বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৩ অপরাহ্ন

ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বক্ষণে বিশেষ তিনটি আলামত

– আল-ইখলাছ ডেস্ক

(০১) দাজ্জালের আবির্ভাব

নাওয়াস ইবনু সাম‘আন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাজ্জালের আলোচনা করে বললেন, যদি তার আবির্ভাব হয় আর আমি তোমাদের মাঝে বিদ্যমান থাকি, তখন তোমাদের মধ্যে আমিই তার সাথে দলীল প্রমাণে বিজয়ী হব। আর যদি তার আবির্ভাব ঘটে আর আমি বিদ্যমান না থাকি, তখন তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি সরাসরি দলীল প্রমাণে তার মুকাবিলা করবে। তখন মুসলিমের জন্য আমার পরিবর্তে আল্লাহই হবেন সহায়ক। দাজ্জাল হবে একজন জওয়ান, মাথার চুল কোঁকড়ানো, ফোলা চক্ষু বিশিষ্ট। আমি তাকে ইহুদী আব্দুল উযযা ইবনু কাত্বানের সাথে তুলনা করতে পারি। সুতরাং যে কেউ তাকে পাবে, সে যেন তার সম্মুখে সূরা কাহফের প্রথমাংশ হতে পাঠ করে। কারণ এ আয়াতগুলো তোমাদেরকে দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদে রাখবে। সে সিরিয়া ও ইরাকের মধ্যবর্তী রাস্তা দিয়ে বের হবে এবং চলার পথে ডানে ও বামে এলাকাসমূহে ধ্বংসাত্মক ফাসাদ সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা ঈমান ও আক্বীদাসহ দ্বীনের উপর অটল থাক।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! সে কতদিন যমীনে অবস্থান করবে? তিনি বললেন, চল্লিশ দিন। তবে তখনকার প্রথম একদিন হবে এক বছরের সমান এবং দ্বিতীয় একদিন হবে এক মাসের সমান। আর তৃতীয় একদিন হবে এক সপ্তাহের সমান। আর অন্যান্য দিনগুলো হবে তোমাদের সাধারণ দিনের মত। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আচ্ছা বলুন তো! সেই একদিন যা একবছরের সমান হবে, সেদিন কি আমাদের পক্ষে এক দিনের ছালাতই যথেষ্ট হবে? তিনি বললেন, বরং সে দিনকে এক একদিন পরিমাণ হিসাব করে ছালাত আদায় করতে হবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তার যমীনে চলার গতি কী পরিমাণ দ্রুত হবে? তিনি বললেন, সেই মেঘের ন্যায় যার পিছনে প্রবল বায়ু থাকে। অতঃপর সে কোন এক সম্প্রদায়ের নিকট আসবে এবং তাদেরকে তার অনুসরণের আহ্বান করবে। অতঃপর লোকেরা তার প্রতি ঈমান আনবে। তখন সে আকাশকে নির্দেশ করবে। ফলে আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করবে। যমীনকে নির্দেশ করবে ফলে যমীন ঘাস, ফসলাদী উৎপাদন করবে। মানুষের গবাদি পশু সেই চারণ ভূমি হতে সন্ধ্যায় যখন ফিরবে, তখন উচ্চ কুঁজ বিশিষ্ট এবং স্তন ভর্তি অবস্থায় খেয়ে কোমর টান টান অবস্থায় ফিরবে।

অতঃপর দাজ্জাল অপর এক সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদের সামনে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবী করবে, কিন্তু তারা তার দাবী প্রত্যাখ্যান করবে। তখন সে তাদের নিকট হতে প্রত্যাবর্তন করবে। আর এই সম্প্রদায়ের লোকেরা মহা দুর্ভিক্ষে নিপতিত হবে। ফলে তাদের হাতে ধন সম্পদ কিছুই থাকবে না। তারপর দাজ্জাল একটি অনাবাদ জায়গা অতিক্রম করবে এবং তাকে লক্ষ্য করে বলবে, তোমার অভ্যন্তরে যে সমস্ত গুপ্ত সম্পদ আছে তা বের করে দাও। অতঃপর উক্ত ধন-সম্পদ এমনিভাবে তার পেছনে ছুটতে থাকবে, যেমনিভাবে মৌমাছির দল তাদের নেতার পেছনে ছুটে চলে। অতঃপর দাজ্জাল যৌবনে পরিপূর্ণ এক যুবককে তার আনুগত্যের প্রতি আহ্বান করবে, কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করবে, এতে দাজ্জাল তাকে তরবারীর আঘাতে দ্বি-খণ্ডিত করে ফেলবে এবং উভয় খণ্ডকে এত দূরে নিক্ষেপ করবে যে, একটি নিক্ষিপ্ত তীরের দূরত্ব পরিমাণ তার মধ্যে ব্যবধান হবে। অতঃপর সে উভয় খণ্ডকে নিজের দিকে ডাকবে, ফলে উক্ত যুবক জীবিত হয়ে তার সামনে ফিরে আসবে, তখন তার মুখমণ্ডল হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

(০২) ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর পুনরায় আগমন

দাজ্জাল যখন এ সমস্ত কাণ্ডেলিপ্ত, ঠিক এমন সময় আল্লাহ তা‘আলা হঠাৎ ঈসা ইবনু মারিয়ামকে আকাশ হতে প্রেরণ করবেন। তিনি দামেশকের পূর্ব প্রান্তের সাদা মিনার হতে হলুদ বর্ণের দু’টি কাপড় পরা অবস্থায় দু’জন ফেরেশতার পাখায় হাত রেখে অবতরণ করবেন। তিনি যখন মাথা নীচু করবেন, তখন ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরবে। আর যখন মাথা উঁচু করবেন, তখন উহা স্বচ্ছ মুক্তার ন্যায় ঝরতে থাকবে। তাঁর শ্বাস যে কাফেরকেই লাগবে সে কাফের সাথে সাথে মারা যাবে। আর তাঁর শ্বাস তাঁর দৃষ্টির প্রান্তঃসীমা পর্যন্ত পৌঁছবে। এ অবস্থায় তিনি দাজ্জালকে খোঁজ করতে থাকবেন। অবশেষে তিনি তাকে বায়তুল মাক্বদিসের ‘লুদ্দ’ দরজার কাছে পাবেন এবং তাকে হত্যা করবেন। অতঃপর এমন একটি সম্প্রদায় ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট আসবে, যাদেরকে আল্লাহ দাজ্জালের ফিতনা হতে নিরাপদে রেখেছিলেন। তিনি তাদের মুখমণ্ডলে হাত ফিরাবেন এবং তাদেরকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ দিবেন। এদিকে এ সমস্ত কাজে লিপ্ত থাকতেই আল্লাহ ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর নিকট এ সংবাদ পাঠাবেন যে, আমি আমার এমন কিছু বান্দাকে সৃষ্টি করে রেখেছি, যাদের সাথে মুকাবিলা করার শক্তি কারও নেই। অতএব তুমি আমার বান্দাদেরকে তূর পর্বতে নিয়ে হেফাযতে রাখ।

(০৩) ইয়াজূজ ও মাজূজের বহিঃপ্রকাশ

অতঃপর আল্লাহ ইয়াজূজ ও মাজূজ জাতিকে পাঠাবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু জায়গা হতে নীচে নেমে খুব দ্রুত বিচরণ করবে এবং তাদের একটি দল সিরিয়ার তাবারীয়া নামক একটি নদী অতিক্রম করবে এবং তারা ঐ নদীর সব পানি শেষ করে ফেলবে। পরে তাদের সর্বশেষ দল সে স্থান অতিক্রম করার সময় বলবে, হয়তো কোন এক সময় এখানে পানি ছিল। অতঃপর তারা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে ‘খামার’ নামক পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছবে। আর সে পাহাড় বায়তুল মাক্বদিসের নিকটে অবস্থিত। এখানে পৌঁছে তারা বলবে, যমীনে যারা বসবাস করত ইতিমধ্যে আমরা নিশ্চিত সবাইকে হত্যা করে ফেলেছি। এসো এবার আকাশবাসীকে হত্যা করব। এই বলে তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের তীরগুলোকে রক্তমাখা অবস্থায় তাদের প্রতি ফেরত দিবেন। এ সময় আল্লাহর নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সাথীগণকে তূর পর্বতে চরম দুরবস্থায় অবরোধ করা হবে।

এ সময় তারা ভীষণ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হবেন। এমনকি তাদের কারো জন্য গরুর মাথা এ যুগের একশ’ দিনার স্বর্ণ মুদ্রা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান হবে। এ চরম অবস্থায় আল্লাহর নবী ঈসা এবং তাঁর সঙ্গীগণ আল্লাহর দিকে ফিরে যাবেন এবং ইয়াজূজ ও মাজূজের ধ্বংসের জন্য দু‘আ করবেন। অতঃপর আল্লাহ তাদের গর্দানের উপর বিষাক্ত কীটের আযাব অবতীর্ণ করবেন। ফলে তারা মুহূর্তের মধ্যে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপর ঈসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সঙ্গীগণ পর্বত হতে নীচে যমীনে নেমে আসবেন। কিন্তু ইয়াজূজ ও মাজূজের মরদেহের চর্বি ও দুর্গন্ধ হতে মুক্ত এমন এক বিঘত যমীনও খালি পাবেন না। তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর সঙ্গীগণ উক্ত বিপদ হতে পরিত্রাণের আশায় আল্লাহর নিকট দু‘আ করবেন। তখন আল্লাহ বখতী উটের গর্দানের ন্যায় লম্বা লম্বা গর্দান বিশিষ্ট পাখির ঝাঁক প্রেরণ করবেন। পাখির দল তাদের মরদেহ সমূহকে তুলে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় কোন এক স্থানে নিক্ষেপ করবেন। অবশ্য অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, তাদেরকে ‘নহবল’ নামক স্থানে নিক্ষেপ করবে।

আর মুসলিমগণ তাদের ধনুক, তীর এবং তীর রাখার কোষ সমূহ সাত বছর যাবৎ লাকড়ি স্বরূপ জ্বালাতে থাকবে। তারপর আল্লাহ প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। যার কারণে জনবসতির যে কোন ঘর মাটির হোক কিংবা পশমের হোক ধুয়ে পরিষ্কার করে দিবে। অবশেষে তা আয়নার ন্যায় স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে। তারপর যমীনকে বলা হবে, তোমার ফলফলাদী বের করে দাও এবং তোমার কল্যাণ ও বরকত ফিরিয়ে আন। ফলে সে সময় একটা ডালিম এক জামা‘আত লোক পরিতৃপ্ত হয়ে খাবে এবং তার খোসা দ্বারা লোকেরা ছায়া গ্রহণ করবে। আর দুগ্ধের মধ্যে বরকত দান করা হবে। একটি উটনীর দুধ একদল লোকের যথেষ্ট হবে এবং একটি গাভীর দুধ এক গোত্রের মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে এবং একটি ছাগলের দুধ একটি পরিবারের লোকের জন্য যথেষ্ট হবে। মোটকথা লোকেরা সার্বিকভাবে সুখ-স্বাচ্ছন্দে জীবন-যাপন করতে থাকবে। এমন সময়ে হঠাৎ একদিন আল্লাহ এক মৃদু বাতাস প্রবাহিত করবেন। তা তাদের বগল স্পর্শ করবে এবং সে বাতাস প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের আত্মা বের করে নিবে। তারপর শুধু পাপী লোকেরাই অবশিষ্ট থাকবে। তারা গাধা বা পশু প্রাণীর ন্যায় লজ্জাহীনভাবে যেনায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। আর এসব লোকের উপরেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে।

তথ্যসূত্র : (ছহীহ মুসলিম, হা/২৯৩৭ ‘ফিতনা ও ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার শর্তসমূহ’ অধ্যায়; মিশকাত, হা/৫৪৭৫)।

শিক্ষা :

ক). উক্ত হাদীছে দাজ্জালের পরিচয় ফুটে উঠেছে। সুতরাং কোন জাতির সংস্কৃতি ও কালচারকে দাজ্জাল বলে চালিয়ে দেয়া উচিত নয়।
খ). ঈসা (আলাইহিস সালাম) জীবিত আছেন। তিনি দ্বিতীয় আসমানে অবস্থান করছেন। ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে পুনরায় তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উম্মত হিসাবে পৃথিবীতে আসবেন।
গ). বায়তুল মাক্বদিস ক্বিয়ামত পর্যন্ত মুসলিমদের অধিকারে এবং তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকবে। বর্তমানে ইহুদী-খ্রিষ্টানরা বায়তুল মাক্বদিস বা ফিলিস্তীন নিয়ে যে ষড়যন্ত্র করছে তা অচিরেই বন্ধ হবে এবং তারা বিতাড়িত হবে ইনশাআল্লাহ।
ঘ). ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত হক্বপন্থী একটি দল থাকবে, যারা হবেন চির বিজয়ী। তাদের উপর পাহাড়সম বা ততোধিক বিপদ আসলেও আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হেফাযত করবেন। বিদ্রোহীরা কখনোই তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।




মূসা ও খাযির (আলাইহিমাস সালাম)-এর কাহিনী - আল-ইখলাছ ডেস্ক
যিনাকারীর পরিণাম - আবূ মাহী
শিক্ষনীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১২তম পর্ব) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ই একমাত্র সুপারিশকারী - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১১তম পর্ব) - আল-ইখলাছ ডেস্ক

ফেসবুক পেজ