শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০ অপরাহ্ন
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা
-মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম*

সোনাঝরা সকাল। স্নিগ্ধ রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের উত্তাপ গোটা গায়ে মেখে গবাদি পশুগুলোকে নিয়ে ঘাস খাওয়াতে বেরিয়েছেন মুহাম্মাদ আশরাফ। সঙ্গে চৌদ্দ বছরের ছেলে রেযওয়ান। এই চোখ জুড়িয়ে যাওয়া পরিবেশ, এই মাটির গন্ধ, এই নির্মল বাতাস তাদের বড্ড চেনা। তাদের বড় আপন। হঠাৎ এক বিস্ফোরণে নিমেষে বদলে গেল তাদের জীবন। চারিদিকে পাথর উড়তে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতা কিছুটা কাটিয়ে একরাশ কালো ধোঁয়ার মাঝে এখনো বেঁচে আছেন এটা নিশ্চিত হয়ে আশরাফ যখন মাথা তুলে দেখলেন, ততক্ষণে তার গরুগুলোর সঙ্গে লাশ হয়ে পড়ে আছে রেযওয়ান!

শ্রীনগর শহরের স্বাভাবিক ব্যস্ত দিন। আরজা বেগমকে জম্মু কাশ্মীর হাইকোর্ট সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ক্ষতিপূরণের রায় ঘোষণা করল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর মানসিকভাবে ক্লান্ত আরজা বেগম তখন বলছেন, ‘আমি টাকা চাইনি, চেয়েছি ন্যায় বিচার!’ ১৪ বছর আগের গভীর রাতে সন্ত্রাসী সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছিল তাঁর অটোড্রাইভার ছেলে মুস্তাক। তারপর থেকে আজ অবধি হন্যে হয়ে কাশ্মীরের প্রতিটি জেল, প্রতিটি কবরস্থান ঘুরেও আরজা বেগম নিজের ছেলের হদিস পাননি!

শীতের নিকষ রাত্রি ভেদ করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছে বাদ্গাম জেলার ছাত্তাম গ্রামের তিন কিশোর। মেহরাজুদ্দ্যীন, ফয়সল আর বাসিমহ। আর্মি চেকপোস্টের অফিসারের সংকেত বুঝে গাড়ির ব্রেক কষতে দেরি হওয়াতেই বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে নিথর হয়ে গেল দুই কিশোরের তরতাজা জীবন!

‘যুদ্ধের খবর পাবলিক দারুণ খাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি পত্রিকারই বিক্রি বেড়ে চলেছে হু-হু করে। এই সময় অন্য খাবার খাওয়ানো মুশকিল’। নিজ পত্রিকা দপ্তরে বসে বলছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদক। কার্গিলে যুদ্ধের রমরমা বাজারে প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে মৃত সেনারা তখন পণ্য। মৃত কাশ্মীরের দাম মরা হাতির থেকেও তখন বেশি!

সুধী পাঠক! অবশেষে কাশ্মীরে শেষ পেরেক ঠুকেই দিল ভারত। গত ফেব্রুয়ারীতে পুলওয়ামা হামলায় ৪৫ জনের বেশি আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা ভারতের জন্য ‘ইজ্জত কা সওয়াল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল কাশ্মীর। বর্তমান ভারতের দুই মহাশক্তিমান নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিল তাতে। বিরক্ত মোদি তাই পদক্ষেপটা নিয়েই নিলেন। কাশ্মীর দখল করে নিয়েছেন তিনি। হঠাৎ করে করা কিছু নয় এটা, যেন হিসাব করেই নেয়া। এমনিতেই তার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল যে, কাশ্মীরের ৩৭০ বিধি রাখা হবে না। অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন মোদি। এখন তা কার্যকর করলেন।

কাশ্মীরের গত ৭২ বছরের ইতিহাস ভারত-পাকিস্তান একাধিক যুদ্ধের ইতিহাস। তারপর ১৯৮৯ সাল থেকে স্বাধীনতার জন্য শুরু ৩০ বছরের সশস্ত্র লড়াইয়ে রক্তের নদী বয়ে গেছে। বলা হয়, এক লাখের মত মানুষ এ সময়ে প্রাণ দিয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন দশ হাজারেরও বেশি নারী। হাজার হাজার কিশোর-তরুণ ছররা গুলীতে অন্ধ হয়ে ঘরে পড়ে আছে। লাখ লাখ মানুষ আহত হয়ে অকেজো, পঙ্গু ও বোঝায় পরিণত হয়েছেন। তবে সে কাহিনী বলার জন্য এ লেখা নয়। এ লেখার প্রেক্ষাপট ২০১৯ সালের আগস্ট মাসের চূড়ান্ত ঘটনা প্রবাহ।

৫ আগস্ট, ২০১৯। এটি কাশ্মীরের ইতিহাসের চির অন্ধকারের দিন, সর্বশেষ টিকে থাকা সামান্য ম্বাধীন সত্তাটুকু চিরকালের মত বিলুপ্ত হয়ে একদা স্বাধীন রাজ্যের ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাওয়ার দিন। ভারতের হিন্দুত্ববাদী, ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী, ভারত থেকে মুসলিম বিলোপের নীলনকশা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দিয়ে এদিন কাশ্মীর দখল সম্পন্ন করেছে।

সারা বিশ্ব কাশ্মীরের এই ঐতিহাসিক মৃত্যু যেন নীরবে চেয়ে দেখেছে। একমাত্র পাকিস্তান ছাড়া কেউ এর প্রতিবাদ করেনি। বিশ্ব মুসলিম সংগঠন ‘ওআইসি’ প্রথমে কিছু বলেনি। তবে পরে একটি নাম মাত্র বিবৃতি দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় নেতা সউদী আরব যে বিবৃতি দিয়েছে তা দেয়া হয়েছে অনেকটা ভারতকে সন্তুষ্ট করতে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত ভারতের কাশ্মীর দখলকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে কোন মুসলিম দেশ আরেকটি মুসলিম অঞ্চলকে গ্রাস করতে যে কোন অমুসলিম দেশকে সমর্থন করতে পারে, তার প্রমাণ দিল দেশটি। আর মুসলিমরাই যে মুসলিমদের বড় শত্রু, তার প্রমাণও নতুন করে দিয়েছে এ দেশটি।

পাকিস্তানের চাপাচাপিতে চীনের অনুরোধে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৬ আগস্ট এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়। পঞ্চাশ বছরের মধ্যে এটি ছিল কাশ্মীর বিষয়ে প্রথম বৈঠক। যেমনটি আশা করা হয়েছিল, বৈঠকের ফল ঠিক তেমনটিই হয়েছে। বাকি চার বিশ্ব শক্তির কেউ কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি। বৈঠকের কোন বিবৃতি প্রকাশিত হয়নি। কাশ্মীর সংকট নিয়ে কোন যরূরী বৈঠকের প্রয়োজন কেউ মনে করেনি। চীন নিজেও নয়। তাই হয়তো আর কোন বৈঠক হবে না।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত যতটা পরিচিত, তার যত প্রভাব রয়েছে, পাকিস্তানের তা নেই। অব্যাহত সন্ত্রাসের শিকার দেশটির অর্থনীতি শেষ হয়ে গেছে। ইমরান খানের আমলে কোন রকমে অস্তিত্ব রক্ষা করে আছে পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একদা ভারতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দেশটি এখন গুরুত্ব হারানোর পর্যায়ে। আফগান তালিবানের সাথে চুক্তির জন্য তারা পাকিস্তানের সাথে এখনো খানিকটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন মনে করছে। চুক্তি হয়ে গেলে হয়ত সম্পর্ক ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে যাবে তারা। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চিরবৈরী ভারত বিশ্বের পারমাণবিক ক্ষমতা সম্পন্ন একটি দেশকে যেভাবে তার দীর্ঘকালের মিত্রদের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলে কোণঠাসা করে ফেলেছে তা বিস্ময়করই বটে। অন্যদিকে পাকিস্তান যা হারাচ্ছে তার কানাকড়িও আর ফিরে পাচ্ছে না বলেই দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের এ অসহায়ত্ব সে দেশের জনগণের জন্য যত বেদনাদায়ক, কাশ্মীরীদের জন্যও তা বটে। কারণ পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী অবস্থান কাশ্মীরীদের জন্য সুবিধাজনক হত।

একজন মুসলিম হিসাবে, একজন মানুষ হিসাবে আমার বুক ফেটে যায়, যখন দেখি ৫ আগস্টের পর থেকে ভারতের বিজেপি নেতারা কাশ্মীরী মেয়েদের বিয়ে করার জন্য সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে। কাশ্মীরী মেয়েরা যেন বেওয়ারিশ জিনিস, তাদেরকে যে খুশি সেই ভোগের জন্য নিয়ে আসতে পারে। তারা মানুষ নয়। তাদের কোন অধিকার নেই। তারা কি মুসলিম নয়? একজন মুসলিম নারী কি কোন বিধর্মীকে বিয়ে করে? কিন্তু কাশ্মীরী নারীদের সে মত প্রকাশ বা নিজেদের কথা বলার অধিকার বিজেপি স্বীকার করে না বলে মনে হচ্ছে।

অনেকেই বলছেন, কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার কেড়ে নেয়া অন্যায় হয়েছে। তাদের সে অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হোক। ভারতের দু’শ’ বুদ্ধিজীবী, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এ আহ্বান জানিয়ে ১৫ আগস্ট বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে কী এসে যায়? এর আগে অরুন্ধতী রায় একাধিকবার কাশ্মীরে বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন জুন মাসে বলেছিলেন, ‘অধিকৃত কাশ্মীরে ভারত যে নিষ্ঠুরতা চালাচ্ছে তা ভারতের গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক’। বিজেপি তার নির্বাচনী ইশতেহারেই বলেছিল যে, ক্ষমতায় গেলে তারা কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার দেয়া ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ বিধি বাতিল করবে। ৩৭০ ধারা কী? ভারত সরকার স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয় ছাড়া আর কোন বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না। বাকি সব দেখবে রাজ্য কর্তৃপক্ষ। ৩৫এ কী? বাইরের কেউ এসে কাশ্মীরে স্থায়ী হতে পারবে না। এর বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে স্বল্প একটা ধারণা দেয়া যায়। ফলে এতদিন কাশ্মীরের সব চাকরি শুধু কাশ্মীরীরাই পেয়েছে, দ্বিতীয়ত বাইরের কেউ এসে কাশ্মীরের বাসিন্দা হতে পারেনি। চরম আক্রোশে এ সবই এক তুড়িতে উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি।

এখন কথা উঠেছে, ৩৭০ ধারার ভিত্তিতেই ভারতে যোগ দিয়েছিলেন কাশ্মীরের তৎকালীন নেতা শেখ আব্দুল্লাহ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু তা মেনে নিয়েছিলেন। ৩৭০ ধারাই যদি বিজেপি বাতিল করে, তাহলে কাশ্মীরের ভারতে যোগদান হয় না। তার মানে কাশ্মীর স্বাধীন দেশ। কিন্তু তাদের বিধান সভার অনুমোদন না নিয়ে বিজেপি কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছে। অর্থাৎ কাশ্মীর দখল করল ভারত। কিন্তু এ দখলকে মোদি সরকার ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করেছে এবং এ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে।

ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যায় যে, কাশ্মীর নিয়ে অন্যায়টা করে চলেছে ভারতই। ভারতের সরকারী সেবাদাস ও স্বদেশ প্রেমে গদগদ মিডিয়া নেহরু-উত্তরকালে কাশ্মীর বিষয়ে জাতিসংঘের গণভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাবকে কবর দিয়ে দিয়েছে। আমরা আদ্যোপান্ত ইতিহাস না বলে কাশ্মীর বিষয়ে নেহরুর অবস্থান সম্পর্কে একটি দলীল পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে পারি। ভারতের তৎকালীন প্রধান বাংলা ‘দৈনিক অমৃত বাজার’ পত্রিকায় ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরুর একটি বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীর ভারত বা পাকিস্তানের সম্পত্তি নয়। কাশ্মীর কাশ্মীরী জনগণের। কাশ্মীর যখন ভারতে যোগ দেয় আমরা কাশ্মীরী জনগণের নেতাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে আমরা চূড়ান্তভাবে তাদের গণভোটের রায় মেনে নেব। তারা যদি আমাদের চলে যেতে বলে, তাহলে আমি কাশ্মীর ত্যাগ করতে কোন দ্বিধা করব না। আমরা বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে গিয়েছি এবং সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করার অঙ্গীকার করেছি। একটি মহান জাতি হিসাবে আমরা কথার খেলাপ করতে পারি না। আমরা সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানের ভার কাশ্মীরের জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছি এবং তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে আমরা সংকল্পবদ্ধ’।

এটি কোন পূর্ণাঙ্গ বিবৃতি নয়, কিন্তু পন্ডিত নেহরু এতে কয়েকটি সত্য উচ্চারণ করে গেছেন। যেমন- ১. কাশ্মীর কাশ্মীরীদের ২. কাশ্মীরে গণভোট আয়োজন ভারত কর্তৃক স্বীকৃত ৩. ভারত গণভোটের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। বলাবাহুল্য, ইতিহাস সত্যকে তুলে ধরে, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষমতা রাখে না। নেহরুর ভারত গত ৭০ বছরেও জাতিসংঘের কাছে দেয়া কথা রাখেনি, আর সে কথা খোদ জাতিসংঘও ভুলে গেছে। অথচ সেই গণভোট অনুষ্ঠিত হলে আজ কাশ্মীর এ রকম ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত হত না।

৫ আগস্টের পর কাশ্মীরের অবস্থা সম্পর্কে বিশ্ব অন্ধকারে। সেখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে, কেউ জানে না। কোন খবর পাবার উপায়ও নেই। বিশ্ব মিডিয়ার এক বিরাট অংশই এ ব্যাপারে তৎপর হলেও বাকি বিশ্ব বলতে গেলে নীরব। এদিকে ভারতের নয়াদিল্লী থেকে ৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ‘সলিডারিটি টিম’ কাশ্মীর পরিস্থিতি সরেযমীনে দেখার জন্য ৯ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত ৫ দিন ব্যাপকভাবে কাশ্মীর সফর করেন। এ দলে ছিলেন অর্থনীতিবিদ জাঁ দেরেজ, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স অব পিপলস মুভমেন্টের বিমলভাই; সিপিআই (এমএল) ও নিখিল ভারত প্রগতিশীল নারী সমিতির কবিতা কৃষ্ণান এবং নিখিল ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির মায়মুনা মোল্লা। তারা সারা কাশ্মীর ঘুরে ১৪ আগস্ট নয়াদিল্লী ফিরে আসেন। তবে সাংবাদিক সম্মেলনে তারা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে পারলেও কাশ্মীরের যে ভিডিও চিত্র ধারণ করে এনেছেন- পুলিশ তা প্রদর্শন করতে দেয়নি।

এই টিমের প্রথম কথাই ছিল ৫ আগস্ট পরবর্তী কাশ্মীর পরিস্থিতি বিষয়ে ভারত সরকার যা বলছে, ভারতের সংবাদ মাধ্যম যা বলছে এর চেয়ে সত্যের অপলাপ আর কিছু হতে পারে না। কাশ্মীরে ভারতীয় মিডিয়ার বিরুদ্ধে মানুষের রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। তারা বলেন, কাশ্মীরে এখন বিরাজ করছে বন্দুকের নলের সামনে নীরবতা। আমরা কাশ্মীরী পন্ডিত, শিখ, মুসলিম সবার সাথেই কথা বলেছি। কিন্তু বিজেপির কাশ্মীর মুখপাত্র ছাড়া আমরা এমন একজনকেও পাইনি যিনি ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ বিধি বাতিলকে সমর্থন করেছেন। সব জায়গাতেই মানুষের মধ্যে রাগ আর ভয়।

তারা জানান, কাশ্মীরের জনজীবন থামিয়ে দেয়া হয়েছে। অচল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। কাশ্মীরে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার দাবি চূড়ান্ত ভাবে বিভ্রান্তিকর। সেখানে এখন শ্রীনগরে আমরা একটি পার্কে কয়েকটি ছোট শিশুকে খেলতে দেখলাম। শুনলাম, তারা বলছে যে, মোদি ইবলিশ (শয়তান)।

কাশ্মীরের মানুষ তাদের বলেছেন, সরকার কাশ্মীরীদের সাথে ক্রীতদাসের মত আচরণ করছে। কাশ্মীরী মেয়েদেরকে উঠিয়ে অন্য স্থানে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। আমাদের ঘরে বন্দি করে রেখে আমাদের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তারা বলেন, ৩৭০ ধারা হচ্ছে কাশ্মীর ও ভারতের মধ্যে চুক্তি। এ চুক্তি না থাকলে ভারতেরও আর কাশ্মীর দাবির কোন ভিত্তি নেই। তারা নিজেরাই যেহেতু এ চুক্তি বাতিল করেছে তাই এখন আমরা মুক্ত।

প্রতিনিধি দল জানান, কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে এখন বিরাট আশংকা যে, এখন বিনিয়োগকারীদের কাছে কাশ্মীরের জমি সস্তা দরে বিক্রি করা হবে। আম্বানি, পতঞ্জলি এসে যাবে। কাশ্মীরের সম্পদ ও জমি দখল করা হবে।

বান্দিপোরার কাছে বাটপুরে মানুষ তাদের বলেছেন, এটা সেনাবাহিনীর শাসন, মোদির শাসন নয়। গোটা রাজ্যের প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই সৈন্য। সব মানুষই সন্ত্রস্ত। আর্মি ক্যাম্পগুলো অসম্ভব সব নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হলে আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরতে হবে। দেরী হলেই তারা নাজেহাল করবে। কারো শহর থেকে গ্রামে কিংবা গ্রাম থেকে শহরে স্বাধীনভাবে যাওয়া-আসার অধিকার নেই। এলাকার ওষুধের দোকান আর হাসপাতালের স্টক শেষ।

প্রতিনিধি দল জানান, প্রতিটি গ্রাম, এমনকি শ্রীনগর থেকেও খুব অল্প বয়সী স্কুল ছাত্র আর কিশোরদের সেনা বা পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের জন-সুরক্ষা আইনে ফাঁসিয়ে দেয়া হতে পারে বা ‘হারিয়ে’ যেতে পারে। আবার মুসলিমের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে পুরুষ-মহিলা-শিশু-কিশোরদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করছে। যুবকদের ধরে নিয়ে আসছে। অতঃপর প্রতিনিধি দল উপসংহারে বলেন, ‘পুরো কাশ্মীর এই মুহূর্তে সামরিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে একটি কারাগার’।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট কাশ্মীর প্রসঙ্গে একটি সাড়া জাগানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতে এক জাতি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। কাশ্মীর দখল তার সেই পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন। একই সাথে তা ইসলামের বিরুদ্ধে হিন্দুদের বিজয়। তার কাশ্মীর দখল হিন্দু জাতীযতাবাদী ভোটারদের সন্তুষ্ট করেছে। তাদের কাছে মোদি নিজেকে ভারতের ‘নতুন পিতা’ (নিউ ফাদার) হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মনে হচ্ছে, এর পরের পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ শুরু।

পরিস্থিতি বলছে, কাশ্মীরে তথাকথিত জঙ্গি হানার বা কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আর কোন অবকাশ মোদি সরকার রাখল না। শক্তির ভয়াবহতা দিয়ে কাশ্মীরের আজাদীর আগুনকে চিরতরে নিভিয়ে দিল তারা। তাদের প্রথম পর্যায়ের বিজয় সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কাশ্মীরের ৮০ লাখ মানুষের বিপরীতে এর আগেই ৭ লাখেরও বেশি সেনা মোতায়েন ছিল। বিভিন্ন সূত্রের খবর, অতি সম্প্রতি আরো ৩৫ হাজার নতুন সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আরো সেনা পাঠানো হবে। অর্থাৎ প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি ৮ জন কাশ্মীরীর জন্য একজন সেনা এবং অধিকাংশ বাড়ির সামনেই সেনা। এভাবেই কাশ্মীরের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে সেনা-চাদরে মুড়ে দিয়েছে মোদি সরকার। উল্লেখ্য, এর আগে এ কৌশল সফল হয়েছে চেচনিয়ায়, ফিলিস্তীনে এবং চীনের জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ক্ষেত্রে। কোন স্বাধীনতা সংগ্রামে জনসংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ১৩০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা অনধিক ২০ কোটি। তারা ছড়িয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে। তারা ঐক্যবদ্ধ নয়, সে সুযোগও নেই। গোটা ভারতে কাশ্মীরই ছিল একমাত্র মুসলিম সংখ্যাাগরিষ্ঠ রাজ্য। এখন থেকে আর কিছুদিন পর কাশ্মীরের সে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কারো সাধ্য নেই মোদিকে রুখবার। এরপর ভারতকে মুসলিম মুক্ত করতে মোদি নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নীল-নকশার গতিপ্রবাহ আগামীতে কোন্দিকে মোড় নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।

পরামর্শ

১. কাশ্মীরে একটি কার্যকরী পরিষদ গঠন করে, তার অধীন কাশ্মীরের জনগণকে একতাবদ্ধ করা।

২. সেই কার্যকরী পরিষদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীরিদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা।

৩. কাশ্মীরের বাসিন্দাদের শিক্ষা ও প্রাথমিক চাহিদাপূরণে প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহে ও তার ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘ ও ওআইসির সাথে একযোগে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৪. বিশ্বে জনমত সৃষ্টির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা ও কর্মসূচী হাতে নেয়া।

৫. কাশ্মীরের সমস্যার সহজতম সমাধান হতে পারে, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনতার রায় জানতে চাওয়া এবং রায় মোতাবেক কাশ্মীরকে তার আজাদীর পথে হাটতে দেয়া।

৬. কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে উভয় দেশের সরকার (পাকিস্তান ও ভারত) যাতে বাধ্য হয়, সেজন্য প্রচলিত  বৈধ পন্থায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে সামরিক-বেসামরিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া।

৭. ভারত কর্তৃক কাশ্মীরকে যথেষ্ট স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে গৃহযুদ্ধের অবসান করা। কারণ কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের যতগুলো পথ রয়েছে তার মধ্যে পর্যাপ্ত স্বায়ত্ত্বশাসনই ভারতীয় শাসকদের জন্য সহনীয়।

৮. ভারত-পাকিস্তান উভয়কেই কাশ্মীরকে টোপ হিসাবে ব্যবহার না করা।

৯. আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ভারত-পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে করে উভয় দেশের সরকার সংলাপের মাধ্যমে সীমান্তে হত্যাকা- দূর করতে পারে।

১০. আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ভারত-পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে কাশ্মীরে স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের ব্যবস্থা করা।

১১. সর্বোপরি ভারত-পাকিস্তানের ফলপ্রসূ আলোচনাই হতে পারে এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ।

পরিশেষে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রতি একান্ত আহ্বান, কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসুন। তাদের মতের পক্ষে পদক্ষেপ নিন। মহান আল্লাহ কাশ্মীরবাসীকে হেফাযত করুন- আমীন!!




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
নির্যাতিত মানুষের আর্তচীৎকার ও আল্লাহর সাহায্য - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
করোনা ভাইরাস - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় - হাসিবুর রহমান বুখারী
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক - তানযীল আহমাদ
ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস - এহসান বিন মুজাহির
ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন

ফেসবুক পেজ