উত্তর: ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) ও ‘ইসলাম ওয়েব’-এর আলেমগণ বলেন, ‘হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো অনুসরণ করতে হবে। যথা: (১) নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব বর্জন করে সৎ মানুষের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করা: সমাজ ও মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকা এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা হতাশা ও বিষণ্নতা থেকে মুক্তির অন্যতম কার্যকর মহৌষধ। আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক মানুষ বরাবরই নিজের কষ্টের সময়গুলো মানুষের সাথে ভাগাভাগি করতে না পেরে নিদারুণ মানসিক কষ্টে আপতিত হয়। সুতরাং সমাজের ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকা, সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা মানুষের জন্য খুবই যরূরী এবং ইসলামের অন্যতম নির্দেশনা। একাকী বিচ্ছিন্ন জীবন ইসলামের কাম্য নয়।
রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘জামা‘আতবদ্ধ জীবন রহমত আর বিচ্ছিন্ন জীবন হল আযাব’ (ছহীহুল জামি‘, হা/৩১০৯)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থাক। কেননা শয়তান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দু’জন সংঘবদ্ধ মানুষ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম জায়গার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে’ (তিরমিযী, হা/২১৬৫)।
(২) নিজেকে কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখা: কর্মহীনতা ও বেকারত্ব বিষন্নতার অন্যতম প্রধান কারণ। সেজন্য যে কোন বৈধ ও হালাল পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে (সূরা আল-ক্বাছাছ: ২৪-২৭)।
(৩) নির্ধারিত সময়ে ছালাত আদায় করা: নিঃসন্দেহে ছালাত মানুষকে সময় সম্পর্কে সচেতন করে এবং মানুষের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে।
(৪) তাক্বদীরের উপর পূর্ণাঙ্গ ঈমান ও আল্লাহর উপর পূর্ণাঙ্গ তাওয়াক্কুল করা: আল্লাহর উপর ভরসা ও তাক্বদীরে বিশ্বাস যে কোন মানুষের জন্য অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস ও সৃদৃঢ় মনোবলের খোরাক। কেননা সে জানে যে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। বিশ্বাসী বান্দার একান্ত মঙ্গলের জন্যই তাঁর কর্মপরিকল্পনা। এই বিশ্বাস তাকে কখনও পথ হারাতে দেয় না। আশার প্রদীপ নেভাতে দেয় না। বরং বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাসে সে সর্বাবস্থায় বলতে পারে- আলহামদুলিল্লাহ। সুতরাং আল্লাহর প্রতি এই দৃঢ় ঈমান যে কোন হতাশা থেকে মুক্তির অব্যর্থ মাধ্যম (সূরা আয-যুমার: ৫৩; সূরা আত-ত্বালাক্ব: ৩, ৭)।
(৫) বেশি বেশি যিকির-আযকার করা: যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَہٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُہٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَعۡمٰی
‘আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য অবশ্যই কষ্টকর জীবন রয়েছে এবং আমরা তাকে অন্ধ অবস্থার হাশর করাব’ (সূরা ত্বো-হা: ১২৪)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘অতএব তাদের জন্য ধ্বংস যাদের অন্তর এতটা কঠোর যে তাতে আল্লাহর কথা মনে পড়ে না’ (সূরা আয-যুমার: ২২)।
(৬) তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত করা: অর্থাৎ আল্লাহর সাথে তাঁর ইবাদতে কোন কিছুকে শরীক না করে এবং তাঁর সকল গুণের সাথে অন্য কাউকে শরীক না করে একচেটিয়াভাবে শুধু তাঁরই ইবাদত করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আমি অচিরেই কাফিরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করব, কেননা তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে- যে বিষয়ে তিনি কোন দলীল প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি’ (সূরা আলে ইমরান: ১৫১)।
(৭) উপকারী ইলম বা জ্ঞান অর্জন করা: কেননা আলিমরাই (জ্ঞানীরাই) সর্বাপেক্ষা সুখী, স্বচ্ছন্দ, ঝঞ্জাটমুক্ত এবং পরিতুষ্ট। বিষন্নতা ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে কোন আলিম আত্মহত্যা করেছেন পৃথিবীতে এমন কোন নজির নেই। কেনইবা আলিমরা এমনটি হবেন না? তারা যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উত্তরাধিকারী।
(৮) বেশি বেশি আমলে ছালিহ বা সৎকাজ করা: একটি নেকির কাজ বা সৎ আমল অন্তর ও চেহারা উভয় স্থানকেই আলোকিত করে এবং রিযিকে প্রশস্ততা বয়ে আনে আর অন্যান্য লোকের অন্তরে নেক আমলকারীর জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি করে’ (সূরা আন-নূহ: ১০-১৪)।
(৯) পাপ না করা: পাপ মানুষের মনের শান্তি নষ্ট করে দেয় এবং পাপের ফলে মানুষ নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবে ও চারিদিকে অন্ধকার দেখে। একজন আরব কবি বলেন,
رأيت الذنوب تميت القلوب ٭ وقد يورث الذل إدمانها
‘আমি পাপকে দেখেছি যে উহা অন্তরকে মেরে ফেলে, আর পাপের আসক্তি আসক্তকে (পাপীকে) অপমানিত করে’।
(১০) কাজে সংযমী হওয়া: কথা-বার্তায়, ঘুমে, মানুষের সাথে মেলামেশার ব্যাপারে এবং খাওয়া-দাওয়ায় সংযত হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ مُعۡرِضُوۡنَ ‘আর যারা অনর্থক ক্রিয়া-কলাপ থেকে বিরত থাকে’ (সূরা আল মুমিনূন: ৩)। একজন আরব কবি বলেছেন, ‘হে কুকর্মকারী! তুমি তো অনেক ঘুমিয়েছ, তুমি কি জান না যে, মৃত্যুর পর লম্বা ঘুম আছে?’ (ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-২৩৫৮২৬৬)।
(১১) নিরন্তন দু’আ করা: বিশেষ করে দুশ্চিন্তা, হতাশা ও বিষন্নতা থেকে মুক্তির নির্ধারিত দু’আ গুলো (বিস্তারিত দ্র.: হিসনুল মুসলিম)। রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘মুমিনের অবস্থা বিস্ময়কর। সকল কাজই তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এ বৈশিষ্ট্য লাভ করতে পারে না। যখন তারা কল্যাণ ও মঙ্গলের মধ্যে থাকে, তখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর যখন অসচ্ছলতা কিংবা বিপদাপদে আক্রান্ত হয়, তখন ধৈর্যধারণ করে। ফলে প্রতিটি অবস্থাই তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়’ (ছহীহ মুসলিম, হা/৭৩৯০)।
প্রশ্নকারী : গোলাম রাব্বী, বরিশাল।