উত্তর : ইসলামী দাওয়াতের স্বার্থে নবী (ﷺ) কখনো কখনো দুর্নাম বা লোকের কথার ভয়ে কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতেন। জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, ‘তখন উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আপনি আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই মুনাফিকের (আব্দুল্লাহ্ ইবনু উবাই এর) গর্দান উড়িয়ে দিই। নবী (ﷺ) বললেন, دَعْهُ لَا يَتَحَدَّثُ النَّاسُ أَنَّ مُحَمَّدًا يَقْتُلُ أَصْحَابَهُ ‘উমার! তাকে ছেড়ে দাও, যাতে লোকেরা এমন কথা বলতে না পারে যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর সাথীদের হত্যা করছেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩৫১৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২৫৮৪)। নবী (ﷺ) লোকের কথা ও সমালোচনার ভয়ে মুনাফিক্বদের হত্যা করেননি। কারণ, তারা লোকেদের ইসলাম গ্রহণ করতে বাধা প্রদান করত। তারা বলত যে, ‘দেখো মুহাম্মাদ তার সাথীদের হত্যা করছে’। রাসূল (ﷺ)-এর মুক্ত ক্রীতদাস ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, ‘... এমতাবস্থায় রাসূল (ﷺ) আসলেন। তখন ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর গলার হারটি তাঁর হাতে ছিল।
তিনি বললেন, ‘ফাতিমা! তুমি কি পসন্দ কর যে, লোক বলাবলি করবে যে, রাসূল (ﷺ)-এর কন্যা, অথচ তাঁর হাতে আগুনের হার রয়েছে। অতঃপর তিনি (ﷺ) বের হয়ে গেলেন, আর বসলেন না। ফাতিমা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) তখনই হারখানা খুলে বাজারে পাঠিয়ে তা বিক্রি করালেন এবং তা দ্বারা একজন ক্রীতদাস ক্রয় করে আযাদ করে দিলেন। এ খবর শুনে রাসূল (ﷺ) বললেন, আল্লাহর শুকর, যিনি ফাতিমাকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করলেন’ (নাসাঈ, হা/৫১৪০, ৫১৫৫; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৪১১)।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, লোকের কথার ভয়ে বা মানুষ কি বলবে সেই ভয় যখন এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত রাখে, যে কাজকে সাধারণ মানুষ অপসন্দ করে, তখন সেটি প্রশংসনীয়। সেটাকে আপনি হারাম মনে করে বর্জন করছেন না, বরং এটিকে মানুষ অপসন্দ করে তাই সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্য বর্জন করছেন। যেমন, কেউ লোকলজ্জার কারণে নাইট ড্রেস পরে বা লুঙ্গি পরে বাজারে বাহির হয় না অথবা কেউ জনসম্মুখে খেতে বা চিবাতে অপসন্দ করে ইত্যাদি। পক্ষান্তরে যদি কেউ দুর্নামের ভয়ে হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে, এক্ষেত্রে তাকে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার কারণে কোন ছাওয়াব দেয়া হবে না। কেননা সে তো আল্লাহর ভয়ে হারাম ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকে-নি, বরং সে মানুষের কথার ভয়ে বা সামাজিক পদমর্যাদা হারানোর ভয়ে বিরত থেকেছে।
আবূ হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ বলেন, আমার বান্দা কোন গুনাহর কাজ করতে চাইলে তা না করা পর্যন্ত তার গুনাহ লেখো না। আর যদি তা করেই ফেলে, তাহলে তা সমপরিমাণ লেখো। আর যদি আমার (মাহাত্ম্যের) কারণে তা ত্যাগ করে, তাহলে তার পক্ষে একটি নেকী লেখো...’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭৫০১; ছহীহ মুসলিম, হা/১২৮)।
অনুরূপভাবে যদি কেউ দুর্নামের ভয়ে বা সমালোচনার ভয়ে শরী‘আত নির্দেশিত ভালো কাজ করে, আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই কাল ক্বিয়ামতের দিন সকলের সামনে প্রকাশ করে দেবেন। যেমন, যদি কেউ লোকের ভয়ে ছালাত আদায় করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা সকলের সামনে তা প্রকাশ করে দেবেন। আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার পায়ের নলা দেখা মাত্রই ঈমানদারগণ সবাই সাজদাহয় পড়ে যাবে। বাকি থাকবে তারা, যারা লোক-দেখানো এবং লোক-শোনানো সাজদাহ করেছিল। তবে তারা যখন সাজদাহর মনোভাব নিয়ে সাজদাহ করার জন্য যাবে, কিন্তু তাদের মেরুদণ্ড একটি তক্তার মত শক্ত হয়ে যাবে...।
‘ছহীহ মুসলিম’-এর বর্ণনায় এসেছে, তখন পৃথিবীতে যারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আল্লাহর উদ্দেশে সাজদাহ করত, সে মুহূর্তে তাদেরকে আল্লাহ সাজদাহ করতে অনুমতি দিবেন এবং তারা সবাই সাজদাহবনত হয়ে পড়বে। আর যে কারো ভয়-ভীতি কিংবা লোক দেখানোর জন্য সাজদাহ করতো তার মেরুদণ্ড শক্ত ও অনমনীয় করে দেয়া হবে। যখনই তারা সাজদাহ করতে ইচ্ছা করবে তখনই তারা চিত হয়ে পড়ে যাবে....’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭৪৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৩)।
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, লোকের কথার ভয়ে বা মানুষ কী বলবে সেই ভয়ে যখন আপনি এমন কোন কাজ করা থেকে বিরত থাকছেন, যে কাজকে ইসলাম হারাম করেছে, অথবা এমন কোন কাজ করছেন যে কাজ করতে ইসলাম আদেশ করেছে, তখন সেটি নিন্দনীয়। অতএব মোদ্দাকথা হল- দুর্নামের ভয়ে ভালো কাজ করলে বা দান করলে সেটি রিয়া হিসাবে গণ্য হবে।
প্রশ্নকারী : হৃদয়, বকশিবাজার, ঢাকা।