উত্তর :সূদমুক্ত কিস্তি ইসলামে জায়েয। অনুরূপভাবে সূদের কথা উল্লেখ করা ব্যতীত দামে কমবেশিও জায়েয। ইসলামের দৃষ্টিতে এই পদ্ধতিকে বায়ে মুয়াজ্জাল বলে। বায়ে মুয়াজ্জাল (بيع المؤجل) বলতে বোঝায় বাকিতে বা ধারে ক্রয়-বিক্রয় করা। ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘বায়ে মুয়াজ্জাল জায়েয’ (আল-মুগনী, ৬/৩৮৫ পৃ.)। বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা সুস্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত। যেমন, আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ اشْتَرَى طَعَامًا مِنْ يَهُوْدِيٍّ إِلَى أَجَلٍ وَرَهَنَهُ دِرْعًا مِنْ حَدِيْدٍ
‘নবী করীম (ﷺ) জনৈক ইয়াহুদীর নিকট হতে নির্দিষ্ট মেয়াদে মূল্য পরিশোধের শর্তে (অর্থাৎ ধারে) খাদ্য ক্রয় করেন এবং তার নিকট নিজের লোহার বর্ম বন্ধক রাখেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/২০৬৮, ২০৯৬; ছহীহ মুসলিম, হা/১৬০৩)। ঋণ বা কর্জ পরিশোধ করার দু’টি পদ্ধতি। যথা : (১) নির্দিষ্ট দিনে এক সঙ্গে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা, যা উপরিউক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। (২) নির্ধারিত মেয়াদে নির্দিষ্ট সংখ্যা কিস্তিতে উক্ত ঋণ পরিশোধ করা, যা নিম্নোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, جَاءَتْنِيْ بَرِيْرَةُ فَقَالَتْ كَاتَبْتُ أَهْلِيْ عَلَى تِسْعِ أَوَاقٍ فِيْ كُلِّ عَامٍ وَقِيَّةٌ فَأَعِيْنِيْنِيْ... ‘বারীরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা) আমার কাছে এসে বলল, আমি আমার মুক্তিপণ হিসাবে মালিক পক্ষের সাথে ৯ উকিয়াতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। (১উকিয়া =৪০ দিরহাম) এবং কিস্তি (ওহংঃধষষসবহঃ) স্বরূপ প্রতি বছর এক উকিয়া করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছি (অর্থাৎ নয় বছরে নয়টা কিস্তি)। অতএব আপনি (এ ব্যাপারে) আমাকে সাহায্য করুন...’ (ছহীহ বুখারী, হা/২১৬৮, ২৫৬৩, ২৭২৯; ছহীহ মুসলিম, হা/ ১৫০৪; আবূ দাঊদ, হা/৩৯৩০)। উপরিউক্ত দু’টি হাদীছ থেকে বায়ে মুয়াজ্জাল বা বাকিতে ও কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের বৈধতা প্রমাণিত হল।
দ্বিতীয়তঃ বাকিতে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধি করা যাবে কি না? মানে একই জিনিস নগদে ১০০ টাকায় আর বাকীতে ১১০ টাকায় বিক্রয় করা যাবে কিনা? বর্তমানে সিংহভাগ কোম্পানীতে এই পদ্ধতি চালু আছে, বিশেষ করে মোটর-যান কম্পানীতে। এই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে সামান্য মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ আলেম এটাকে জায়েয বলেছেন, যার মধ্যে রয়েছেন চার মাযহাব তথা হাম্বালী, শাফিঈ, মালিকী ও হানাফী মাযহাবের ইমামরা’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৯/৪৯৯ পৃ.; আল-ওয়াজিয, ১/৮৫ পৃ.; বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ২/১০৮ পৃ.; বাদায়িউছ ছানায়ী, ৫/১৮৭ পৃ.)। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ বলেন,
ذلك جائز، لا بأس به؛ لدخوله في عموم قوله تعالي {وَ اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ } (البقرة: ٢٧٥) و قوله تعالي { یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا تَدَایَنۡتُمۡ بِدَیۡنٍ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی فَاکۡتُبُوۡہُ} (البقرة: ٢٨٢) وهذا المشتري عرضت عليه السلعة بثمنين: ثمن النقد، والثمن المؤجل، و لنفرض أن ثمن النقد مائة، وأن المؤجل مائة و خمسون، فأخذ بالمؤجل في نفس المجلس،و ذهب بالسلعة، فثبت في ذمته مئة و خمسون علي وجه التحديد و التعين، فهذا بيع لا بأس به، لأن المشتري خير بين هذا، أو هذا .
‘এটি বৈধ, এতে কোন সমস্যা নেই। কারণ এটি সাধারণ বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ اَحَلَّ اللّٰہُ الۡبَیۡعَ ‘আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৭৫)। অন্যত্র বলেন, یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا تَدَایَنۡتُمۡ بِدَیۡنٍ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی فَاکۡتُبُوۡہُ ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা নির্ধারিত সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৮২)। এখানে ক্রেতাকে দুই ধরনের মূল্যে পণ্যটি সরবরাহ করা হচ্ছে। (১) নগদ মূল্যে (২) ধার বা বাকিতে। আমরা ধরে নিচ্ছি যে, নগদ মূল্য ১০০ টাকা, আর ধারের মূল্য ১৫০ টাকা। ঐ বৈঠকেই ক্রেতা ধারের মূল্য ১৫০ টাকাতে ক্রয় করে পণ্যটি নিয়ে চলে গেলেন। অতএব এখন তার দায়িত্বে নির্ধারিত মেয়াদে ১৫০ টাকা ঋণ প্রতিষ্ঠিত হল। এ জাতীয় ক্রয়-বিক্রয়ে কোন সমস্যা নেই। কারণ এখানে ক্রেতাকে ১০০ ও ১৫০ টাকার মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ র্দাব ইবনে উছাইমীন, ৯/৫৭; ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমা, ১৩/১৯২-১৯৭ পৃ.)। শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতিতে নগদের তুলনায় বাকিতে বেশি জায়েয আছে (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা, ২/৩৩১ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩৯৭৩)। আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ ﷺ أَمَرَهُ أَنْ يُجَهِّزَ جَيْشًا فَنَفِدَتْ الْإِبِلُ فَأَمَرَهُ أَنْ يَأْخُذَ فِيْ قِلَاصِ الصَّدَقَةِ، فَكَانَ يَأْخُذُ الْبَعِيْرَ بِالْبَعِيْرَيْنِ إِلَى إِبِلِ الصَّدَقَةِ
‘রাসূল (ﷺ) তাকে একটি অভিযানের জন্য সৈন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। সৈন্য প্রস্তুতে উটের অভাব দেখা দিলো। তিনি তাকে যাকাতের উট প্রাপ্তি সাপেক্ষে ধার নিতে বললেন। তদনুযায়ী তিনি যাকাতের উট প্রাপ্তি সাপেক্ষে দু’টি করে উটের বিনিময়ে একটি করে উট গ্রহণ করলেন’ (আবূ দাঊদ, হা/৩৩৫৭; সনদ হাসান, ইরওয়াউল গালীল, হা/১৩৫৮; ফাতাওয়া ইবনু বায, ১৯/১০৭; আল-মাজমূঊ লিন নাবাবী, ৯/৩৯৯ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : কাজী আল আমীন বিন মা‘রূফ, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ।