আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে শাসক ও জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য
আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম*
৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশ। ইসলামের বিধান মতেই এদেশ চলবে এটাই কাম্য। এর কল্যাণ স্পর্শে দেশ নবজীবন লাভ করবে এবং সর্বদা উন্নতি ও অগ্রগতির পথে থাকবে। সেজন্য আমাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে দৃঢ়চিত্ত আল্লাহভীরু একজন শাসক বা খলীফা নির্বাচন করা। যিনি আল্লাহর বিধান মতে দেশ পরিচালনা করবেন। যে দেশ বা রাষ্ট্র রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সত্য বিধানের আলোকে পরিচালিত হবে সেটিই হবে বিশ্ব মানবতার জন্য সত্যিকারের আদর্শ রাষ্ট্র। আর শাসক বা সরকার ও জনগণ আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সরকারকে রাষ্ট্রের মুখপাত্র বলা হয়। সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কর্মসূচি ও নীতিমালা প্রকাশিত ও কার্যকর হয়। সরকার ছাড়া রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। আবার জনগণ ছাড়া রাষ্ট্রও কল্পনা করা যায় না। তাই বলা যায় যে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে; অনুরূপভাবে জনগণেরও দায়িত্ব রয়েছে। মহান আল্লাহ প্রত্যেক জাতির জন্য একজন ইমাম নির্ধারণের অনুমোদন দিয়েছেন যাকে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন, তার কাছে শাসনভার অর্পণ করেছেন, তার উপর ন্যায়বিচার করা আবশ্যক করেছেন এবং অধীনস্তদের উপর তার কথা শ্রবণ ও আনুগত্য করার অধিকার দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا.
‘হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর’ (সূরা আন-নিসা: ৫৯)। *
ইরবায বিন সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে আমাদের উদ্দেশ্যে মর্মস্পর্শী উপদেশ দিলেন, তাতে চোখগুলো অশ্রুসিক্ত হল এবং অন্তরগুলো বিগলিত হল। তখন আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ যেন বিদায়ী ভাষণ! অতএব আপনি আমাদেরকে উপদেশ দেন। তিনি বললেন,
أُوْصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدٌ حَبَشِىٌّ فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ يَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ.
‘আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি এবং শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি। কারণ তোমাদের মধ্যে আমার পরে যারা জীবিত থাকবে তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত এবং আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাত অনুসরণ করবে, এমনকি তা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। আর সাবধান থাকবে (ধর্মে) নব আবিষ্কৃত প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে! কারণ প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয় বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[১]
আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচয়
রাষ্ট্র বলতে এমন এক রাজনৈতিক সংগঠনকে বুঝায় যা কোন একটি ভৌগোলিক এলাকা ও তৎসংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। রাষ্ট্রে সাধারণত একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ হিসাবে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক সীমার ভেতর বসবাসকারী সমাজের সদস্যদের শাসনের জন্য নিয়ম-কানুন তৈরি করে। একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক উপাদান যরূরী। আর তাহল ১. নির্দিষ্ট ভূমি ২. জনসংখ্যা ৩. সরকার এবং ৪. সার্বভৌমত্ব। এই চারটির একটিও যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তাকে রাষ্ট্র বলা হয় না। আবার সকল রাষ্ট্রই আদর্শ রাষ্ট্র নয়। আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচয় ও ব্য্যাখা যার যার আদর্শ অনুযায়ী হতে পারে। তবে ইসলামে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচয় ভিন্ন। আদর্শ রাষ্ট্র হল সেই রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র ইসলামী আইন তথা অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত হয়। যেখানে মহান আল্লাহ হলেন সকল সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ও অধিকারী। রাষ্ট্রের সকল মূলনীতি ও আইনের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ থেকে প্রাপ্ত আদেশ ও নিষেধই চূড়ান্ত সিন্ধান্ত বলে বিবেচিত হয়। এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে সর্বোত্তম উৎকৃষ্ট ও সুন্দর উদাহরণ হল মুহাম্মাদ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদার শাসিত চল্লিশটি বছর। পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা পুরো মুসলিম উম্মাহকে ধারণ করতে পারেনি। খুলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া খেলাফত, অতঃপর আব্বাসী খেলাফত এবং সর্বশেষ সাম্রাজ্যবাজদের চাপিয়ে দেয়া বস্তুবাদী মতাদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের বিষবাম্প ছড়িয়ে দুর্বলচেতা মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করে ওছমানীয় খেলাফতের পতন ও বিলুপ্ত করা হয়। ফলশ্রুতিতে মুসলিমদের রাজনৈতিক ঐক্য শেষ হয়ে যায়। মুসলিমদের ঈমানী দুর্বলতা ও পারস্পরিক স্বার্থদ্বন্দ ও ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের মানবরচিত দর্শন ও চক্রান্তই খেলাফত বিলুপ্তির কারণ। বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ একই রোগে আক্রান্ত। একই চক্রান্তের শিকার হয়ে তারা আজ ইসলামী খেলাফতের স্বপ্ন ছেড়ে কুফরী রাষ্ট্র কায়েমে জান-মাল, সময়, শ্রম সবকিছু উৎসর্গ করছে। বাংলাদেশও তার বাহিরে নয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও (পূর্ব ও পশ্চিম) পাকিস্তান আলাদা হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল ইসলাম। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আদর্শ রাষ্ট্র তথা ইসলামী খেলাফতের নমুনা আমরা দেখতে পাইনি।
আদর্শ রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা কেন?
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বরে বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ লিখিত আকারে গৃহীত হয় এবং ১৬ই ডিসেম্বরে তা কার্যকর হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের ‘সংবিধান’ সর্বমোট ১৭ বার সংশোধিত হয়েছে। এই ‘সংবিধান’ সংশোধনের জন্য সংবিধানের ১৪২নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্যদের মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের প্রয়োজন হয়। যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা তাদের মত করে ‘সংবিধান’ সংশোধন করে। আবার ক্ষমতার পালাবদলে পরবর্তী সরকার পূর্বের সংশোধনী বাতিলও করে। ক্ষমতাসীনরা মনে করে, বাংলাদেশের সংবিধান কেবল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইনই নয়; সংবিধানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মূল চরিত্রও বর্ণিত রয়েছে। সংবিধানে বলা আছে; দেশটি হবে প্রজাতান্ত্রিক, গণতন্ত্র হবে এদেশের প্রশাসনিক ভিত্তি, জনগণ হবে সকল ক্ষমতার উৎস এবং বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস হলেও দেশ আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ এই প্রত্যেকটা মূলনীতিই ঈমান ও ধর্ম বিধ্বংসী মতবাদ। যেমন,
জাতীয়তাবাদ মানবতা বিধ্বংসী মতবাদ। যার মৌলিক উপাদান ৬টি। (১) বংশ (২) অঞ্চল, (৩) ভাষা, (৪) বর্ণ, (৫) অর্থনৈতিক ঐক্য এবং (৬) শাসনতান্ত্রিক ঐক্য। উক্ত ছয়টি উপাদানের মধ্যে ধর্মকে স্থান দেয়া হয়নি। জাতীয়তাবাদ ধর্মকে নস্যাৎ করার জন্য সৃষ্ট প্রথম কোন বিজাতীয় মতবাদ। এটা ধর্ম বিধ্বংসী জাতি ও গোত্র ভিত্তিক সংকীর্ণ মতবাদ। কতিপয় খ্রীস্টান দার্শনিক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই মতবাদ ধর্মহীন পশুত্বের জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এটা মূলতঃ জাহেলী যুগে প্রচলিত গোষ্ঠী ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থার নাম। অথচ আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী সভ্যতার দিকে ফিরে যেতে নিষেধ করেছেন (সূরা আল-মায়েদাহ: ৫০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাবতীয় জাহেলী কর্মকাণ্ডকে কবর দিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসনের সূচনা করেছিলেন।[২] তাই বলা যায়, এই জাহেলী মতবাদের মাধ্যমে সমাজে কখনো শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। কেননা ইসলামকে উৎখাত করা এবং মুসলিম রাষ্ট্র সমূহকে গ্রাস করার জন্যই উক্ত মতবাদের জন্ম হয়েছে।
সমাজতন্ত্র স্রষ্টা বিরোধী, ঈমান বিধ্বংসী এবং চরমপন্থী মতবাদ। আল্লাহদ্রোহী কার্লমার্কস ও এঙ্গেলস সমাজতন্ত্রের সূচনা করেন। তারা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমূলে হরণ করতে চেয়েছেন। কার্লমার্কস স্রষ্টাকে অস্বীকার করে বলেছেন,
ওঃ রং হড়ঃ ৎবষরমরড়হ ঃযধঃ পৎবধঃবং সধহ নঁঃ সধহ যিড় পৎবধঃবং ৎবষরমরড়হ. জবষরমরড়হ রং ঃযব মৎড়ধহ ড়ভ ঃযব ফড়হি ভৎড়ফফবহ পৎবধঃঁৎব. ওঃ রং ঃযব ড়ঢ়রঁস..... ঃযব রফবধ ড়ভ এড়ফ সঁংঃ নব ফবংঃৎড়ুবফ.
‘ধর্ম মানুষকে সৃষ্টি করেনি, বরং মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। ধর্ম নিপীড়িত মানবগোষ্ঠীর মূর্ত আর্তনাদ। এটা আফিম... সুতরাং আল্লাহ্র কল্পনা মানুষের মন থেকে উৎখাত করতে হবে’। অনুরূপ তার সহচর এঙ্গেলসও স্রষ্টাকে অস্বীকার করে বলেন, ঞযব ভরৎংঃ ড়িৎষফ ড়ভ জবষরমরড়হং রং ধ ষরব. ‘ধর্মের প্রথম শব্দটাই মিথ্যা’ (আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস)।[৩]
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন মূলত যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে তাদের বিরুদ্ধে পরিচলিত হয়। তাছাড়া এটা চরমপন্থী মতবাদও। তারা সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানবতার উপর অত্যাচার করেছে। এই মতবাদের দোহাই দিয়ে লেলিন (রাশিয়ায়) মাওসেতুং (চীনে) লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছেন।[৪] অতএব বলা যায় যে, যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী তারা কার্লমার্কসের মত আল্লাহকে বিশ্বাস করে না। তাই কোন মুসলিম ব্যক্তি উক্ত মতবাদের অনুসারী হতে পারে না।
গণতন্ত্রের সাধারণ অর্থ জনগণের শাসন। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় এটি একটি শাসনব্যবস্থা। অতীতে ও মধ্যযুগে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বিপরীতে উক্ত অর্থেই ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। আধুনিক যুগে এটি কেবল সরকার ব্যবস্থাই নয়, বরং একটি সমাজ ব্যবস্থাকে বুঝায়। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ভাষায় উবসড়পৎধপু রং ঃযব মড়াবৎহসবহঃ ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ধহফ ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব. ‘গণতন্ত্র এমন একটি সরকার ব্যবস্থা, যা মানুষের উপর মানুষের দ্বারা পরিচালিত মানুষের প্রভুত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা বুঝায়’।[৫] পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি.এফ.স্ট্রং বলেন, উবসড়পৎধপু রসঢ়ষরবং ঃযধঃ মড়াবৎহসবহঃ যিরপয ংযধষষ ৎবংঃ ড়হ ধপঃরাব পড়হংবহঃ ড়ভ ঃযব মড়াবৎহবফ. শাসিত জনগণের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত, তাকেই গণতন্ত্র বলা যায়। অধ্যাপক সিলী বলেন, ‘যে সরকার ব্যবস্থায় সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত থাকে, তাকে গণতন্ত্র বলে’।[৬]
অথচ বাংলাদেশে গনতন্ত্র তার স্বরূপে নেই। এদেশে তা ক্ষমতাসীনদের শাসন বা দলীয় শাসন। প্রতিটি দল বা ক্ষমতাসীনরা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। গতনন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে এদেশে যত নির্বাচন হয়েছে, তার অধিকাংশ আতাত করে অথবা জোরপূর্বক ক্ষমতায় বসা। যেগুলোতে সাধারণ জনগণের সক্রিয় সম্মতি ছিল না এবং সকলের অংশগ্রহণও নিশ্চিত ছিল না। গণতন্ত্রের নাম করে প্রতিটি সরকার সাধারণ জনতার সাথে ফ্যাসিষ্ট আচরণ করেছে এবং তাদের উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার চালিয়েছে।
তাছাড়া এই ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি ইসলামের দৃষ্টিতে শিরকী শব্দ। এর অর্থ মানুষের আইন। চোর, ডাকাত, হত্যাকারী, দেশের সম্পদ লুটকারী ও পাচারকারী এবং দুর্নীতিবাজ এমপিরা সংসদে গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে আইন করে মানুষের উপর বাস্তবায়ন করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া কেউ আইন বা বিধান তৈরির অধিকার রাখে না। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষ আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করবে (সূরা আশ-শূরা: ২১; সূরা ইউসুফ: ৪০)।
গণতন্ত্র শুধু মানব রচিত জীবন বিধানের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। এটা আল্লাহর সাথে শরীকানা করার তন্ত্রমন্ত্রও। এই দর্শনের শ্লোগান হল, সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ। অথচ মহান আল্লাহ হলেন সকল ক্ষমতার উৎস (সূরা আল-বাক্বারাহ: ১৬৫)। এটা একটি শিরকি দাবি। এই কথা বিশ্বাস করলে ঈমান-আমল সব বরবাদ হয়ে যাবে। এই মতবাদ ইসলাম বিরোধী মতবাদ। এটা মানুষের রচিত আইন দ্বারা দেশ শাসন করে। ফলে এর মূলনীতি ও আইন পরিবর্তনশীল। কিন্তু আল্লাহর বিধান অপরিবর্তনশীল এবং সার্বজনীন। ক্বিয়ামত পর্যন্ত পরিবর্তন হবে না; কেউ করতেও পারবে না। এটার সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড ক্ষমতাসীন মানুষ। কিন্তু ইসলামে হক্ব ও বাতিলের মানদণ্ড অভ্রান্ত সত্যের চূড়ান্ত উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ। এটাতে অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত। কিন্তু ইসলামে সংখ্যার কোন মূল্য নেই; বরং সত্যই চূড়ান্ত। তা যদি একজনের পক্ষেও হয়।
গণতন্ত্র একদিকে মানুষকে ধর্ম ও আখেরাত থেকে বিমুখ করে, অন্যদিকে ধনীদের মাধ্যমে সাধারণ জনতাকে শোষণ করে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা শাসন করবে আর সংখ্যালঘু শাসিত হবে। মূলত এটা দুর্বৃত্তের স্বৈরতন্ত্র ও লম্পটদের ধোঁকাতন্ত্র, দলবাজদের হিংসাতন্ত্র এবং দুর্নীতিবাজদের পাচারতন্ত্র। এজন্যই এটা অজ্ঞ ও সর্বাপেক্ষা অক্ষমদের শাসন। কেননা এই তন্ত্রই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আর জুতা সেলাই করা মূর্খ মুচি বা সুইপারের মর্যাদা সমান করে দিয়েছে। কারণ একটা ভোটের কারণেই যে কেউ বিজয়ী হবে, হোক তা ভিসির ভোট বা সুইপারের ভোট।
ভোগবাদী গণতন্ত্র সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য, সাধুকে চোর, চোরকে সাধু, বৈধকে অবৈধ, অবৈধকে বৈধ বানানোর ক্ষমতা সংরক্ষণ করে।[৭] এটা একটা ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক মিথ্যা শাসন ব্যবস্থা। এই মিথ্যা ও ধোঁকাবাজির শাসন ব্যবস্থা দ্বারা জনগণের কোন কল্যাণই সাধিত হতে পারে না। তাই তা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা একটি নিরেট মিথ্যা ‘কুফর’কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।[৮]
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি প্রাচীন মতবাদ। যা মূলত ধর্মহীনতাবাদ, বৈষয়িকতাবাদ। ফরাসী বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার মাধ্যমে আধুনিক যুগে পশ্চিম ইউরোপে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের আবির্ভাব হয়। এভাবে ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে বিশেষ মতবাদ হিসাবে রূপ দেন এর মূল প্রবক্তা ব্রিটেনের জর্জ জেকব হোলিয়ক। তিনি ধর্ম ও আল্লাহর বিশ্বাসকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে উক্ত মতবাদ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে পড়েন। মানুষকে ধর্মহীন করাই এই মতবাদের মূল উদ্দেশ্য।[৯] কেননা এ মতবাদের পরিচিতিতে বলা হয়েছে যে, সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্রীয় নীতি, শিক্ষা প্রভৃতি ধর্মমুক্ত থাকবে। এটা এমন এক মতবাদ, যা মনে করে আল্লাহ বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস নির্ভর সমস্ত বিবেচনা থেকে মুক্ত থেকে মানব জাতির কল্যাণ চিন্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এটি এমন একটি সামাজিক আন্দোলনের নাম, যা মানুষকে আখেরাত থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল পার্থিব বিষয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়।[১০] উক্ত মতবাদের মূল শ্লোগান হল, জবষরমরড়হ ংযড়ঁষফ হড়ঃ নব ধষষড়বিফ ঃড় পড়সব রহঃড় ঢ়ড়ষরঃরপং. ওঃ রং সবৎবষু ধ সধঃঃবৎ নবঃবিবহ সধহ ধহফ মড়ফ. অর্থাৎ ‘ধর্মকে রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশাধিকার দেয়া উচিত নয়। এটি মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যকার একটি (আধ্যাত্মিক) বিষয় মাত্র’।[১১]
এই কুফরী মতবাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল- মানুষকে ধর্মহীন করা। প্রথমে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনের বিশাল গোণ্ডী থেকে ধর্মকে উৎখাত করে কেবল ধর্মীয় জীবনে বন্দী করা। অতঃপর ধর্ম জীবন সম্পর্কে কটূক্তি করে এবং তার অনুশাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ব্যক্তি জীবন থেকেও ধর্মের মূলোৎপাটন করাই হল এই মতবাদের মৌলিক উদ্দেশ্য। এই মতবাদ মানুষের জীবনকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ধর্মীয় জীবন ও বৈষয়িক জীবন। অতঃপর বৈষয়িক জীবনকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ফলে অধিকাংশ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী মানুষ মনে করে ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি ধর্মীয় জীবন। আর রাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, চাকরি, কৃষি, ডাক্তারী ইত্যাদি বৈষয়িক জীবন। ফলে এগুলোর ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কোন জবাবদিহি করা লাগবে না। অথচ শরী‘আতে জীবনকে ভাগ করার কোন সুযোগ নেই। মানুষের সার্বিক জীবনেই ইসলাম পালন করা বাধ্যতামূলক (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২০৮ ও ২০৯)। কেউ যদি বৈষয়িক জীবনে ইসলামকে অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফের (সূরা আন-নিসা: ১৫০-১৫১)।
১৯৭২ সাল থেকে আজ অব্দি উপরিউক্ত মানবতা ও স্রষ্টা বিরোধী, ঈমান বিধ্বংসী, চরমপন্থী, ইসলাম বিরোধী এবং ধর্মহীন মতবাদগুলো দিয়ে এদেশ পরিচালিত হয়েছে। ফলে তৈরি হয়েছে কখনো বাকশাল, কখনো স্বৈরচার এবং কখনো ফ্যাসিবাদ। কেউ নিজের ক্ষমতা টিকে রাখতে অন্যের বাকস্বাধীনতা হরণ করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। কেউবা নিজে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য শাসককে হত্যা করেছে। কেউ স্বৈরতন্ত্র কায়েম রেখেছে। আবার কখনো গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরচারের পতন ঘটেছে। কেউ নিজের দলকে টিকিয়ে রাখতে নিপিড়ণ, নির্যাতন, গুম, খুন অব্যাহত রেখেছে। কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আইন করেছে, কেউবা আবার বাতিল করেছে। কেউ কেউ আইন পরিবর্তন করে নিজের মত আইন তৈরি করেছে। আবার কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সামরিক ক্যু হয়েছে। কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আতাত হয়েছে। রাজনীতিবিদরা বা বিভিন্ন দল কখনো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাদের রূপ পরিবর্তন করেছেন। কখনো কখনো কেউ কারো সঙ্গী হয়েছেন আবার সাথে না থাকার কারণে জঙ্গীও হয়েছেন। বলা যায় যে, ১৯৭২ হতে ২০২৪-এর ৫ আগষ্ট পর্যন্ত প্রতিটি শাসনকাল অন্যায়, অত্যাচার, দুর্বৃত্তায়ন, স্বৈরচার, ফ্যাসিবাদ, ধোঁকা, হিংসা-প্রতিহিংসা, সংঘাত, দমন, নিপীড়ন, প্রতারণা, চুরি-ডাকাতি, আত্মসাৎ, লুটতারাজ, অর্থপাচার, হত্যা, গুম, খুন, চাঁদাবাজি, যেনা-ব্যভিচার, সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারি, নেশা, মওজুদদারী, মোনাফাখরী, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং সিন্টিকেট প্রভৃতির শাসনকাল। যা থেকে বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, স্বাধীনতা চায়।
২০২৪-এর জুলাই-আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বহু হতাহত, নিহত ও রক্তের বিনিময়ে ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন হয়েছে এবং বাংলাদেশ নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করেছে (ফালিল্লাহিল হামদ)। দেশের আনাচে কানাচে বৈষম্য দূর, ইনসাফ কায়েম, মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের বাস্তবায়নের আন্দোলন ও আহ্বান অব্যাহত আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ন্যায় নীতি ও ইনসাফ কায়েমের কথা কথা ব্যক্ত করছেন। তবে যে মূলনীতির আলোকে তারা দেশের সংস্কার করতে চাচ্ছেন, ৫৩ বছরে ঐ একই মূলনীতি দিয়ে দেশে বৈষম্য দূর হয়নি, ইনসাফ কায়েম হয়নি এবং হবেও না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যতদিন থাকবেন, ততোদিন হয়তো দেশ ভালো থাকবে। কিন্তু বস্তাপচা গণতন্ত্রের মাধ্যমে আবার যারা ক্ষমতায় আসবে, তাদের মাধ্যমে আবারও মানবাধিকার লুণ্ঠিত হবে, ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে এবং বৈষম্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।
এগুলো দূর করতে আদর্শ রাষ্ট্রের বিকল্প নেই। যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য, হবে না মানবাধিকার ভুলণ্ঠিত এবং কেউ চাইলেও আইনের পরিবর্তন করতে সক্ষম হবে না এবং সাহস করবে না। কারণ আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হল ইসলাম। মনে রাখা যরূরী যে, ইসলামে যেমন ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতের বিধান আছে, তেমনি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ব্যবসারও বিধান রয়েছে। ইসলাম সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। মানুষের জীবনের এমন কোন দিক নেই, ইসলাম তার সমাধান দেয়নি। পাশ্চাত্য দর্শণের প্রেমিকরা রাষ্ট্রনীতির নামে মানুষের বৈষয়িক জীবনকে দ্বীন থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অথচ ইসলামে যে রাষ্ট্রনীতির পূর্ণাঙ্গ ফর্মুলা পেশ করা হয়েছে, তা তাদের জানা নেই। যা মুহাম্মাদ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদার শাসিত ইসলামী খেলাফতের চল্লিশটি বছর প্রমাণ করেছে। এই শাসন ব্যবস্থা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থা। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর আদর্শের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপায়ন হয়েছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল। পাশ্চাত্যের ঐ সমস্ত বশংবদরা ঠিকই জানেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) হলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক, সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। কিন্তু স্বীকার করেন না এবং তার আদর্শ গ্রহণও করে না। কারণ তাদের অন্তরটা ইবলীস শয়তানের স্বর্গরাজ্য। ইসলামের কথা শুনলে পাশ্চাত্য দর্শন প্রেমিদের গা জ্বালা করে, তাদের অন্তর প্রকম্পিত হয় এবং মৌলবাদ, উগ্রবাদ ও জঙ্গীবাদের সুর তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কারণ ইসলামের প্রতি তাদের ভালোবাসা নেই, আবেগ নেই, পরকালের কোন ভয় নেই, কবরের কোন চিন্তা নেই। ধর্মহীন বস্তুবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে নীতিহীন পশুতে পরিণত করেছে। দুনিয়া উপার্জনই তাদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্পদ উপার্জনের নেশা তাদেরকে রোবটে পরিণত করেছে। তাদের চোখ থেকেও তারা দেখে না, হৃদয় থাকার পরেও তাদের বোধগম্য হয় না। ইতিহাস থেকেও শিক্ষা গ্রহণ করে না। সর্বদা ক্ষমতার নেশায় নমরূদ, ফেরআউন, হামান, কারূণ, আবু জাহল, আবু লাহাবদের মত জনগণকে শোষণ করতে চায়। ফলে তাদেরও শেষ রক্ষা হয় না। লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
মূলতঃ মানুষের জীবনে অনেকগুলো কর্মক্ষেত্র থাকলেও প্রত্যেকটিই পরিচালিত হবে আল্লাহ প্রদত্ত চূড়ান্ত সংবিধান পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয দায়িত্ব হল, সার্বিক জীবনে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ প্রদত্ত সংবিধানের অনুসরণ করা। মহান আল্লাহ বলেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ادۡخُلُوۡا فِی السِّلۡمِ کَآفَّۃً ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّہٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ . فَاِنۡ زَلَلۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡکُمُ الۡبَیِّنٰتُ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰہَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ.
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের রাস্তা সমূহের অনুসরণ কর না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। তোমাদের নিকট স্পষ্ট দলীল আসার পরেও যদি পদস্খলিত হও, তাহলে জেনে রেখ, আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২০৮ ও ২০৯)।
উক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে, ইসলামের প্রত্যেকটি বিধানকেই গ্রহণ করতে হবে। কিছু গ্রহণ করব আর কিছু প্রত্যাখ্যান করব তা হবে না। কারণ ইসলাম ছাড়া আর যারই অনুসরণ করা হোক তা হবে শয়তানের অনুসরণ। সুতরাং যে ব্যক্তি ধর্মীয় জীবনে ইসলামের বিধান কিছু মানবে আর বৈষয়িক জীবনে ত্বাগূতের বিধান মানবে, তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। মহান আল্লাহ বলেন,
اَفَتُؤۡمِنُوۡنَ بِبَعۡضِ الۡکِتٰبِ وَ تَکۡفُرُوۡنَ بِبَعۡضٍ ۚ فَمَا جَزَآءُ مَنۡ یَّفۡعَلُ ذٰلِکَ مِنۡکُمۡ اِلَّا خِزۡیٌ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ یُرَدُّوۡنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الۡعَذَابِ ؕ وَ مَا اللّٰہُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ . اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا بِالۡاٰخِرَۃِ ۫ فَلَا یُخَفَّفُ عَنۡہُمُ الۡعَذَابُ وَ لَا ہُمۡ یُنۡصَرُوۡنَ.
‘তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে, আর কিছু অংশের সাথে কুফরী করবে? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করবে, তাদের জন্য দুনিয়াবী জীবনে লাঞ্ছনা রয়েছে এবং ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোর শাস্তিতে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর সে বিষয়ে আল্লাহ অমনোযোগী নন। এরাই পরকালের বিনিময়ে দুনিয়াবী জীবনকে খরিদ করে নিয়েছে। অতএব তাদের শাস্তি হালকা করা হবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ৮৫ ও ৮৬)।
অতএব মুসলিমের জীবনের কোন ক্ষেত্রকে আল্লাহর হুকুমের আওতামুক্ত করা যাবে না। সে যখন যে ক্ষেত্রে অবস্থান করবে, তখন সেই স্থানের শারঈ নীতি নিরঙ্কুশভাবে অনুসরণ করবে।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
* পি-এইচ. ডি গবেষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[১]. মুসনাদে আহমাদ, হা/১৭১৮৫, সনদ ছহীহ।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/১২১৮।
[৩]. আল্লামা আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কোরাইশী, আল-ইসলাম বনাব কমিউনিজম (ঢাকা : আল-হাদীছ প্রিন্টিং, আগস্ট ২০০০), পৃ. ১২।
[৪]. ডা. যাকির নায়েক, লেকচার সমগ্র, পৃ. ৬০৫।
[৫]. সৈয়দ মকসুদ আলী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ৩য় সংস্করণ, জুন ১৯৮৩), পৃ. ২৮৫।
[৬]. মোঃ মকসুদুর রহমান, রাষ্ট্রীয় সংগঠনের রূপরেখা (রাজশাহী : ইমপিরিয়াল বুকস, জানুয়ারী ১৯৯১), পৃ. ৭৬।
[৭]. মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালীন (ঢাকা : গ্লোবাল পাবলিশিং নেটওয়ার্ক, বাংলাবাজার, ৬৬ প্যারীদাস রোড, জুলাই ২০১২), পৃ. ৪৬৬-৪৬৭।
[৮]. মওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, গণতন্ত্র নয় পূর্ণাঙ্গ বিপ্লব (ঢাকা : ইসলামী ঐক্য আন্দোলন, তেজগাঁও ১৯৮৫), পৃ. ১০।
[৯]. মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, নভেম্বর ২০০২), পৃ. ২১।
[১০]. ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ ইৎরঃধহরপধ, ১৫ঃয ঊফহ. ২০০২.ঠড়ষ-ঢ. ঢ়. ৫৯৪.
[১১]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তিনটি মতবাদ (ঢাকা : পাহলেয়ান প্রেস, জানুয়ারী ১৯৮৭), পৃ. ১৮।