ক. মাযলূমের বদদু‘আ
ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেন, কূফার লোকজন এসে ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট সেখারকার হাকিম সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরূদ্ধে অভিযোগ করল। ফলে তাঁকে অপসারণ করে ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ‘আম্মার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে সেখানকার হাকিম নিযুক্ত করলেন। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ছিল, তার একটি হল- তিনি ভালভাবে ছালাতও পড়াতে পারতেন না। অতঃপর সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডেকে ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আবু ইসহাক! কূফাবাসীর অভিযোগ, আপনি ছালাতও ঠিকভাবে পড়াতে পারেন না’। জবাবে সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর কসম! আমি তাদের রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছালাত পড়াই। তাতে কোনরূপ কমবেশি করি না। এশার প্রথম দু’রাক‘আতে ক্বিরাআত লম্বা করি। আর শেষ দু’রাক‘আত শুধু সূরা আল-ফাতিহা পড়ি’। ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আবু ইসহাক! আপনার ব্যাপারে আমার এই ধারণাই ছিল।
অতঃপর সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সাথে এক ব্যক্তিকে দিয়ে ‘উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাদের কূফা পাঠালেন। সেখানকার সবগুলো মসজিদে ঘুরে ঘুরে ঐ ব্যক্তি সা‘দ ভ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করত। সবাই তাকে ভাল বলল এবং প্রশংসা করল। তবে বনু আবসের মসজিদে আবু সা‘দা উসামা ক্বাতাদা নামক এক লোক জিজ্ঞাসাকারীকে বলল, আপনি যখন কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করছেন, তখন আমাদের অভিযোগ হল- সা‘দ যুদ্ধে যেত না, গণীমতের মাল সঠিকভাবে বণ্টন করত না এবং ইনসাফের সাথে ফায়ছালা করত না। তার কথা শোনার পর সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, আল্লাহর কসম! তুমি তিনটা মিথ্যা অভিযোগ করেছ। আমিও তোমাকে তিনটি বদদু‘আ দিচ্ছি। ‘হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দা যদি মিথ্যাবাদী হয় এবং নাম কামাই করার জন্য যদি আমার বিরূদ্ধে অভিযোগ করে থাকে, তাহলে তার আয়ু বাড়িয়ে দিবেন, ততদিন তাকে দারিদ্রে লিপ্ত রাখেন এবং তাকে ফিতনায় লিপ্ত করেন’। [ঐ ব্যক্তির উপর সা‘দ ভ বদদু‘আ লেগে গেল] তাকে জিজ্ঞেস করা হলে বলত, আমি বুড়ো হযে গেছি; পরীক্ষায় পতিত হয়েছি, সা‘দের বদদু‘আ আমার উপর লেগে গেছে।
আব্দুল মালেক [এক বর্ণনাকারী] বলেন, পরবর্তীতে আমি ঐ লোকটাকে দেখেছি, অতি বার্ধক্যের কারণ তার ভ্রু চোখের উপর ঝুলে গেছে এবং সে রাস্তায় মেয়েদের বিরক্ত করত এবং তাদের চিমটি দিত।
[তথ্যসূত্র : ছহীহ বুখারী, হা/৭৫৫ ‘আযান’ অধ্যায়-১০]
খ. তোমার সাক্ষ্যের ভিত্তি কী?
ইমাম যুহরী (রাহিমাহুল্লাহ) উমারা ইবনু খুযাইমা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তির নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একটি ঘোড়া ক্রয় করেছিলেন। দাম নেয়ার জন্য তাকে তাড়াতাড়ি আসতে বলে তিনি আগে আগে চললেন। ঘোড়াটি নিয়ে সে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পিছু পিছু আসছিল। পথে পথে লোকজন তার ঘোড়াটা কেনার জন্য দাম বলছিল। তাদের জানা ছিল না, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটি ক্রয় করে নিয়েছেন। তাদের একজনের বলা দাম রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দাম থেকে বেশী ছিল। তাই গ্রাম্যলোকটা সজোরে আওয়াজ করে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উদ্দেশ্যে বলল, ‘ঘোড়া কিনলে কিনে নিন। নচেৎ আরেকজনের কাছে বিক্রয় করে দিব’। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘তোমার থেকে কি আমি ঘোড়া কিনে নেইনি?’ গ্রাম্যলোকটি বলল, ‘না! না! বেচাকেনা তো এখনও পুরো হয়নি’। এরপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ঐ লোকের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হল। তা দেখে লোকজন জমা হয়ে গেল। গ্রাম্যলোকটি বলল, ‘আপনার নিকট আমি ঘোড়া বেচে থাকলে সে ব্যাপারে সাক্ষী আনুন!’ তাদের কথোপকথন যেসব মুসলিম শুনছিলেন, তারা তাকে বললেন, ‘ধ্বংস হোক তোমার! জেদ করছ কেন? কেন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে তর্ক করছ? সত্য ছাড়া রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি আর কিছু বলবেন?’ এর মধ্যে খুযাইমা ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) সেখানে পৌঁছলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে গ্রাম্য লোকটির তর্ক-বিতর্ক শুনলেন। তার এ কথা শুনে বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় তুমি তোমার ঘোড়াটা রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বিক্রয় করেছ’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুযাইমা ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর দিকে ফিরলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীসের ভিত্তিতে তুমি সাক্ষ্য দিচ্ছ? [অথচ ঘোড়া বেচাকেনার সময় তো তুমি সেখানে ছিলেই না]। তখন খুযাইমা বিন ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) জবাবে বললেন, ‘আপনাকে বিশ্বাস করার উপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য দিচ্ছি’। তখন থেকে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুযাইমা ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু)-এর একার সাক্ষ্যকে দুই সাক্ষ্যের সমান বলে ঘোষণা দিলেন।
অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুযাইমা ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহুল আনহু)-কে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘কীসের উপর ভিত্তি করে তুমি সাক্ষ্য দিচ্ছ, যখন তুমি আমাদের সাথেই ছিলে না?’ তখন খুযাইমা ইবনু ছাবিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আপনি যখন আসমানের সংবাদ বলেন তথা অহি নিয়ে আসেন, তখন আমি বিশ্বাস করি। তাহলে কি আপনার এ কথা বিশ্বাস করব না?’
[তথ্যসূত্র : আবূ দাঊদ, হা/৩৬০৭ ‘বিচার ব্যবস্থা’ অধ্যায়; মুসনাদে আহমাদ, হা/২১৯৩৩; মুস্তাদরাক হাকিম, হা/২১৮৭, সনদ ছহীহ]
শিক্ষণীয় বিষয়
১. কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ না করা।
২. বিচার-ফায়ছালার ক্ষেত্রে উপস্থাপিত তথ্যের সঠিকতা যাচাই-বাছাই করা।
৩. মাযলূমের বদদু‘আ থেকে বিরত থাকা। কেননা মাযলূমের দু‘আ ও আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না।
৪. রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের দাবী হল- তাঁর প্রতিটি কথা বিনা বাক্যে বিশ্বাস করা ও গ্রহণ করা।