শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৩৩ অপরাহ্ন

আত্মত্যাগের নযীরবিহীন ঘটনা 


ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল ইয়ারমুকের যুদ্ধ। বলা হয় যে, এই যুদ্ধে মানুষ শুধু কেবল দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা ও কাটা হাত দেখেছে। এই ইয়ারমুকের প্রান্তরে আত্মত্যাগের এক নযীরবিহীন ঘটনা সংগঠিত হয়েছিল। ৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে আবূ বকর ছিদ্দীক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতকালীন রোমানদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ হয়। যা বর্তমানে সিরিয়া, জর্ডান ও ইসরায়েলের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গ্যালিলি সাগরের পূর্বে অবস্থিত ইয়ারমুক নামক নদীর তীরে অবস্থিত। মুসলিমদের সৈন্যবাহিনী ছিল ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার। আর রোমানদের ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার। একপ্রান্তে ক্ষুদ্র মুসলিম সেনাদল আর অপর প্রান্তে রোমকদের বিশাল সৈন্যবাহিনী। উভয় দলই ভয়াবহ এক যুদ্ধের মুখোমুখি দণ্ডায়মান।

এই যুদ্ধে অনেক প্রসিদ্ধ ছাহাবী উপস্থিত ছিলেন। যেমন আবূ ওবায়দাহ, মু‘আয ইবনু জাবাল, আমর ইবনুল ‘আছ, আবূ সুফিয়ান, আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) ইত্যাদি। সৈন্যদেরকে উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলার জন্য তারা পরস্পর হৃদয়গ্রাহী উপদেশ প্রদান করেন। আবূ ওবায়দাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগলকে স্থির রাখবেন’। তিনি আরো বলেন, ‘হে মুসলিম সেনাবাহিনী! তোমরা ধৈর্যধারণ কর। কেননা ধৈর্য কুফরী থেকে বাঁচায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের এবং লজ্জা নিবারণের উপায়। তোমরা তোমাদের যুদ্ধের সারি থেকে কখনো সরে দাঁড়াবে না। কাফেরদের দিকে এক ধাপও অগ্রসর হবে না এবং আগ বেড়ে তাদের সাথে যুদ্ধের সূচনাও করবে না। শত্রুদের দিকে বর্শা তাক করে থাকবে এবং বর্ম দিয়ে আত্মরক্ষা করবে। তোমাদেরকে যুদ্ধের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা মনে মনে আল্লাহর যিকির করতে থাকবে’। ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘হে মুসলিমগণ! আপনাদের দৃষ্টি সংযত করুন, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়ান। বর্শা দিয়ে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই শুরু করুন। তারা তোমাদের তলোয়ারের নাগালের মধ্যে আসলে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ুন, যেভাবে কোন সিংহ তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে’। আবূ সুফিয়ান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘হে মুসলিম জাতি! আপনারা যা দেখছেন সেটাই আমাদের বর্তমান বাস্তবতা। মনে রাখবেন, আপনাদের সামনে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং আপনাদের পিছনে শয়তান ও জাহান্নাম’।

উক্ত উৎসাহব্যঞ্জক ও অনুপ্রেরণামূলক উপদেশ শুনার পর নির্দেশমত যুদ্ধ শুরু হল এবং তা প্রচণ্ড আকার ধারণ করল। যুদ্ধের একটি পর্যায়ে এসে হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আহতদের মধ্যে তাঁর চাচাত ভাইকে খুঁজতে শুরু করলেন। তাঁর সাথে ছিল সামান্য পানি। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর চাচাত ভাইয়ের শরীর দিয়ে অবিরত ধারায় রক্ত ঝরছিল। তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁকে বললেন, ‘তুমি কি পানি পান করবে’? সে তাঁর কথার কোন উত্তর দিতে সক্ষম না হওয়ায় ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত করল। আহত ব্যক্তি হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর কাছ থেকে পানি পান করার জন্য হাতে নিতেই তাঁর পাশে এক সৈনিককে ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করতে শুনল। পিপাসার্ত ঐ সৈনিকের বুকফাটা আর্তনাদ শুনে তাঁর পূর্বে তাকে পানি করানোর জন্য হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ইঙ্গিত দিলেন। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তাঁর নিকট গিয়ে বললেন, ‘আপনি কি পানি পান করতে চান’? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি পানি পান করার জন্য পাত্র উপরে তুলে ধরতেই পানির জন্য পার্শ্বের অন্য একজন সৈনিকের চিৎকার শুনতে পেলেন। তিনি পানি পান না করে হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, ‘তাঁর দিকে দ্রুত ছুটে যাও এবং সে পানি পান করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে আমাকে দিয়ো’। হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আহত সৈন্যটির কাছে গিয়ে দেখলেন, সে মারা গেছে। অতঃপর দ্বিতীয়জনের কাছে ফিরে এসে দেখলেন সেও মারা গেছে। অতঃপর চাচাত ভাইয়ের কাছে ফিরে আসলে দেখেন তিনিও শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন’ (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১১-১২; সীরাতু আবী বকর ছিদ্দীক্ব, পৃ. ২৬৮)

পানির পাত্রটি তখনও হুযায়ফা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাতে। এতটুকু পানি। অথচ তা পান করার মত এখন আর কেউ বেঁচে নেই। যাদের পানির প্রয়োজন ছিল তারা আরেকজনের পানির পিপাসা মেটাবার জন্য এতই পাগলপারা ছিলেন যে, অবশেষে কেউই সে পানি পান করতে পারেননি। অথচ সবারই প্রাণ ছিলো ওষ্ঠাগত। সুবহানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহ!


শিক্ষণীয় বিষয় :

ক). আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্ট অর্জনের জন্য সর্বদা আত্মত্যাগের জাযবা তৈরি করা।
খ). সংখ্যাধিক্য বিজয়ের মানদ- নয়। বরং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় ঈমান ও নির্ভরতা সফলতার চূড়ান্ত মানদ-।
গ). কর্মীদেরকে উৎসাহ প্রদানের জন্য নের্তৃবর্গের পক্ষ থেকে উপদেশ প্রদান করা উচিত।
ঘ). নিজে যা পসন্দ করা হয় অন্য মুসলিম ভাইয়ের জন্য তাই পসন্দ করা কর্তব্য।
ঙ). এটি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের একটি অনুপম নিদর্শন। 




শিক্ষনীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ - মুহাম্মাদ জাহিদুল ইসলাম
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১২তম পর্ব) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মূসা ও খাযির (আলাইহিমাস সালাম)-এর কাহিনী - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৮ম সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষণীয় ঘটনা (১ম বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা) - আল-ইখলাছ ডেস্ক
আত্মত্যাগের নযীরবিহীন ঘটনা - আল-ইখলাছ ডেস্ক
মাযলূমের বদদু‘আ ও তোমার সাক্ষ্যের ভিত্তি কী? - আল-ইখলাছ ডেস্ক

ফেসবুক পেজ