উম্মাহর প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার: একটি বিশ্লেষণ
-ড. মুহাম্মাদ বযলুর রহমান*
(৪র্থ কিস্তি)
‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য দেয়া’র অর্থ
মুহাম্মাদ (ﷺ) হলেন পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলা প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। এটিকে স্বীকার করে নেয়া ‘ঈমান’-এর রূকনসমূহের অন্যতম। ইসলাম গ্রহণের ক্ষেত্রে যে দু’টি বিষয়ের ঘোষণা দেয়া আবশ্যক, তাহল: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ ‘আমি এই মর্মে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল’।[১] উক্ত ঘোষণার প্রথমটি হল- নির্ভেজাল তাওহীদের স্কীকৃতি এবং দ্বিতীয়টি হল মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হওয়ার স্বীকৃতি। এ দু’টি বিষয়ের পূর্ণ স্বীকৃতি ব্যতীত একজন মানুষ যেমন মুসলিম হতে পারে না, তেমনি মুমিন হওয়াও অসম্ভব। সুতরাং নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য দেয়া’র বিষয়টি আক্বীদা শাস্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যা ব্যতীত ঈমান পরিপূর্ণ লাভ করে না। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ আক্বীদার মৌলিক এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। বিশেষ করে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নিয়ে উম্মতে মুহাম্মাদীর অধিকাংশ মানুষ বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত। তাঁর সম্পর্কে মানুষের অতি বাড়াবাড়ি, মিথ্যা হাদীছ বর্ণনা, অতি ভক্তি দেখাতে তাঁকে অপমান-অপদস্ত করা, তিনি গায়েবের খবর জানেন বলে বিশ্বাস করা, নূরের তৈরি বলে মনে করা, মৃত্যুর পর কবরে থেকেও তাঁর উম্মতের উপকার করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা, তাঁর নামে হাজার হাজার বিদ‘আতী আমলের প্রচলন করা ইত্যাদি অন্যায় বিশ্বাস ও কর্মের মাধ্যমে উম্মতের প্রতি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকারকে সর্বদা ভুলূণ্ঠিত করছে। বিনষ্ট করে দিয়েছে মুসলিম উম্মহার ঈমান চেতনাকে।
অন্যদিকে নাস্তিক, ভণ্ড ও প্রতারক একশ্রেণীর নরপশু তাঁকে গালমন্দ করে, নানাবিধ মিথ্যা অবপাদ আরোপ করে, ব্যঙ্গচিত্র অংকন করে, কটুক্তি করে, তাঁর শান বিরোধী অনেক কথাবার্তা ইত্যাদি বলে থাকে। যা মুসলিমদের ঈমানী শক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে। যার ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রান্তে বিস্ফোরিত প্রতিবাদ পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিমকে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ সম্পর্কে যেমন পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে হবে, তেমনি মুহাম্মাদ (ﷺ) ও তার রিসালাতের উপর পরিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন ধারণা রাখতে হবে। অন্যথা ইসলাম সঠিকভাবে পরিপালন করা সম্ভব হবে না। দাওয়াতী কাজ যেমন বাধাগ্রস্ত হবে, তেমনি সামগ্রিক সংস্কার কার্যক্রমও ব্যর্থতায় পর্সবসিত হবে। তাই এতদসংশ্লিষ্ট বিষয়ে মুসলিমদেরকে ধারণা দেয়া যরূরী হয়ে পড়েছে। এক্ষণে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ বর্ণনা করা হল:
১- অর্থ
‘মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল’ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ এই যে, অন্তরে বিশ্বাস এবং মুখে এ কথার স্বীকৃতি প্রদান করা যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সমস্ত জিন্ন ও মানুষের জন্য রাসূল হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ يٰۤاَيُّهَا النَّاسُ اِنِّيْ رَسُوْلُ اللّٰهِ اِلَيْكُمْ جَمِيْعَا ا۟لَّذِيْ لَهٗ مُلْكُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ١ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ يُحْيٖ وَ يُمِيْتُ١۪ فَاٰمِنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهِ النَّبِيِّ الْاُمِّيِّ الَّذِيْ يُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ كَلِمٰتِهٖ وَ اتَّبِعُوْهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُوْنَ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের প্রতি আমি আল্লাহ প্রেরিত রাসূল, সমগ্র আসমান ও যমীনের রাজত্ব তাঁর। তিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই ঈমান আনয়ন কর আল্লাহর ওপর, তার প্রেরিত উম্মী নবীর ওপর, যিনি ঈমান আনয়ন করেন আল্লাহর ওপর এবং তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। আর তাঁর অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সরল পথ পেতে পার’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৫৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
تَبٰرَكَ الَّذِيْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰى عَبْدِهٖ لِيَكُوْنَ لِلْعٰلَمِيْنَ نَذِيْرَاۙ
‘পরম কল্যাণময় তিনি যিনি তাঁর বান্দার প্রতি ফায়সালার গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন যাতে তিনি বিশ্ব জগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন’ (সূরা আল-ফুরক্বান: ১)।
‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে আল্লাহর রাসূল হিসাবে সাক্ষ্য দেয়া’র অর্থ বর্ণনায় দু’জন সম্মানিত শায়খের বক্তব্য নিম্নে তুলে ধরা হল: (এক) শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, হল-
১. تستلزم اتباعه বা দৃঢ়ভাবে তাঁর আনুগত্য করা।
২. طاعته فيما أمر বা তিনি যা নির্দেশ করেছেন তা অনুসরণ করা।
৩. تصديقه فيما أخبر বা তিনি যে সংবাদসমূহ নিয়ে এসেছেন তাকে সত্যায়ন করা।
৪. واجتناب ما نهى عنه وزجر বা তিনি যা নিষেধ করেছেন তা থেকে সর্বোতভাবে বিরত থাকা।
৫. ألا يعبد الله إلا بما شرع বা তিনি যা শরী‘আতসম্মত করেছেন সে অনুযায়ী ইবাদত করা।[২]
(দুই) শায়খ ছালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন,
১. طاعتهُ বা তাঁর আনুগত্য করা।
২. تصديقُهُ বা তাঁকে সত্যায়ন করা।
৩. ترك ما نهى عنه বা তিনি যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা।
৪. الاقتصار على العمل بسنته বা আমল করার ক্ষেত্রে তাঁর সুন্নাতের উপর সীমাবদ্ধ থাকা।
৫. ترك ما عداها من البدع والمحدثات বা বিদ‘আত ও নবাবিষ্কৃত আমলসমূহ বর্জন করা
৬. تقديم قوله على قول كل أحد বা প্রত্যেকের কথার উপর তাঁর কথাকে প্রাধান্য দেয়া’।[৩]
এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেয়ার অন্যতম দাবী হলো: সৃষ্টি বা পরিচালনায় এবং প্রভুত্বে কিংবা ইবাদতে রাসূল (ﷺ)-এর কোন অধিকার নেই; বরং তিনি ‘আবদ বা আল্লাহর দাস ও বান্দা। মা‘বূদ নন। তিনি সত্য রাসূল। তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যাবে না। তিনি নিজের জন্য কিংবা অপরের জন্য কল্যাণ-অকল্যাণের কোন ক্ষমতা রাখেন না। মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের একমাত্র মালিক আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
قُلْ لَّاۤ اَقُوْلُ لَكُمْ عِنْدِيْ خَزَآىِٕنُ اللّٰهِ وَ لَاۤ اَعْلَمُ الْغَيْبَ وَ لَاۤ اَقُوْلُ لَكُمْ اِنِّيْ مَلَكٌ١ۚ اِنْ اَتَّبِعُ اِلَّا مَا يُوْحٰۤى اِلَيَّ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভাণ্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। আমি এমনও বলি না যে, আমি ফিরিশতা, যা আমার কাছে আসে’ (সূরা আল-আন‘আম: ৫০)। সুতরাং তিনি একজন আদেশপ্রাপ্ত বান্দা মাত্র। তাঁর প্রতি যা আদেশ করা হয় তিনি কেবল তারই অনুসরণ করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ اِنَّمَاۤ اَدْعُوْا رَبِّيْ وَ لَاۤ اُشْرِكُ بِهٖۤ اَحَدًا۰۰۲۰ قُلْ اِنِّيْ لَاۤ اَمْلِكُ لَكُمْ ضَرًّا وَّ لَا رَشَدًا۰۰۲۱ قُلْ اِنِّيْ لَنْ يُّجِيْرَنِيْ مِنَ اللّٰهِ اَحَدٌ١ۙ۬ وَّ لَنْ اَجِدَ مِنْ دُوْنِهٖ مُلْتَحَدًاۙ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি তোমাদের ক্ষতি সাধন করার ও সুপথে আনয়ন করার মালিক নই। (হে নবী!) আপনি বলুন, আল্লাহ তা‘আলার কবল থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না এবং তিনি ব্যতীত আমি আশ্রয়স্থল পাব না’ (সূরা আল-জিন্ন: ২১-২২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,
قُلْ لَّاۤ اَمْلِكُ لِنَفْسِيْ نَفْعًا وَّ لَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰهُ١ؕ وَ لَوْ كُنْتُ اَعْلَمُ الْغَيْبَ لَا سْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ١ۛۖۚ وَ مَا مَسَّنِيَ السُّوْٓءُ١ۛۚ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِيْرٌ وَّ بَشِيْرٌ لِّقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَؒ
‘(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই। কিন্তু আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েবের খবর জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কখনো কোন অমঙ্গল হত না। আমি তো শুধু একজন ভীতি প্রদর্শক এবং সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য’ (সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮৮)।
সুধী পাঠক! এই সাক্ষ্য ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রথম স্তম্ভের দ্বিতীয় অংশ। নবী (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান, ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত, যা জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর বিখ্যাত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। মূলত ঈমান তাঁর প্রতি হৃদয়ের বিশ্বাস এবং তাঁর স্বীকৃতির সাথে সুনির্দিষ্ট। আর শাহাদত বা সাক্ষ্যের উদ্দেশ্য হল- জিহ্বা বা মৌখিকভাবে উচ্চারণ এবং তার স্বীকৃতি প্রদান করা। সুতরাং বিস্তারিতভাবে শাহাদত বা সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ হল- مَعْرِفَةً وَإِقْرَارًا وَانْقِيَادًا وَطَاعَةً ‘জ্ঞান অর্জন করা, স্বীকৃতি প্রদান করা, আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য করা’। যেমনটি ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খি.) বলেছেন।[৪]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) (৬৬১-৭২৮ হি./১২৬৩-১৩২৮ খ্রি.) বলেন,
وَأَمَّا "الْإِيمَانُ بِالرَّسُولِ" فَهُوَ الْمُهِمُّ إذْ لَا يَتِمُّ الْإِيْمَانُ بِاَللهِ بِدُوْنِ الْإِيْمَانِ بِهِ وَلَا تَحْصُلُ النَّجَاةُ وَالسَّعَادَةُ بِدُوْنِهِ إذْ هُوَ الطَّرِيْقُ إلَى اللهِ سُبْحَانَهُ؛ وَلِهَذَا كَانَ رُكْنَا الْإِسْلَامِ: "أَشْهَدُ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
‘আর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে এটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন তাঁর প্রতি ঈমান আনয়ন ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। তাঁকে ছাড়া মুক্তি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হয় না। কারণ তিনি আল্লাহ তা‘আলার পথেই রয়েছেন। আর এ কারণেই এটি ইসলামের স্তম্ভ। তাহল: أَشْهَدُ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[৫]
২- শর্তসমূহ
‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান ‘আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু’ তথা আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দেয়ার শর্তসমূহ নিম্নরূপ:
১. الاعتراف برسالته، واعتقادها باطنًا في القلب বা তাঁর উপর প্রদত্ত রিসালতের প্রতি স্বীকারোক্তি প্রদান করা এবং অন্তরে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা
২. النطق بذلك، والاعتراف به ظاهرً باللسان বা তাঁর পক্ষে কথা বলা এবং মৌখিকভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া
৩. المتابعة له؛ بأن يعمل بما جاء به من الحق، ويترك ما نهى عنه من الباطل বা যথাযথভাবে তাঁর অনুসরণ করা। অর্থাৎ তিনি যে সত্য বিধান নিয়ে এসেছেন, তার উপর আমল করা এবং যে বাতিল থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা
৪. تصديقه فيما أخبر به من الغيوب الماضية والمستقبلة বা অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি যে গায়েবের সংবাদ দিয়েছেন, তার প্রতি বিশ্বাস করা
৫. محبته أشد من محبة النفس والمال والولد والوالد والناس أجمعين বা নিজের জীবন, সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতা-মাতা এবং সকল মানুষের চেয়ে তাঁকে অধিক ভালোবাসা।
৬. تقديم قوله على قول كل أحد، والعمل بسنته বা প্রত্যেকের কথার উপর তাঁর কথাকে প্রাধান্য দেয়া এবং তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করা।[৬]
৩- শাহাদাত বা সাক্ষ্য প্রদানের স্তরসমূহ (مراتب الشهادة)
মানুষ যখন সাক্ষ্যদ্বয়ের তথা ‘এই মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর রাসূল’-এর অর্থ এবং তাদের শর্তগুলো সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে অবগত হবে, তখন তাদের সচেতন থাকা উচিত যে, সাক্ষ্যের এমন কিছু স্তর রয়েছে যেগুলো সাক্ষ্যদাতা পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হয়, যতক্ষণ না সে সাক্ষ্যের প্রয়োজনীয় বা উপযুক্ততা অর্জন করে। সাক্ষ্যদ্বয়ের সেই স্তরগুলো ৪টি।[৭] যথা:
স্তর নং-১: যা সাক্ষ্য দেয়া হয় এবং সাব্যস্ত করা হয়, তার বিশুদ্ধতার জন্য জ্ঞান অর্জন করা, উপযুক্ত বোধগম্যতা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। সুতরাং সাক্ষ্যদাতাকে অবশ্যই দু’টি সাক্ষ্যের অর্থ জানতে হবে এবং বুঝতে হবে, অন্যথা সাক্ষ্যদাতা এমন কিছুর সাক্ষ্য দিবেন যা সম্পর্কে তার কোনও জ্ঞান নেই। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَ هُمْ يَعْلَمُوْنَ ‘তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে তার সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত’ (সূরা আল-যুখরুফ: ৮৬)।
স্তর নং-২: ঈমানের দু’টি সাক্ষ্য তাকে মৌখিকভাবে উচ্চারণ করা। যদিও সে অন্য কাউকে এগুলো সম্পর্কে না বলে। প্রয়োজনে তা নিজের কাছে আবৃত্তি করবে, স্মরণ রাখবে, উচ্চারণ করবে অথবা লিখে রাখবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ جَعَلُوا الْمَلٰٓىِٕكَةَ الَّذِيْنَ هُمْ عِبٰدُ الرَّحْمٰنِ اِنَاثًا١ؕ اَشَهِدُوْا خَلْقَهُمْ١ؕ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَ يُسْـَٔلُوْنَ
‘তারা দয়াময় আল্লাহ্র বান্দা ফেরেশতাদেরকে নারী গণ্য করেছে; এদের সৃষ্টির সময় কি তারা উপস্থিত ছিল? তাদের সাক্ষী লিপিবদ্ধ করা হবে এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে’ (সূরা আয-যুখরুফ: ১৯)। এই লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি তাদের জন্য সাক্ষী করে তুলেছিল। এমনকি যদি তারা সাক্ষ্যের কথাটি মুখে উচ্চারণ নাও করে বা অন্যদের সামনে তা সম্পাদন নাও করে, তবুও লিপিবদ্ধ থাকার কারণে সেই সাক্ষ্যকে অস্বীকার করার সুযোগ থাকবে না।
স্তর নং-৩: সাক্ষ্যদাতা যার সাক্ষ্য দিয়েছেন তা অন্যকে জানানো, সে সম্পর্কে সংবাদ দেয়া ও ব্যাখ্যা করা। তথা জানানো ও সংবাদ দেয়ার দু’টি স্তর। যথা: (১) إعلام بالقول বা কথার মাধ্যমে তথ্য প্রদান এবং (২) إعلام بالفعل বা কাজের মাধ্যমে তথ্য প্রদান। আর এই মর্যাদা প্রত্যেক শিক্ষকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যিনি অন্যকে কিছু শেখান। কখনও তিনি তাকে কথার মাধ্যমে, কখনও কাজের মাধ্যমে তা শেখান। এটি যা নির্দেশ করে তা হল: সাক্ষ্য প্রদানটা অবশ্যই বাস্তবে হতে হবে তথা কর্মের মাধ্যমে হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِيْنَ۠ اَنْ يَّعْمُرُوْا مَسٰجِدَ اللّٰهِ شٰهِدِيْنَ عَلٰۤى اَنْفُسِهِمْ بِالْكُفْرِ
‘মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরী স্বীকার করে সাক্ষ্য দেয়, তখন তারা আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে এটা সঙ্গত নয়’ (সূরা আত-তাওবাহ: ১৭)। এই আয়াতটি তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ থেকে একটি সাক্ষ্য।[৮]
স্তর নং-৪: সাক্ষ্যদ্বয়ের বিষয়বস্তু ও নির্দেশনা দৃঢ়ভাবে মেনে চলা। শুধু সাক্ষ্য দেয়াই যথেষ্ট নয়। বরং সাক্ষ্য দ্বারা এটি নির্দেশ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাক্ষ্যের মাধ্যমে এ ব্যাপারে বিধানরোপ করেছেন, নির্দেশনা জারি করেছেন, আদেশ প্রদান করেছেন এবং তাঁর বান্দাদের তা করতে বাধ্য করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَ قَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ وَ بِالْوَالِدَيْنِ۠ اِحْسَانًا
‘তোমার প্রতিপলক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ২৩)। অন্যত্র তিনি বলেন,
وَ مَاۤ اُمِرُوْۤا اِلَّا لِيَعْبُدُوْۤا اِلٰهًا وَّاحِدًا١ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ
‘তাদের আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধু এক মা‘বূদের ইবাদত করবে, যিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই’ (সূরা আত-তাওবাহ: ৩১)।
মূলত পুরো কুরআনই এরই সাক্ষ্য দিয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একাকীত্বের সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,
شَهِدَ اللّٰهُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ۙ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةُ وَ اُولُوا الْعِلْمِ قَآىِٕمًۢا بِالْقِسْطِ١ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُؕ
‘আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয় তিনি ব্যতীত সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং ফেরেশতাগণ, ন্যায়নিষ্ঠ বিদ্বানগণও (সাক্ষ্য প্রদান করেন) তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মা‘বূদ নেই, তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’ (সূরা আলে ইমরান: ১৮)।
(ইনশাআল্লাহ চলবে)
[১]. ছহীহ বুখারী, হা/৪৬২; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭৬৪; মিশকাত, হা/৩৯৬৪।
[২]. মুহাম্মাদ ইবনু সালিহ ইবনু মুহাম্মাদ আল-‘উছাইমীন, মাজমূ‘ঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, ৭ম খণ্ড (দারুল ওয়াতান, ১৪১৩ হি.), পৃ. ৩৫৭।
[৩]. শাইখ সালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, ‘আকীদাতুত তাওহীদ ওয়া বায়ানু মা ইউযাদ্দুহা আও ইয়ানকুসুহা মিনাশ শিরকিল আকবারি ওয়াল আসগারি ওয়াত তা‘তীলি ওয়াল বিদাঈ ওয়া গাইরা যালিক, পৃ. ৫১।
[৪]. ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ‘ইবাদ, ১ম খণ্ড (বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি.), পৃ. ৩৬।
[৫]. শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ৭ম খণ্ড (মদীনা, সঊদী আরব: মাজমাঊল মালিক ফাহাদ লিত্ববা‘আতিল মাছহাফ আশ-শরীফ, ১৪১৬ হি./১৯৯৫ খ্রি.), পৃ. ৬৩৮।
[৬]. শাইখ সালিহ আল-ফাওযান আল-ফাওযান, ‘আকীদাতুত তাওহীদ ওয়া বায়ানু মা ইউযাদ্দুহা আও ইয়ানকুসুহা মিনাশ শিরকিল আকবারি ওয়াল আসগারি ওয়াত তা‘তীলি ওয়াল বিদাঈ ওয়া গাইরা যালিক, পৃ. ৫০-৫১।
[৭]. শাইখ আব্দুল আযীয ইবনু মুহাম্মাদ আস-সালমান, কিতাবু কাওয়াশিফুল জালিয়্যাহ ‘আন মা‘আনিল ওয়াসিত্বিয়্যাহ, পৃ. ৩৮-৪০।
[৮]. কিতাবু কাওয়াশিফুল জালিয়্যাহ ‘আন মা‘আনিল ওয়াসিত্বিয়্যাহ, পৃ. ৩৯-৪০।
প্রসঙ্গসমূহ »:
মুসলিম জাহান