(ক) পরামর্শই সফলতার মাপকাঠি
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সিরিয়ার দিকে রওয়ানা করেছিলেন। শেষে তিনি যখন র্সাগ এলাকায় গেলেন, তখন তাঁর সঙ্গে সৈন্য বাহিনীর প্রধান আবূ ‘উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও তাঁর সঙ্গীগণ সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা তাঁকে জানালেন যে, সিরিয়া এলাকায় প্লেগের বিস্তার ঘটেছে। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমার নিকট প্রবীণ মুহাজিরদের ডেকে আন। তখন তিনি তাঁদের ডেকে আনলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সিরিয়ার প্লেগের বিস্তার ঘটার কথা জানিয়ে তাঁদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তখন তাঁদের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হল। কেউ বললেন, আপনি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বের হয়েছেন। সুতরাং তা থেকে প্রত্যাবর্তন করা আমরা পসন্দ করছি না।
আবার কেউ কেউ বললেন, বাকী লোক এবং রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছাহাবীগণ আপনার সঙ্গে রয়েছেন। কাজেই আমরা সঠিক মনে করি না যে, আপনি তাদেরকে এই প্লেগের মধ্যে ঠেলে দিবেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমরা আমার নিকট থেকে চলে যাও। এরপর তিনি বললেন, আমার নিকট আনছারদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম। তিনি তাদের কাছে পরামর্শ চাইলে তাঁরাও মুহাজিরদের পথ অবলম্বন করলেন এবং তাঁদের মতই মতপার্থক্য করলেন। ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, তোমরা উঠে যাও। এরপর আমাকে বললেন, এখানে যে সকল বয়োজ্যেষ্ঠ কুরাইশী আছেন, যাঁরা মক্কা বিজয়ের বছরে হিজরত করেছিলেন, তাদের ডেকে আন। আমি তাদের ডেকে আনলাম, তখন তারা পরস্পরে মতভেদ করলেন না। তাঁরা বললেন, আপনার লোকজনকে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করা এবং তাঁদের প্লেগের মধ্যে ঠেলে না দেয়াই আমরা ভাল মনে করি। তখন ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) লোকজনের মধ্যে ঘোষণা দিলেন যে, আমি ভোরে সাওয়ারীর পিঠে আরোহণ করব (ফিরার জন্য)। অতএব তোমরাও সকালে সওয়ারীর পিঠে আরোহণ করবে।
আবূ ‘উবাইদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন? ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আবূ ‘উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলত! হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেকটি তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি। তুমি বলতো, তোমার কিছু উটকে যদি তুমি এমন কোন উপত্যকায় নিয়ে যাও, যেখানে আছে দু’টি মাঠ। তন্মধ্যে একটি হল সবুজ শ্যামল, আর অন্যটি হল শুষ্ক ও ধূসর। এবার বল ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ মাঠে চরাও, তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তাহলে তাও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ীই চরিয়েছ। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় ‘আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আসলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তাঁর কোন প্রয়োজনের কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার নিকট একটি তথ্য আছে, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোন এলাকায় (প্লেগের) বিস্তারের কথা শুনতে পাবে, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোন এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে এবং তোমরা সেখানে থাক, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আল্লাহর প্রশংসা করলেন, তারপর প্রত্যাবর্তন করলেন (ছহীহ বুখারী, হা/৫৭২৯ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়-৭৬, ‘প্লেগ রোগ সম্পর্কে’ অনুচ্ছেদ-৩০)।
(খ) বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ
ইমরান ইবনু হুছাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, বদ-নযর কিংবা বিষাক্ত দংশন ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে ঝাড়ফুঁক নেই। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর এ হাদীছ আমি সাঈদ ইবনু যুবায়র (রাহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে উল্লেখ করলে তিনি বললেন, আমাদের নিকট ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আমার সামনে সকল উম্মতকে পেশ করা হয়েছিল। (তখন আমি দেখেছি) দু’একজন নবী পথ চলতে লাগলেন এমতাবস্থায় যে, তাঁদের সঙ্গে একজনও নেই। অবশেষে আমার সামনে তুলে ধরা হল বিশাল দল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী? এ কি আমার উম্মত? উত্তর দেয়া হল, না, ইনি মূসা (আলাইহিস সালাম) এবং তাঁর কওম।
আমাকে বলা হল, আপনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকান। তখন দেখলাম, বিশাল একটি দল, যা দিগন্তকে ঢেকে রেখেছে। তারপর আমাকে বলা হল, আকাশের দিগন্তসমূহ ঢেকে দিয়েছে এমন একটি বিশাল দলের প্রতি লক্ষ্য করুন। তখন বলা হল, এরা হল আপনার উম্মত। আর তাদের মধ্য থেকে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারপর নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে চলে গেলেন। উপস্থিতদের কাছে কথাটির কোন ব্যাখ্যা প্রদান করলেন না। ফলে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হল। তাঁরা বলল, আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি এবং তাঁর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অনুসরণ করে থাকি।
সুতরাং আমরাই তাদের অন্তর্ভুক্ত কিংবা তারা হল আমাদের সে সকল সন্তান-সন্ততি, যারা ইসলামের যুগে জন্মগ্রহণ করেছে। আর আমাদের জন্ম হয়েছে জাহিলী যুগে। নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছালে তিনি বেরিয়ে আসলেন এবং বললেন, তারা হল সে সব লোক, যারা মন্ত্র পাঠ করে না, পাখির মাধ্যমে কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ণয় করে না এবং আগুনের সাহায্যে দাগ লাগায় না। বরং তারা তো তাদের রবের উপরই ভরসা করে থাকে। তখন উক্কাশা ইবনু মিহছান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তাদের মধ্যে কি আমি আছি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন আরেকজন দাঁড়িয়ে বলল, তাদের মধ্যে কি আমিও আছি? তিনি বললেন, ‘উক্কাশা এ সুযোগ তোমার আগেই নিয়ে নিয়েছে (ছহীহ বুখারী, হা/৫৭০৫ ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়-৭৬, অনুচ্ছেদ-১৭)।
শিক্ষা
ক. সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা।
খ. পারস্পরিক তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাগ করা এবং কুরআন-সুন্নাহর নিকট আত্মসমর্পণ করা।
গ. কুফরী মন্ত্র পাঠ না করা, পাখির মাধ্যমে কোন কাজের ভাল-মন্দ নির্ণয় না করা এবং আগুনের সাহায্যে দাগ না লাগানো।
ঘ. সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং সকল কাজে প্রথমেই অবদান রাখার চেষ্টা করা।