কৃপণদের উপার্জন ধ্বংস হওয়ার দৃষ্টান্ত
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমরা তাদেরকে (কুরাইশদের) পরীক্ষা করেছি, যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান অধিপতিদেরকে, যখন তারা শপথ করেছিল যে, তারা প্রত্যুষে আহরণ করবে বাগানের ফল এবং তারা ইনশাআল্লাহ বলেনি’ (সূরা আল-কলম : ১৭-১৮)। আল্লাহ তা‘আলা পূর্ববর্তী যুগের বাগানের মালিকদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন। ঐ বাগানে বিভিন্ন প্রকারের ফল ছিল। ঐ লোকগুলো পরস্পর শপথ করে বলেছিল যে, অতি প্রত্যুষে অর্থাৎ রাত কিছুটা বাকী থাকতেই তারা গাছের ফল আহরণ করবে, যাতে দরিদ্র, মিসকীন এবং ভিক্ষুকরা বাগানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ না পায় ও তাদের হাতে কিছু দিতে না হয়, বরং সমস্ত ফল তারা বাড়ীতে নিয়ে আসতে পারে। তারা তাদের এ কৌশলে কৃতকার্য হবে ভেবে খুব আনন্দ বোধ করল।
সকালে তারা একে অপরকে চুপি চুপি ডাক দিয়ে বলে, ফল আহরণের ইচ্ছা থাকলে আর দেরী করা চলবে না, চল এখনই বের হয়ে পড়ি। তারা চুপে চুপে কথা বলতে বলতে চলল, যাতে কেউ শুনতে না পায় এবং গরীব, মিসকীনরা যেন টের না পায়। এভাবে দৃঢ় সংকল্পের সাথে গরীব দরিদ্রদের প্রতি ক্রোধের ভাব নিয়ে তারা তাদের বাগানের পথে যাত্রা শুরু করল। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বাগানের ফল তাদের দখলে রয়েছে। সুতরাং তারা ফল আহরণ করে সবই বাড়ীতে নিয়ে আসবে।
তারা আনন্দে এমন আত্মহারা হয়ে পড়ল যে, আল্লাহ থেকেও ভুলে গেল। তাই ‘ইনশাআল্লাহ’ কথাটিও তাদের মুখ দিয়ে বের হল না। এ জন্যই তাদের এ শপথ পূর্ণ হল না। রাতারাতিই তাদের পৌঁছার পূর্বেই আসমানী বিপদ তাদের গোটা বাগানকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিল। তাদের বাগানটি এমন হয়ে গেল যে, যেন তা কালো ছাই ও কর্তিত শস্য। বাগানে পৌঁছে তারা হতভম্ভ হয়ে পড়ল। দেখল যে, সবুজ-শ্যামল শস্যক্ষেত এবং পাকা ফলের গাছ সব ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গেছে। এখন এগুলোর আধা পয়সারও মূল্য নেই। গাছগুলোর জ্বলে যাওয়া কালো কালো কা- ভয়াবহ আকার ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথমতঃ তারা মনে করল যে, ভুল করে তারা অন্য কোন বাগানে এসে পড়েছে। যা হোক পরক্ষণেই তাদের ভুল ভেঙ্গে গেল। তারা বলল, আমাদের বাগানতো এটাই, কিন্তু আমরা হতভাগ্য বলে আমরা বাগানের ফল লাভে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। ঐ বাগানটি তারা তাদের পিতার নিকট হতে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিল। তাদের পিতার নীতি এই ছিল যে, বাগানে উৎপাদিত ফল ও শস্যের মধ্য হতে বাগানের খরচ বের করে এবং নিজের ও পরিবার পরিজনের সারা বছরের খরচ বের করে নিয়ে বাকীগুলো আল্লাহর নামে ছাদাক্বাহ করে দিতেন।
পিতার ইন্তিকালের পর তার এই সন্তানরা পরস্পর পরামর্শ করে বলল, আমাদের পিতা বড়ই নির্বোধ ছিলেন। তা না হলে তিনি এতগুলো ফল ও শস্য প্রতি বছর গরীবদেরকে দিতেন না। আমরা যদি এগুলো ফকীর-মিসকীনদেরকে প্রদান না করি এবং তা যথারীতি সংরক্ষণ করি, তাহলে অতি সত্বর আমরা ধনী হয়ে যাব। তারা তাদের এ সংকল্প দৃঢ় করে নিল। ফলে তাদের উপর ঐ শাস্তি এসে পড়ল, যা তাদরে মূল সম্পদকেও ধ্বংস করে দিল। তারা হয়ে গেল সম্পূর্ণ রিক্ত হস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘শাস্তি এরূপই হয়ে থাকে এবং আখিরাতের শাস্তি কঠিনতর, যদি তারা জানত!’ (সূরা আল-কলম : ৩৩)।
তাদের মধ্যে সৎ ও ন্যায়পন্থী ব্যক্তি তাদেরকে বলল, ‘দেখ, আমিতো তোমাদেরকে পূর্বেই বলেছিলাম, তোমরা ইনশাআল্লাহ বলছ না কেন? আল্লাহ তোমাদেরকে যা দান করেছেন সেই জন্য তোমরা কেন আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা ঘোষণা করছ না এবং প্রশংসা করছ না? এ কথা শুনে তারা বলল, ‘আমাদের রব পবিত্র ও মহান। নিশ্চয় আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। যখন শাস্তি পৌঁছে গেল তখন তারা আনুগত্য স্বীকার করল, যখন আযাব এসে পড়ল তখন তারা নিজেদের অপরাধ মেনে নিল’।
অতঃপর তারা একে অপরকে তিরস্কার করতে লাগল এবং বলতে থাকল, ‘আমরা বড়ই মন্দ কাজ করেছি যে, মিসকীনদের হক্ব নষ্ট করতে চেয়েছি এবং আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা হতে বিরত থেকেছি। তারপর তারা সবাই বলল, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের হঠকারিতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণেই আমাদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়েছে’ (সূরা আল-কলম-এর তাফসীর দ্র.; তাফসীরে ত্বাবারী, ২৩তম খ-, পৃ. ৫৫০-৫৩; তাফসীর ইবনু কাছীর, ৮ম খ-, পৃ. ১৮৪; উল্লেখ্য যে, পূর্বযুগীয় কোন কোন বিজ্ঞজনের উক্তি এই যে, এটা ইয়ামানবাসীর ঘটনা। সাঈদ ইবন যুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, এ লোকগুলো ছিল যাওয়ানের অধিবাসী যা (তৎকালীন ইয়ামানের রাজধানী) ছান‘আ হতে ছয় মাইল দূরবর্তী একটি গ্রাম। অন্যান্য মুফাসসির বলেন যে, এরা ছিল ইথিওপিয়ার অধিবাসী। তারা আহলে কিতাব ছিল)।
শিক্ষা
ক. আল্লাহ থেকে বিস্মরণ না হওয়া।
খ. সর্বদা ছাদাক্বাহ করা এবং মিসকীনের হক্ব নষ্ট না করা।
গ. সর্বদা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং প্রশংসা করা।
ঘ. আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ না করা এবং তাঁর নে‘মতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং হঠকারিতা না করা।
ঙ. সর্বদা আল্লাহর অনুগত থাকা।