কা‘ব ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর তাওবাহ
- মূল: ফাউযিয়া বিনতে মুহাম্মাদ আল-ঊক্বাইলী
- অনুবাদ: হাফীযুর রহমান বিন দিলজার হোসাইন*
আব্দুল্লাহ ইবনু কা‘ব ইবনু মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, কা‘ব ইবনু মালিকের পুত্রদের মধ্যে আব্দুল্লাহ তাঁর পিতা কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর সাহায্যকারী ও পথপ্রদর্শনকারী ছিলেন। আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমি কা‘ব ইবনু মালিককে তাঁর তাবূক যুদ্ধে পেছনে থেকে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করতে শুনেছি’। কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যতগুলো যুদ্ধ করেছেন, তার মধ্যে তাবূক যুদ্ধ ব্যতীত আমি আর কোন যুদ্ধ থেকে পেছনে থাকিনি। তবে আমি বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করিনি। তবে বদর যুদ্ধে যারা পেছনে থেকে গিয়েছিলেন, তাদের কাউকে তিনি ভর্ৎসনা করেননি। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শুধু একটি কুরাইশ কাফেলার সন্ধানে বের হয়েছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের ও শত্রুদের মাঝে অঘোষিত এ যুদ্ধ সংঘটিত করেন। আর আকাবার রাতে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি তখন ইসলামের উপর দৃঢ়ভাবে কায়েম থাকার জন্য আমাদের কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করেন। তাই আমি আকাবার বায়‘আতের চেয়ে বদরের যুদ্ধকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম না। যদিও মানুষের মাঝে আকাবার ঘটনা অপেক্ষা বদর যুদ্ধ অধিক প্রসিদ্ধ ছিল। যাইহোক আমার ঘটনা এই যে, আমি যখন তাবূকের যুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলাম, সে সময়ের চেয়ে অন্য কোন সময়েই আমি অধিক শক্তিশালী ও সচ্ছল ছিলাম না। আল্লাহ্র কসম! ইতিপূর্বে আমার কাছে কখনো একসাথে দু’টো সওয়ারী ছিল না। অথচ এ যুদ্ধের সময় (যুদ্ধের পূর্বে) আমি তা সংগ্রহ করেছিলাম। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখনই কোন যুদ্ধর ইচ্ছা করতেন, তখন (যাতে শত্রুরা বুঝতে না পারে) সেজন্য বিপরীত পন্থা অবলম্বন করতেন। কিন্তু এ যুদ্ধের সময় যখন আসল, তখন ছিল ভীষণ গরম। পথ ছিল দীর্ঘ এবং স্থান ছিল বিশাল মরুভূমি। আর শত্রু সংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। কাজেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যেদিকে যাত্রা করবেন, তা বলে দিলেন। যাতে তারা তাদের যুদ্ধের সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তখন তার সাথে বিপুলসংখ্যক মুসলিম ছিলেন। তবে তাদের নাম কোন রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ ছিল না।*
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ফলে যদি কেউ যুদ্ধে না যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করত, তাহলে সহজেই তা করতে পারত, যতক্ষণ না তার বিষয়ে অহি নাযিল হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন এক সময় এ অভিযান শুরু করেছিলেন, যখন ফলমূল পাকার ও গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়ার সময় ছিল। রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাথে সকল মুসলিম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমিও প্রত্যহ সকালে তাঁদের সাথে যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহণ করতে থাকি। কিন্তু ফিরে এসে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। শুধু মনে মনে বলতাম, ‘আমি তো যে কোন সময় প্রস্তুত হওয়ার ক্ষমতা রাখি। এভাবে দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে আমার সময় কেটে যেতে লাগল। পক্ষান্তরে লোকেরা পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল।
একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমদের নিয়ে রওয়ানা দিলেন। অথচ তখনো আমি কোন প্রকার প্রস্তুতি নেইনি। মনে মনে ভাবলাম, ‘দু’এক দিন পরে প্রস্তুতি নিয়েও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হতে পারব’। তারা চলে যাওয়ার পর একদা আমি মসজিদে গেলাম এবং প্রস্তুতি নেয়ার পরিকল্পনা করলাম কিন্তু সিদ্ধান্তহীনভাবে ফিরে আসলাম। পরদিন সকালে যাওয়ার নিয়ত করলাম, কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত না নিয়েই ফিরে আসলাম। আমার এ দোদুল্যমানতার মাঝে মুসলিম সেনারা দ্রুত চলছিলেন এবং বহুদূর চলে গেলেন। আর আমি রওনা দিয়ে তাঁদের ধরে ফেলার ইচ্ছা পোষণ করতে থাকলাম। আফসোস! আমি যদি এমটি করে ফেলতাম (তাহলে ভালই হত)! কিন্তু তা আমার ভাগ্যে ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চলে যাওয়ার পর আমি যখন বাইরে বের হতাম, তখন পথে-ঘাটে মুনাফিক্বদেরকে অথবা দুর্বল হওয়ার কারণে আল্লাহ যাদেরকে অক্ষম করে দিয়েছিলেন, তাদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পেতাম না। আর এটা আমাকে চিন্তান্বিত করে তুলত।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাবূকে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন না, তবে তাবূকে পৌঁছে যখন তিনি সবাইকে নিয়ে বসলেন, তখন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কা‘বের কী হল? বনী সালামার একজন ব্যক্তি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! তাঁর বসন-ভূষণ ও অহংকারই তাঁকে বাধা দিয়েছে’। মু‘আয ইবনু জাবাল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘তুমি নিতান্তই বাজে কথা বললে। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা তাঁর ব্যাপারে ভাল বৈ আর কিছুই জানি না’। এতদশ্রবণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চুপ থাকলেন।
কা‘ব ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে অবহিত হলাম, তখন আমি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম, কোন মিথ্যা তালবাহানা করা যায় কি-না? যার মাধ্যমে আগামীকাল আমি তাঁর ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারি। এ ব্যাপারে পরিবারের কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তির পরামর্শও চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন বলা হল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় একেবারে নিকটে এসে পৌঁছে গেছেন, তখন আমার মন থেকে বাতিল ধ্যান-ধারণা বিদূরিত হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, তাঁর নিকট মিথ্যা বলে আমি মুক্তি পাব না। সুতরাং সত্য বলার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী হলাম।
সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মদীনায় পৌঁছে গেলেন। আর তাঁর নিয়ম ছিল যখনই তিনি সফর থেকে ফিরে আসতেন, প্রথমে মসজিদে যেতেন এবং সেখানে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। তারপর লোকদের জন্য সাক্ষাৎ করার জন্য বসে যেতেন। যখন তিনি ছালাত শেষ করে (মসজিদে নববীতে) বসে গেলেন, তখন তাবূক যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে থাকা লোকেরা আসতে লাগল। তাঁরা হলফ (শপথ) করে নিজেদের ওযর পেশ করতে লাগল। এদের সংখ্যা ছিল আশির ঊর্ধ্বে। বাহ্যিক অবস্থার বিচারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের ওযর কবুল করতঃ তাদের কাছ থেকে পুনরায় বাই‘আত নিয়ে তাদের মাগফিরাতের জন্য দু‘আ করলেন এবং তাদের মনের গোপন বিষয়ে আল্লাহ্র নিকট সোপর্দ করলেন।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমিও আসলাম তাঁর কাছে। আমি সালাম দিতেই তিনি বিরাগমিশ্রিত মুসকি হেসে বললেন, ‘এস এস’। আমি গিয়ে তাঁর সামনে বসে পড়লাম। অতঃপর তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী কারণে তুমি পিছনে পড়ে থাকলে? তুমি কি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাহন ক্রয় করনি’? আমি বললাম হ্যাঁ, ক্রয় করেছি’। আরো বললাম, ‘আল্লাহর কসম! যদি আমি আপনার সামনে না বসে দুনিয়ার অন্য কোন লোকের সামনে বসতাম, তাহলে আমি সুনিশ্চিত যে, যে কোন ওযর পেশ করে তাঁর ক্রোধকে নির্বাপিত করতে পারতাম। আর আমি তর্কে পটু। কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি জানি আজ যদি আপনার কাছে মিথ্যা বলে আপনাকে খুশি করে যাই, তাহলে অচিরেই আল্লাহ আপনাকে আমার উপর ক্রুদ্ধ করে দিবেন। আর যদি আজ আপনার সাথে সত্য কথা বলে যাই, তাতে আপনি নাখোশ হলেও আল্লাহর ক্ষমা লাভের আশা করা যায়। আল্লাহ্র কসম! আমার কোন ওযর ছিল না। আল্লাহ্র কসম! আমি যখন (অর্থাৎ তাবূক যুদ্ধে) আপনাদের থেকে পিছনে থেকে যাই, তখনকার মত আর কোন সময় আমি ততটা শক্তি-সামর্থ্যরে ও সচ্ছলতার অধিকারী ছিলাম না’। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘যদি আসলে এরূপ হয়, তবে কা‘ব সত্য বলেছে। ঠিক আছে, চলে যাও, দেখ আল্লাহ তোমার ব্যাপারে কী ফায়ছালা দেন’।
আমি উঠে পড়লাম। বনী সালামার কিছু লোক আমাকে অনুসরণ করতে লাগল। তারা আমাকে বলল, আল্লাহর কসম! ইতিপূর্বে তুমি কোন পাপ করেছ বলে তো আমরা জানি না। পেছনে থেকে যাওয়া অন্যান্য লোকদের মত তুমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট একটি বাহানা পেশ করতে পারলে না? তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ক্ষমা প্রার্থনাই তোমার পাপ মোচনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত। তারা আমাকে এমনভাবে তিরস্কার করতে লাগল যে, একপর্যায়ে আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে ফিরে গিয়ে আমার প্রথম কথাটিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার মনস্থ করলাম। অতঃপর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা আমার মত নিজের ভুল স্বীকার করেছে এমন আর কাউকেও কি তোমরা সেখানে দেখেছ’? তারা জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আরো দু’জন লোককে আমরা দেখেছি, যারা তোমার মত একই কথা বলেছেন। আর তাদেরকেও তোমার মত সেই একই কথা বলা হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? লোকেরা জবাব দিল, তারা দু’জন হচ্ছেন মুরারাহ ইবনু রাবী‘ আল-‘আমরী এবং হিলাল ইবনু উমাইয়া আল-ওয়ারিফী। তারা আমার কাছে এমন দু’জন সৎ লোকের কথা বললেন, যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং আদর্শস্থানীয় ছিলেন। তাঁদের দু’জনের কথা শুনে আমি চলতে শুরু করলাম।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পেছনে থেকে যাওয়া লোকদের মধ্য থেকে আমাদের এ তিনজনের সাথে কথা বলা সমস্ত মুসলিমের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছেন। কাজেই লোকেরা আমাদেরকে এড়িয়ে চলতে লাগল এবং আমাদের প্রতি তাদের আচরণ পরিবর্তন করে ফেলল। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে লাগল যে, চিরচেনা দুনিয়া যেন অচেনা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আমরা ৫০ রাত অতিবাহিত করলাম। আমরা সাথীদ্বয় নীরব হয়ে ঘরের মধ্যে বসে গেলেন এবং কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তবে আমি ছিলাম খুব শক্তিশালী এবং ধৈর্যশীল যুবক। তাই আমি বাইরে বের হয়ে মুসলিমদের সাথে ছালাতে যোগ দিতাম এবং বাজারে ঘুরাফিরা করতাম। কিন্তু কেউ আমার সাথে কথা বলত না। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে আসতাম। তিনি যখন ছালাতের পর মজলিসে বসতেন, আমি তাঁকে সালাম দিতাম। আমি মনে মনে বলতাম, আমার সালামের জবাবে তাঁর ঠোট নড়ল, কি নড়ল না? তারপর আমি তাঁর সন্নিকটে ছালাত আদায় করতাম। আমি আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁকে দেখতাম। কাজেই দেখতে পেতাম যে, যখন আমি ছালাতে মশগূল থাকি, তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আবার আমি যখন তাঁর দিকে দৃষ্টি দিতাম, তখন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিতেন। এভাবে আমার প্রতি লোকদের কঠোরতা ও এড়িয়ে চলা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকল।
একদিন আমার চাচাত ভাই আবূ ক্বাতাদাহ্র বাগানের প্রাচীর টপকে তার কাছে আসলাম। সে ছিল আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের জবাব দিল না। আমি তাকে বললাম, হে আবূ ক্বাতাদাহ! আল্লাহর দোহায় দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি জান না, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসি? সে চুপ করে থাকল। আমি আবার আল্লাহর নামে কসম করে তাকে এ প্রশ্ন করলাম। এবার সে জবাব দিল, ‘(এ ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন’। (এতদশ্রবণে) আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। অতঃপর প্রাচীর টপকে পুনরায় ফিরে এলাম।
কা‘ব (ﷺ) বলেন, ইত্যবসরে একদিন আমি মদীনার বাজারে হাঁটছিলাম। সিরিয়ার একজন খ্রিস্টান কৃষক মদীনার বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে এসেছিল। সে লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করছিল, কে আমাকে কা‘ব ইবনু মালিকের ঠিকানা বলে দিতে পারে? তখন লোকেরা তাকে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। সে আমার কাছে এসে গাস্সানের রাজার একটি চিঠি আমার হাতে অর্পণ করল। তাতে লেখা ছিল, ‘পর সমাচার এই যে, আমি জানতে পেরেছি আপনার সাথী আপনার উপর যুল্ম করেছেন। অথচ আল্লাহ আপনার লাঞ্ছনা ও অবমাননাকর অবস্থায় রাখেননি। আপনি আমাদের এখানে চলে আসুন। আমরা আপনাকে সাহায্য-সহযোগিতা করব’। চিঠিটা পড়ে আমি বললাম, এটাও একটি পরীক্ষা। কাজেই আমি চুলা খুঁজে চিঠিটা আগুনে জ¦ালিয়ে দিলাম।
এভাবে ৫০ দিনের মধ্যে ৪০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এমন সময় আমার কাছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একজন দূত এসে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমাকে তোমার স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি বললাম, আমি কি তাকে ত্বালাক্ব দিব, না কী করব? তিনি বললেন, না, ত্বালাক্ব দিবে না। বরং তার থেকে পৃথক থাকবে এবং তার কাছে ঘেঁষবে না। আমার অন্য দু’জন সাথীর কাছেও এ মর্মে দূত পাঠানো হল। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি তোমার পরিবারের কাছে চলে যাও। আর আল্লাহ আমার এ ব্যাপারে কোন ফায়ছালা না দেয়া পর্যন্ত তাদের সাথে অবস্থান কর।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, হিলাল ইবন উমাইয়ার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! হিলাল ইবনু উমাইয়া অতিশয় বৃদ্ধ। তার কোন সেবক নেই। যদি আমি তার সেবা করি, তবে কি আপনি অপসন্দ করবেন? তিনি জবাব দিলেন, না, তবে সে যেন তোমার কাছে না ঘেঁষে। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! তার মধ্যে এ কাজের প্রতি উৎসাহবোধ-ই নেই। আল্লাহর কসম! যেদিন থেকে এ ঘটনা ঘটেছে সেদিন থেকে অদ্যবধি সে কাঁদছে।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমাকেও আমার পরিবারের কেউ কেউ বলল, তুমিও তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট থেকে অনুমতি নিয়ে এস, যাতে সে তোমার সেবা করতে পারে, যেমন হিলাল ইবনু উমাইয়ার স্ত্রী তার স্বামীর সেবা করার ব্যাপারে অনুমতি নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, আল্লাহ্র কসম! আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অনুমতি আনতে যাব না। জানি না যখন আমি এ ব্যাপারে অনুমতি চাইব, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কী বলবেন! কারণ আমি একজন যুবক। এভাবে আরো ১০ দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদের সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ করে দেয়ার পর পঞ্চাশতম রাত্রিটিও অতিক্রম করল। ঐদিন সকালে ফজরের ছালাত আদায় করলাম এবং আমাদের এক ঘরের ছাদে বসেছিলাম, যে অবস্থার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করেছেন। মনে হচ্ছিল, জীবন ধারণ আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে এবং পৃথিবী যেন তার সমস্ত বিস্তীর্ণতা সত্ত্বেও আমার জন্য অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এমন সময় আমি সাল‘ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পর্বতের উপর উচ্চৈঃস্বরে চীৎকারকারী একজনের শব্দ শুনতে পেলাম। সে চীৎকার করে বলছে, হে কা‘ব ইবনু মালিক! সুসংবাদ গ্রহণ কর!
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি আল্লাহ্র দরবারে সিজদায় পড়ে গেলাম। আমি অনুধাবন করতে পারলাম যে, এবার সংকট কেটে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফজরের ছালাতের পর ঘোষণা করে দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ আমাদের তওবা কবুল করেছেন। কাজেই লোকেরা আমার ও আমার অপর দু’জন সাথীর নিকট সুসংবাদ দেয়ার জন্য আসতে লাগল। একজন তো ঘোড়ায় চড়ে এক দৌড়ে আমার নিকট আসলেন এবং আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি দৌড়ে পাহাড়ে উঠলেন। তার কথা অশ্বারোহীর চেয়েও দ্রুততর হল। যার শব্দ আমি শুনেছিলাম সে যখন আমার নিকট সুসংবাদ প্রদান করতে আসল, তখন সুসংবাদ দেয়ার প্রতিদান স্বরূপ আমার পোশাক জোড়া খুলে তাকে পরিয়ে দিলাম। আল্লাহ্র কসম! তখন আমার নিকট ঐ পোশাক জোড়া ব্যতীত আর কোন কাপড় ছিল না। তারপর আমি এক জোড়া পোশাক ধার করে নিলাম এবং তা পরিধান করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সাক্ষাতের নিমিত্তে বের হলাম। পথে দলে দলে লোকজন সাথে সাক্ষাৎ করছিল এবং তওবা কবুল হওয়ার জন্য তারা আমাকে মুবারকবাদ জানাচ্ছিল। তারা বলছিল, তোমার তওবা কবুল করে আল্লাহ তোমাকে যে পুরস্কৃত করেছেন, এজন্য তোমাকে মুবারকবাদ। কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, এভাবে আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। সেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লোকজন পরিবেষ্টিত হয়ে বসেছিলেন। ত্বালহা ইবনু ওবাইদুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে দেখে দৌড়ে এসে মুছাফাহা করলেন এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। আল্লাহর কসম! মুহাজিরদের মধ্য থেকে সে ব্যতীত অন্য কেউ এভাবে এসে আমাকে ধন্যবাদ জানায়নি। আমি কোনদিন তাঁর অনুগ্রহ ভুলব না।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তারপর আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সালাম দিলাম। তখন খুশীতে তাঁর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (হে কা‘ব)! তোমার মা তোমাকে জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত অতিক্রান্ত দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভাল দিনের সুসংবাদ গ্রহণ কর! কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহ্র পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, না, এ তো আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন খুশী হতেন, তখন তাঁর চেহারা এক ফালি চাঁদের মত উজ্জ্বল হয়ে উঠত। আমরা চেহারা দেখে তা খুশী বুঝতে পারলাম। তারপর আমি তাঁর সামনে বসে বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! আমার তওবা কবুলের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সমস্ত ধন-সম্পদ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর পথে ছাদাক্বা করে দিতে চাই। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, তোমার সম্পদের কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে দাও। তাতে তোমার কল্যাণ হবে। আমি বললাম, তাহলে আমি শুধু খায়বারের অংশটুকুই আমার জন্য রাখলাম। তারপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আল্লাহ এবার সত্য কথা বলার কারণে আমাকে মুক্তি দিয়েছেন। কাজেই আমার এ তওবা কবুল হওয়ার কারণে আমি জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে সত্য কথাই বলতে থাকব। আল্লাহ্র কসম! আমি জানি না, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট সত্য কথা বলার কারণে সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ আমার প্রতি যে মেহেরবানী করেছেন, তেমনটি আর কোন মুসলিমের উপর করেছেন কি-না। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে যেদিন থেকে এ কথা বলেছি, সেদিন থেকে সজ্ঞানে মিথ্যা কথা বলিনি। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ আমাকে মিথ্যা থেকে বাঁচাবেন বলে আশা করি।
আর আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করেছেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহপরায়ণ হলেন নবীব প্রতি এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রতি যারা তাঁর অনুসরণ করেছিল সংকটকালে-এমনকি যখন তাদের এ দলের চিত্ত-বৈকল্যের উপক্রম হয়েছিল। পরে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি তো তাদের প্রতি দয়ার্দ্র, পরাম দয়ালু’। এবং তিনি ক্ষমা করলেন অপর তিনজনকেও, যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল, যে পর্যন্ত না পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য তা সংকুচিত হয়েছিল এবং জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়েছিল এবং তারা উপলব্ধি করেছিল যা, আল্লাহ ব্যতীত কোন আশ্রয়স্থল নেই, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন ব্যতীত, পরে তিনি তাদের তওবা কবুল করলেন যাতে তারা তওবায় স্থির থাকে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’। হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও’ (সূরা আত-তওবাহ: ১১৭-১১৯)।
আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহণ করার পর এর চাইতে উৎকৃষ্ট আর কোন অনুগ্রহ আল্লাহ আমার উপর করেননি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে সত্য বলার তাওফীক্ব দান করে আমাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। অন্যথা অন্য মিথ্যাবাদীদের মত আমিও ধ্বংস হয়ে যেতাম। কারণ অহি যখন নাযিল হচ্ছিল (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবদ্দশায়), সে সময় যারা মিথ্যা বলেছিল তাদের সম্পর্কে আল্লাহ যে মারাত্মক কথা বলেছিলেন, তা আর কারো সম্পর্কে বলেননি।
মহান আল্লাহ বলেছিলেন, ‘তোমরা তাদের নিকট ফিরে আসলে অচিরেই তারা আল্লাহ্র শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের উপেক্ষা কর। সুতরাং তোমরা তাদেরকে উপেক্ষা করবে। তারা অপবিত্র এবং তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ জাহান্নাম তাদের আবাস্থল’। তারা তোমাদের নিকট শপথ করবে যাতে তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও। তোমরা তাদের প্রতি তুষ্ট হলেও আল্লাহ তো সত্যত্যাগী সম্প্রদায়ের প্রতি তুষ্ট হবেন না’ (সূরা আত-তওবা: ৯৫-৯৬)।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আর আমরা তিনজন সেসব লোকদের থেকে আলাদা, যারা তাদের যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট মিথ্যা শপথ করেছিল এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের কথা মেনে নিয়ে তাদেরকে বাই‘আত করিয়েছিলেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন (আল্লাহ্র উপর)। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ যে ব্যাপারে ফায়ছালা দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, وَّ عَلَی الثَّلٰثَۃِ الَّذِیۡنَ خُلِّفُوۡا ‘সেই তিনজন, যারা পেছনে থেকে গিয়েছিল’ (সূরা আত-তওবা: ১১৮)। (অর্থাৎ আল্লাহ তাদেরকে মাফ করে দিয়েছিলেন)। যারা জেনে বুঝে জিহাদ থেকে পেছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের কথা এখানে বলা হয়নি। বরং এখানে কেবল আমাদের (তিনজনের) কথা বলা হয়েছিল। আর যারা হলফ করেছিল ও ওযর পেশ করেছিল এবং তাদের ওযর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গ্রহণ করেছিলেন তাদের থেকে আমাদের ব্যাপারে ফায়ছালাটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল’।[১]
শিক্ষনীয় বিষয়
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর আনুগত্যে অবহেলা সম্পর্কে ব্যক্তিকে জানানো জায়েয এবং এই অবহেলার কারণে এই ব্যক্তিকে ত্যাগ করা, তিরস্কার করা ও তিব্র নিন্দা করা বৈধ। এটা তার কর্মের প্রতিফল যা তাকে সংকীর্ণ করে দেয়। আর এই বিশাল পৃথিবী তার জন্য সংকীর্ণ হয়ে যায়। আর এই অবহেলার উল্লেখ্য-এর মধ্যে মুসলিমের জন্য নছীহাত রয়েছে, যাতে মুসলিম ব্যক্তি এই ধরণের অপরাধকে ঘৃণা করতে পারে। আর এর মাধ্যমে শান্ত¦না লাভ করতে পারে এবং অপরাধ পরিত্যাগ করতে ও পাপ কাজ ছেড়ে দিতে পারে। কারণ এর মন্দ প্রভাব ও হীনকর ফলাফল রয়েছে। অতএব বৃদ্ধিমান তিনিই যিনি অন্যের দ্বারা শিক্ষা লাভ করেন।
২. গুপ্তচর ব্যক্তির ব্যাপারে সতর্কীকরণ এবং কল্যাণের স্বার্থে প্রজাদের কিছু বিষয় গোপন করা প্রয়োজন।
৩. বিলম্বিতকরণের ভয়াবহতা এমন যে, তা বাস্তব দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের ক্ষতি স্বাধন করে। ইবনুল জাওযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, إياك والتسويف فإنه أعطم جنود إبليس ‘বিলম্বিতকরণ থেকে বেঁচে থাক, কেননা তা শয়তানের বড় সৈন্য বাহিনী’।
আবূ হামেদ গায্যালী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বিলম্বিতকরণ চারটি বিষয় সৃষ্টি করে। যথা: (ক) আনুগত্য ছেড়ে দেয়া এবং আনুগত্যে অলসতা করা। (খ) তওবা পরিত্যাগ করা এবং এতে বিলম্বিত করা। (গ) দুনিয়ার প্রতি উদ্ভুদ্ধ হওয়া এবং দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং (ঘ) হৃদয়ের কঠোরতা এবং আখেরাত ভুলে যাওয়া।
৪. অবহেলার কারণে যা ছুটে গেছে তার জন্য লজ্জিত হওয়া এবং এই লজ্জিত হওয়া আনুগত্যের জন্য চিন্তাকে প্রতিহত করে। যাতে ছুটে যাওয়া বিষয় অনুধাবন করতে পারে। এই জন্য কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘আমি প্রস্থান করার চিন্তা করলাম যে, আমিও রওনা হয়ে তাদের সাথে একত্রিত হয়ে যাব। হায় আফসোস! আমি যদি তা করতাম’।
৫. মুসলিমদের সম্মান রক্ষা করার প্রতি গুরুত্ব দেয়া। যেমন, কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সমালোচনাকারীকে মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) প্রতিবাদ দিয়েছিলেন। তাকে তাঁর ধন-সম্পদ ও অহংকার আসতে দেয়নি। এর উত্তরে মু‘আয (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তুমি যা বলছ তা ঠিক নয়। আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমরা তাঁকে উত্তম বলে জানি। প্রত্যেক সমালোচনাকারী যদি তাঁর পক্ষে লোক পেত তাহলে অনেক উদ্ভট কথা ছড়িয়ে পড়ত। আল্লাহ মুসলিমদের সম্মান রক্ষা করুন।
৬. মুমিনদের অন্যতম গুণ হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা এবং মুমিনদের মিত্র ও কাফেরদের ঘৃণা করা। তাই কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং আবূ ক্বাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-এর মাঝে ভ্রাতৃত্য ও ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর জন্য আবূ ক্বাতাদাহ কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে কথা বলেননি। বরং তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বক্তব্য, তিনি বলেন, ‘একদিন আমার চাচাত ভাই আবূ ক্বাতাদার বাগানের প্রাচীর টপকে তার কাছে আসলাম। সে ছিল আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। আমি তাকে সালাম দিলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম! সে আমার সালামের জবাব দিল না। আমি তাকে বললাম, হে আবূ ক্বাতাদাহ! আল্লাহর দোহায় দিয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি কি জান না, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে ভালোবাসি? সে চুপ করে থাকল। আমি আবার আল্লাহর নামে কসম করে তাকে এ প্রশ্ন করলাম। এবার সে জবাব দিল, ‘(এ ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)ই ভাল জানেন’।
৭. বিপদাপদে মুমিনের উপর ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট ধৈর্যধারণ করার সাহায্য কামনা কর মুমিনের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর পরীক্ষা দুঃখের সময়েও হয়। কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট এই বিপদের সময় গাসসান এর অধিপতির চিঠি এসেছিল, যা আরেকটি পরীক্ষা। যেমন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন, এই দ্বীনের উপর অটল থাকা এটি একটি বড় কারণ। যেমন তিনি বলেন, আমি চিঠিটি আগুনে পুড়িয়ে দিলাম।
৮. যে কোন পাপই হোক তা খুবই বড় ও ঘৃণিত। ইবনু হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাসান বাছরী (রাহিমাহুল্লাহ) সতর্ক করেছেন এই বিষয়ে। ইবনু আবূ হাতেম (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, সুবহানাল্ল-হ! এ তিনজন ছাহাবী কোন হারাম সম্পদ ভক্ষণ করেননি এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করেননি। তার পরেও তাঁরা এই পরীক্ষায় পতিত হয়েছেন। পৃথিবী তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়েছে। তাহলে সে ব্যক্তির ক্যী হবে? যে ফাহেসা কাজে লিপ্ত হয়, কাবীরা গুনাহ করে। আল্লাহু আকবার! এটা কতই না বড় উপদেশ এ ব্যক্তির জন্য যার অন্তর রয়েছে।
৯. দ্বীনের প্রতি শক্তিশালী ব্যক্তি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন দ্বীনের প্রতি দুর্বল ব্যক্তির চেয়ে। তুমি লক্ষ্য কর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে পিছনে থাকা ছাহাবীদের দিকে। তিনি ছাহাবীগণ কারো সাথে কথা বলতে নিষেধ করেননি এই তিন জন ব্যতীত। যখন তাঁরা তাঁদের ঈমানের মাধ্যমে ধৈর্যধারণ করলেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন তখন তাঁরা আরও বেশি আল্লাহভীরু হলেন।
১০. বাহ্যিক দিক বিবেচনা করে বিধান প্রয়োগ করতে হবে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দিতে হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুনাফিক্বদের মিথ্যা জানার পরেও তাদের বাহ্যিক ওযর গ্রহণ করেছেন এবং তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ আমরা মানুষের অন্তর ফেড়ে দেখার নির্দেশ পায়নি।
১১. মুসলিমদের মাঝে ভালোবাসার ভিত্তি হল অপর মুসলিমদের আনন্দে খুশি হওয়া। বরং বান্দার আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। যা এক মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে চলাফেরা, ওঠাবসা করার মাধ্যমে অর্জন করে। যেমন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমি চিৎকারকারীর চিৎকার শুনতে পেলাম সে সালা‘ পর্বতের চুঁড়ায় উঠে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকারে বলছে, ‘হে কা‘ব ইবনু মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর’।
১২. আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া আল্লাহর রহমত থেকে দূরে থাকার একটি বড় কারণ। বরং তা কুফরের সঙ্গী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّہٗ لَا یَایۡـَٔسُ مِنۡ رَّوۡحِ اللّٰہِ اِلَّا الۡقَوۡمُ الۡکٰفِرُوۡنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কেউ নিরাশ হয় না অবিশ্বাসা সম্প্রদায় ব্যতীত’ (সূরা ইউসুফ: ৮৭)।
১৩. সর্বাবস্থায় সত্য কথার উপর দৃঢ় থাকতে হবে। সত্য পরিত্রাণদানকারী এবং মিথ্যার রশি খুবই ছোট। কা‘ব এবং তাঁর দু’ই সাথী সত্যের মাধ্যমেই মুক্তি পেয়েছেন।
১৪. দ্রুত তওবা করতে হবে এবং ছোট-বড় সকল গুনাহ থেকে ফিরে আসতে হবে। কারণ তা আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِنَّ اللّٰہَ یُحِبُّ التَّوَّابِیۡنَ وَ یُحِبُّ الۡمُتَطَہِّرِیۡنَ ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২২)। যেমন আল্লাহ বান্দার তওবায় খুশি হন’।[২]
১৫. নিশ্চয় এই ঘটনা এই তিনটি আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ (সূরা আত-তওবাহ: ১১৭-১১৯)। যেমন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর আলোচনা।
আয়াতে وَّ عَلَی الثَّلٰثَۃِ الَّذِیۡنَ خُلِّفُوۡا ‘আর তিনি ক্ষমা করলেন অপর তিনজনকেও, যাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল’ (সূরা আত-তওবা: ১১৭-১১৯)। পশ্চাতগামীতার অর্থ যুদ্ধ থেকে পিছনে থাকা উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল, যেমন কা‘ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘যারা জেনে বুঝে জিহাদ থেকে পেছনে থেকে গিয়েছিল, তাদের কথা এখানে বলা হয়নি। বরং এখানে কেবল আমাদের (তিনজনের) কথা বলা হয়েছিল। আর যারা হলফ করেছিল ও ওযর পেশ করেছিল এবং তাদের ওযর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গ্রহণ করেছিলেন তাদের থেকে আমাদের ব্যাপারে ফায়ছালাটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল’।[৩]
*পরিচালক: দারুস সালাম ইসলামী কমপ্লেক্স, পিরুজালী ময়তাপাড়া, গাযীপুর।
তথ্যসূত্র:
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১৮, ২৭৭৫ ‘মাগাযী’ অধ্যায়, কা‘ব ইবনু মালিক (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ঘটনা’ অনুচ্ছেদ, ‘শব্দ বিন্যাস তাঁরই’; মুসলিম, হা/২৭৬৯।
[২]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৪৭; মিশকাত, হা/২৩৩২।
[৩]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৪১৮, ২৭৭৫; ছহীহ মুসলিম, হা/২৭৬৯।
প্রসঙ্গসমূহ »:
শিক্ষণীয় ঘটনা