সূরা আল-হুজুরাতে বর্ণিত ঘটনাসমূহ
ঘটনা-১ : ইবনু আবী মুলায়কা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উত্তম দু’ব্যক্তি- আবূ বকর ও ‘ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে কণ্ঠস্বর উঁচু করে ধ্বংস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিলেন। যখন বনী তামীম গোত্রের একদল লোক নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসেছিল। তাদের একজন বনী মাজাশে গোত্রের আকরা ইব্নু হাবিসকে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তাব করল এবং অপরজন অন্যজনের নাম প্রস্তাব করল। নাফি‘ বলেন, এ লোকটির নাম আমার মনে নেই। তখন আবূ বকর ছিদ্দীক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, আপনার ইচ্ছা হল কেবল আমার বিরোধিতা করা। তিনি বললেন, না, আপনার বিরোধিতা করার ইচ্ছা আমার নেই। এ ব্যাপারটি নিয়ে তাঁদের আওয়াজ উঁচু হয়ে গেল। তখন আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গলার আওয়াজের উপর নিজেদের গলার আওয়াজ উঁচু করবে না’.....শেষ পর্যন্ত (সূরা আল-হুজুরাত : ২)। ইব্নু যুবায়র (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এত আস্তে কথা বলতেন যে, দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস না করা পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা শুনতে পেতেন না। তবে তিনি আবূ বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে এমন কথা বর্ণনা করেননি (ছহীহ বুখারী, হা/৪৮৪৫, ‘তাফসীর’ অধ্যায়)।
ঘটনা-২ : আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَرۡفَعُوۡۤا اَصۡوَاتَکُمۡ فَوۡقَ صَوۡتِ النَّبِیِّ থেকে وَ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ পর্যন্ত অবতীর্ণ হলে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাবিত ইবনু ক্বাইস (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে তাঁর মজলিসে অনুপস্থিত পেলেন। তখন এক ছাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমি তার সম্পর্কে জানি। তিনি গিয়ে দেখেন যে, ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর ঘরে অবনতমস্তকে বসে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে ছাবিত! কী অবস্থা তোমার? তিনি বললেন, অত্যন্ত খারাপ। তার গলার স্বর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর গলার স্বর হতে উঁচু হয়েছিল। কাজেই তার সব নেক আমল নষ্ট হয়ে গেছে। সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ঐ ব্যক্তি ফিরে এসে নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালেন যে, ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এসব কথা বলেছে। মূসা ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ঐ ছাহাবী এক মহা সুসংবাদ নিয়ে হাযির হলেন যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তুমি যাও ছাবিতকে বল, নিশ্চয় তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত নও বরং তুমি জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত (ছহীহ বুখারী, হা/৩৬১৩, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়-৬১, ‘ইসলামে নবুওয়াতের নিদর্শন’ অনুচ্ছেদ-২৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এরপর থেকে আমরা ছাবিত ইবনু ক্বাইছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জীবিত অবস্থায় চলাফিরা করতে দেখতাম এবং জানতাম যে, তিনি একজন জান্নাতী মানুষ। অতঃপর ইয়ামামার যুদ্ধে যখন আমরা কিছুটা ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়ি, তখন আমরা দেখি যে, ছাবিত ইবনু ক্বাইছ ইবনু শামস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সুগন্ধিময় কাফন পরিহিত হয়ে শত্রুদের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন এবং বলছেন, সবচেয়ে খারাপ কাজ হল- যা তোমরা শত্রুদের কাছ থেকে গ্রহণ কর। তোমরা তোমাদের সাথীদের জন্য মন্দ দৃষ্টান্ত রেখে যেও না। এ কথা বলে তিনি শত্রুদের মধ্যে ঢুকে পড়েন এবং বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে যান (মুসনাদে আহমাদ, হা/১২৪২২, সনদ ছহীহ)।
ঘটনা-৩ : সুদ্দী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইমরান নামক একজন আনছারী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল উম্মে যায়িদ। তিনি (তার স্ত্রীর) তার পিত্রালয়ে যেতে চান। কিন্তু তার স্ত্রীর স্বামী বাধা দেন এবং বলেন যে, তার স্ত্রীর পিত্রালয়ের কোন লোক যেন তার বাড়ীতে না আসে। স্ত্রী তখন তার পিত্রালয়ে এ খবর পাঠিয়ে দেন। খবর পেয়ে সেখান হতে লোক এসে উম্মু যায়িদকে বাড়ী হতে বের করে এং সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করে। ঐ সময় তার স্বামী বাড়ীতে ছিলেন না। তার লোক তার চাচাতো ভাইদেরকে খবর দেয়। খবর পেয়ে তারা দৌড়ে আসে এবং স্ত্রীলোকের ও স্বামীর লোকদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায় এবং মারামারি ও জুতা ছুঁড়াছুঁড়ি হয়। তাদের ব্যাপারে وَ اِنۡ طَآئِفَتٰنِ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اقۡتَتَلُوۡا فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَہُمَا থেকে اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ الۡمُقۡسِطِیۡنَ পর্যন্ত ‘এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উভয়পক্ষের লোকদেরকে ডেকে তাদের মধ্যে সন্ধি করিয়ে দেন (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম, ৭ম খ-, পৃ. ৩৭৪-৩৭৫)। অন্যত্র বর্ণিত্র হয়েছে, সাঈদ ইবনু যুবাইর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, খেজুর গাছের ডাল-পালা নিয়ে আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে এক সময় হাতাহাতির রূপ নেয়। তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন (ঐ, ৭ম খ-, পৃ. ৩৭৪)।
শিক্ষা
ক. কণ্ঠস্বর উঁচু করে কথা বলা ঠিক নয়।
খ. আল্লাহ ও রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিপরীতে কারও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার নেই।
গ. ইসলামের বিধানের উপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আত্মসমর্পণের দৃষ্টান্ত।
ঘ. পরস্পর দ্বন্দ্ব-ফাসাদ, মারামারি করা ঠিক নয়।
ঙ. মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হলে উভয়ের মাঝে শান্তিপূর্ণভাবে ফায়ছালা করে দেয়া উচিত।