উত্তর : বিবাহ বিচ্ছিন্ন হবে না। কারণ এক মাজলিসে বা এক সঙ্গে তিন ত্বালাক্ব দিলেও মূলত এক ত্বালাক্বই গণ্য হবে (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ৩৩/৭-১২; ই‘লামুল মুওয়াক্বক্বিঈন, ৩/৩৪; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ২১/৩০৫)। তাই তারা সংসার করতে পারবে। যেমন হাদীছে এসেছে,
أَنَّ رُكَانَةَ إِنَّمَا طَلَّقَ امْرَأَتَهُ الْبَتَّةَ فَجَعَلَهَا النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم وَاحِدَةً.
‘আবূ রুকানাহ তাঁর স্ত্রীকে একসঙ্গে তিন ত্বালাক্ব প্রদান করেন। নবী (ﷺ) এটা এক ত্বালাক্ব নির্ধারণ করলেন’ (আবূ দাঊদ, হা/২১৯৬, সনদ হাসান)। অতএব উপরিউক্ত আলোচনা থেকে একথা দিবালোকের ন্যায় প্রতীয়মান হয় যে, এক মাজলিসে বা এক সঙ্গে তিন ত্বালাক্ব দিলে মূলত তা এক ত্বালাক্ব হিসাবেই গণ্য হবে।
তবে এক বৈঠকে তিন ত্বালাক্ব দেয়া একটি গর্হিত অপরাধ ও জঘন্যতম কাজ। ইসলামে একই সঙ্গে তিন ত্বালাক্ব দেয়ার কোন বিধান নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, তুমি যদি তাকে এক সঙ্গে তিন ত্বালাক্ব দিয়ে থাক, তবে স্ত্রীকে ত্বালাক্ব দেয়ার ব্যাপারে তুমি তোমার প্রতিপালকের অবাধ্য হয়েছ (ছহীহ বুখারী, হা/৪৯০৮, ৫৩৩২; ছহীহ মুসলিম হা/১৪৭১)। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা যখন তোমাদের স্ত্রীদেরকে ত্বালাক্ব দিতে ইচ্ছা কর, তখন তাদেরকে ত্বালাক্ব দিও ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে, আর ইদ্দতের হিসাব রেখো এবং তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর, তোমরা তাদেরকে তাদের বাসগৃহ হতে বহিষ্কার কর না এবং তারা নিজেও যেন বের না হয়, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা। আর যে আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজের উপরই অত্যাচার করে। আপনি জানেন না, হয়তো আল্লাহ এর পর কোন উপায় করে দেবেন’ (সূরা আত-ত্বালাক্ব : ১)।
ত্বালাক্ব দেয়ার পর ইদ্দতের অর্থাৎ তিন তুহুর বা তিন মাসের মধ্যে স্বামী তার স্ত্রীকে বিনা শর্তে (অর্থাৎ নতুন বিবাহ ও মোহরানা ছাড়াই) ফিরিয়ে নেয়ার পূর্ণ অধিকার রাখেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَ بُعُوۡلَتُهنَّ اَحَقُّ بِرَدِّهنَّ فِیۡ ذٰلِکَ اِنۡ اَرَادُوۡۤا اِصۡلَاحًا ‘আর যদি তারা আপোষ-নিষ্পত্তি করতে চায় তবে ইদ্দতের মধ্যে তাদের স্বামীরা তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অধিক হকদার’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২২৮)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ত্বালাক্ব প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয় না। বরং স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ইদ্দত অর্থাৎ তিন মাস শেষ না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকে। ইদ্দতের মধ্যে ত্বালাক্ব প্রত্যাহার করলে পূর্বের বিয়েই অক্ষুণœ থাকে। ফিরিয়ে নেয়ার পদ্ধতি মুখে ফিরিয়ে নেয়ার কথা উচ্চারণ করা। যেমন আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিলাম অথবা স্ত্রী মিলন বা সহবাস করা (তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আল-বাক্বারাহ : ২২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা, ইবনে কাছীর, ফাৎহুল ক্বাদীর)। তবে হ্যাঁ, সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি, শায়খ ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘এক ত্বালাক্ব দেয়ার পর যদি ইদ্দতকাল (অর্থাৎ তিন তুহুর বা তিন মাস) অতিক্রান্ত হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে ত্বালাক্বপ্রাপ্তা স্ত্রীকে নতুন বিবাহের মাধ্যমে ফিরিয়ে নেয়া জায়েয। এক্ষেত্রে স্ত্রীর সম্মতি, অভিভাবক এবং দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতি এবং নতুন মোহরানা অপরিহার্য’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২০/২৩৫-২৩৬; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ ইবনে বায, ২২/৩১৫-৩১৭ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২২৩৫৭২)।
হাসান (রাহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত, মা’কীল ইবনু ইয়াসার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর বোন এক ব্যক্তির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। সে তাকে ত্বালাক্ব দিয়েছিল। অতঃপর তাকে ফিরিয়ে না নিয়ে তার থেকে দূরে অবস্থান করতে থাকে, আর এভাবেই তার ইদ্দতকাল অতিবাহিত হয়ে গেল, পরক্ষণেই সে আবার তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল। মা‘কীল (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এতে খুবই রাগান্বিত হলেন এবং তিনি বললেন, সময় থাকতে ফিরিয়ে নিল না, এখন আবার প্রস্তাব পাঠাচ্ছে! তিনি বিয়ের ব্যাপারে তাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন। এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতটি অবতীর্ণ করেন, ‘আর তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে ত্বালাক্ব দাও এবং তারা তাদের ‘ইদ্দতকাল পূর্ণ করে, অতঃপর তারা যদি বিধিমত পরস্পর সম্মত হয়, তাহলে স্ত্রীগণ নিজেদের স্বামীদেরকে পুনর্বিবাহ করতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিও না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩২)। এরপর রাসূল (ﷺ) মা‘কীল (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে ডাকলেন এবং তাঁর সম্মুখে আয়াতটি পাঠ করলেন। তিনি তার অহমিকা পরিত্যাগ করতঃ আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করেন (ছহীহ বুখারী হা/৫৩৩১, ৪৫২৯, ৫১৩০; আবূ দাঊদ, হা/২০৮৭; তিরমিযী, হা/২৯৮১)।
উল্লেখ্য যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর যুগ পর্যন্ত তিন ত্বালাক্বকে এক ত্বালাক্ব গণনা করা হত। অতঃপর মানুষের মধ্যে ত্বালাক্ব প্রদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ধমকী স্বরূপ এক বৈঠকে প্রদত্ত তিন ত্বালাক্বকে তিন ত্বালাক্ব হিসাবেই গণ্য করার নির্দেশ জারি করা হয়। যা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও সাময়িক বিষয় (ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৭২; সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি, ২০/১৬৩-১৬৪)।
প্রশ্নকারী : নূরুযযামান, গাজীপুর।