উত্তর : উক্ত দাবী বিভ্রান্তিকর। এটা তার মূর্খতা। ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) এবং ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত-ই হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের ব্যাখ্যাকারী’ (রিসালাতুশ শাফিঈ, ১/৭৯ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৩১১১)।
ইমাম শাফিঈ (রাহিমাহুল্লাহ) নিম্নের আয়াত পেশ করে বলেন,
مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰہَ ‘যে রাসূলের আনুগত্য করল, সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য করল’ (সূরা আন-নিসা : ৮০)। এমন প্রত্যেকটি বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে ফরয করেছেন, যেমন ছালাত, যাকাত, হজ্জ ইত্যাদি, যদি রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এগুলোর নিয়ম-নীতি, পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্য, আকার-আকৃতি, ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত না করতেন, তাহলে আমরা সেগুলো কিভাবে আদায় করতাম? তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ব্যতীত আমাদের পক্ষে কোন ইবাদতই করা সম্ভবপর হত না (আল-বাহরুল মুহীত্ব, ৬/৭-৮ পৃ.)।
অসংখ্য আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরআনুল কারীমের ব্যাখ্যাকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الذِّکۡرَ لِتُبَیِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ اِلَیۡہِمۡ وَ لَعَلَّہُمۡ یَتَفَکَّرُوۡنَ ‘আর আপনার প্রতি যিকির অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষকে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (সূরা আন-নাহল : ৪৪)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘আমি তো আপনার প্রতি কিতাব এ জন্যই অবতীর্ণ করেছি, যাতে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করে, তাদেরকে আপনি তা সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন, এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ নির্দেশ ও দয়া স্বরূপ’ (সূরা আন-নাহল : ৬৪; ইসলাম ওয়েব : https://www.islamweb.net/amp/ar/article/24305/)।
আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩৮)। এখানে সাধারণভাবে চুরি করলেই চোরের হাত কাটার কথা বলা হয়েছে। জাহিরিয়্যাহ মাযহাবের ফক্বীহবিদদের মতানুযায়ী চুরির এই বিধান সকল প্রকার চুরির জন্য ব্যাপক, চুরির পরিমাণ অল্প হোক অথবা বেশি, সুরক্ষিত জায়গা থেকে চুরি করা হোক অথবা অরক্ষিত জায়গা থেকে হোক, সর্বাবস্থাতেই চোরের হাত কাটা যাবে। অথচ বাণীসূচক হাদীছের মধ্যে রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘এক চতুর্থাংশ স্বর্ণমুদ্রা (দীনার) বা ততধিক চুরি করলে তবেই হাত কাটা যাবে (ছহীহ বুখারী, হা/৬৭৮৯, ৬৭৯০, ৬৭৯১)।
এ রকম বহু আয়াত আছে যার বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সুন্নাত ছাড়া সম্ভব নয়। যেমন (১) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَہُمۡ بِظُلۡمٍ اُولٰٓئِکَ لَہُمُ الۡاَمۡنُ وَ ہُمۡ مُّہۡتَدُوۡنَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে যুলম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’ (সূরা আন-আন‘আম : ৮২)। ছাহাবীগণ এই আয়াতের ‘যুলম’ শব্দ দ্বারা সাধারণ ছোট-বড় অত্যাচার করা বুঝেছিলেন। এ আয়াত অবতীর্ণ হলে ছাহাবীগণ চমকে উঠেন এবং ভীতিকর অবস্থায় জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহ রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুলম করেনি? এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কী? রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে যুলম বলতে শিরককে বুঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ‘নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় যুলম’ (সূরা লুক্বমান : ১৩; ছহীহ বুখারী, হা/৩২, ৩৩৬০, ৩৪২৮, ৩৪২৯, ৪৬২৯, ৪৭৭৬, ৬৯১৮, ৬৯৩৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৪; তিরমিযী, হা/৩০৬৭)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা যখন দেশ-বিদেশে সফর করবে, তখন যদি তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফিররা তোমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করবে, তাহলে ছালাত ক্বছর করলে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয় কাফিররা তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা আন-নিসা : ১০১)। উক্ত আয়াত থেকে প্রতিভাত হচ্ছে যে, সফরে ক্বছরের ছালাত ভয়-ভীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সে জন্যই কিছু ছাহাবী রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বিস্মৃত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নিরাপদে থাকা অবস্থায় ছালাত ক্বছর করা যাবে কি-না? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওটা তো একটি ছাদাক্বাহ বিশেষ, যা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের দান করেছেন। কাজেই তোমরা তাঁর ছাদাক্বাহ গ্রহণ কর’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৬৮৬)।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত ...’ (সূরা আল-মায়িদাহ : ৩)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত মাছ ও কলিজার বিধান কী হবে? খাওয়া যাবে কি-না? রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীসূচক হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, প্রাণীর মধ্যে সকল প্রকারের মৃত মাছ ও মৃত টিড্ডি খাওয়া হালাল। আর রক্তের মধ্যে কলিজা বা লিভার ও প্লীহা খাওয়া হালাল। আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমাদের জন্য দু’প্রকারের মৃতজীব ও দু’ধরনের রক্ত হালাল করা হয়েছে। মৃত জীব দু’টি হল মাছ ও টিড্ডি এবং দু’প্রকারের রক্ত হল কলিজা ও প্লীহা’ (ইবনু মাজাহ, হা/৩৩১৪; মুসনাদে আহমাদ, হা/৫৭২৪; ছহীহুল জামে‘, হা/২১০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/১১১৮)। এক্ষেত্রে কেউ কোন দ্বিমত পোষণ করে না, এমনকি যারা নিজেকে আহলে কুরআন বলে দাবী করে তারাও না। তারাও নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজা করে মৃত মাছ ও কলিজা খাচ্ছে।
প্রশ্নকারী : আব্দুল্লাহ, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।