মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ন

ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি

-আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*



ইহুদী জাতির পরিচয়

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক্ব (আলাইহিস সালাম)-এর পুত্র ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর অপর নাম ছিল ‘ইসরাঈল’। সে হিসাবে ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর বংশধরকে বনু ইসরাঈল (بنو إسرائيل) বলা হয়। ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম) ও বনু ইসরাঈলদের আদি বাসস্থান ছিল কেন‘আন, যা বর্তমান ফিলিস্তীন এলাকায় অবস্থিত। তখনকার সময় ফিলিস্তীন ও সিরিয়া একত্রিতভাবে ‘শাম’ নামে পরিচিত ছিল। প্রথম ও শেষ নবী ব্যতীত প্রায় সকল নবীরই আবাস্থল ছিল ইরাক ও শাম অঞ্চলে। যার গোটা অঞ্চলকে এখন ‘মধ্যপ্রাচ্য’ বলা হচ্ছে। ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর মোট ১২ জন সন্তান ছিলেন। পরবর্তীতে এই ১২ জন সন্তান হতে ১২টি গোত্রের উদ্ভব হয়। আজকের ইসরাঈল জাতি, নবী ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তান সৃষ্ট ১২টি সম্প্রদায়ের সদস্য। ইতিহাসে যাদেরকে ইহুদী নামে নামকরণ করা হয়েছে।

ইহুদীদের ধূর্তামি এবং পরিণতি

বনু ইসরাঈল বা ইহুদী জাতির ইতিহাস শুরু হয় নবীদের সাথে প্রবঞ্চণার মাধ্যমে। তাদের এই প্রতারণা ও ঠকামি শেষ নবী এবং তাঁর উম্মত পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-এর ১০ কুচক্রী ভাইয়েরা তার পিতার সঙ্গে ছলনার আশ্রয়ে তাকে প্রতারিত করেছিল। এই ইহুদী জাতি এতটাই ধূর্ত ও নিষ্ঠুর, যাদের ইতিহাস পড়লে শরীরের লোমে শিহরণ জাগে। অন্তরটা ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠে। যেমন-

(১) ইউসুফ (আলাইহিস সালাম)-কে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা তাকে অত্যন্ত জঘন্য ও নির্মমভাবে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।

(২) বস্তুত ইয়াকূব (আলাইহিস সালাম)-এর বারজন পুত্রের বংশধারা থেকেই যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন লক্ষাধিক নবী ও রাসূল। আর এই ইহুদীরা নবীদের বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে চুরি, যেনা, পাগল, জাদুকর সহ অসংখ্য নোংরা তোহমত লাগিয়েছে এবং হাযার হাযার নবীকে হত্যা করেছে। ফলে তারা অনেক সময় আল্লাহ কর্তৃক এবং বিভিন্ন শাসক কর্তৃক শাস্তি প্রাপ্ত হয়েছে। তারা তাদের হঠকারিতার জন্য তীহ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দিত্ব জীবন যাপন করেছে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য আল্লাহ তাদের জন্য আসমানী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’ এবং ১২টি ঝর্ণার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু তারা আসমানী খাদ্যের পরিবর্তে যমীনের শস্য ফসলের আবেদন করল। ফলে মূসা (আলাইহিস সালাম) সেই জন্য মর্মাহত হলেন। এই বনু ইসরাঈল মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে ব্যভিচারের অপবাদ দিয়েছিল। এই ইহুদী জাতির মাধ্যমে ইয়াহইয়া (আলাইহিস সালাম)-এর শিরচ্ছেদ করা হয়।

(৩) বনু ইসরাঈলের সর্বশেষ নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর জীবনে সংগঠিত ঘটনাবলীকে পূজি করে কুচক্রী ইহুদী পণ্ডিতরা খ্রীষ্টানদের চরম ভ্রান্তির ভিতর ফেলে। তারা পৃথিবীতে সর্ব প্রথম ‘ত্রিত্ববাদ’-এর জন্ম দেয়। কুচক্রী ইহুদীরা রোমান সম্রাটকে ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর বিরুদ্ধে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে। ফলে রোমান আদালত ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে মৃত্যুদ-ের নির্দেশ দেয়।[১] অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে আসমানে উঠিয়ে নেন। ইহুদীরা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে নবী বলে স্বীকার করেনি। বরং অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে তারা তাকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রির জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)।[২]

কুচক্রী ইহুদীরা ঈসা (আলাইহিস সালাম)-কে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হল না। বরং নাছারাদের উপর অমানবিক নির্যাতন, অত্যাচার শুরু করে। রোমান সরকারের সমর্থন নিয়ে তাদেরকে ধরে ধরে হত্যা করে। তারা চক্রান্ত করে সেন্টপলের মাধ্যমে ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর ধর্মকে এবং ধর্ম গ্রন্থকে বিকৃতি করে। ইহুদীরা জেনেশুনে প্রবঞ্চণা করতঃ ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর সত্য দ্বীনকে বিকৃতি ও বিধ্বস্ত করে দেয়; তাই কুরআন ইহুদীদেরকে (مغضوب)  বা ‘অভিশপ্ত’ বলে অভিহিত করেছে। নবীদেরকে হত্যা এবং শেষ নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য খ্রীষ্টানদেরকে ‘পথভ্রষ্ট’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (সূরা আল-ফাতিহা : ৭)। এমনিভাবে যুগ যুগ ধরে ইহুদীরা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার পর কেউ কেউ হেদায়াতপ্রাপ্ত হল আবার কেউ আল্লাহদ্রোহী রয়েই গেল। ফলে অভিশপ্ত জাতির প্রতারণা, ধূর্তামির লেজুর হিসাবে থেকেই গেল।

(৪) একদা একদল ইহুদী (সিরিয়ায়) শেষ নবীকে হত্যা করার জন্য ওঁৎ পেতে বসেছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন ব্যবসায়ী কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় আগমন করলেন, তখন ৭জন সশস্ত্র ইহুদী যুবক কাফেলার দিকে ছুটে যান মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে হত্যার জন্য। কিন্তু খ্রীষ্টান ধর্মযাজক উপস্থিত থাকার কারণে তা সম্ভব হয়নি।[৩] ধর্মযাজক রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -এর চাচাকে বালক মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সাথে করে দেশে ফিরে যেতে বলেন। আবূ তালিব তাই করেন।[৪]

(৫) ইহুদীরা বনু আউস ও বনু খাযরাজ গোত্রকে এক অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ‘বূয়াস’ এর মত দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত করে।

(৬) মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন তার বিরুদ্ধে নানারূপ কুৎসা ও মিথ্যা প্রচার করে বেড়াতে থাকে। আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই মুনাফিক্ব দলের সাথে মিলিত হয়ে দিন-রাত মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।[৫]

(৭) ইহুদীরা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই-এর নেতৃত্বে উহুদ যুদ্ধে ৩০০ জন সৈন্য মাঝপথ হতে কেটে পড়ে। মুসলিমদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা শক্র বাহিনীকে সাহায্য করে।[৬] ছাদের উপর থেকে পাথর গড়িয়ে দিয়ে মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যার চক্রান্ত করে বনু নযীর নামক এক ইহুদী গোত্র।[৭] শুধু তাই নয় সালাম বিন মিশকাম নামক এক ইহুদীর স্ত্রী জয়নব বিনতুল হারিছ বকরীর গোশতের মধ্যে বিষ মিশিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে হত্যা করার চেষ্টা করে।[৮] রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তেকালের পর ইহুদীরা দলে দলে মুসলিমদের ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করে। ফলে সংগঠিত হয় রিদ্দার যুদ্ধ।

(৮) আব্দুল্লাহ ইবনু সাবা ছিল অত্যন্ত ধুরন্দর ইহুদী। ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতের সময় মিশরে গিয়ে প্রচার করল আলীই প্রকৃতপক্ষে খেলাফতের উত্তরাধিকারী; খলীফা ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অন্যায়ের অধিকারী। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্য কুচক্রী সাবা কূফার মানুষদের খলীফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করল। সাবার কারণে বিদ্রোহীরা ৪০ দিন পর্যন্ত ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বাসগৃহ অবরোধ করে শেষ পর্যন্ত তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল।

(৯) অতঃপর আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) খেলাফতের আসনে সমাসীন হলে সাবায়ীপন্থীরা ভান করে আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর পক্ষাবলম্বন করে এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বংশধরদের প্রতি একান্ত মহব্বত রাখে মর্মে একটি দল গঠন করে।[৯] তারা ওছমান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হত্যার বিচারকে উপলক্ষ করে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে দুই ভাগে ভাগ করে উষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনা ঘটায়। যাতে প্রায় দশ হাযার লোক শহীদ হন।

(১০) ইহুদীদের প্ররোচনায় ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ছিফ্ফীনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এই অপ্রীতিকর ও কলঙ্কময় ঘটনার পেছনে ইহুদী নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার চক্রান্তই সক্রিয়ভাবে কাজ করছিল। এর মূল কারণ ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে সাবার নীল-নকশা ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যকার ভুল বুঝাবুুঝি। শুধু তাই নয় আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ঊর্ধ্বে তুলতে তুলতে তাঁকেই প্রকৃত নবী বলে তারা প্রচার করতে থাকে। এরাই ইতিহাসে ‘শী‘আ’ নামে পরিচিত। মূলত কুচক্রী ইহুদীদের এটা ছিল মুসলিমদের ঐক্য ও সংহতি বিনষ্টের এক শক্তিশালী দুরভিসন্ধি।

প্যালেষ্টাইনে ইসরাঈলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা পরাশক্তির প্রতারণা এবং তার পরিণাম  

প্যালেষ্টাইন মুসলিম, খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের নিকট এক পবিত্র ভূমি। সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের সময়ে প্যালেষ্টাইন তুর্কীদের অধিকারে আসে। এই সময় আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাথে প্যালেষ্টাইনে আরো একটি আন্দোলন শুরু হয়। ইহুদীদের এ আন্দোলন ‘জিওনিষ্ট আন্দোলন’ (ঞযব তরড়হরংঃ গড়াবসবহঃ) নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা ইহুদী নেতা থিয়োডোর হারজালের নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তারা দলে দলে প্যালেষ্টাইনে এসে বসতি স্থাপন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্ক জার্মানীর পক্ষ নিলে মিত্রশক্তি মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালি ঘাঁটি তৈরি করতে চায়। মূলত এটি ছিল আরব জাহানের নেতৃবৃন্দদের জন্য একটি টোপ বিশেষ।

আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য মিত্র শক্তি সাহায্য করবে। ইংরেজরা ইবনে সঊদকে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য উষ্কানি দিল। কিন্তু ইবনে সঊদ বৃটিশ অভিসন্ধি বুঝতে পেরে চুপ থাকলেন। মুনাফিক শরীফ হুসাইন ক্ষমতার লোভে আরব নেতৃবৃন্দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং ইংরেজদের প্ররোচনায় হঠাৎ তুরস্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।[১০] অন্যদিকে মিত্রশক্তি জিওনিষ্টদের প্যালেষ্টাইনে জাতীয় আরবভূমি স্থাপনে সাহায্য করবে বলে জানায়। ইহুদী ও আরবদের নিকট ব্রিটিশ সরকারের পরস্পর বিরোধী প্রতিশ্রুতি দানের মাধ্যমে ইংরেজদের সুবিধা হল। আরব সৈন্য নিয়ে ইংরেজরা তুরস্ক আক্রমণ করল এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়া অধিকার করল। বিজাতীয় তুর্কীদের তাড়াতে গিয়ে আরবরা প্রতারক ইউরোপিয়দের ডেকে আনল। ইহুদীদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ইহুদীদের জাতীয় আরবভূমি সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা তৈরি করল এবং তা ঘোষণা করল ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে। যা ‘বেলফোর ঘোষণা’ (ইবষভড়ঁৎ উবপষধৎধঃরড়হ) নামে পরিচিত।

ফলে প্যালেষ্টাইনে সমস্যা শুরু হল। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দে ‘প্যারিস সম্মেলন’ যখন প্যালেষ্টাইন নামক দেশটিকে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ‘ম্যান্ডেট’ হিসাবে স্থাপন করে, তখন থেকে অসংখ্য ইহুদী দলে দলে আসতে শুরু করে। তাছারা ইহুদীদের প্যালেষ্টাইনে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপ্রধান। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ইহুদীদের জাগাতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘হে ইহুদী! জাগো, এই তো সময়!’ শুধু তাই নয় অনেক কবি কবিতা রচনা করে, প্যালেষ্টাইনে আসার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন।

১৯১৭ সালে প্যালেষ্টাইনে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ লাখ। যার শতকরা ৯২ ভাগ আরব ফিলিস্তীন ও শতকরা আট ভাগ ইহুদী। এদিকে বৃটেন এক ইহুদী স্যার হার্বাট স্যামুয়েলকে ফিলিস্তীনে বৃটিশ হাই কমিশনার করে পাঠায়। ফলে ১৯১৮ সালে ছিল ৫৬,০০০ জন ইহুদী। ১৯২৫ সালে হল ১,০৮,০০০ জন, ১৯৩৫ সালে ৩,০০,০০০ জন এবং ১৯৪৮ সালে ৫,৪০,০০০ জন।[১১]

বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় দলে দলে ইহুদী আগমন করলে আরব-ইহুদী দাঙ্গা শুর হয়। ১৯২১, ২৯ ও ৩৬ খ্রীষ্টাব্দে উপরিউক্ত দাঙ্গার ফলে অসংখ্য লোক হতাহত হয়। ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার একটি রয়েল কমিশন (Royal commission) নিয়োগ করে। এর মাধ্যমে প্যালেষ্টাইনকে আরব, ইহুদী ও বৃটিশ অধিকৃত জেরুজালেম অঞ্চলে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করে। ফলে আরব-ইহুদী সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তার নিজের নীতি ‘হোয়াইট পেপার’-এ ঘোষণা করে। এত বলা হয় যে, দশ বছর পর একটি প্যালেষ্টাইন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। প্যালেষ্টাইনে ইহুদী প্রবেশ সীমাবদ্ধ করা হল। এই সিন্ধান্ত আরব বিশ্ব মেনে নিলেও ইহুদীরা মেনে নেয়নি। তৎপরবর্তীকালে তারা আমেরিকার সহযোগিতা কামনা করে। ১৯৪২ ও ১৯৪৪ সালে বিশ্ব জিওনিষ্ট সম্মেলন হয়। তারা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ঢ্রুম্যানকে চাপ দেয়। ফলে তিনি প্যালেষ্টাইনে এক লক্ষ ইহুদী অধিবাসী গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দেন। ফলে ১৯৪৫ সালে আরবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ সরকার প্যালেষ্টাইন সমস্যা জাতিসংঘে পেশ করল। জাতিসংঘ একটি বিশেষ কমিটি (ঝঢ়বপরধষ পড়সসরঃবব) নিয়োগ করে। এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্যালেষ্টাইন আরব, ইহুদী ও জেরুজালেম রাষ্ট্রে বিভক্ত হল। ফলে ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে ইহুদী ও আরবদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। অতঃপর আরবগণ যখন বিজয়ের পথে, তখন জাতিসংঘ চার সপ্তাহের জন্য যুদ্ধ থামাতে বলে। তাদের কৌশল হল, ইহুদীরা যাতে এই যুদ্ধ বিরতির সময় আমেরিকা ও রাশিয়া হতে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে। তারা তাই করল। আমেরিকা উদ্বাস্তু বেশে প্যালেষ্টাইনে সৈন্য পাঠাল। আরবগণ ইহুদীদের সঙ্গে আর পেরে উঠতে পারল না। ফলশ্রুতিতে তারা প্যালেষ্টাইনের একটি অংশ দখল করে ইসরাঈল বা ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং তেলআবিবকে রাষ্ট্রের রাজধানী করে। জাতিসংঘ ১৯৪৯ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম জাহানের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ইসরাঈল রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নেয়।[১২] ফলে আজ পর্যন্ত পরাশক্তির প্রতারণা, জাতিসংঘের ধূর্তামি ও হঠকারিতার জন্য ইহুদীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে আরব বিশ্বে রক্তের গঙ্গা প্রবাহিত করছে।

ইসরাঈলী বর্বরতা এবং ফিলিস্তীনের অবস্থা

ইহুদী পথভ্রষ্ট জাতির পশুত্বব্যঞ্জক ও নিষ্ঠুর আচরণে ফিলিস্তীন আজ এক মৃতুপুরী। লক্ষ লক্ষ  নিরপরাদ মুসলিমকে হত্যা করেও তাদের রক্ত পিপাসা নিবারণ হয়নি। এর আগে ‘অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ’ নামে গণহত্যা চালিয়েছে। স্থলপথে ইসরাঈল সেনা গাযায় ঢুকে ধ্বংসলীলা অব্যাহত রেখেছে। ইসরাঈলী ডিফেন্স ফোর্স হামাসের সুড়ঙ্গ ঘাটিগুলো নির্মূল করার নামে গাযায় প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে গেছে। তাদের হত্যার কৌশল যেন রাজার হাতে পশু শিকারের ন্যায়। একদিকে রাজার বাহিনী জঙ্গল হতে পশু প্রাণীকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে, অন্যদিকে রাজারা তাদের রাজ আসনে বসে জঙ্গলের এক কর্ণারে বন্দুকের নল দ্বারা পশু শিকার করছে। বোমারু বিমান দ্বারা যখন তারা বোমা হামলা করছে মানুষ তখন আশেপাশের এলাকায় বাঁচার জন্য পলায়ন করার চেষ্ট করছে, তখনই হায়েনারূপী ইহুদীরা তাদেরকে স্থল ও সমুদ্র থেকে পশুর মত হত্যা করেছে। যুবতী নারীকে পেলে বাঘের মত গর্জন করে তার সতীত্বের সর্বনাশ করে হত্যা করেছে। এমনকি গর্ভবতী কোন মহিলাকে তারা ছাড় দেয়নি। ফেরাউনের মত তারা শিশুদের যব্হ করেছে। তারা মনে করে ‘গাযাবাসী মানুষ নয়’। স্রেফ কিছু প্রাণী, যাদের ব্যাপারে কোন দায় দায়িত্ব নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম ‘সিবিএস’-কে নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ‘দুর্ঘটনায় সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত; কিন্তু এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ দায় হামাসের’।

বর্তমানে আবারো গাযায় বর্বরোচিত হামলা। জ্বলন্ত গাযায় ঝরছে প্রাণ। মরছে নিরীহ নারী-পুরুষ আর নিষ্পাপ শিশু। মায়ের কোলে থাকা শিশুর প্রাণ যাচ্ছে বোমার আঘাতে, বাবার হাত ধরে পথে থাকা শিশুও মরছে একইভাবে। অনেক আদরের ছোট্ট সোনার ছোট্ট শরীরটি কাপড়ে মুড়ে মা তুলে দিচ্ছেন বাবার হাতে দাফন করতে। কিন্তু এই কলিজার টুকরা শিশু সন্তান দাফন করতে গিয়ে বাবাকেও কাফনের কাপড় পরিধান করতে হচ্ছে। হাসপাতালে শিশুদের আহাজারী, বুকফাঁটা আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অনেকেই হয়তো জানে না তাদের পিতামাতা আর বেঁচে আছে কি-না। আবার কেউ বুকফাঁটা আর্তনাদ নিয়ে বাবার লাশের পিছনে ছুটছে। কেউ ইয়াতীম হয়েছে, কেউবা মা ও স্বজন হারিয়েছে। ইসরাঈলী বর্বরতায় ফিলিস্তীনি শিশুদের করুণ অবস্থা বর্ণনাতীত। ১৭ মে ২০২১ সোমবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে স্বজন হারানো এমনই এক শিশুর করুণ আর্তনাদ। ভিডিওতে ওই শিশুর কান্না আর অসহায়ত্ব একদিনেই দেখেছে ৪০ লাখের বেশি মানুষ। পাষাণ হৃদয়ও গলে যাবে সেই শিশুর আকুতি শুনে। দশ বছরের ওই শিশুর নাম নাদাইন আবদেল তাইফ। ইসরাঈলি হামলায় বিধ্বস্ত প্রতিবেশী বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শিশুটি জানে না জীবনের বাকিটা সময় কীভাবে কাটাবে। শিশুটি এখন স্বজন হারিয়ে একেবারেই একা। শিশু তাইফ বলছে,

‘আমি এখন কী করব? কী করে সামলাব? আমার তো মোটে ১০ বছর বয়স। এসব আর সহ্য করতে পারছি না! আমি সবসময়ই অসুস্থ থাকি, কিছুই করতে পারি না। আমি আমার দেশবাসীকে সাহায্য করতে ডাক্তার হতে বা কিছু একটা করতে চাই। কিন্তু কী করব, আমি তো একজন শিশু! আমার ভয় করছে। আমার নিজের লোকজনের জন্য আমি যে কোন কিছু করব! কিন্তু কী করতে হবে, সেটা জানি না’।[১৩]

বিশ্ব মোড়লদের দ্বৈবিধ্য আচরণ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনে হত্যার উৎসব  

মুসলিম বিশ্ব যখন ছিয়ামের আত্মশুদ্ধি অর্জনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই নেতানিয়াহু ও বিশ্ব মোড়লরা আল-আকছা মসজিদ প্রাঙ্গনে ফিলিস্তীনিদের ওপর হামলা চালিয়ে মুসলিম নিধনে ব্যস্ত। তারা ছালাতরত অবস্থায় মুছল্লীদের ওপর বুলেট, টিয়ার শেল এবং শব্দ বোমা ব্যবহার করে। ১০ মে ২০২১ এ ঘটনা ঘটে। জেরুজালেম দিবসে কট্টর ইয়াহুদীদের পতাকা মিছিলের পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। ১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুজালেম দখলের স্মরণে এ দিবস পালন করা হয়। যদিও আন্তর্জাতিক পরিসরে এটি স্বীকৃত নয়। বর্তমানে ইয়াহূদীদের জন্য নতুন বসতি স্থাপন নিয়ে ইসরাঈল ও ফিলিস্তীনিদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। উত্তেজনার মধ্যে জুমু‘আর দিন এবং তারাবীহর ছালারত অবস্থায় আল-আকছা মসজিদে ফিলিস্তীনি মুছল্লিদের ওপর হামলা চালায় ইসরাঈলী পুলিশ।[১৪]

এর আগেও তিন ইসরাঈলী কিশোর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একমাস পর হামাসের উপর দোষারোপ করে ইয়াহুদী সম্প্রদায় গাযার উপর যে বর্বর হামলা করেছিল তা ইতিহাসে বিরল। ভারী অস্ত্র, বোমা, ক্ষেপনাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস করেছিল নিরাপরাধ একটি বেসামরিক জনসমাজ। যাদের কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনী নেই, নেই অস্ত্রশস্ত্র, তাদেরই উপর চালানো হয়েছিল পুরাদস্তুর সামরিক আক্রমণ। দানবীয় হত্যালীলার বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিক মহল এবং বিশ্বমোড়লরা বরাবরের মত নগ্নভাবে ইসরাঈলের পক্ষ নিয়েছিল। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সামরিক হামলা, জাতিসংঘ চার্টার অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনও নীতিবিরোধী। তারপরও জাতিসংঘ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নীরব ছিল; বরং তারা ইসরাঈলকে সমর্থন করেছিল এবং বর্তমানেও করছে।

হে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়! তোমরা নীরব কেন? বিশ্বমোড়ল নামের হায়েনা পশুরূপী মানুষদের দ্বৈবিধ্য আচরণ আর কতদিন সহ্য করবে? কোথায় বিশ্বশান্তি সংস্থা? কোথায় মানবাধিকার সংস্থা? কোথায় জাতিসংঘ? অথচ জাতিসংঘ সনদে সকল জাতিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সীমানা সম্পর্কে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়া আছে।[১৫] কিন্তু স্থায়ী অধিবাসী ফিলিস্তীনিদের হটিয়ে, হত্যা করে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত (জাতিসংঘের মাধ্যমে) ইহুদী রাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে কোন সীমানা নেই। একটি মাত্র রাষ্ট্র, যার সীমানা অনির্ধারিত। তাই সে জেরুযালেম, ফিলিস্তীন, লেবানন ও সিরিয়ার একটি অংশকে যুক্ত করে বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র গঠন করবে এবং সীমানা ঘোষণা করবে। ৬৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন তারা সীমান্তের চূড়ান্ত রূপ দেয়নি। এটাকে বলে এৎববহ ষরহব. তাদের লক্ষ্য হল ইউফ্রেটিস থেকে নীলনদ, লোহিত সাগরের তীর থেকে তুর্কী সীমান্ত এই আরবী এলাকা, যা এক সময় অটোমান সা¤্রাজ্যের অধীনে ছিল, তা দখলে এনে চূড়ান্ত সীমান্ত ঘোষণা করা। এটাই হল জায়নবাদী ইসরাঈলী আধিপত্যবাদ। আর এটাকে জাতিসংঘ এবং পরাশক্তি নামে মোড়লরা সমর্থন দিচ্ছে, আঞ্জাম দিচ্ছে হত্যা করতে সামরিক শক্তির। পাশাপাশি উদ্বিগ্ন আমেরিকা ইসরাঈলের এই নৃশংস হামলাকে বলেছে যথাযথ এবং যুক্তিসঙ্গত, কেননা তা আত্মরক্ষার জন্য। ধিক! জাতিসংঘ, ধিক! ইউরোপ।

মুসলিম বিশ্বের মানসিকতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিণতি  

মুসলিম নেতৃবৃন্দের মানসিকতার ফল হল আজকে গাযার রক্ত স্রোত। আজ মুসলিম বিশ্বসহ আরব বিশ্ব মুখে কুলুখ দিয়ে মজা দেখছে; বরং প্রকারন্তরে ফিলিস্তীনের হত্যালীলা এবং ধ্বংসযজ্ঞকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করছে। মুসলিম প্রধান দেশের নেতৃবৃন্দের ক্ষমতার প্রতি লোভ এবং মুনাফিক্বীর কারণে ইসরাঈল এরূপ বর্বরতম ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো একবাক্যে ইসরাঈল এবং পশ্চিমা পরাশক্তিদের যদি হুঙ্কার ছাড়ে তাহলে তারা অবশ্যই এই রক্তের হোলি খেলা বন্ধ করতে বাধ্য। কিন্তু না; অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি ক্ষমতার চেয়ার ছিটকে পরে। বরং তাদের কাছে মুসলিম বন্ধুর চেয়ে আমেরিকা বন্ধু অনেক ভাল। কারণ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে পারলেই ক্ষমতার চেয়ার সুদৃঢ় থাকবে, অন্যথা নয়। আরব রাষ্ট্রগুলোতে রাজনীতিকদের মধ্যে ইসলাম ভীতি এত বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে যে, তা ইসরাঈলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যক্রম অপসন্দ করার বিষয়টিও পেছনে ঠেলে দিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে সঊদী আরব ও মিশর ভিন্ন ভূমিকা পালন করছে। সঊদী আরব বিভিন্নভাবে ইসরাঈলদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে। ইতিমধ্যে তারা ইসরাঈলদের জন্য সঊদীর আকাশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে।[১৬] অন্যদিকে একটি স্থায়ী অস্ত্রবিরতি চুক্তি এবং শান্তির পথ পুনর্জীবিত করার ক্ষেত্রে মিশর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যার কারণে বর্তমানে গাযায় ১১ দিনের ব্যাপক সহিংসতার অবসান ঘটে।[১৭]

অন্য মুসলিম দেশগুলো ইহুদী খ্রীষ্টানদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে মুসলিমরা মুসলিমদের নিধন কাজে ব্যস্ত, সেখানে গাযার মানুষের করুণ আর্তনাদ কি তাদের কর্ণকুহরে পৌঁছাবে? এমনকি অমুসলিমরাও মুসলিম নেতৃবৃন্দের নীরবতার জন্য সামলোচনা করেছেন। বৃটিশ এম.পি, লেখক ও সাংবাদিক জর্জ গ্যালওয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের কড়া সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘আপনাদের লজ্জা বলতে কি কিছু আছে’?

স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ লড়াই এবং পরাশক্তিদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি

প্রতিবারের মত এবারের অভিযানে ইসরাঈলের সামরিক উদ্দেশ্য হল, ফিলিস্তীনের ধ্বংস সাধন। এই কথা বলে ইসরাঈল আগেও একাধিকবার হামলা করেছে। যেমন ২০০৮, ২০১২ সালের আক্রমণ ইসরাঈল কী চায়? তাদের স্ট্রাটেজি বা কৌশল কী? মধ্যপ্রাচ্যকে উত্তপ্ত রাখা ও ধ্বংস সাধনের উদ্দেশ্য কী? ইসরাঈলের সামরিক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, তারা এক দীর্ঘমেয়াদি লড়াইয়ের অংশ হিসাবেই এসব স্বল্প মেয়াদি সংঘাতে লিপ্ত আছে। তাদের যুক্তি হল, এটি হল ইংরেজীতে যাকে বলে ‘লং ওয়ার অব অ্যাট্রিশন’, যার অর্থ ‘স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ লড়াই’। তারা স্বল্প ক্ষতির মাধ্যমে দীর্ঘ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত।

প্রথম আরব-ইসরাঈল যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৪৮ সালে, দ্বিতীয়বার আবার যুদ্ধ হয় ১৯৫৬ সালে সুয়েজখাল নিয়ে। এরপর ১৯৬৭ সালে। সর্বশেষ যুদ্ধটি হয় ১৯৭৩ সালে। প্রতিটি যুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরাঈলের নিকট পরাজিত হয়েছে এবং একই সাথে বিশাল এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছে। ইতিপূর্বে পশ্চিম তীর ছিল জর্ডানের অধীন এবং গাযা উপদ্বীপ ছিল মিসরের মালিকানাধীন। ৬৭ সালে ইসরাঈল এই এলাকাগুলো দখল করে নেয়। তাছাড়া পরাশক্তি তথা ইউরোপ দেশগুলো এই স্বল্প ক্ষতির দীর্ঘ লড়াইয়ের পিছনে অনেক কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে, যা তাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতির অন্তর্ভুক্ত। তারা ইসরাঈলের মাধ্যমে এগুলো বাস্তবায়ন করতে চায় এবং ইসরাঈলকে পুরোপুরি এই কাজে নিয়োজিত রাখতে চায় সহযোগী হিসাবে। তার মৌলিক কারণের মধ্যে অন্যতম হল :

১. মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশকেই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠতে না দেয়া।[১৮] ২. মধ্যপ্রাচ্যে তেলসম্পদ ও ভূরাজনৈতিক সম্ভাবনার প্রতি লক্ষ্য রেখে এখানে একটি লাঠিয়াল রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাঈলকে প্রতিষ্ঠা করা। ৩. সামরিক স্বৈরাচার ও রাজ পরিবারকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা এবং কোথাও আঞ্চলিক সামরিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তা সমূলে ধ্বংস করা। ৪. আরবদের হত্যা করা এবং তাদেরকে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের দাসে পরিণত করা।[১৯] ৫. ইহুদী হোলোকস্ট[২০] (Holocaust)-এর কাহিনী দ্বারা খ্রীষ্টান হোলোকষ্ট ভুলিয়ে দেয়া। যেমন ইউরোপে ইহুদীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা চর্চার পরিণতি হিসাবে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।

প্রশ্ন হচ্ছে আবার সেই ইহুদী নির্যাতন ও হত্যার ঘটনাকেই সাম্রাজ্যবাদ মহীয়ান করতে চায় কেন? তাহল তাদের অতীতের জঘন্য ও ঘৃণ্য অপরাধ লুকিয়ে রাখার মতলব।

সুধী পাঠক! ইউরোপের এই সাদা মানুষগুলো কি আদিবাসীদের নিবির্চারে হত্যা করেনি? জনগোষ্ঠীর পর জনগোষ্ঠীকে কী নিশ্চিহ্ন করেনি? কালোদেরকে কী দড়িতে লটকিয়ে মারেনি? পুড়িয়ে হত্যা করেনি? তাদের ইতিহাস কী আমরা মনে রেখেছি বা জানি? আমেরিকান ইন্ডিয়ান, মায়া, ইনকা, দাস হিসাবে ধরে নিয়ে যাওয়া আমেরিকায় আফ্রিকার কালো মানুষসহ আরো অগণিত মানুষ, যাদের ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদ মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানের হামলাটাও সাদা মানুষদের হোলোকষ্টকে ভুলিয়ে দেয়ার একটি অংশ।

ইসরাঈলী আগ্রাসন মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধের নির্দশন 

প্রথম মহাযুদ্ধ শতবর্ষ পূর্তি হয় ২০১৪ সালে। মাঝখানে দ্বিতীয়। এখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আলামত অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে চলমান মহাযুদ্ধের পার্থক্য হচ্ছে, সেসব যুদ্ধ সম্পর্কে সারাবিশ্বের মানুষ জানত। এখন বার্সিলোনা বা বুয়েন্স আয়ারেসের রাস্তায় চলমান লোকজন বুঝতেই পারছে না যে, একটি যুদ্ধ চলছে।

মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি বাগদাদ নগরী এবং ওছমানিয়া খেলাফত ধ্বংস করার পরও মুসলিম নেতৃবৃন্দের বোধোদয় হয়নি। প্রতিটি বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি করে ঘটনাকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অষ্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর পারমানবিক বোমা ব্যবহারের ভীতি। মুসলিমদের সঙ্গে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধ শুরু করেও তারা যখন লাভবান হতে পারল না; তখন মধ্যপ্রাচ্যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে। তবে সেই জন্য নাইন-ইলেভেনের মত সন্ত্রাসী ঘটনাকে অনুঘটক হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। আর এই ঘটনার মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল জায়নবাদী ইহুদীচক্র এবং খ্রিষ্টানরা। কিন্তু সেটা না হওয়াতে তারা ‘ছায়া যুদ্ধ’ শুরু করেছে। মুসলিমদেরকে দু’খ-ে বিভক্ত করে শেষ করে দিচ্ছে। আফগানিস্তানের তালেবানদের কমিউনিষ্ট বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধে আল-কায়েদার মত মুসলিম জঙ্গি সংগঠন গড়ে তোলার পেছনে ‘সি আই’-এর ভূমিকার কথা এখন সর্বজনবিদিত। সেই আল-কায়েদাকে দমনের নামে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে মার্কিনীদের দেশব্যাপী যুদ্ধ চলছে। মুসলিম দেশগুলোতে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইকে চাঙ্গা করার জন্য বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাদের মাঝে সমন্বয় করতে ইসরাঈলের ‘মোসাদ’ কাজ করছে। এর অংশ হিসাবে সিরিয়ার আল-কায়েদাকে যেমন অস্ত্রশস্ত্র দানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তেমনিভাবে প্রতিপক্ষ মিলিশিয়াকেও অস্ত্রের যোগান দেয়া হচ্ছে। এক পক্ষকে পশ্চিমা উৎস হতে অন্যপক্ষকে রাশিয়া হতে। এইভাবে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে এক সময় লড়াইরত আল-কায়েদা জিহাদী গ্রুপ ও হিজবুল্লাহর শী‘আ মিলিশিয়া গ্রুপকে ইরাক এবং সিরিয়ায় পরস্পরের মুখোমুখি রাখা হয়েছে। তাছারা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিমদের মধ্যকার শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্ব। আফগানিস্তান, ইরাক শেষ। সিরিয়াকে মিশর থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ইসরাঈলের অবস্থান। পাশাপাশি সকল জায়গায় গৃহ যুদ্ধ। এখন ইসরাঈল ফিলিস্তীনে যে হামলা চালাচ্ছে এটা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ছায়াযুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণে আনা মানে গোটা মুসলিম বিশ্ব পরিণত হবে পশ্চিমাদের হাতের পুতুলে। এটাই তাদের মুসলিম বিশ্বযুদ্ধ বনাম ছায়াযুদ্ধের মৌলিক উদ্দেশ্য। এটা শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং অন্যান্য অঞ্চলেও কাজ চলছে।

আফ্রিকার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র নাইজেরিয়া থেকে মুসলিম নেতৃত্ব সরানো হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকা-ের মাধ্যমে, সুদানকে দ্বিখ-িত করা হল। আলজেরিয়ার জনগণের হাতে ক্ষমতা নেই। মালিতে মুসলিমদের অবস্থা সূচনীয়। আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রের অবস্থা আরও করুণ। সেখানে এখনিক ক্লিনসিং (জাতি নিশ্চিতকরণ) চলছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে। ইউরোপের খ্রীষ্টানেরা বন্দুকের জোরে প্রায় সমগ্র আফ্রিকা দখল করল। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদান তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

উপসংহার  

ইসরাঈলের পিতা বলে পরিচিত বেনগুরিয়ান বলেছিলেন, We must terror, assassination, Intimidation, land, confiscation and the catting of all social services to rid the galilee of its Arab population. তাই তারা তাদের পিতার ঘোষণা অনুযায়ী ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাসী, গুপ্তহত্যা, জমি বাজেয়াপ্ত করা কোনটার ব্যাত্যয় করেনি। হবেও না কোনদিন। অতএব হে মুসলিম নেতৃবৃন্দ! ঐক্যবন্ধ হৌন! আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন ও দলে দলে বিভক্ত হওয়া এবং ইহুদী-খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করা থেকে বিরত হোন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন-আমীন!!


* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

তথ্যসূত্র :
[১]. মাহমূদ ও মুহাম্মাদ সিদ্দিক, ইসরাঈল ও মুসলিম জাহান (ঢাকা : ইসলামিক ফাউ-েশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ, জানুয়ারী ১৯৮৯), পৃ. ১৪৮-৫০।
[২]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, নবীদের কাহিনী (রাজশাহী : হাদীছ ফাউ-েশন বাংলাদেশ, ১১তম প্রকাশ, ডিসেম্বর, ২০১০), ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৫।
[৩]. ইসরাঈল ও মুসলিম জাহান, পৃ. ১৬৪-৬৫।
[৪]. সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৪২।
[৫]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ১৪৯।
[৬]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২১৮।
[৭]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ২৬৯।
[৮]. আর-রাহীকুল মাখতূম, পৃ. ৩৪৭।
[৯]. ইসরাঈল ও মুসলিম জাহান, পৃ. ১৯৩।
[১০]. মোঃ একরাম উল্লাহ দুলাল, মধ্য প্রাচ্যের ইতিহাস (ঢাকা : কে আলী প্রকাশক, প্রথম সংস্করণ, ১৯৬৫), পৃঃ ৩২৬।
[১১]. ইসরাঈল ও মুসলিম জাহান, পৃ. ৩০৭।
[১২]. মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, পৃ. ৩৪১।
[১৩]. “সব হারিয়ে ফিলিস্তিনি শিশুর প্রশ্ন ‘আমি এখন কী করব?” দৈনিক যুগান্তর, ১৭ মে ২০২১।
[১৪]. “আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলের হামলা, শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত” বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১০ মে ২০২১।
[১৫]. মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস, পৃ. ১৯৩।
[১৬]. “ইসরাঈলের জন্য সৌদির আকাশ পথ বন্ধ” নিউজ টুয়েনটিফর, ২৭ মে ২০২১।
[১৭]. “গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরাঈল ও মিশরের বৈঠক” দৈনিক ইত্তেফাক্ব, ৩১ মে ২০২১।
[১৮]. নয়া দিগন্ত, শনিবার ৯ আগষ্ট ২০১৪।
[১৯]. নয়া দিগন্ত, শনিবার ৯ ই আগষ্ট ২০১৪।
[২০]. Holocaust অর্থ আগুনে সম্পূর্ণ ধ্বংস, (বিশেষতঃ মানুষের জীবন) সামগ্রিক হত্যাকাণ্ড বা সম্পূর্ণ বিনাশ হওয়া বুঝায়।




প্রসঙ্গসমূহ »: সাময়িক প্রসঙ্গ
নির্যাতিত মানুষের আর্তচীৎকার ও আল্লাহর সাহায্য - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
করোনা ভাইরাস - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় - হাসিবুর রহমান বুখারী
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (শেষ কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
ইহুদী ও পশ্চিমা পরাশক্তির ধূর্তামি এবং ফিলিস্তিনের পরিণতি - আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম
ইসলামে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক - তানযীল আহমাদ
ক্যাসিনো : মদ্যপ, জুয়াড়ি ও যৌনাচারের আখড়া - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
ধর্ষন : বিকৃত মানসিকতার ভয়ংকর আক্রমণ - আব্দুল্লাহ আল-মামুন
কাশ্মীর দখল : মুসলিমমুক্ত করার নীলনকশা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম
মানব বিধ্বংসী এনার্জি ড্রিংকস - এহসান বিন মুজাহির
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শানে আপত্তিকর কটুক্তি ও আমাদের করণীয় (২য় কিস্তি) - হাসিবুর রহমান বুখারী
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও প্রতিকার : একটি পর্যালোচনা - মুহাম্মাদ আমীনুল ইসলাম

ফেসবুক পেজ