতিকর তথা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠার জন্যই ডেনমার্ক, ফ্রান্স, চীন, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এনার্জি ড্রিংকস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নরওয়ে ও আর্জন্টিনায় এর বিক্রি সীমিত করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে স্টিমুল্যান্ট ড্রিংকস কমিটি এটা নিষিদ্ধের জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। সুতরাং বাংলাদেশে এনার্জি ড্রিংকস নিষিদ্ধ করা যরূরী। তা না হলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকাসক্ত থেকে বিরত কঠিন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এনার্জি ড্রিংকসের ক্ষতিকর দিকগুলো জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করে তাদের সচেতন করাতে হবে। সরকার যেভাবে ফরমালিনের বিরুদ্ধে অভিযান, নিষিদ্ধকরণ দণ্ডবিধি আরোপ করেছে, তদ্রুপ এনার্জি ড্রিংকসের আমদানি বিপণন নিষিদ্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ অতীব যরূরী। এ ব্যাপারে সরকার ও জনসাধারণ সকলকেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে।
[সংকলিত]
তথ্যসূত্র :
. সাইমন এম মেশার জে: অ্যালকোহল, এনার্জি ড্রিংকস অ্যান্ড ইয়ুথ: এ ডেনজারাস মিক্স : ক্যালিফোর্নিয়া : মেন ইনস্টিউট ২০০৭।
. নাওরাট পি : ফুড এডিট কনটামা, ২০০৩।