উত্তর : একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (ﷺ) ব্যতীত অন্য কারোর নিরঙ্কুশভাবে আনুগত্য করা যাবে না। তাছাড়া মুসলিম শাসকের আনুগত্যের বিষয়টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্যের অধীনস্থ। যদি তিনি অবাধ্যতার আদেশ দেন তবে অবশ্যই তাঁর আনুগত্য করা যাবে না, আর কোন বিষয়ে যদি বিরোধ সৃষ্টি হয় তবে বিষয়টি কিতাব ও সুন্নাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বিবাদমান বিষয়ে মীমাংসার দায়িত্ব রাসূল (ﷺ)-এর উপর ছেড়ে দেয়া অপরিহার্য করে দিয়েছেন এবং এটাকে ঈমানের শর্ত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ‘উলুল আমর’ বা ক্ষমতাশীলদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন কর- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটিই কল্যাণকর এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর’ (সূরা আন-নিসা : ৫৯)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আয়াতে ‘যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ’ নির্দেশ করছে, যে ব্যক্তি বিবাদমান বিষয়ের মীমাংসা কুরআন ও সুন্নাহ হতে গ্রহণ করে না এবং এ দু’টির কাছে ফিরে আসে না সে আল্লাহর প্রতি ও শেষ দিনের প্রতি ঈমানদার নয় (তাফসীরে ইবন কাছীর, ২/৩৪৬)।
অপরদিকে নবী (ﷺ) বলেন, لَا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةٍ، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ ‘আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতায় কোনরূপ আনুগত্য নেই। আনুগত্য করতে হয় কেবল ন্যায়সঙ্গত কাজে (ছহীহ বুখারী, হা/৭২৫৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪০)। অন্যত্র তিনি বলেন, لَا طَاعَةَ لِمخْلُوْقٍ فيِ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অসন্তুষ্টির কাজে সৃষ্টির কোন আনুগত্য নেয়’ (ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর, হা/৩৮১; ছহীহুল জামি‘, হা/৭৫২০, সনদ ছহীহ)। সুতরাং কোন শাসকের শরী‘আত বিরোধী নির্দেশ মানা যাবে না। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, তার শরী‘আতসম্মত নির্দেশগুলোও অমান্য করতে হবে। বরং এক্ষেত্রে তার আনুগত্য করা অপরিহার্য (আযওয়াউল বায়ান, ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-২৮৩৪৩২)।
দ্বিতীয়তঃ মানুষ হিসাবে একমাত্র রাসূল (ﷺ)-ই নিষ্পাপ। মুসলিম শাসকেরাও মানুষ হিসাবে ভুল করেন। নিঃসন্দেহে তাদের অনেক ভুল রয়েছে। তারা কেউ নিষ্পাপ নন। কিন্তু আমরা তাদের ভুলকে নিন্দার ক্ষেত্র মনে করে তাদের আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিব না, তারা প্রকাশ্য কুফরী না করা পর্যন্ত আমরা তাদের আনুগত্য করব। যেমনটা নবী করীম (ﷺ) আদেশ করেছেন (আক্বীদাতুত্ব ত্বাহাবী, পৃ. ৩৭৯)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা অবশ্যই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করবে এবং এমন কিছু বিষয় দেখতে পাবে, যা তোমরা অপসন্দ করবে। তখনও তোমরা তাদের হক্ব পূর্ণরূপে আদায় করবে, আর তোমাদের হক্ব আল্লাহর কাছে চাইবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭০৫২; তিরমিযী, হা/২১৯০)। অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যে লোক নিজ আমীরের কাছ থেকে অপসন্দনীয় কিছু দেখবে সে যেন তাতে ধৈর্যধারণ করে। কেননা যে লোক সুলতানের আনুগত্য হতে এক বিঘতও বিচ্ছিন্ন হবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়্যাতের মৃত্যু’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭০৫৩, ৭০৫৪, ৭১৪৩; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৮৭)।
উল্লেখ্য, মুসলিম শাসকের ভুল বা অন্যায় কার্যকলাপের জন্য প্রতিবাদ করা যাবে এই উদ্দেশ্যে যে, তিনি যেন সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকেন। কিন্তু তার আনুগত্য থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিদ্রোহ করা যাবে না, করলে অমুসলিমের মৃত্যুবরণ করতে হবে। মুসলিমদের ঐক্য বজায় রাখা ও মুসলিম দেশের প্রতিরক্ষার লক্ষ্যে রাসূল (ﷺ) তাদের ব্যাপারে এমনটিই নির্দেশ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই আলেমগণ, উপদেষ্টাগণ ও সৎ লোকেরা শাসককে উপদেশ প্রদান করবেন (আল-ফাতহ, ৫/১৩ ও ৮/১৩ পৃ.)। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সৎ কাজের আদেশ প্রদান এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদানের মাধ্যম হল নম্রতা। এজন্য বলা হয়, ‘তোমার সৎ কাজের আদেশ যেন সৎ পন্থায় হয় এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান যেন অসৎ পন্থায় না হয়। যেহেতু সৎকাজের আদেশ প্রদান করা এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করা ওয়াজিব ও অন্যতম পসন্দনীয় কাজ। সুতরাং এর উপকারিতা অবশ্যই অনিষ্টের উপর প্রাধান্য পাবে। বরং আল্লাহ তা‘আলা যা কিছুর নির্দেশ প্রদান করেছেন সেগুলোই সৎকর্ম। আল্লাহ সৎকর্ম ও তার সম্পাদনকারীর প্রশংসা করেছেন এবং অনেক স্থানে বিশৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলাকারীর নিন্দা করেছেন। আল্লাহর নির্দেশিত পন্থা ছাড়া অন্য কোন পন্থায় সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের বাধা প্রদান কতই না মারাত্মক হতে পারে। মুমিন বান্দার উপর আবশ্যক হল, সে আল্লাহর বান্দাদের অধিকারের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করবে। মানুষকে হিদায়াত প্রদান করার দায়িত্ব তার উপর অর্পিত নয়’ (আল আমরু বিল মা‘রুফ ওয়া আন-নাহ্য়ু 'আনিল মুনকার, পৃ. ১৯; মানহাজ,-আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ, প্রশ্নোত্তর নং-১৮)।
প্রশ্নকারী : শাওন, টাঙ্গাইল।