শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৫০ পূর্বাহ্ন

রাজনৈতিক সংস্কার 

- ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান* 



রাজনৈতিক সংস্কার (Political reforms)

রাজনীতির পরিমণ্ডলেও ইসলামের রয়েছে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট সকলকে সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক। ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দায়িত্ব পালনের কার্যাবলী তিন ভাগে বিভক্ত। যথা : আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ।[১] ইসলামে আইনদাতা হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা।[২] আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَفَحُکۡمَ الۡجَاہِلِیَّۃِ یَبۡغُوۡنَ ؕ وَ مَنۡ اَحۡسَنُ مِنَ اللّٰہِ حُکۡمًا لِّقَوۡمٍ یُّوۡقِنُوۡنَ ‘তারা কি জাহিলিয়াতের আইন চায়? বিশ্বাসীগণের জন্য আল্লাহর চেয়ে উত্তম হুকুমদাতা আর কে হতে পারে?’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৫০)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, إِنَّ اللهَ هُوَ الْحَكَمُ وَإِلَيْهِ الْحُكْمُ ‘আল্লাহই হলেন আইনদাতা, আর তাঁর নিকট থেকেই আইন নিতে হবে’।[৩] আর সে আইন কেবল আল-কুরআন ও সুন্নাহর মধ্যেই মওজুদ রয়েছে। তাই আইনসভার দায়িত্ব হলো আল-কুরআন ও সুন্নাহ কর্তৃক অনুমোদিত আইনই কেবল পাশ করা এবং মানব রচিত কোন আইন পাশ না করা।

আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত আইন মানুষের নিত্যনৈমত্তিক ও ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়ন করা নির্বাহী বিভাগের কাজ। এক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বশীলবৃন্দ যেমন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সচিব, টিএনও, ডিসি, এসপি ইত্যাদি সকলকে যেমন জনগণের সেবক হতে হবে, তেমনি আল্লাহর আইন জারি ও যথাযথভাবে কার্যকরকরণে কোনরূপ অনীহা, উপেক্ষা, দুর্বলতা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করা যাবে না। এজন্য প্রশাসন বিভাগকে অত্যন্ত শক্তিশালী, সাহসী ও দৃঢ় হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدۡ  اَرۡسَلۡنَا  رُسُلَنَا بِالۡبَیِّنٰتِ وَ اَنۡزَلۡنَا مَعَہُمُ  الۡکِتٰبَ وَ الۡمِیۡزَانَ لِیَقُوۡمَ النَّاسُ بِالۡقِسۡطِ ۚ  وَ اَنۡزَلۡنَا الۡحَدِیۡدَ فِیۡہِ بَاۡسٌ شَدِیۡدٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَ لِیَعۡلَمَ اللّٰہُ  مَنۡ یَّنۡصُرُہٗ وَ رُسُلَہٗ  بِالۡغَیۡبِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ  قَوِیٌّ عَزِیۡزٌ

‘নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়-নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লৌহও দিয়েছি, যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি ও মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ; এটা এ জন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করে দিবেন কে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলদেরকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (সূরা আল-হাদীদ : ২৫)

উক্ত আয়াতে ‘আল-হাদীদ’ বা লৌহ বলে প্রশাসনিক শক্তিকে বুঝানো হয়েছে। এমনকি কোনপ্রকার নমনীয়তা, দুর্বলতা কিংবা দয়া-সহানুভূতি প্রদর্শন করাও যাবে না। আল্লাহর আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ (ﷺ) ছিলেন কর্মদক্ষতার মূর্ত প্রতীক। এক্ষেত্রে তিনি যেমন কোনরূপ দুর্বলতা দেখাননি, তেমনি কোনরূপ সুপারিশ গ্রহণ করাকেও বরদাশত করেননি।[৪]

রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা এবং সর্বত্র আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি আনিল মুনকারের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগই পালন করবে। অনুরূপভাবে এ বিভাগের সর্বোচ্চ ব্যক্তি দেশের আইনশৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন এবং আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন। মানুষের উপর প্রভুত্ব কায়েম করবেন না। মানুষের উপর কোন রকম যুলুম বা অত্যাচার করবেন না। নিজের মনগড়া বিধান জনগণের উপর চাপিয়ে দিবেন না। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কাউকে ব্যবহারও করবেন না। বরং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাকে সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, لَاطَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘সৃষ্টিকর্তার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেই’।[৫] এক্ষেত্রে আল্লাহভীতি জরুরী ভূমিকা পালন করবে। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন,

إِنَّمَا الْإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ وَيُتَّقَى بِهِ فَإِنْ أَمَرَ بِتَقْوَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَعَدَلَ كَانَ لَهُ بِذَلِكَ أَجْرٌ وَإِنْ يَأْمُرْ بِغَيْرِهِ كَانَ عَلَيْهِ مِنْهُ

‘ইমাম বা শাসক ঢালস্বরূপ। তার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা হয় এবং শত্রুর ক্ষতি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। সে যদি তাকওয়া ও ন্যায়-বিচারের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করে, তবে তার জন্য সে পুরস্কৃত হবে। আর যদি ন্যায় ব্যতীত অন্য কিছু আদেশ করে তবে সে পাপের জন্য দায়ী হবে’।[৬] এজন্যই তো তাদের মর্যাদাও অনেক বেশি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় একদিন পাহারা দেয়া, সমস্ত দুনিয়া ও তার উপরের যাবতীয় সম্পদ হতে উত্তম’।[৭] এজন্য প্রশাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে ধার্মিক, জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও নেতৃত্বদানে দক্ষ ব্যক্তিকে নির্বাচন করা উচিত।

স্বাধীন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। এজন্য আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশিদুনের যুগে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন ছিল। মূলত সে যুগগুলোতে প্রয়োগকৃত বিচারব্যবস্থাই হলো ইসলামী বিচার ব্যবস্থা। ইসলামী বিচার বিভাগের বৈশিষ্ট্য দু’টি। যথা : (১) রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আল-কুরআন ও সুন্নাহকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মেনে চলা এবং (২) একটি প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি প্রণয়ন করা, যার সাহায্যে রাষ্ট্রের নতুন ও বিচিত্র পরিস্থিতিতে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সঠিক প্রয়োগ সম্ভব হয়।[৮] আর বিচার ব্যবস্থায় আইনের উৎস ৪টি। যথা : (ক) আল-কুরআন (খ) আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ, যার মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কর্তৃক বিচারের রায়গুলোও অন্তর্ভুক্ত। (গ) ইজমা তথা সাহাবীগের ঐকমত্য এবং (ঘ) ইজতিহাদ বা ব্যক্তিগত মতামত ও সিদ্ধান্ত। আর তা তখনই নেয়া হয় যখন একজন বিচারক কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা থেকে কোন বিষয়ে রায় প্রদানের আইন খুঁজে না পান।[৯]

অতএব এ বিভাগের সাথে যারা জড়িত থাকবেন তারা বিচার বিভাগের উক্ত বৈশিষ্ট্য ও আইনের উৎসগুলোর ভিত্তিতে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন। মামলার দীর্ঘসূত্রিতা উৎখাত করে যতসম্ভব দ্রুত ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। হয়রানী, প্রতারণা ও স্বজনপ্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করবেন না। এ প্রসঙ্গে ইসলামের মূলনীতি সুস্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন, সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা কাফির, যালিম ও ফাসিক’।[১০] ইসলামে বিচারকের অবস্থা বর্ণনায় নিচের হাদীছটি যথেষ্ট। বুরাইদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

اَلْقُضَاةُ ثَلَاثَةٌ وَاحِدٌ فِى الْجَنَّةِ وَاثْنَانِ فِى النَّارِ فَأَمَّا الَّذِىْ فِى الْجَنَّةِ فَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَقَضَى بِهِ وَرَجُلٌ عَرَفَ الْحَقَّ فَجَارَ فِى الْحُكْمِ فَهُوَ فِى النَّارِ وَرَجُلٌ قَضَى لِلنَّاسِ عَلَى جَهْلٍ فَهُوَ فِى النَّارِ

‘বিচারক তিন প্রকার। এক শ্রেণীর বিচারক জান্নাতী, আর দুই শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামী। (১) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করে এবং তদনুযায়ী বিচার করে, সে জান্নাতী (২) যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু তদনুযায়ী বিচার করে না, সে জাহান্নামী। (৩) আর এক শ্রেণীর বিচারক সত্য উপলব্ধি করতে পারে না। অজ্ঞতার ভিত্তিতে বিচার করে, সেও জাহান্নামী’।[১১] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে যে, ‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা প্রজা সাধারণের উপর দায়িত্বশীল করেন অথচ সে যখন মারা যায় তখনও সে প্রজা সাধারণগণের প্রতি প্রতারণাকারী থাকে, তাহলে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দেন’।[১২]

তাই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি শরী‘আতের মূলনীতি অনুসরণ করেই রাজনীতির ময়দানে বিচরণ করবেন। মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকবেন। অর্থ ও নেতৃত্বের নেশায় মত্ত হবেন না। অস্ত্রের মহড়া দেখিয়ে ত্রাসের রাজ্য কায়েম করবেন না। রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত মূলনীতিগুলো অনুসরণ করবেন-

ক. রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পদ্ধতি অনুসরণ করবেন। এক্ষেত্রে মানব রচিত আধুনিক বা প্রাচীন কোন পদ্ধতি বা মতবাদকে সমর্থন ও গ্রহণ করবেন না। ইরবায ইবনু সারিয়া (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أُوصِيْكُمْ بِتَقْوَى اللهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ عَبْدًا حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَّعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِىْ فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيْرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّيْنَ الرَّاشِدِيْنَ تَمَسَّكُوْا بِهَا وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُوْرِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ

‘(একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে অসিয়ত করার সময় বলেন,) আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির, (আমীরের কথা) শ্রবণ ও আনুগত্যের উপদেশ দিচ্ছি, যদিও সে (আমীর) একজন হাবাশী গোলামও হয়। কারণ তোমাদের মধ্যে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে তারা অচিরেই প্রচুর মতবিরোধ দেখতে পাবে। এমতাবস্থায় তোমরা অবশ্যই আমার সুন্নাত ও আমার হিদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নাতকে অনুসরণ করবে, তা দাঁত দিয়ে মযবুত করে আঁকড়ে থাকবে। সাবধান! নবাবিষ্কৃত বিষয় থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রতিটি নবাবিষ্কৃত বিষয় হল বিদ‘আত আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[১৩]

খ. আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি শার‘ঈ আইন প্রয়োগ করবেন এবং এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবেন। আল্লাহ প্রদত্ত আইনের বিরোধিতা করে নতুন কোন আইন রচনা করবেন না। কারণ তিনি আইন প্রণেতা নন; বরং আইনের প্রয়োগকারী মাত্র। মূলত আইন প্রণেতা হলেন আল্লাহ। তাঁর আইনকে উপেক্ষা করে কোন আইন ও বিধান তৈরির অধিকার কারো নেই। এটা করলে আল্লাহর অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন এভাবে,

اَمۡ لَہُمۡ شُرَکٰٓؤُا شَرَعُوۡا  لَہُمۡ مِّنَ الدِّیۡنِ مَا لَمۡ یَاۡذَنۡۢ بِہِ اللّٰہُ ؕ وَ لَوۡ لَا کَلِمَۃُ  الۡفَصۡلِ لَقُضِیَ بَیۡنَہُمۡ ؕ وَ  اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ لَہُمۡ عَذَابٌ  اَلِیۡمٌ

‘তাদের কি এমন কিছু শরীক আছে, যারা তাদের জন্য আইন প্রণয়ন করে, যে বিষয়ে আল্লাহ অনুমতি দেননি? (কিয়ামতের) ফায়সালার ঘোষণা না থাকলে তাদের বিষয়ে ফায়সালা হয়েই যেত। নিশ্চয় সীমালংঘনকারীদের জন্য কঠোর শাস্তি বিদ্যমান’ (সূরা আশ-শূরা : ২১)।

অন্যত্র তিনি বলেন, وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না তারা যালিম’ এবং وَ مَنۡ لَّمۡ یَحۡکُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ  الۡفٰسِقُوۡنَ ‘আল্লাহ তা‘আলা যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন সে অনুযায়ী যারা শাসনকার্য পরিচালনা করে না, তারা ফাসিক’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৫ ও ৪৭)। একই অপরাধ করে কেউ কাফির হচ্ছে, কেউ যালিম আবার কেউ ফাসিক হচ্ছে। তাই এর কারণ জানা আবশ্যক। কখন কাফির, কখন যালিম এবং কখন ফাসিক তা স্পষ্ট না হলে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। মূলত যারা আল্লাহর বিধানকে বিশ্বাস করে না, অনুসরণ করে না এবং অন্যকে অনুসরণ করতে বাধা দেয় তারা পরিষ্কার কাফির। যারা বিশ্বাস করে কিন্তু নিজেরা অনুসরণ করে না, কাউকে করতেও দেয় না তারা যালিম। আর যারা বিশ্বাস করে কিন্তু মানে না, কেউ অনুসরণ করলে বাধা দেয় না তারা ফাসিক।[১৪]

গ. মুসলিম ব্যক্তি মাত্রই যেন সালাত আদায় করে সে জন্য বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এবং সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা রাজনৈতিক ময়দানে আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতা উল্লেখ করে বলেন,

اَلَّذِیۡنَ  اِنۡ مَّکَّنّٰہُمۡ  فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَ اَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ  نَہَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لِلّٰہِ  عَاقِبَۃُ  الۡاُمُوۡرِ

‘আমি যদি তাদেরকে পৃথিবীতে রাজত্ব দান করি, তবে তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দিবে, সৎকাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজ হতে বাধা প্রদান করবে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে’ (সূরা আল-হজ্জ : ৪১)। অতএব রাজনৈতিক ময়দানে বিচরণকালে সালাতই হবে প্রধান কর্মসূচী। কারণ যাবতীয় অন্যায়-অশ্লীলতা প্রতিরোধে সালাতই সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ঔষধ।[১৫]

ঘ. শরী‘আত বিরোধী প্রচলিত যাবতীয় মতবাদ ও দর্শন, নিয়ম-নীতি বাতিল ও উচ্ছেদ করবেন। যার জন্য আল্লাহ মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে প্রেরণ করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ہُوَ الَّذِیۡۤ  اَرۡسَلَ  رَسُوۡلَہٗ  بِالۡہُدٰی وَ دِیۡنِ  الۡحَقِّ لِیُظۡہِرَہٗ  عَلَی الدِّیۡنِ کُلِّہٖ وَ لَوۡ  کَرِہَ  الۡمُشۡرِکُوۡنَ

‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি সকল দ্বীনের উপর তাকে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও তা মুশরিকরা অপসন্দ করে’ (সূরা আস-সাফ্ : ৯)। যে কাজ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও চার খলীফা করেছিলেন। নবী কারীম (ﷺ) মক্কা বিজয়ের দিন সর্বাগ্রে কা‘বা চত্বর থেকে ৩৬০টি মূর্তি অপসারণ করেন।[১৬]


তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন, ‘আমার রব আমাকে মূর্তি ভাঙ্গার জন্য প্রেরণ করেছেন’।[১৭] ‘আলী (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে নির্দেশ দিলেন, ছবি-মূর্তি ও সৌধ নির্মাণ করা যত উঁচু কবর রয়েছে সবগুলো ভেঙ্গে দাও। কোথাও যেন অবশিষ্ট না থাকে।[১৮] লাত, মানাত, উযযা, দেব-দেবী, পূর্বপুরুষ, গোত্রপ্রধান ও সমাজ নেতাদের দোহাই দিয়ে প্রণীত আইনকে বাতিল করে বলে দিলেন, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তোমরা তার আনুগত্য কর। তাই মুসলিম হিসাবে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি আল্লাহর বিধান লংঘন করে ত্বাগূতের আইন ও বিধানের তাবেদারী করতে পারেন না। তিনি শয়তানী নীতির সামনে মাথা নত করতে পারেন না। বরং তিনি ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠায় হবেন আপোসহীন।

* ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান

তথ্যসূত্র : 
[১]. মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম, আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, তা.বি.), পৃ. ১৫৭।     
[২]. সূরাহ আল-আন‘আম : ৫৭; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৪০১।     
[৩]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, পৃ. ৮৯৬, হাদীছ নং-৪৯৫৫ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়-৩৫; আহমাদ ইবন শু‘আইব আবূ ‘আব্দির রহমান আন-নাসাঈ, আস-সুনান, ৮ম খণ্ড (আলেপ্পো : মাকতাবুল মাতবূ‘আতিল ইসলামিয়্যাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪০৬ হি./১৯৮৬ খ্রি.), পৃ. ২২৬, হাদীছ নং-৫৩৮৭।     
[৪]. সূরাহ আন-নূর : ২; ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, পৃ. ৫৬৯, হাদীছ নং-৩৪৭৫ ‘নবীগণের বর্ণনা’ অধ্যায়-৬০, অনুচ্ছেদ-৫৪; ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ৫৫১, হাদীছ নং-১৬৮৮ ‘হুদূদ’ অধ্যায়-২৯, ‘সম্ভ্রান্ত ও অন্যান্য চোরদের হাত কর্তন ও আইন বাস্তবায়নে সুপারিশ নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ-২; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৮ম খণ্ড, পৃ. ২৭-২৮; তাইসীরুল কারীমির রহমান ফী তাফসীরি কালামিল মান্নান, পৃ. ৮৪২।     
[৫]. ইমাম তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ১৭০, হাদীছ নং-৩৮১।
[৬]. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ৬১০, হাদীছ নং-১৮৪১ ‘প্রশাসন’ অধ্যায়-৩৩, ‘ইমাম ঢালস্বরূপ, যার অধীনে যুদ্ধ করা হয় ও নিরাপদ থাকা যায়’ অনুচ্ছেদ-৯।
[৭]. ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, পৃ. ৪৭৩, হাদীছ নংÑ২৮৯২; ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৯, হাদীছ নং-২২৯২৩।     
[৮]. ড. মুহাম্মাদ আয-যুহাইলী, তারীখুল কাযা ফিল ইসলাম (বৈরূত : দারুল ফিকরিল মু‘আসির, ১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ৮৪।     
[৯]. ড. ‘আলী মুহাম্মাদ আস-সাল্লাবী, আল-খালীফাতুল আওয়াল আবূ বাকর আস-সিদ্দীক শাখসিয়্যাতুহু ওয়া ‘আসরুহু (বৈরূত : দারুল মা‘আরিফাহ, ৭ম সংস্করণ, ১৪৩০ হি./২০০৯ খ্রি.), পৃ. ১৪২।     
[১০]. সূরাহ আল-মায়িদাহ : ৪৪-৪৫ ও ৪৭।   
[১১]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, পৃ. ৬৪১, হাদীছ নং-৩৫৭৩ ‘বিচার ব্যবস্থা’ অধ্যায়-১৮, ‘বিচারক ভুল করলে’ অনুচ্ছেদ-২।    
[১২]. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ৬৩-৬৪, হাদীছ নং-১৪২; মুহাম্মাদ ইবন হিব্বান ইবন আহমাদ আবূ হাতিম আত-তামীমী, আস-সহীহ, ১০ম খণ্ড (বৈরূত : মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২য় সংস্করণ, ১৪১৪ হি./১৯৯৩ খ্রি.), পৃ. ৩৪৬, হাদীছ নং-৪৪৯৫।    
[১৩]. ইমাম আবূ দাঊদ, আস-সুনান, পৃ. ৮৩২, হাদীছ নং-৪৬০৭; ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, ৫ম খণ্ড, পৃ. ৪৪, হাদীছ নং-২৬৭৬; ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১২৬, হাদীছ নং-১৭১৮৫; ইমাম তাবারনী, আল-মু‘জামুল আওসাত, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮, হাদীছ নং-৬৬; ইমাম দারিমী, আস-সুনান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭, হাদীছ নং-৯৫; মিশকাতুল মাসাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৬, হাদীছ নং-১৬৫। 
[১৪]. আবূ ‘আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবন আহমাদ শামসুদ্দীন আল-কুরতুবী, আল-জামি‘ঊ লি আহকামিল কুরআন, ৬ষ্ঠ খণ্ড (রিয়াদ : দারু ‘আলিমিল কুতুব, ১৪২৩ হি./২০০৩ খ্রি.), পৃ. ১৯০; তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১২০।     
[১৫]. সূরাহ আল-‘আনকাবূত : ৪৫।     
[১৬]. ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, পৃ. ৩৯৭-৩৯৮, হাদীছ নং-২৪৭৮; আহমাদ ইবন শু‘আইব আবূ ‘আব্দির রহমান আন-নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, ৬ষ্ঠ খণ্ড (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১১ হি./১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ৪৩৮, হাদীছ নং-১১৪২৮।       
[১৭]. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ২৪৯, হাদীছ নং-৮৩২; ইমাম বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৫৪, হাদীছ নং-৪১৭৮; আল-আহকামুশ শার‘ইয়্যাহ আল-কুবরা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৭৫।      
[১৮]. ইমাম মুসলিম, আস-সহীহ, পৃ. ২৯১, হাদীছ নং-৯৬৯; ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল, আল-মুসনাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৯৬, হাদীছ নং-৭৪১; মিশকাতুল মাসাবীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮২, হাদীছ নং-১৬৯৬।        




প্রসঙ্গসমূহ »: সমাজ-সংস্কার রাজনীতি

ফেসবুক পেজ