ফাযায়েলে রামাযান
-মুহাম্মাদ আবু সাঈদ*
‘রামাযান’ رَمَضَانُ আরবী মাসের নবম মাস। মূল শব্দ رَمَضَ হতে নির্গত। যার অর্থ পুড়ে যাওয়া, জ্বলে যাওয়া, তীক্ষ্ম, প্রখর, আগুনে ঝলসানো। যেমন বলা হয়- رَمِضَتِ اَلْاَرْضُ ‘যমীন সূর্যতাপে পুড়ে গেছে’, رَمِضَتْ قَدَمُه ‘তার পা গরমে পুড়ে গেছে’, رَمِضَ الصَّائِمُ ‘ছায়েমের পেট ক্ষুৎ-পিপাসায় জ্বলে গেছে’। অতএব অধিক জ্বলে পুড়ে খাক হওয়াকে রামাযান رَمَضَانُ বলা হয়।[১] কেননা একটানা একমাস ছিয়াম সাধনার ফলে মুমিনের জৈব প্রবৃত্তিকে ক্ষুৎ-পিপাসার আগুনে জ্বালিয়ে দুর্বল করে ফেলা হয় বলে এ মাসটিকে ‘রামাযান’ মাস বলা হয়েছে’। পরিভাষায় রামাযান হল- اَلْاِمْسَاكُ عَنِ الْأَكْلِ وَالشُّرْبِ وَسَائِرِ الْمُفْطَرَاتِ مَعَ النِّيَّةِ مِنْ طُلُوْعِ الْفَجْرِ الصَّادِقِ إِلَي غُرُوْبِ الشَّمْسِ ‘ছুবহে ছাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিয়াম রাখার নিয়তে পানাহার, সমস্ত খাদ্যদ্রব্য ও স্ত্রী সম্ভোগ হতে বিরত থাকার নাম ছিয়াম’।[২] অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
الصيام هو الإمساك عن المفطرات من الأكل والشرب والجماع من طلوع الفجر إلى غروب الشمس بنية الصوم
‘ছুবহে ছাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ছিয়ামের নিয়তে খাওয়া, পান করা এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নামকে ছিয়াম বলে’।[৩]
ছিয়ামের রুকন
ছিয়ামের রুকন দু’টি।[৪] (১) নিয়ত করা।[৫] (২) ছুবহে ছাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যাবতীয় খাদ্যদ্রব্য ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা। মহান আল্লাহ বলেন,
فَالۡـٰٔنَ بَاشِرُوۡہُنَّ وَ ابۡتَغُوۡا مَا کَتَبَ اللّٰہُ لَکُمۡ ۪ وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ
‘সুতরাং এখন তোমরা তাদের সাথে সংগত হও এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাত্রির কালো রেখা হতে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। অতঃপর তোমরা রাত্রি (সূর্যাস্ত) পর্যন্ত ছিয়াম পূর্ণ কর’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)।
রামাযানের ফযীলত
(ক) রামাযান মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয় :
আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا دَخَلَ شَهْرُ رَمَضَانَ فُتِّحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ
‘যখন রামাযান মাস আগমন করে তখন জান্নাতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়’।[৬] অন্য বর্ণনায় এসেছে, فُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ ‘জান্নাতের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়’[৭] এবং فُتِحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ ‘রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেয়া হয়’।[৮]
(খ) জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ :
রামাযান মাস বান্দাদের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি অন্যতম মাস। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا كَانَتْ أَوَّلُ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ صُفِّدَتِ الشَّيَاطِينُ وَمَرَدَةُ الْجِنِّ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ النَّارِ فَلَمْ يُفْتَحْ مِنْهَا بَابٌ وَفُتِحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ فَلَمْ يُغْلَقْ مِنْهَا بَابٌ وَنَادَى مُنَادٍ يَا بَاغِىَ الْخَيْرِ أَقْبِلْ وَيَا بَاغِىَ الشَّرِّ أَقْصِرْ وَلِلهِ عُتَقَاءُ مِنَ النَّارِ وَذَلِكَ فِى كُلِّ لَيْلَةٍ
‘যখন রমাযান মাসের প্রথম রাত্রি আসে, তখন সমস্ত শয়তান ও অবাধ্য জিনকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই খোলা হয় না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খোলা হয়, অতঃপর তার কোন দরজাই বন্ধ করা হয় না। এ মাসে একজন আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকে, হে কল্যাণের অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও, হে মন্দের অন্বেষণকারী! থাম। আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে বহু ব্যক্তিকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেন, আর এটা প্রত্যেক রাতেই হয়ে থাকে’।[৯] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন, إِنَّ لِلهِ عُتَقَاءَ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ ‘অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা রামাযান মাসের প্রত্যেক দিন ও রাতে অসংখ্য ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন এবং প্রত্যেক মুমিন বান্দার একটি করে দু‘আ কবুল করেন’।[১০]
(গ) আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভের সুবর্ণ সুযোগ :
আল্লাহ তা‘আলা এই মাসে অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করতে পারল না, তার জন্য চরম দুর্ভোগ। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন,
رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَىَّ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ ثُمَّ انْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلاَهُ الْجَنَّةَ
‘ঐ ব্যক্তির নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, যার সামনে আপনার কথা আলোচিত হয় তথাপি সে আপনার ওপর দরূদ পড়ে না। ঐ ব্যক্তির নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, যে রামাযান মাস পেল, অথচ শেষ হওয়ার আগে তাকে ক্ষমা করা হল না। এরপর তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তির নাক ধূলায় ধূসরিত হোক, যে তার পিতা-মাতাকে কিংবা যেকোন একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে যেতে পারল না’।[১১]
অন্যত্র কা‘ব ইবনু উজরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা বললেন, তোমরা মিম্বার নিয়ে আস। আমরা নিয়ে আসলে তিনি প্রথম স্তরে বসেন এবং আমীন বলেন। অতঃপর যখন তিনি দ্বিতীয় স্তরে উঠেন তখনও আমীন বলেন। যখন তৃতীয় স্তরে উঠেন তখনও আমীন বলেন। তারপর যখন খুৎবা শেষ করে মিম্বর থেকে অবতরণ করলেন তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কাছে আজ এমন কিছু শুনলাম, যা এর পূর্বে শুনিনি। তিনি বললেন, আমার কাছে জিবরীল এসে বললেন, ঐ ব্যক্তি অপমাণিত হোক, যে ব্যক্তি রামাযান মাস পেল, কিন্তু তাকে ক্ষমা করা হল না। আমি বললাম, আমীন। আমি দ্বিতীয় স্তরে উঠলাম তখন তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি অপমাণিত হোক, যে ব্যক্তির কাছে আমাকে উল্লেখ করা হল, অথচ আমার উপর দরূদ পড়ল না। তখন আমি বললাম আমীন। অতঃপর যখন তৃতীয় স্তরে উঠলাম, তখন তিনি বললেন, ঐ ব্যক্তি অপমাণিত হোক, যে ব্যক্তি পিতা-মাতা উভয়কে বা তাদের একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেল অথচ তারা দুইজন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারল না। আমি বললাম, আমীন (আল্লাহ কবুল করুন) ।[১২]
(ঘ) ছিয়াম বান্দার জন্য সুপারিশকারী : ক্বিয়ামতের ময়দানে বান্দার জন্য যখন কোন সুপারিশকারী থাকবে না, তখন কুরআন এবং ছিয়াম সুপারিশ করবে। আল্লাহ তাদের সুপারিশ কবুল করবেন। আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন,
اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآَنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَقُوْلُ الصِّيَامُ أَي رَبِّ إِنِّي مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهْوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِيْ فِيْهِ وَيَقُوْلُ الْقُرْآَنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفَّعْنِي فِيْهِ فَيُشْفَعَانِ
‘ছিয়াম ও কুরআন ক্বিয়ামতের দিন মানুষের জন্য এভাবে সুপারিশ করবে যে, ছিয়াম বলবে, হে প্রতিপালক! আমি দিনের বেলায় তাকে পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। কুরআন বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে রাতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে’।[১৩]
(ঙ) সব ধরনের পাপাচার থেকে দূরে রাখে : ছিয়ামের মূল লক্ষ্য ও কাক্সিক্ষত ফলাফল হল- সব ধরনের পাপ থেকে তাকে দূরে রাখে। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِى أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ‘যে ব্যক্তি ছিয়াম অবস্থায় মিথ্যা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার খাদ্য ও পানীয় ত্যাগ করাতে আল্লাহ্র কোন প্রয়োজন নেই’।[১৪]
(চ) ছিয়াম বান্দার জন্য ঢালস্বরূপ : ছিয়াম দুনিয়াতে যেমন বান্দাকে যাবতীয় পাপ হতে রক্ষা করে, ঠিক তেমনি আখেরাতেও জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুন হতে তাকে হেফাযত করবে। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
الصِّيَامُ جُنَّةٌ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يَجْهَلْ وَإِنِ امْرُؤٌ قَاتَلَهُ أَوْ شَاتَمَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّىْ صَائِمٌ مَرَّتَيْنِ وَالَّذِىْ نَفْسِىْ بِيَدِهِ لَخُلُوْفُ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ تَعَالَى مِنْ رِيْحِ الْمِسْكِ يَتْرُكُ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ وَشَهْوَتَهُ مِنْ أَجْلِى الصِّيَامُ لِىْ وَأَنَا أَجْزِىْ بِهِ وَالْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا
‘ছিয়াম ঢাল স্বরূপ। সুতরাং তোমরা অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মত কাজ করবে না। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায় অথবা তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দু’বার বলে, আমি ছিয়াম পালন করছি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই ছিয়াম পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মিসকের গন্ধের চাইতেও উৎকৃষ্ট। সে আমার জন্য খাদ্য, পানাহার ও কামাচার পরিত্যাগ করে। ছিয়াম আমার জন্যই। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ’।[১৫] অন্য হাদীছে এসেছে, ‘ছিয়াম জাহান্নামের ঢাল’।[১৬]
(ছ) জান্নাত লাভের মাধ্যম : আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَنَّ أَعْرَابِيًّا أَتَى النَّبِىَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ دُلَّنِى عَلَى عَمَلٍ إِذَا عَمِلْتُهُ دَخَلْتُ الْجَنَّةَ قَالَ تَعْبُدُ اللهَ لاَ تُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا وَتُقِيمُ الصَّلاَةَ الْمَكْتُوبَةَ وَتُؤَدِّى الزَّكَاةَ الْمَفْرُوضَةَ وَتَصُومُ رَمَضَانَ قَالَ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ أَزِيدُ عَلَى هَذَا فَلَمَّا وَلَّى قَالَ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى رَجُلٍ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى هَذَا
‘একদা একজন বেদুইন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলল, আমাকে এমন আমলের কথা বলুন, যে আমল করলে আমি জান্নাতে যেতে পারব। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, ফরয ছালাত আদায় করবে, ফরয যাকাত দিবে এবং রামাযানের ছিয়াম পালন করবে। তখন ঐ ব্যক্তি আল্লাহর শপথ করে বলল, আমি এর বেশী করব না। যখন লোকটি চলে গেল, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, যে ব্যক্তি একজন জান্নাতী ব্যক্তিকে দেখে আনন্দিত হতে চায় সে যেন এই ব্যক্তির দিকে দেখে’।[১৭]
(জ) ছিয়াম বান্দার পূর্ববর্তী সকল ছগীরা গুনাহের কাফফারা : আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও নেকী অর্জনের আশায় রামাযানের ছিয়াম রাখবে, আল্লাহ তার অতীতের সকল (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দিবেন’।[১৮]
(ঝ) অসংখ্য নেকী অর্জনের মাধ্যম : আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلاَّ الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِى وَأَنَا أَجْزِى بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِى لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ. وَلَخُلُوفُ فِيهِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ
‘আদম সন্তানের প্রতিটি নেক কাজের জন্য ১০ থেকে ৭শ গুণ পর্যন্ত ছওয়াব নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেন, ছিয়াম এর ব্যতিক্রম। কেননা সেটা একমাত্র আমার জন্যই রাখা হয় এবং আমি নিজ হাতেই এর পুরস্কার দেব। সে আমার জন্যই যৌন বাসনা ও খানা-পিনা ত্যাগ করেছে। ছিয়াম পালনকারীর জন্য দু’টি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে। একটা হচ্ছে ইফতারের সময় এবং অন্যটি হচ্ছে আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের সময়। আল্লাহ্র কাছে ছায়েমের মুখের গন্ধ মিশক-আম্বরের সুঘ্রাণের চাইতেও উত্তম’।[১৯]
(ঞ) জান্নাতে ‘রাইয়ান’ নামক দরজা দিয়ে প্রবেশকারী : সাহল ইবনু সা‘দ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِنَّ فِى الْجَنَّةِ بَابًا يُقَالُ لَهُ الرَّيَّانُ يَدْخُلُ مِنْهُ الصَّائِمُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ يُقَالُ أَيْنَ الصَّائِمُونَ فَيَقُومُونَ لاَ يَدْخُلُ مِنْهُ أَحَدٌ غَيْرُهُمْ فَإِذَا دَخَلُوا أُغْلِقَ فَلَمْ يَدْخُلْ مِنْهُ أَحَدٌ
‘জান্নাতে ‘রাইয়ান’ নামক একটি দরজা আছে। ক্বিয়ামতের দিন ছিয়াম পালনকারী ব্যতীত অন্য কেউ উক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। বলা হবে, কোথায় ছিয়াম পালনকারীরা? অতঃপর তারা দ-ায়মান হবে এবং ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। যখন তারা প্রবেশ করবে, তখন তা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং ঐ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না’।[২০]
(ট) ছিয়ামের সমতুল্য কোন আমল নেই : আবু উমামা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
أَتَيْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقُلْتُ مُرْنِىْ بِأَمْرٍ آخُذُهُ عَنْكَ قَالَ عَلَيْكَ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَا مِثْلَ لَهُ
‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন, যার দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি ছিয়াম রাখ। কেননা ছিয়ামের সমতুল্য কিছুই নেই।[২১]
* দাওরায়ে হাদীছ, আলাদীপুর, নওগাঁ; এম. এ, আল-হাদীছ এ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
তথ্যসূত্র :
[১]. ইবরাহীম মুছত্বফা ও তার সাথীবৃন্দ, আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৩।
[২]. কিতাবুল ফিক্বহিল মুইয়াসসার, পৃ. ১৪৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-৪।
[৩]. ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ও জাওয়াব, প্রশ্ন নং-১১৪৫।
[৪]. কিতাবুল ফিক্বহুল মুইয়াসসার, পৃঃ ১৪৯ ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-৪।
[৫]. ছহীহ বুখারী হা/১; মিশকাত হা/১।
[৬]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৯; মিশকাত, হা/১৯৫৬।
[৭]. ছহীহ বুখারী হা/১৮৯৮, ৩২৭৭; নাসাঈ হা/২০৯৭; মিশকাত হা/১৯৫৬।
[৮]. মুসলিম হা/২৫৪৮; নাসাঈ হা/২১০০; মুসনাদে আহমাদ হা/৭৭৬৭; মিশকাত হা/১৯৫৬।
[৯]. তিরমিযী, হা/৬৮২; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৪২; মিশকাত, হা/১৯৬০, সনদ ছহীহ।
[১০]. মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৩; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘, হা/২১৬৯; ছহীহ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১০০২।
[১১]. তিরমিযী, হা/৩৩৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৪৪৪; মিশকাত হা/৯২৭; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৫১০।
[১২]. হাকিম, হা/৭২৫৬; বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান, হা/১৪৭১; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/১৬৭৭ ।
[১৩]. বায়হাক্বী-শু‘আবুল ঈমান, হা/১৯৯৪; মিশকাত হা/১৯৬৩, সনদ ছহীহ।
[১৪]. ছহীহ বুখারী হা/১৯০৩, ৬০৫৭; আবুদাঊদ হা/২৩৬২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৮৯; তিরমিযী হা/৭০৭; মিশকাত হা/১৯৯৯।
[১৫]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪; নাসাঈ, হা/২২১৫।
[১৬]. ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৯; সনদ ছহীহ।
[১৭]. ছহীহ বুখারী, হা/১৩৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/১৪; মিশকাত, হা/১৪।
[১৮]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৮ ও ২০১৪; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬০; মিশকাত, হা/১৯৫৮।
[১৯]. ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৩৮; মিশকাত, হা/১৯৫৯।
[২০]. ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১১৫২।
[২১]. নাসাঈ হা/২২২০-২১; সনদ ছহীহ, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/৯৮৬।