শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ পূর্বাহ্ন

কোটা নয়, মেধাই হোক প্রকৃত মূল্যায়ন

-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*


কোন সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল মেধাবী, যোগ্য, অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তিদেরকে স্ব স্ব স্থানে মূল্যায়ন করা। অন্যথা সফলতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রতিটি বিভাগ ও ক্ষেত্রে যোগ্যতা, মেধা ও গুণাবলী যথাযোগ্য মূল্যায়িত না হলে অযোগ্য, কপর্দকহীন, অর্বাচিন ও অথর্ব কিছু মানুষ ঐ স্থানগুলো দখল করে থাকে। ফলে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে সমস্যা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসম্পূর্ণতা, বিশৃঙ্খলা পরিদৃষ্ট হয়। যা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বর্বর জাহেলী যুগে সমাজ সংস্কারকের লক্ষ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মেধাবী, যোগ্য ও অভিজ্ঞদেরকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করেছিলেন। তাঁর ছাহাবীগণের মধ্যে অনেকেই নির্দিষ্ট বিষয়ে অন্যদের তুলনায় অধিক পারদর্শী  ও অভিজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাঁর ছাহাবীগণের মধ্যে থাকা আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা ও গুণাবলীর মূল্যায়ন করতেন, প্রতিভা ও শক্তিমত্তা অনুযায়ী তাদের সাথে আচরণ করতেন। যেমন কাব্যিক প্রতিভায় হাসসান বিন ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু), বিচারকার্য ও ফায়সালা প্রদানে আলী ও মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), দাঈ, দূত ও শিক্ষকতায় মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), স্মরণশক্তির দিক দিয়ে আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং সমরবিদ্যা ও যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে পারদর্শী ছিলেন খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে ছাহাবী যে কাজে অধিক পারদর্শী ও অভিজ্ঞ, তিনি তাঁকে সে কাজের দায়িত্ব দিতেন। এটা মেধাবী, যোগ্য ও প্রতিভাবান ব্যক্তিদের সাথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উত্তম আচরণের বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছুই ছিল না।*

১- দ্বীন প্রচারের জন্য মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে মদীনায় প্রেরণ

ইসলামের প্রথম দূত ও শিক্ষক হিসাবে রাসূল (ﷺ) সর্বপ্রথম মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে মদীনায় প্রেরণ করেছিলেন। কেননা তিনি শিক্ষকতা ও দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিলেন। যার বাস্তবতাও রয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশ এবং কাফির-মুশরিকদের শক্তিশালী দলবদ্ধ জোট থাকার পরেও তিনি তার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা সর্বোপরি মহান আল্লাহর অনুগ্রহে মদীনার প্রতিটি মানুষের নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে মদীনাতে রাসূল (ﷺ)-এর হিজরতের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল এবং তিনি সেখানে হিজরতও করেছিলেন। সাথে সাথে বিশ্বের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ইসলামী রাষ্ট্রের সূচনা হয়েছিল। বলা যায় যে, মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর উক্ত দাওয়াতী কাজই ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের সূতীকাগার।

উল্লেখ্য, মুছ‘আব ইবনু উমায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু) মদীনার মানুষদের নিকট ইসলামের দাওয়াত দিতেন, মুসলিমদেরকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়সমূহ, ইসলামের বিধি-বিধান ও কুরআন মাজীদ শিক্ষা দিতেন। এ কারণেই মদীনাবাসী তাকে ‘মুক্বরী’ তথা কুরআন পাঠকারী নামকরণ করেছিলেন।[১] মাদানী ছাহাবী বারা ইবনু ‘আযীব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, أَوَّلُ مَنْ قَدِمَ عَلَيْنَا مُصْعَبُ بْنُ عُمَيْرٍ وَابْنُ أُمِّ مَكْتُوْمٍ، وَكَانَا يُقْرِئَانِ النَّاسَ ‘আমাদের নিকট সর্বপ্রথম আগমন করেছিলেন মুছ‘আব ইবনু উমায়ের ও আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতূম (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)। তারা দু’জন লোকদের কুরআন শেখাতেন’।[২]

২- বিদেশী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অত্যন্ত মেধাবী ও স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ছিলেন। তার তীক্ষ্ম মেধাশক্তি ও প্রতিভার কারণেই রাসূল (ﷺ) তাকে অহী লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত করেছিলেন।[৩] পরবর্তীতে খলীফা আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে কুরআন সংকলনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং অত্যন্ত সফলতার সাথে সে দায়িত্ব তিনি পালন করেন।[৪] ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘তাঁর (যায়েদ) পিতা হিজরতের পূর্বে বু‘আসের যুদ্ধে নিহত হন। ফলে যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ইয়াতীম হিসাবে লালিত-পালিত হন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী’।[৫] ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সীমাহীন মেধাবী ছিলেন। তিনি মাত্র পনের দিনে ইহুদীদের ভাষা ও লেখা রপ্ত করেছিলেন। এ ছাড়াও তিনি কিসরার দূতের নিকট থেকে মাত্র আঠারো দিনে ফারসী ভাষা শিখেছিলেন এবং রাসূল (ﷺ)-এর বিভিন্ন খাদিমের নিকট থেকে হাবশী, রোমানিক ও কিবতী ভাষা শিক্ষা অর্জন করেছিলেন।[৬] এ প্রসঙ্গে যায়েদ ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

أَمَرَنِىْ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ أَنْ أَتَعَلَّمَ لَهُ كَلِمَاتِ كِتَابِ يَهُوْدَ. قَالَ ্রإِنِّىْ وَاللهِ مَا آمَنُ يَهُوْدَ عَلَى كِتَابٍগ্ধ. قَالَ فَمَا مَرَّ بِىْ نِصْفُ شَهْرٍ حَتَّى تَعَلَّمْتُهُ لَهُ قَالَ فَلَمَّا تَعَلَّمْتُهُ كَانَ إِذَا كَتَبَ إِلَى يَهُوْدَ كَتَبْتُ إِلَيْهِمْ وَإِذَا كَتَبُوْا إِلَيْهِ قَرَأْتُ لَهُ كِتَابَهُمْ.

‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাকে ইয়াহূদীদের কিতাবী ভাষা (হিব্রু) অধ্যয়নের জন্য আদেশ করেন এবং বলেন, আল্লাহর কসম! আমি আমার পত্রাদির ব্যাপারে ইয়াহূহীদের উপর নিশ্চিন্ত হতে পারি না। তিনি (বর্ণনাকারী) বলেন, তারপর মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই আমি সুফিয়ানী ভাষা আয়ত্ত করে ফেললাম। এ ভাষা শিক্ষার পর থেকে তিনি ইয়াহূদীদের নিকট কোন কিছু লিখতে চাইলে আমিই তা লিখে দিতাম। আর তারা তাঁর নিকট কোন চিঠি পাঠালে, আমি তাঁকে তা পড়ে শুনাতাম’।[৭]

৩- কাব্যিক প্রতিভায় হাস্সান ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন অনন্য

হাস্সান ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তৎকালীন কাব্য সাহিত্যে অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। ইহুদী-খ্রিস্টান ও কাফির-মুশরিকদের কবিতার প্রতিবাদে হাস্সান ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রাসূল (ﷺ)-এর পক্ষে তথা ইসলামের পক্ষে কবিতা বর্ণনা করতেন। বারা ইবনু আযীব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) হাস্সান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, اهْجُهُمْ أَوْ هَاجِهِمْ وَجِبْرِيْلُ مَعَكَ ‘তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ কর, জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তোমার সাথে রয়েছেন’।[৮] আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ‘কুরায়শদের বিপক্ষে তোমরা বিদ্রƒপ কবিতা তৈরি কর। কারণ তা তাদের বিপক্ষে তীর ছোড়ার চেয়ে সর্বাধিক শক্তিশালী। তারপর তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু রাওয়াহাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট জনৈক লোককে পাঠালেন। তিনি তাকে বললেন, ওদের বিপক্ষে বিদ্রƒপ করে কবিতা তৈরি কর। অতঃপর তিনি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করলেন। কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তখন তিনি কা‘ব ইবনু মালিককে ডেকে পাঠালেন। তারপর তিনি হাস্সান ইবনু ছাবিতের নিকট এক ব্যক্তি প্রেরণ করলেন। সে যখন তার নিকট গেল তখন হাস্সান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন,

قَدْ آنَ لَكُمْ أَنْ تُرْسِلُوْا إِلَى هَذَا الْأَسَدِ الضَّارِبِ بِذَنَبِهِ ثُمَّ أَدْلَعَ لِسَانَهُ فَجَعَلَ يُحَرِّكُهُ فَقَالَ وَالَّذِىْ بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لأَفْرِيَنَّهُمْ بِلِسَانِىْ فَرْىَ الْأَدِيْمِ.

‘তোমাদের জন্য সঠিক সময় হয়েছে যে, তোমরা সে সিংহকে ডেকে পাঠিয়েছ, যে তার লেজ দিয়ে আঘাত করে দেয়। তারপর তিনি তার জিহ্বা বের করে নাড়াতে লাগলেন এবং বললেন, সে মহান সত্তার শপথ, তিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমি আমার জিহ্বার মাধ্যমে তাদেরকে এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিব, যেমনভাবে হিংস্র বাঘ তার থাবা দিয়ে চামড়া টেনে ছিঁড়ে ফেলে’।

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হে হাস্সান! তুমি তাড়াতাড়ি করো না। কারণ আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কুরায়শদের বংশ তালিকা সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞ। কেননা তাদের সাথে আমারও আত্মীয়তার বন্ধন বিদ্যমান। অতএব তিনি এসে আমার বংশ তোমাকে আলাদা করে বলে দিবেন। তারপর হাস্সান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর (আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু))-এর নিকট গেলেন এবং (বংশ তালিকা সম্বন্ধে জ্ঞাত হয়ে) ফিরে এলেন। সে মহান সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন আমি আপনাকে তাদের মাঝখান হতে এমন সুকৌশলে বের করে আনব, যেমনভাবে আটার খামির থেকে সূক্ষ্ম চুল বের করা হয়। ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হাস্সান-এর ব্যাপারে বলতে শুনেছি যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর তরফ হতে কাফিরদের দাঁতভাঙ্গা উত্তর দিতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ‘রূহুল কুদুস’ অর্থাৎ জিবরীল (আলাইহিস সালাম) সারাক্ষণ তোমাকে সহযোগিতা করতে থাকবেন। আর তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, হাস্সান তাদের (কাফিরদের বিরুদ্ধে) ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করে মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি এনে দিলেন এবং কাফিরদের মান-সম্মানকে ভূলুণ্ঠিত করে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন’। অতঃপর হাস্সান ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) কঠিন কবিতার মাধ্যমে রাসূল (ﷺ)-এর পক্ষে দৃঢ়ভাবে জবাব দিয়েছিলেন।[৯]

৪- বিচারপতি হিসাবে অভিজ্ঞ ছিলেন মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

রাসূলূল্লাহ (ﷺ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইয়ামানের বিচারপতি নিয়োগ করেছিলেন। তিনি হালাল-হারাম চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আসওয়াদ ইবনু ইয়াযীদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,

أَتَانَا مُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ بِالْيَمَنِ مُعَلِّمًا وَأَمِيْرًا، فَسَأَلْنَاهُ عَنْ رَجُلٍ تُوُفِّىَ وَتَرَكَ ابْنَتَهُ وَأُخْتَهُ، فَأَعْطَى الْاِبْنَةَ النِّصْفَ وَالأُخْتَ النِّصْفَ.

‘মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের নিকট শিক্ষক অথবা আমীর হিসাবে ইয়ামানে আসলে আমরা তাঁর কাছে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম, যে এক কন্যা ও এক বোন রেখে মারা গেছে (তার মীরাছের বণ্টন কিভাবে হবে?)। তখন তিনি (মৃতের সম্পদের) অর্ধেক মেয়েকে ও বাকী অর্ধেক বোনকে দিলেন’।[১০]

৫- গোয়েন্দাগীরী বা গুপ্তচরে অভিজ্ঞ ছিলেন হুজায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

গোয়েন্দাগীরী বা গুপ্তচরের কাজ অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাপারে হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ভেতর প্রবেশ করে তাদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য রাসূল (ﷺ) তাকে প্রেরণ করেছিলেন। যেমন,

ইবরাহীম তাইমী (রাহিমাহুল্লাহ) তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘একবার আমরা হুজাইফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে ছিলাম, এমন সময় এক ব্যক্তি বলে উঠলেন, হে আবূ আব্দুল্লাহ! আপনি কি রাসূল (ﷺ)-কে দেখেছেন এবং তাঁর সাহচর্য গ্রহণে ধন্য হয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার ভাতিজা। লোকটি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমরা যদি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পেতাম, তবে তাঁর সঙ্গে পথ চলার সময় তাঁকে আমাদের কাঁধে তুলে নিতাম। তাঁর সঙ্গে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং এতে কোনরূপ পিছপা হতাম না’। হুজায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘তুমি তা-ই করতে? কিন্তু আমি তো খন্দক যুদ্ধের রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলাম। (সে রাতে) প্রচণ্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। এমনই সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ঘোষণা করলেন,

أَلَا رَجُلٌ يَأْتِيْنِيْ بِخَبَرِ الْقَوْمِ جَعَلَهُ اللهُ مَعِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟

‘ওহে! এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে শত্রুশিবিরের খবর এনে দেবে; তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন?’ আমরা তখন চুপ ছিলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। অতঃপর রাসূল (ﷺ) রাতের একটি অংশ পর্যন্ত ছালাত পড়লেন। তারপর আমাদের নিকট এসে আবার বললেন,

أَلَا رَجُلٌ يَأْتِيْنِيْ بِخَبَرِ الْقَوْمِ جَعَلَهُ اللهُ مَعِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟

‘ওহে! এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে শত্রুশিবিরের খবর এনে দেবে; তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন?’ এবারও আমরা চুপ থাকলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি। তিনি আবার ঘোষণা করলেন,

أَلَا رَجُلٌ يَأْتِيْنِيْ بِخَبَرِ الْقَوْمِ جَعَلَهُ اللهُ مَعِيْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ؟

‘ওহে! এমন কেউ আছে কি, যে আমাকে শত্রুশিবিরের খবর এনে দেবে; তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্বিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে রাখবেন?’ এবারও আমরা চুপ ছিলাম এবং আমাদের কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি। আসলে আমরা সবাই চরম ঝুঁকি, অসহ্য ক্ষুধাযন্ত্রণা ও প্রচণ্ড শীতের কারণে সাড়া দিচ্ছিলাম না ।

এবার তিনি বললেন, ‘হে হুজাইফা! ওঠো এবং আমাদের নিকট শত্রুপক্ষের খবর নিয়ে এস’। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন এবার আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তাই ওঠা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। তিনি আরও বললেন,

يَا حُذَيْفَةُ فَاذْهَبْ فَادْخُلْ فِي الْقَوْمِ فَانْظُرْ مَا يَفْعَلُوْنَ وَلَا تُحْدِثَنَّ شَيْئًا حَتَّى تَأْتِيَنَا

‘হে হুজায়ফা! তুমি গিয়ে শত্রুশিবিরের মাঝে ঢুকে পড়বে, তারপর তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করবে। কিন্তু খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাদের কাছে আসা পর্যন্ত নতুন কোন সমস্যা সৃষ্টি কর না’।

তারপর আমি যখন তাঁর নিকট থেকে প্রস্থান করলাম, তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে চলছি। এভাবে আমি তাদের (শত্রুপক্ষের) নিকট পৌঁছে গেলাম। তারপর আমি তাদের মাঝে প্রবেশ করলাম। সেখানে দেখতে পেলাম, ঘূর্ণিঝড় আর আল্লাহর সৈন্যরা যথেষ্ট কাজ করেছে। কাফিরদের ডেক-পাতিলগুলো এলোমেলো পড়ে আছে (সেগুলোতে কোন খাবার নেই) আর না তাদের চুলায় আগুন আছে। তাদের তাঁবুগুলোও ঠিক নেই। তখন আবূ সুফইয়ান বিন হারব দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হে কুরাইশ সম্প্রদায়! তোমাদের প্রত্যেকে নিজের পাশের জনকে শনাক্ত করে নাও (যেন কোন গুপ্তচর থাকলে ধরা পড়ে যায়)। তখন আমি আমার পাশে থাকা লোকটির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কে?’ সে বলল, ‘আমি অমুকের ছেলে অমুক’।

অতঃপর আবূ সুফইয়ান বললেন, ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম, তোমাদের অবস্থান করার মত জায়গায় নেই। আমাদের রসদপাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। ওদিকে বনু কুরাইজা আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। এখন পর্যন্ত তাদের থেকে অসন্তোষজনক খবরই শুনতে পাচ্ছি আমরা। আর তোমরা তো দেখতেই পাচ্ছ, আমরা এখন ঘূর্ণিঝড়ের কবলে। আল্লাহর কসম! না আমরা রান্না চড়াতে পারছি, না আগুন ধরাতে পারছি। তার ওপর তাঁবুও স্থাপন করা যাচ্ছে না। তাই তোমরা ফিরে চল। কারণ আমি ফিরে যাব’। অতঃপর তিনি তার উটের কাছে দাঁড়ালেন। উটটি বাঁধা ছিল। উটের ওপর বসে তিনি সেটার ওপর আঘাত করলেন। উটটি তিন-চারবার লাফিয়ে উঠল অতঃপর রশি খুলে দিলে সেটি দাঁড়িয়ে গেল।

তখন আমি একটি তীর তুলে ধনুকে সংযোজন করলাম। যেই আবূ সুফইয়ানের প্রতি তীর ছুড়তে যাব, তখনিই মনে পড়ে গেল, রাসূল (ﷺ)-এর সাবধান বাণী: ‘ওখানে নতুন কোন সমস্যা সৃষ্টি কর না’। আমি নিশ্চিত, যদি আমি তখন তীর নিক্ষেপ করতাম, তবে তীর নির্ঘাত লক্ষ্যভেদ করত’।

অতঃপর আমি রাসূল (ﷺ)-এর নিকট ফিরে আসলাম। আসার সময় মনে হচ্ছিল, যেন আমি উষ্ণ আবহাওয়ার মধ্যেই পথ চলছি। তারপর যখন ফিরে এসে শত্রুদের খবর তাঁকে দিলাম এবং আমার দায়িত্ব থেকে অবসর হলাম, তখন আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করতে শুরু করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অতিরিক্ত একটি কম্বল দ্বারা আমাকে আবৃত করে দিলেন, যা তিনি ছালাত আদায়ের সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় আচ্ছন্ন রইলাম। যখন ভোর হল, তখন তিনি বললেন, ‘হে ঘুমকাতুরে! এখন উঠে পড়’।[১১]

সুধী পাঠক! রাসূল (ﷺ) এমন প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে এমন একটি কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য হুজায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কেই বেছে নিয়েছেন। কেননা তিনি তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি-সামর্থ্য, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতা ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিলেন। তাঁর মাঝে একজন আত্মত্যাগী ও দুঃসাহসী সৈনিকের সবটুকু গুণ বিদ্যমান ছিল। ঝুঁকি ও শঙ্কার ভিতর থেকে কীভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়ে, তা তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন। এজন্যই তো গভীর অন্ধকার, প্রচণ্ড ঝড়-ঝাঞ্ঝা ও ঠাণ্ডার তীব্রতা উপেক্ষা করে বিশাল সৈন্যবাহিনীর শিবিরে অকুতোভয় সৈনিকের মতে ঢুকে পড়তে তাঁর সামান্য পরিমাণ বুকও কাঁপেনি। মূলত এই ঘটনায় তাঁর সাহসিকতা ও বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি তার ঈমানের দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

৬- মেধাবী আলেম ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যোগ্যতা ও মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করতেন। ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) প্রাথমিক সময়ে ইসলাম গ্রহণকারী ছাহাবীগণের অন্তর্ভুক্ত এবং উচ্চস্তরের জ্ঞানী ও পণ্ডিত ছিলেন’। একটু পরে লেখক আরো বলেন, ‘তিনি অল্পসংখ্যক তুখোড় মেধাবী আলিমদের মধ্যে একজন ছিলেন’।[১২] শাক্বীক্ব ইবনু সালামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

خَطَبَنَا عَبْدُ اللهِ فَقَالَ وَاللهِ لَقَدْ أَخَذْتُ مِنْ فِىْ رَسُوْلِ اللهِ ﷺ بِضْعًا وَسَبْعِيْنَ سُوْرَةً، وَاللهِ لَقَدْ عَلِمَ أَصْحَابُ النَّبِىِّ ﷺ أَنِّىْ مِنْ أَعْلَمِهِمْ بِكِتَابِ اللهِ وَمَا أَنَا بِخَيْرِهِمْ. قَالَ شَقِيْقٌ فَجَلَسْتُ فِى الْحِلَقِ أَسْمَعُ مَا يَقُوْلُوْنَ فَمَا سَمِعْتُ رَادًّا يَقُوْلُ غَيْرَ ذَلِكَ.

‘একদা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) আমাদের সামনে ভাষণ দিলেন এবং বললেন, আল্লাহর শপথ! সত্তরেরও কিছু অধিক সূরা আমি রাসূল (ﷺ)-এর মুখ থেকে হাসিল করেছি। আল্লাহর কসম! নবী করীম (ﷺ)-এর ছাহাবীরা জানেন, আমি তাঁদের চেয়ে আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে অধিক জ্ঞাত; অথচ আমি তাঁদের মধ্যে সর্বোত্তম নই। শাক্বীক্ব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ছাহাবীগণ তাঁর কথা শুনে কী বলেন তা শোনার জন্য আমি মজলিসে বসে থাকলাম, কিন্তু আমি কাউকে অন্যরকম কথা বলে আপত্তি করতে শুনিনি’।[১৩]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর নিকট থেকে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَالَ لِى النَّبِىُّ ﷺ ্রاقْرَأْ عَلَىَّগ্ধ. قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ آقْرَأُ عَلَيْكَ وَعَلَيْكَ أُنْزِلَ قَالَ ্রنَعَمْগ্ধ . فَقَرَأْتُ سُوْرَةَ النِّسَاءِ حَتَّى أَتَيْتُ إِلَى هَذِهِ الآيَةِ (فَکَیۡفَ اِذَا جِئۡنَا مِنۡ کُلِّ اُمَّۃٍۭ بِشَہِیۡدٍ وَّ جِئۡنَا بِکَ عَلٰی ہٰۤؤُلَآءِ شَہِیۡدًا) قَالَ ্রحَسْبُكَ الآنَগ্ধ . فَالْتَفَتُّ إِلَيْهِ فَإِذَا عَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ .

‘একদিন নবী করীম (ﷺ) আমাকে বললেন, তুমি কুরআন পাঠ কর। আমি আরয করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি আপনার কাছে কুরআন পাঠ করব? অথচ তা তো আপনার উপরই অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, হ্যাঁ। এরপর আমি ‘সূরাহ নিসা’ পাঠ করলাম। যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত আসলাম ‘চিন্তা করো আমি যখন প্রত্যেক উম্মতের মধ্য থেকে একজন করে সাক্ষী উপস্থিত করব এবং সকলের ওপরে তোমাকে সাক্ষী হিসাবে হাযির করব তখন তারা কী করবে।’ নবী করীম (ﷺ) বললেন, আপাততঃ যথেষ্ট হয়েছে। আমি তাঁর চেহারার দিকে তাকালাম, দেখলাম, তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে’।[১৪]

রাসূল (ﷺ) তাঁর থেকে কুরআন নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে,

্রاسْتَقْرِئُوا الْقُرْآنَ مِنْ أَرْبَعَةٍ مِنَ ابْنِ مَسْعُوْدٍ وَسَالِمٍ مَوْلَى أَبِىْ حُذَيْفَةَ، وَأُبَىٍّ، وَمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍগ্ধ.

‘কুরআন পাঠ শিখ চারজনের নিকট হতে। যথা: আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আবূ হুযাইফার আযাদকৃত গোলাম সালিম, উবাই ইবনু কা‘ব ও মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) থেকে’।[১৫]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, আবূ বকর ও উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তাকে সুসংবাদ দেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَقْرَأَ الْقُرْآنَ غَضًّا كَمَا أُنْزِلَ فَلْيَقْرَأْهُ عَلَى قِرَاءَةِ ابْنِ أُمِّ عَبْدٍ ‘যে ব্যক্তি কুরআন মাজীদ উত্তমরূপে তিলাওয়াত করতে চায়, যেভাবে তা নাযিল হয়েছে, সে যেন ইবনু উম্মে আবদ তথা আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর পাঠ মোতাবেক তিলাওয়াত করে’।[১৬]

৭. অলৌকিক স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، إِنِّىْ أَسْمَعُ مِنْكَ حَدِيْثًا كَثِيْرًا أَنْسَاهُ. قَالَ ্রابْسُطْ رِدَاءَكَগ্ধ فَبَسَطْتُهُ. قَالَ فَغَرَفَ بِيَدَيْهِ ثُمَّ قَالَ ্রضُمُّهُগ্ধ فَضَمَمْتُهُ فَمَا نَسِيْتُ شَيْئًا بَعْدَهُ.

‘আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমি আপনার নিকট হতে অনেক হাদীছ শুনি কিন্তু ভুলে যাই’। তিনি বললেন, ‘তোমার চাদর মেলে ধর। আমি তা মেলে ধরলাম। তিনি দু’হাত খাবল করে তাতে কিছু ঢেলে দেয়ার মত করে বললেন, এটা তোমার বুকের সাথে লাগাও। আমি তা বুকের সাথে লাগালাম। অতঃপর আমি আর কিছুই ভুলে যাইনি’।[১৭]

হাদীছ জানার প্রতি আগ্রত ছিল তাঁর অতীব প্রবল। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ ﷺ ্রلَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَنْ لَا يَسْأَلَنِىْ عَنْ هَذَا الْحَدِيْثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ، لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الْحَدِيْثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِগ্ধ.

‘একদা আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! ক্বিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ লাভের ব্যাপারে কে সবচেয়ে অধিক সৌভাগ্যবান হবে? আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, আবূ হুরায়রা (ﷺ)! আমি মনে করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার পূর্বে আমাকে আর কেউ জিজ্ঞেস করবে না। কেননা আমি দেখেছি হাদীছের প্রতি তোমার বিশেষ লোভ রয়েছে। ক্বিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি যে একনিষ্ঠচিত্তে لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ ‘আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই’ বলে’।[১৮]

৮. কুরআনের ক্বিরায়াতে অভিজ্ঞ ছিলেন উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)

ছাহাবীদের মধ্যে উবাই ইবুন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) শ্রেষ্ঠ ক্বারী ছিলেন। ছালাতের কুরআন তেলাওয়াতে রাসূল (ﷺ)-এর কোন ভুল হলে তাকে লুকমা দেয়ার জন্য বলতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তার পিতা উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে,

أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ صَلَّى صَلَاةً فَالْتُبِسَ عَلَيْهِ، فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ لِأَبِيْ: ্রأَشَهِدْتَ مَعَنَا؟গ্ধ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: ্রفَمَا مَنَعَكَ أَنْ تَفْتَحَهَا عَلَيَّ؟গ্ধ.

‘একদা ছালাতে ক্বিরায়াত পড়ার সময় রাসূল (ﷺ) সাদৃশ্যপূর্ণ আয়াতে আটকে গেলেন। যখন ছালাত শেষ হল তখন উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, তুমি কি আমাদের সাথে ছালাত আদায় করেছ? তিনি বললেন, জি হ্যাঁ। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, তাহলে লুকমা দাওনি কেন?’।[১৯]

রামাযান মাসে উমার ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) উবাই ইবনু কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তারাবীহর জামা‘আতের ইমাম নিয়োগ করেছিলেন।[২০]

৯- খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন প্রখ্যাত সমরবিশারদ

তিনি ছিলেন আল্লাহর তরবারি, ইসলামের ঘোড়সওয়ার, ময়দানের সিংহ, সরদার, নেতা, মহান সেনাপতি, মুজাহিদদের কমান্ডার। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে ‘সাইফুল্লাহ’ তথা আল্লাহ তরবারি খেতাব প্রদান করেছিলেন। রাসূল (ﷺ)-এর জীবদ্দশায় তিনি মক্কা বিজয় ও হুনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুরতাদদের বিরুদ্ধে এবং ভণ্ডনবী মুসাইলামা কাযযাবের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ইরাকের জিহাদে শরীক হয়েছেন। শামের সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে ইসলামী সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। অতঃপর তাঁর ও আবূ উবাইদা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর নেতৃত্বে দামেস্কে অবরোধ করে তা বিজয় করা হয়। তিনি ৬০ বছর জীবিত ছিলেন। এ সময় তিনি অনেক অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ বীর-বাহাদুরকে হত্যা করেছেন। কিন্তু ঘরের বিছানায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যার কারণে তিনি অঝোর ধারায় কাঁদতেন। হিমস শহরে ২১ হিজরী সনে তিনি ইন্তিকাল করেন।[২১]

১০- আবূ জাহলের হত্যাকারী মু‘আয ইবনু আমর ও মু‘আয ইবনু আফরা

আব্দুর রহমান ইবনু ‘আউফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন,

بَيْنَا أَنَا وَاقِفٌ فِى الصَّفِّ يَوْمَ بَدْرٍ فَنَظَرْتُ عَنْ يَمِيْنِىْ وَشِمَالِىْ فَإِذَا أَنَا بِغُلَامَيْنِ مِنَ الْأَنْصَارِ حَدِيْثَةٍ أَسْنَانُهُمَا، تَمَنَّيْتُ أَنْ أَكُوْنَ بَيْنَ أَضْلَعَ مِنْهُمَا، فَغَمَزَنِىْ أَحَدُهُمَا فَقَالَ يَا عَمِّ، هَلْ تَعْرِفُ أَبَا جَهْلٍ قُلْتُ نَعَمْ، مَا حَاجَتُكَ إِلَيْهِ يَا ابْنَ أَخِىْ قَالَ أُخْبِرْتُ أَنَّهُ يَسُبُّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ، وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَئِنْ رَأَيْتُهُ لَا يُفَارِقُ سَوَادِى سَوَادَهُ حَتَّى يَمُوْتَ الأَعْجَلُ مِنَّا. فَتَعَجَّبْتُ لِذَلِكَ، فَغَمَزَنِى الآخَرُ فَقَالَ لِىْ مِثْلَهَا، فَلَمْ أَنْشَبْ أَنْ نَظَرْتُ إِلَى أَبِىْ جَهْلٍ يَجُوْلُ فِى النَّاسِ، قُلْتُ أَلَا إِنَّ هَذَا صَاحِبُكُمَا الَّذِىْ سَأَلْتُمَانِىْ. فَابْتَدَرَاهُ بِسَيْفَيْهِمَا فَضَرَبَاهُ حَتَّى قَتَلَاهُ ، ثُمَّ انْصَرَفَا إِلَى رَسُوْلِ اللهُ ﷺ فَأَخْبَرَاهُ فَقَالَ ্রأَيُّكُمَا قَتَلَهُগ্ধ. قَالَ كُلُّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا أَنَا قَتَلْتُهُ. فَقَالَ ্রهَلْ مَسَحْتُمَا سَيْفَيْكُمَاগ্ধ. قَالَا لَا. فَنَظَرَ فِى السَّيْفَيْنِ فَقَالَ ্রكِلاَكُمَا قَتَلَهُগ্ধ. سَلَبُهُ لِمُعَاذِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْجَمُوْحِ. وَكَانَا مُعَاذَ ابْنَ عَفْرَاءَ وَمُعَاذَ بْنَ عَمْرِو بْنِ الْجَمُوْحِ .

‘যখন আমি বদর যুদ্ধে সারিতে দাঁড়িয়ে আছি, আমি আমার ডানে বামে তাকিয়ে দেখলাম, অল্প বয়ষ্ক দু’জন আনছার যুবকের মাঝখানে আছি। আমার আকাক্সক্ষা ছিল, তাদের চেয়ে শক্তিশালীদের মধ্যে থাকি। তখন তাদের একজন আমাকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা! আপনি কি আবূ জাহলকে চিনেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তবে ভাতিজা, তাতে তোমার দরকার কী? সে বলল, আমাকে জানানো হয়েছে যে, সে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-কে গালাগালি করে। সে মহান সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার প্রাণ। আমি যদি তাকে দেখতে পাই, তবে আমার দেহ তার দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হবে না যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে যার মৃত্যু আগে নির্ধারিত, সে মারা যায়। আমি তার কথায় আশ্চর্য হলাম। তা শুনে দ্বিতীয়জন আমাকে খোঁচা দিয়ে ঐ রকমই বলল। তৎক্ষণাৎ আমি আবূ জাহলকে দেখলাম, সে লোকজনের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন আমি বললাম, এই যে তোমাদের সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে তোমরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে। তারা তৎক্ষণাৎ নিজের তরবারী নিয়ে তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে আঘাত করে হত্যা করল। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর দিকে ফিরে এসে তাঁকে জানালো। তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমাদের মধ্যে কে তাকে হত্যা করেছে? তারা উভয়ে দাবী করল, আমি তাকে হত্যা করেছি। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বললেন, তোমাদের তরবারী তোমরা মুছে ফেলনি তো? তারা উভয়ে বলল, না। তখন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) তাদের উভয়ের তরবারী দেখলেন এবং বললেন, তোমরা উভয়ে তাকে হত্যা করেছো। অবশ্য তার নিকট হতে প্রাপ্ত মালামাল মু‘আয ইবনু ‘আমর ইবনু জামূহের জন্য। তারা দু’জন হল, মু‘আয ইবনু আফরা ও মু‘আয ইবনু ‘আম‌র ইবনু জামূহ’।[২২]

ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, (এই হাদীছে অনেক লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল), কোন কাজে কাউকে তুচ্ছ জ্ঞান করা যাবে না। কারণ অনেক সময় ছোটরা এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে পারে, যা বড়রা পারে না। যেমনটি উল্লেখিত দুই বালক ছাহাবী করেছেন।[২৩]

সুধী পাঠক! উপরিউক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছে যে, কোটা নয়, মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও পারদর্শীতাদের মূল্যায়ন করা আবশ্যক। এর মাধ্যমেই শান্তিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। কোনরূপ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অন্যায়-অপকর্ম স্থান পাবে না। ইসলামের এ নির্দেশনার উপরেই রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। আল্লাহ তা‘আলা দেশের ঊর্ধ্বতন সহ সকল স্তরের দায়িত্বশীল ও কর্ণধারদের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে উপলব্ধি পূর্বক কোটা নয়, বরং মেধাবীদের প্রকৃত মূল্যায়ন করার তাওফীক দান করুন-আমীন!


* শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আল-ইসলামিয়্যাহ, খড়খড়ি, রাজশাহী।

[১]. ছিরাতে ইবনু হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৩৪।

[২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৯২৫।

[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৯৯০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৯৮।

[৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৬৭৯।

[৫]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪২৭।

[৬]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৮ম খণ্ড, পৃ. ৩৩।

[৭]. তিরমিযী, হা/২৭১৫; মিশকাত, হা/৪৬৫৯, সনদ ছহীহ।

[৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২১৩; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৮৬।

[৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৯০।

[১০]. ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৩৪।

[১১]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৮৮; ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৭১২৫; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/১৮২২৩।

[১২]. সিয়ারু আলামিল নুবালা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৬১-৪৬২।

[১৩]. ছহীহ মুসলিম, হা/৫০০০; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬২।

[১৪]. ছহীহ বুখারী, হা/৫০৫০; ছহীহ মুসলিম, হা/৮০০; মিশকাত, হা/২১৯৫।

[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮০৬; ছহীহ মুসলিম, হা/২৪৬৪।

[১৬]. ইবনু মাজাহ, হা/১৩৮; আল-মুসতাদরাক আলাছ ছহীহাইন, হা/২৮৯৪; সনদ হাসান, সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৩০১।

[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১১৯; তিরমিযী, হা/৩৮৩৫।

[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৯৯, ৬৫৭০; মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৮৪৫।

[১৯]. ছহীহ ইবনু হিব্বান, হা/২২৪২, সনদ ছহীহ।

[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/২০১০।

[২১]. সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬৭।

[২২]. ছহীহ বুখারী, হা/৩১৪১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৫২।

[২৩]. ইমাম নববী, শারহু ছহীহ মুসলিম, ১২শ খণ্ড, পৃ. ৬৩।




প্রসঙ্গসমূহ »: বিধি-বিধান

ফেসবুক পেজ