উত্তর : হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথর আল্লাহ্র একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পবিত্র কা‘বার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। হাজারে আসওয়াদ মুসলিমদের জন্য আধ্যাত্মিক আকর্ষণ ও ঐক্যের প্রতীক, যা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাতের সাথে যুক্ত। এর উৎপত্তিগত ইতিহাস অতীব প্রাচীন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম)-এর সময়ে এটি জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর মাধ্যমে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে অবতরণ করে। পবিত্র কা‘বার নির্মাণের সময় ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এই পাথরটি স্থাপন করেন (আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ৬৬/১৮৭-১৮৮ পৃ.)।
নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর যুগে যখন পবিত্র কা‘বা পুনর্নির্মাণ করা হয়, তখন হাজারে আসওয়াদ স্থাপন করা হয়। চার পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কা‘বার দেওয়াল দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে বছরের তীব্র বন্যায় কা‘বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। তাই নবুওয়াতের পূর্বে কুরাঈশরা কা‘বাগৃহ ভেঙে পুনর্নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশীদার হতে চায়। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে হাজারে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে বিবাদ হলে মুহাম্মাদ (ﷺ) সমাধান দেন। তিনি একটি কাপড়ের উপর পাথর রেখে সব গোত্রপ্রধানকে একসাথে তা স্থাপন করতে বলেন, এভাবে বিবাদ নিরসন হয় (সীরাতে ইবনু হিশাম, ১/১৯৭; আহমাদ, হা/১৫৫৪৩; মুসতাদরাক হাকিম, হা/১৬৮৩, সনদ ছহীহ)। এটি কেবল একটি পাথর নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলার এক অনুপম নিদর্শন হিসাবে সম্মানিত। এই জান্নাতী পাথরটি শুরুতে দুধের বা বরফের চেয়েও সাদা ছিল। পরে আদম-সন্তানের পাপ তাকে কালো করে দেয়। রাসূল (ﷺ) বলেছেন,
نَزَلَ الْحَجَرُ الْأَسْوَدُ مِنَ الْجَنَّةِ وَهُوَ أَشَدُّ بَيَاضًا مِنَ اللَّبَنِ-أو الثَّلجِ- فَسَوَّدَتْهُ خَطَايَا بَنِى آدَمَ
‘হাজারে আসওয়াদ বা কালো পাথরটি জান্নাত থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। তখন এটি ছিল দুধের বা বরফের চেয়েও সাদা। কিন্তু মানুষের গুনাহ তাকে কালো করে দিয়েছে’ (তিরমিযী, হা/৮৭৭; আহমাদ, হা/২৭৯৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/২৬১৮)। আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إنَّ مسحَ الحجرِ الأسودِ، و الركنَ اليمانيَّ، يحُطَّان الخطايا حطًّا ‘হাজারে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়’ (তিরমিযী, হা/৯৫৯; নাসাঈ, হা/২৯১৯; ছহীহুল জামি‘, হা/২১৯৪)। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, إنَّ لهذا الحجَرِ لسانًا وشَفَتينِ يشهَدُ لِمَن استَلَمه يومَ القيامةِ بحقٍّ ‘হাজারে আসওয়াদের একটি জিহ্বা ও দু’টি ঠোঁট রয়েছে, যে ব্যক্তি তাকে চুম্বন/স্পর্শ করল, তার পক্ষে সে ক্বিয়ামতের দিন সাক্ষী দেবে’ (ছহীহ ইবনু মাজাহ, হা/২৩৮১; ছহীহ ইবনু খুযাইমাহ, হা/২৭৩৬)।
তবে হাজারে আসওয়াদ কেবলই একটি পাথর, যা কারও কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনটাই করতে পারে না। তাই এটি কোন উপাসনার বস্তু নয়! ইসলামে কোন বস্তুর পূজা নিষিদ্ধ। উমর ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, তিনি হাজারে আসওয়াদের কাছে এসে তা চুম্বন করে বললেন, ‘আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একখানা পাথর মাত্র, তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। নবী (ﷺ)-কে তোমায় চুম্বন করতে না দেখলে কখনো আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৫৯৭, ১৬০৫, ১৬১০; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৭০)। সুতরাং যখন থেকে রাসূল (ﷺ) হজ্জ ও উমরার সময় হাজারে আসওয়াদ চুম্বন বা ইশারা করেন তখন থেকেই এটি সুন্নাত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাথরকে স্পর্শ করা বা চুমু দেয়া যদি রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশ না হত, তাহলে একে স্পর্শ করে বরকত লাভ করার আশা অনর্থক ছিল। অতএব মূলত পাথরকে চুমু বা স্পর্শ নয়, বরং আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসরণের কারণে গুনাহ মাফ হবে’ (শারহু ছহীহিল বুখারী লি ইবনিল বাত্ত্বাল, হা/৬৮-এর আলোচনা, ৪/২৭৯; শরহু রিয়াযিছ ছলিহীন লি ইবনি উছাইমীন, হা/১৬৭, ১/১৮৯ পৃ.)।
হাজারে আসওয়াদের রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী। হাজারে আসওয়াদ পবিত্র কা‘বার দক্ষিণ কোণে যমীন থেকে ১.১০ মিটার উচ্চতায় স্থাপিত। এটি দীর্ঘে ২৫ সেন্টিমিটার ও প্রস্থে ১৭ সেন্টিমিটার। শুরুতে হাজারে আসওয়াদ একটি টুকরো ছিল। কিন্তু উমাইয়া যুগে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবায়ের (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর সময় কা‘বা আক্রমণে পাথরটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তিনটি টুকরো হয়ে যায়। পরে এটি রৌপ্য দিয়ে জোড়া লাগানো হয় (আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ৬৬/১৮৭-১৮৮ পৃ.)। অতঃপর শী’আদের একটি ফিরক্বা কারামিতারা ৩১৭ হিজরীতে কা‘বা থেকে হাজারে আসওয়াদ লুট করে ২২ বছর পর্যন্ত বাহরাইনে গোপন করে রাখে। অতঃপর ৩৩৯ হিজরীতে তা উদ্ধার করা হয়। এই ২২ বছর হাজারে আসওয়াদ ছাড়াই হজ্জ সম্পাদিত হয়েছিল। কারামিতারা হাজারে আসওয়াদ ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৪৬৬৪৩)। কারামিতা সম্প্রদায় পাথরটিকে ভেঙে ৮ টুকরো করে ফেলে। এ টুকরোগুলোর সবচেয়ে বড়টি খেজুরের মত। টুকরোগুলো বর্তমানে অন্য আরেকটি পাথরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যার চার পাশে দেয়া হয়েছে রুপার বর্ডার।
প্রশ্নকারী : ফজলে রাব্বী, বরিশাল।