উত্তর : আহলুস সুন্নাহ্ ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ আলেমের বক্তব্য অনুযায়ী, অত্যাচারী মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং অস্ত্র ধারণ করা জায়েয নয়। যতক্ষণ শাসক স্পষ্ট কুফরিতে লিপ্ত না হবে।
১- ইমাম আবূ হানীফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি লোকেরা মুসলিমদের মধ্য থেকে কোন একজন ইমামের (শাসকের) ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে এবং লোকেরা নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে বসবাস করে এবং রাস্তা-ঘাটও বিপদমুক্ত থাকে। এমতাবস্থায় যদি ইসলামের লেবাসধারী কিছু দুষ্টু মানুষ মুসলিম জামা‘আত সমর্থিত শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তাহলে সাধারণ মুসলিমদের উচিত জামা‘আত সমর্থিত শাসককে সাহায্য করা। আর যদি তারা সাহায্য করতে না পারে, তবে তারা যেন তাদের ঘরের মধ্যেই অবস্থান করে এবং যারা মুসলিম জামা‘আত সমর্থিত শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে, তাদের সঙ্গে বের হবে না, এবং তাদেরকে সাহায্যও করবে না’ (হাশিয়াতুশ শিলবী ‘আলা তাবয়ীনুল হাক্বাঈক্ব, ৩/২৯৪ পৃ.)।
২- ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুসলিমদের শাসকগণের মধ্যে কোন একজন শাসক, যার শাসক হওয়ার ব্যাপারে মুসলিমরা একমত। যদি কেউ বৈধ বা অবৈধ পদ্ধতিতে নিজে শাসক হওয়ার লোভে এমন ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তবে নিশ্চিতরূপে এমন বিদ্রোহ ইসলাম বহির্ভূত এবং রাসূল (ﷺ)-এর আদর্শ বিরোধী। বিদ্রোহী অবস্থায় যদি তার মৃত্যু হয়, তবে সে জাহিলিয়্যাতের অবস্থায় মরবে। জনগণের কারো জন্য শাসকের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ নয় এবং জনগণের কারো জন্য তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাও জায়েয নয়। সুতরাং যে এটি করবে সে নিশ্চিতরূপে বিদ‘আতকারী। সুন্নাহ ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত’ (উছূলুস সুন্নাহ, পৃ. ৪৫)।
৩- ইমাম ত্বাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, لا نَرَى الخُروجَ على أئِمَّتِنا وولاةِ أمورِنا، وإن جارُوا ‘আমরা বৈধ মনে করি না-আমাদের শাসকদের এবং আমাদের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাকে, যদিও তারা অন্যায় করে বা বাড়াবাড়ি করে’ (মাতনুত্ব ত্বাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৮ পৃ.)।
৪- আবূ বাকর আল-ইসমাঈলী (রাহিমাহুল্লাহ) আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা সম্পর্কে বলেন, তাঁরা মনে করতেন যে, প্রত্যেক মুসলিম শাসকের পিছনে জুমু‘আর বা অন্যান্য ছালাত আদায় করা জায়েয। সে শাসক সৎ হোক কিংবা অসৎ। তার আদেশানুয়ী কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা বৈধ মনে করতেন এবং তার জন্য সংশোধন, পরিবর্তন এবং ইনছাফের দু‘আ করাও বৈধ মনে করতেন। কিন্তু তাঁরা শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ বা বিদ্রোহ করা বৈধ মনে করতেন না। তবে তাঁরা ন্যায়বিচারক শাসকের সঙ্গে মিলিত হয়ে শর্ত সাপেক্ষে বিশৃঙ্খলাকারী ও সীমালঙ্ঘনকারী দলটির সাথে যুদ্ধ করা বৈধ মনে করতেন (ই‘তিক্বাদু আয়িম্মাতিল হাদীছ, পৃ. ৭৫)।
৫- ইমাম ইবনু বাত্ত্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ফক্বীহগণ এই ব্যাপারে একমত যে, সীমালংঘনকারী শাসকের আনুগত্য করা ততক্ষণ পর্যন্ত জায়েয যতক্ষণ পর্যন্ত সে জুমু‘আর ছালাত, ঈদের ছালাত এবং জিহাদ প্রতিষ্ঠিত করে এবং অধিকাংশ সময় উৎপীড়িত ও অত্যাচারিতদের সঙ্গে ইনসাফ করে। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার চাইতে তার আনুগত্য করা উত্তম। কারণ এটি জনতাকে শান্ত করে এবং রক্তপাত বন্ধ করে (শারহু ছহীহিল বুখারী, ২/৩২৮ পৃ.)।
৬- ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, পক্ষান্তরে আহলুল হাক্ব অর্থাৎ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী আলেমগণ বলেন, এটিই উত্তম যে, ইমাম অবশ্যই সদাচারী, ন্যায়পরায়ণ ও পরোপকারী হবে। যদি তিনি এমন না হোন! তাহলে তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার চাইতে অত্যাচারী শাসকের আনুগত্য করা এবং ধৈর্য ধারণ করা অধিক উত্তম। কারণ তার সাথে বিবাদ করা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলে, নিরাপত্তা ভয় দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং রক্তপাত ঘটায়, আঘাত হানে এবং পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যায় এবং অনৈতিকতার উপর ধৈর্যধারণ চেয়ে অধিক ভয়াবহ। এমন প্রত্যেক শাসক যে জুমু‘আর ছালাত এবং ঈদের ছালাত আদায় করে। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, শত্রুদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রয়োগ করে, অভিযোগের ভিত্তিতে একে অপরের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত, তার কারণে জনগণের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে, রাস্তা-ঘাটে নিরাপত্তা থাকে। এমন শাসকের প্রত্যেকটি উপদেশ এবং বৈধ আদেশের আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক (আত-তামহীদ, ২৩/২৭৯ পৃ.)।
৭- শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আলুসস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং অস্ত্র ধারণ করা জায়েয নয়। যদিও তারা অত্যাচারী হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) থেকে অসংখ্য ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে’ (মিনহাজুস সুন্নাহ, ৩/৩৯১ পৃ.)। তবে হ্যাঁ, শাসক যদি স্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত হয় কিংবা মুরতাদ (مُرْتَدّ) (স্বধর্মত্যাগী) হয়। সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা জায়েয। ছহীহ বুখারীতে ‘কিতাবুল ফিতান’-এর মধ্যে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘নবী (ﷺ)-এর বাণী, ‘আমার পরে অচিরেই তোমরা এমন কিছু বিষয় দেখতে পাবে, যা তোমরা পসন্দ করবে না’ নামে একটি অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (অধ্যায় নং-৯২, অনুচ্ছেদ নং-২) এবং এর অধীনে তিনি বেশ কয়েকটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীছ হল, জুনাদাহ ইবনু আবূ উমাইয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমরা উবাদাহ ইবনু ছামিত (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট ছিলাম। তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন। ... তিনি (উবাদাহ) বললেন, নবী (ﷺ) আমাদের আহ্বান করলেন। আমরা তাঁর কাছে বাই‘আত করলাম।... আমাদের থেকে যে অঙ্গীকার তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাতে ছিল যে, আমরা আমাদের সুখে-দুঃখে, বেদনায় ও আনন্দে এমনকি আমাদের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার দিলেও পূর্ণরূপে শোনা ও মানার উপর বাই‘আত করলাম। অতঃপর وَأَنْ لَا نُنَازِعَ الْأَمْرَ أَهْلَهُ إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنْ اللهِ فِيْهِ بُرْهَانٌ ‘আরো (বাই‘আত করলাম) যে, আমরা ক্ষমতা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঝাগড়া করব না। তবে হ্যাঁ, যদি তোমরা (শাসককে) স্পষ্ট কুফরীতে দেখো, যে সম্পর্কে তোমাদের কাছে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহলে সেটি ভিন্ন কথা’ (ছহীহ বুখারী, হা/৭০৫৫-৭০৫৬, ৭২০০; ছহীহ মুসলিম, হা/১৭০৯)।
উপরিউক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি শাসক দ্বারা স্পষ্ট কুফরী সংঘটিত হয়, আর সেটা যদি বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়ে তার আনুগত্য করা জায়েয নয়। বরং ক্ষমতা থাকলে প্রতিবাদ করা অপরিহার্য’ (ফাৎহুল বারী, ১৩/৭-৮ পৃ.)। ইমাম খাত্ত্বাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অর্থাৎ সে যদি প্রকাশ্যে কুফরী মূলক কাজ করে’ (গারীবুল হাদীছ, ১/৬৯০ পৃ.)। আবূ ইয়া‘আলা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘সে যদি দ্বীন বিনষ্টকারী কাজ করে, যদি সে ঈমান আনয়নের পর ধর্ম ত্যাগ করে, তাহলে তাকে শাসকের পদ থেকে বহিস্কৃত করতে হবে এবং তাকে হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে’ (আল-মু‘তামিদ ফী উছূলিদ দ্বীন, পৃ. ২৪৩)। ক্বাযী আয়ায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মুসলিমদের ঐকমত্যানুযায়ী কোন কাফিরের জন্য ক্ষমতা বাস্তবায়ন করা যাবে না এবং তাকে সাপোর্ট করা যাবে না’ (ইকমালুল মু‘লিম, ৬/২৪৬ পৃ.)।
ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘অর্থাৎ যদি তার কুফরী স্পষ্ট দলীল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কোন প্রকার সন্দেহ ছাড়াই তার কুফরীর কথা জানা যায়, তাহলে তার আনুগত্য থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে’ (আল-মুফহিম, ৪/৪৬ পৃ.)। শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যদি মুসলিমরা শাসককে স্পষ্ট কুফরী করতে দেখে, সেক্ষেত্রে ক্ষমতা থাকলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা দোষনীয় নয়। আর যদি তাদের ক্ষমতা না থাকে, তাহলে বিদ্রোহ করা যাবে না। অথবা বিদ্রোহ করতে গিয়ে যদি ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য বিদ্রোহ করা যাবে না। এ ব্যাপারে শরী‘আতের স্থিরিকৃত নীতিমালা হল, أنَّه لا يَجوزُ إزالةُ الشَّرِّ بما هو أشَرُ منه، بَل يَجِبُ دَرءُ الشَّرِّ بما يُزيلُه أو يُخَفِّفُه ‘মন্দকে তার চেয়ে খারাপ কিছু দ্বারা প্রতিহত করা জায়েয নয়, বরং যা দ্বারা দূর করা বা কম করা সম্ভব তা দ্বারা মন্দকে দূরে রাখা আবশ্যক। মুসলিমদের ইজমা’ অনুযায়ী, মন্দকে অধিকতর মন্দ দ্বারা দূরীভূত হয় জায়েয নয়’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ৮/২০৩ পৃ.)।
শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইসলামী শরী‘আতের একটি সূত্র হল, ‘মন্দকে মন্দতর দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে না। বরং যা দিয়ে মন্দকে নির্মূল করা যাবে, কিংবা কমানো যাবে তা দ্বারা মন্দকে প্রতিরোধ করতে হবে’। তাই যে শাসক সুস্পষ্ট কুফরীতে লিপ্ত তাকে যারা ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় তাদের যদি এমন সক্ষমতা থাকে যা দিয়ে তারা তাকে পদচ্যুত করতে পারবে এবং তার বদলে একজন ভাল ও নেককার শাসক বসাতে পারবে। আর এর ফলে মুসলিমদের মধ্যে বড় ধরনের কোন বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে না, এ শাসকের অনিষ্টের চেয়ে বড় কোন অনিষ্টের শিকার হবে না, তাহলে এতে কোন বাধা নেই। পক্ষান্তরে, এ বিদ্রোহের মাধ্যমে যদি বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, নিরপরাধ মানুষ যুলুম ও গুপ্ত হত্যার শিকার হয়... ইত্যাদি ইত্যাদি তাহলে বিদ্রোহ করা জায়েয হবে না। বরং ধৈর্য ধারণ করতে হবে, শাসকের ভাল নির্দেশের আনুগত্য করতে হবে। শাসককে উপদেশ দিতে হবে, ভাল কাজ করার দিকে ডাকতে হবে। মন্দকে কমানো ও ভালকে বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এটাই সরল পথ, যে পথ অনুসরণ করা আমাদের কর্তব্য। কারণ এ পথে মুসলিমদের জন্য সার্বিক কল্যাণ নিহিত, এ পথে ক্ষতির দিক কম, কল্যাণের দিক বেশি, এ পথে আরো বড় অকল্যাণ থেকে মুসলিমদের নিরাপত্তা নিহিত আছে’ (আশ-শারহুল মুমতি‘, ১১/৩২৩ পৃ.; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৯৯১১)।
রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘তোমাদের উপরে ভালো ও মন্দ দু’ধরনের শাসক আসবে। যে ব্যক্তি তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে সে দায়িত্বমুক্ত হবে। যে ব্যক্তি তাকে অপসন্দ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। কিন্তু যে ব্যক্তি তার উপর সন্তুষ্ট থাকবে ও তার অনুসারী হবে। তখন ছাহাবায়ে কিরাম বললেন, ‘আমরা কি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না? উত্তরে রাসূল (ﷺ) বললেন, না, যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে। না, যতক্ষণ তারা ছালাত আদায় করে’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১৮৫৪, ১৮৫৬)। ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে ছালাত আদায় করতে থাকবে, তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা যাবে না’ (নাইনুল আওত্বার, ৭/২০৬ পৃ.; শারহুল মিশকাত, ৮/২৫৬২ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : রাসেল মাহমুদ, হাজিগঞ্জ, চাঁদপুর।