শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫২ অপরাহ্ন

ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া

-আব্দুল্লাহ আল-মামুন*


এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।

এই কবিতাটি যতবার শুনি এক ভিন্ন রকমের গর্ব আর আনন্দে মন ভরে যায়। মনের গহীনে শুধু বাজতে থাকে আমি ধন্য এই ‘বাংলাদেশ’ নামক সোনার দেশে জন্মে। ভাবলেই মনটা ভরে যায় আমি বাংলাদেশের নাগরিক। নাগরিকত্ব প্রকাশের সময় গর্ব আর অহংকারমাখা মুখে বলি, ‘আমি বাংলাদেশী’। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অবলোকন করে অন্তর থেকে কান্নার প্রবণ প্রবাহিত হয়। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ভিতরটা ফেঁটে যায়। কী ছিলাম? কী হলাম? কী ছিল? কী হল? ইত্যাদি প্রশ্ন ধেঁয়ে আসে মনের ভেতর। বর্তমান দেশে সর্বাঙ্গে ব্যথা পরিস্থিতি বিরাজমান। প্রতিদিনের পত্র-পত্রিকার কলাম দেখলে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দৃষ্টির সম্মুখে চলে আসে। জনৈক কবি যথার্থই বলেছেন, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’। কেননা খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজ ইত্যাদির সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘ক্যাসিনো’ কাণ্ড।

‘ক্যাসিনো’ শব্দটি দেখে আঁতকে উঠলেন না তো! এটা এখন আর আঁতকে উঠার মত কোন কথা নয়! কয়েকদিন আগেই এই শব্দটির সাথে আমি আপনি পরিচিত ছিলাম না। এমনকি আমাদের সমাজও না। কিন্তু বর্তমানে ৭ বছরের ঐ ছোট্ট শিশুটির মাথায়ও ঠাঁই পেয়েছে ‘ক্যাসিনো’ শব্দটি। চলুন দেখা যাক, ক্যাসিনো কী? কোথা থেকেই বা আসল? এর ভাল-মন্দ দিকই বা কী আছে?

‘ক্যাসিনো’ ইতালীয় ভাষার শব্দ। মূল ‘ক্যাসা’, যার অর্থ ঘর। ক্যাসিনো বলতে ভিলা, গ্রীষ্মকালীন ঘর কিংবা সামাজিক ক্লাবকে বোঝানো হত। ১৯ শতকের দিকে ক্যাসিনো বলতে এমন সব ভবনকে বোঝান হত, যেখানে আনন্দদায়ক কাজকর্ম হত। যেমন নগরের সামাজিক অনুষ্ঠান, যেখানে নাচ, গান, জুয়া ও ক্রীড়ার ব্যবস্থা থাকে।[১] জার্মান ও স্প্যানিশ ভাষায় ক্যাসিনো দ্বারা অফিসার মেস বোঝান হয়।

ক্যাসিনো হচ্ছে জুয়া খেলার নির্দিষ্ট আসর, সাধারণত নামি হোটেল, রেস্টুরেন্ট, শপিং মল, দর্শনীয় স্থানের সাথে বা কাছেই এর অবস্থান থাকে। অনেক ক্যাসিনোতে আবার লাইভ রিয়েলিটি শো, কমেডি শো-এর ব্যবস্থা থাকে। সাথে এক্সটিক (ভাড়া পাওয়া যায় এমন মেয়ে/ছেলে) সার্ভিসও থাকে। ক্যাসিনোতে সুন্দরী মডেল কিংবা পার্টি গার্ল জুয়া খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়ে থাকে। মূলত ক্যাসিনো সরকার নিয়ন্ত্রিত জুয়া খেলার আসর। এটি স্থাপিত হওয়ার পিছেনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। আগে ভারতীয় উপমহাদেশে জুয়া খেলা হত অনিয়ন্ত্রিতভাবে, যেখানে-সেখানে। তাই এ অনিয়ন্ত্রিত জুয়াকে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে নিয়ে আসার জন্য সরকারীভাবে স্থাপন করা হয় ক্যাসিনো। এটি স্থাপনের আরও একটি কারণ ছিল জুয়া থেকে সরকারী লভ্যাংশ ও শুল্ক নিশ্চিত করা।[২]

মূলত ‘ক্যাসিনো’ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার একটি নির্দিষ্ট স্থান, যাকে বাংলায় ‘জুয়ার আখড়া’ বললেও ভুল হবে না। কিন্তু সেটা হয় সুবিশাল পরিসরে। সাধারণত ক্যাসিনো এমন পন্থায় বানানো হয় যে, এর সাথে কিংবা পাশাপাশি হোটেল, খামারবাড়ি, প্রাসাদ, রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, আনন্দ ভ্রমণ জাহাজ, পিকনিক স্পট, মেলার স্থান এবং অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ ঘেষে থাকে।

সব ক্যাসিনোই শুধু জুয়া খেলার কাজে ব্যবহার করা হয় না। ক্যালিফোর্নিয়ার শান্তা কাতালিনা দ্বীপের ‘কাতালিনা ক্যাসিনো’-তে কখনো জুয়া খেলা হয়নি। কোপেনহেগেন ক্যাসিনো একটি থিয়েটার হিসাবে ব্যবহৃত হত। ফিনল্যান্ডের ‘হাংকো ক্যাসিনো’তেও কখনো জুয়া খেলা হয়নি। এটি ১৯ শতকের শেষের দিকে রিসোর্ট হিসাবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এটি রেস্তোরা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু আমার সোনার বাংলায় ক্যাসিনোগুলোতে উল্লেখিত দেশের সকল ক্যাসিনোর সকল সরঞ্জামসহ বর্তমানে নানান সরঞ্জাম সংযোজনে জুয়ার এক মহা আড্ডাখানায় রূপ নিয়েছে। যার কারণেই তো আমরা অনন্য। তাদের কালচারের সাথে নতুন কিছু যুক্ত না করলে আমরা আধুনিক বাঙ্গালি হতে পারলাম কিভাবে? তাইতো অত্যন্ত চালাকির সাথে যুক্ত করেছি জুয়া।

জুয়ার প্রকৃত উৎস স্থলটা একদমই অজানা। ইতিহাসের প্রায় সব সমাজেই কোন না কোনরূপে জুয়ার প্রচলন ছিল। প্রাচীন গ্রীক-রোমান সহ নেপোলিয়ানের ফ্রান্স থেকে বর্তমান বাংলাদেশ সবখানেই জুয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম জুয়া ক্যাসিনো ইউরোপের ভেনিস, ইতালিতে ১৬৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার উদ্দেশ্য ছিল কার্নিভাল সিজনের জুয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা। তবে সামাজিক অবক্ষয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৭৭৪ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয়।[৩]

আমেরিকার চারটি প্রধান শহর নিউ অরেলিন্স, সেন্ট লুইস, শিকাগো, সানফ্রান্সিস্কোতে স্যালুন নামে জুয়াবাড়ি স্থাপিত হয়। এসব স্যালুনে এসে গ্রাহকরা মদ পান করত, আড্ডা দিত এবং প্রায়শই জুয়া খেলত। ১৯৩১ সালে নেভাদায় জুয়া খেলাকে বৈধ করা হলে সেখানে প্রথম বৈধ আমেরিকান ক্যাসিনো নির্মিত হয়। ১৯৭৬ সালে নিউ জার্সি আটলান্টিক শহরে জুয়া খেলা অনুমোদন করে। এটা বর্তমানে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহৎ জুয়াড়ি শহর। খরিদ্দারেরা ক্যাসিনো গেমস দ্বারা জুয়া খেলে থাকে। এই বাজে খেলায় অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাও প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ মানুষ অনভিজ্ঞতার বেড়াজালে পড়ে। ফলে জুয়া কর্তৃপক্ষই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লাভবান হয়। নিঃস্ব হয় সেই নোংরা মানসিকতাসম্পন্ন জুয়াড়ি ব্যক্তিগুলো।

স্লট মেশিন বা ভিডিও লটারি মেশিন ক্যাসিনোর অন্যতম জনপ্রিয় জুয়া খেলা। যুবক থেকে বৃদ্ধ বয়সীদের দেখা মিলে এসব ক্যাসিনোতে। তারা কোটি কোটি টাকা ওড়াতে আর মনোরঞ্জন করতে এখানে আসে। বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত কিছু ক্যাসিনো হল- ভেনিস শহরে ‘রীডাক ক্যাসিনো’, আমেরিকার ‘স্যালন্স ক্যাসিনো’, চীনের ‘দ্য ভ্যালেন্তিরান ক্যাসিনো’ ও ‘ম্যাকাও ক্যাসিনো’, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফক্সীডস রিসোর্ট ক্যাসিনো’, নেপালের ‘নেপাল ক্যাসিনোস’, ‘ক্যাসিনো ইন নেপাল’, ‘ক্যাসিনো সিয়াংগ্রি’, ‘ক্যাসিনো অ্যানা’, ‘ক্যাসিনো এভারেস্ট’ ও ‘ক্যাসিনো রয়েল’। এছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক জোনেও এধরনের আরো ১৭ টি ক্যাসিনো রয়েছে। এসব জুয়ার আসরে মজার খেলাধুলোর মধ্যে রয়েছে পোকার (জুজু খেলা), বাক্কারাট (বাজি ধরে তাস খেলা), রুলেট, পন্টুন, ফ্লাশ, বিট, ডিলার, ব্লাক জ্যাক এবং কার্ড স্লট মেশিনের খেলা। যেসবের পিছনে ওড়ানো হয় কোটি কোটি ডলার। ২৪ ঘণ্টা ধরেই চলে এসব জুয়ার আসর। অনেকে এক রাতেই রাজ্যের রাজা বনে যান, আবার অনেকেই হয়ে যান রাস্তার ফকীর। এগুলো প্রতিটি ক্যাসিনোতে আগ্রহীরা পরিবার-বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। রাতভর জুয়ার পাশাপাশি নারী আর মদের নেশায় মত্ত হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে ক্যাসিনো
বেশ কয়েক বছর পূর্বে বাংলাদেশের মানুষ ক্যাসিনো কী জিনিস হয়তো সেটা জানতো না বা বুঝত না। এটা এতোটা খোলামেলা ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক ক্যাসিনো-এর খোঁজ পাওয়া যায়। দেশের অলিতে গলিতে এর দেখা মিলে। র‍্যাব-১ এর অভিযানে রাজধানীর ফকিরাপুলে ইয়ংমেন্স ক্লাব, শাহজাহানপুরের মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও বনানীতে কয়েকটি ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়া যায়। র‍্যাবের হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬০টিরও বেশি ক্যাসিনো রয়েছে। যেখানে প্রতিরাতে ১২০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। যেখানে জুয়ার পাশাপাশি নানা অনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হয়ে থাকে। গভীর রাতে আসতে শুরু করে বিত্তবানদের গাড়ি। তাদের সঙ্গে থাকে সিনেমার উঠতি নায়িকা বয়সী থেকে শুরু করে নামিদামি মডেল। এসব মডেল-অভিনেত্রী জুয়ার আস্তানায় ‘এস্কর্ট গার্ল’ হিসাবে পরিচিত।[৪]

জুয়া আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটি শব্দ। সমাজের আনাচে-কানাচে এর প্রভাব না থাকলেও চুরি ছলনা করে বাংলার বহু অংশে জুয়ার দেখা মিলে। তবে বহু বছর আগে এর প্রচলন খুব কম ছিল। কিন্তু কয়েক বছর থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন উদ্যাপনকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যের বস্তাপচা সার্কাস নামক সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছে জুয়ার আসর। বিভিন্ন স্থানে মেলা বসিয়ে এসব জুয়ার প্রচলন আছে এখনও। মানুষ দেখেও না দেখার ভান করে চলতে থাকে এসব জুয়া। ছোট বড় সকলের পদচারণা রয়েছে এসব জুয়ার ঘরে। এসব জুয়ার বোর্ডে ১০০ টাকা দিলে মিলে যায় ২০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। টাকার মোহে শেষ পর্যন্ত হয় পকেট ফাঁকা। এমনকি স্ত্রীর গহনা বিক্রি করেও এই জুয়া নামক ভয়ংকর কর্মকা-ে ইনভেস্ট করে জুয়াড়িরা। সর্বোপরি বউকে বাজি রেখে এসব খেলা চালিয়ে যায় সেই বিকৃতমনা পশুগুলো।

গরীবের জন্য রয়েছে এসব জুয়ার বোর্ড লুডু ছক্কা তাস। আর অঢেল সম্পদের মালিক টাকাওয়ালারা হয় ক্যাসিনোর গ্রাহক। বড়লোক ঘরের দুলালরা তাদের বাবার অথবা স্বীয় অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়ে শপিং শেষে একটু রিফ্রেশমেন্ট কিংবা টাইম পাস করার জন্য যায় ক্যাসিনোতে। নিয়মিত ভরা পকেট নিয়ে যায় আর ফিরে আসে যথারীতি খালি পকেটে। এখানে কিছু কিছু খেলায় গাণিতিকভাবে খেলোয়াড়ের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে, তার জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত এসব যুক্তিই একজন জুয়াড়ি খেলোয়াড়কে অনেক সময় ধরে খেলায় জিইয়ে রাখে। সে ধরে নেই যে, সে জিতবেই অথবা জেতার সম্ভাবনা রয়েছে। ক্যাসিনোর কিছু কিছু খেলায় গ্রাহকরা একে অপরের বিপক্ষে বাজি ধরার সুযোগ পায়। এখানে ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ কিছু কমিশন নেয়। একে ‘র‌্যাক’ বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে নানা প্রকার অফার দেয়া হয়। এসব ক্যাসিনোতে জুয়ার পাশাপাশি মদ ও দুধ দুটোই রয়েছে। সুশীল সমাজের সভ্য লোকটি দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে কোলে পিঠে নৃত্যশিল্পী নিয়ে জুয়াকে জমিয়ে রেখেছে, আর সমাজের আরেক ক্যান্সার জাতি নেশাখোররা মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ধেই ধেই করে পলকের মাঝে হাজার লক্ষ কোটি টাকা উজাড় করছে। লেখক রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘যে মাঠ থেকে এসেছিল স্বাধীনতার ডাক, সেই মাঠে আজ বসে নেশার হাট’। এক কথায় ধনী থেকে গরীব হওয়ার সহজ উপায় হল এই ক্যাসিনো।

জনমনে প্রশ্ন হল- এই কটু শব্দ ক্যাসিনোর মত প্রকট ঘৃণিত খেলা আমার সোনার বাংলায় আসলো কোথা থেকে?
সবচেয়ে বড় কারণ হল আমদানী নীতিতে আমদানী নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি নেই। নানান ধরনের পণ্যের চালানে একটি দু’টি করে ক্যাসিনোর স্লট মেশিন, পোকার মেশিন, টেবিল, চিপসহ বিভিন্ন ক্যাসিনো সরঞ্জাম আমদানী করা হয়। ক্যাসিনো যন্ত্রপাতি আমদানী করেছে এমন ছয়টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- সিক্স সি করপোরেশন, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বেস্ট টাইবুন এন্টারপ্রাইজ, নিউ হোপ অ্যাগ্রোটেক লিমিটেড, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ, এ বি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল।[৫]

গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ রবিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘ডাইজ ফাংশনাল ল’ নিয়ে যথার্থ বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আইন ও নিয়মকানুন তৈরি করি একটি পর্যায় পর্যন্ত। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে যদি আইন পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে আইন টিকে থাকে শুধু বাহ্যিকভাবে। বাস্তবে তা কার্যকর থাকে না’। বাহাত্তরের সংবিধানে জুয়া নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল বটে কিন্তু কী লাভ হয়েছে? সেই নিরুৎসাহিতকরণ আজও আইনে রূপান্তরিত হয়নি। যার দরুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের আমদানী নীতিতে আমদানী নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত আমদানী পণ্যের তালিকায় ক্যাসিনোতে ব্যবহার করা হয়, এমন পণ্যের নাম নেই। সুতরাং ক্যাসিনোতে যেসব পণ্য ব্যবহার করা হয় তা আমদানী নিষিদ্ধ নয়। নতুন নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান নীতিমালায় অনুসরণ করছে এনবিআর। যাকে বলা হচ্ছে ‘ডাইজ ফাংশনাল ল’। ফলে সকল প্রকার আইন মেনেই স্প্রে মেশিন, ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ইত্যাদির সাথে আমাদানী হচ্ছে ক্যাসিনোর যন্ত্রপাতি।

আমাদের যুব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ পাপাচার বাসা বেঁধেছে। যার ফলে খুব অল্প সময়ের মাঝে আমাদের সমাজটা নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে এক মহাদুর্যোগের দিকে। ‘দের অয়ে দুরুস্ত অয়ে’ তথা দেরিতে হলেও সঠিক হয়েছে সেটিই সবচেয়ে আশার সংবাদ। এতদিন কোথায় ছিলাম, আগে কেন হয়নি, কেউ করেনি কেন, প্রশাসন কোথায় ছিল, এসব আর বলতে চাই না। বলতে চাই সমাধানের কথা; কোথাও কোন জুয়াড়ি কর্মকা- অবলোকন করলে প্রশাসনকে জানান। যথাসম্ভব নিজেই প্রতিবাদ করুন। এই বাজে অভ্যাসে আপনি স্বয়ং জড়িত থাকলে আজই তা পরিহার করুন। সঠিক উপায়ে আয় উপার্জন করুন, ইনশাআল্লাহ বাজে পথে ব্যয় করতে মন চাইবে না। নিজের জন্য প্রয়োজনীয় নিজের কাজটা যখন নিজেই করবেন, তখন বোধদয় হবে তা কতটা মূল্যবান। আজকে সকালেই নতুন আশায় বুক বাঁধুন। কবি নাজিম হিকমতের কথায় বলতে চাই, ‘যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর, তা আজও আমরা দেখিনি’।

যে ভাল সময় আমরা চাই তা আজও দেখা মিলেনি। রাশি রাশি দুঃখ শেষে একদিন দুঃখের অবসান ঘটবে। আপনার আমার দ্বারাই কলঙ্কমুক্ত হবে সমাজ। বেঁচে যাবেন আপনি, রক্ষা পাবে আপনার সন্তান। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহই মানুষকে পৌঁছে দিবেন দুঃসময় থেকে সুসময়ে। তবে রাস্তার ধারের টংয়ে বসে দিনের আলোয় জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলো গায়ে নিতে চাইলে ভিন্ন কথা।

ইসলামে ক্যাসিনোর বিধান
ইসলামপূর্ব মূর্খতার যুগে মদ ও জুয়াবাজিতে সয়লাব ছিল সমাজ। তখন লোকেরা জুয়া-বাজিতে মারাত্মকভাবে অভ্যস্ত ছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, নিজ স্ত্রী-সন্তান ও ভিটে-মাটির ওপর বাজি ধরতেও কুন্ঠিত হত না। হেরে গিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ও হতাশাগ্রস্ত হত। যখন দেখত তার সম্পদ অন্যের হাতে, তখন শুরু হত বিজয়ীর সঙ্গে বিরোধ, শত্রুতা ও বিদ্বেষ। এভাবে সমাজের পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। বর্তমান বিশ্বেও যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বলা যায় মূর্খতার যুগকেও হার মানিয়েছে।

মূলত লাভ ও লোকসানের মাঝে ঝুলন্ত ও সন্দেহযুক্ত প্রত্যেক বৈষয়িক বিষয়কে জুয়া বলে। অর্থাৎ এমন কাজ, যাতে সম্পূর্ণটাই লাভ বা গোটাটাই লোকসানের বাজির উপর থাকে। আর শরী‘আতের পরিভাষায় জুয়া হল ‘প্রত্যেক ঐ জিনিস, যা আল্লাহর যিকর ও ছালাত থেকে ভুলিয়ে রাখে।[৬] ইসলামী শরী‘আতে এটি একটি হারাম কাজ। পবিত্র কুরআনে এটাকে ‘শয়তানের কাজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জুয়া একটি সামাজিক ব্যাধিও বটে। ক্যাসিনো বা জুয়ার মাধ্যমে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়। ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান। স্রষ্টা হিসাবে আল্লাহই ভাল জানেন মানবজাতির জন্য কোন্ বিধান কল্যাণকর, আর কোন্টি অকল্যাণকর। আল্লাহ তা‘আলা জুয়াকে সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡہُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ-اِنَّمَا یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ یُّوۡقِعَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃَ وَ الۡبَغۡضَآءَ فِی الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ وَ یَصُدَّکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ وَ عَنِ الصَّلٰوۃِ ۚ فَہَلۡ اَنۡتُمۡ مُّنۡتَہُوۡنَ

‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য-নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব এগুলো থেকে বিরত থাক, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হও। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও ছালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত হবে না?’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৯০-৯১)। উক্ত আয়াতের اَلْمَيْسِرُ এর ব্যাখ্যায় ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) তাবেঈ বিদ্বান সুফিয়ান (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,كُلُّ شَيْءٍ مِنَ الْقِمَارِ فَهُوَ مِنَ الْمَيْسِرِ حَتَّى لَعِبِ الصِّبْيَانِ بِالْجَوْزِ ‘প্রত্যেক বাজি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। এমনকি শিশুদের হার-জিতের খেলাও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত’।[৭] অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,

یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ قُلۡ فِیۡہِمَاۤ اِثۡمٌ کَبِیۡرٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ اِثۡمُہُمَاۤ اَکۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِہِمَا

‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। (হে নবী!) আপনি বলুন, উভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে। তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২১৯)।

হাদীছে এসেছে, সুলায়মান ইবনু বুরায়দা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর পিতা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدَشِيْرِ فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَدَهُ فِىْ لَحْمِ خِنْزِيْرٍ وَدَمِهِ ‘যে পাশা খেলল, যে যেন তার হাত শুকরের গোশত ও রক্তে রঞ্জিত করে তুলল’।[৮] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدِ فَقَدْ عَصَى اللهَ وَرَسُوْلَهُ ‘যে ব্যক্তি পাশা খেলল, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করল’।[৯]

পরিশেষে বলব, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদ-জুয়ায় আচ্ছন্ন একটা সমাজকে যে আদর্শ দিয়ে পরিবর্তন করেছিলেন, আজও সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করা দরকার। কারণ আইন করে, অভিযান চালিয়ে, ধরপাকড় করে হয়তো সাময়িকভাবে কিছু সমাধান পাওয়া যাবে, কিন্তু স্থায়ী সমাধানের জন্য ফিরে আসতে হবে ইসলামের কাছেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়ন করা ছাড়া আদর্শিক মুক্তি কল্পনাও করা যায় না। মহান আল্লাহ ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালকদেরকে ক্যাসিনো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন এবং এগুলো প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!!


* অধ্যয়নরত, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ।

তথ্যসূত্র :
[১]. Gamloling in America: An Encyclopedia of History issues and Society. P. 43.
[২]. ক্যাসিনো কি? ক্যাসিনোর ইতিহাস, ক্যাসিনোতে কি হয়? ‘পাঠক নিউজ’, চট্রগ্রাম, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[৩]. Liminality and The Modem: Living Through the In-Between (Ashgate Publishing Ltd.), . P. 160.
[৪]. ‘রাজধানীর ৬০ ক্যাসিনোতে প্রতিরাতে ১২০ কোটি টাকার লেনদেন’ ‘দৈনিক আমাদের কাগজ’, ঢাকা, বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯।
[৫]. দৈনিক প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, পৃ. ১।
[৬]. তাইসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৭৮।
[৭]. আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবনু কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম (দারু ত্বাইয়েবা, ২য় সংস্করণ, ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.), ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২৮।
[৮]. ছহীহ মুসলিম, হা/২২৬০; আবূ দাঊদ, হা/৪৯৩৯; মিশকাত, হা/৪৫০০।
[৯]. আবূ দাঊদ, হা/৪৯৩৮; মিশকাত, হা/৪৫০৫, সনদ হাসান।




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
নির্যাতিত মানুষের আর্তচীৎকার ও আল্লাহর সাহায্য - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় - হাসিবুর রহমান বুখারী
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
করোনা ভাইরাস - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস - এহসান বিন মুজাহির
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক - তানযীল আহমাদ
ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী

ফেসবুক পেজ