উত্তর : গাযওয়াতুল হিন্দের ব্যাপারে ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছ তথা প্রথম হাদীছটি ছহীহ। বাকী আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত সব হাদীছই যঈফ। ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছে কিন্তু গাযওয়াতুল হিন্দের নির্ধারিত সময়কাল উল্লেখ করা হয়নি। তা কখন সংঘটিত হবে? তা কি যে কোন যুগে সংঘটিত হতে পারে? না-কি শেষ যুগে বা মাহদীর যুগেই হবে? এ সম্পর্কে কোন আলোচনা করা হয়নি। ইমাম ইবনু কাছীর, মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহহাব বুহাইরী, সিদ্দীক হাসান খান কান্নৌজী (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ)-এর মতে এ যুদ্ধ বহু পূর্বেই সংঘটিত হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু ক্বাসিম, সুলতান মাহমুদ গাজনাবী বা মাহমুদ ইবনু সুবুক্তগীনের বিজয়ের মাধ্যমে (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৮৫২৯)। মুসলিমরা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে একাধিকবার যুদ্ধাভিযান চালিয়ে জয়লাভ করেছেন। যেমন সর্বপ্রথম উমার ফারুক্ব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খিলাফাতকালে ১৫ হিজরীতে উসমান ইবনু আবুল আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর নেতৃত্বে একটি সামরিক বাহিনী প্রেরণ করা হয়। যারা স্তর থানা, ব্রূস ও দেবল বন্দরে সফল অভিযান পরিচালনা করেন। থানাকে বর্তমানে মুম্বাই, ব্রূসকে গুজরাট এবং দেবলকে করাচী বলা হয়। তাঁরা এ সময় ‘সরনদীব’ জয় করেন। যাকে বর্তমানে শ্রীলঙ্কা বলা হয় (আতহার মুবারকপুরী, আল-ইক্বদুছ ছামীন ফী ফুতুহিল হিন্দ, কায়রো: দারুল আনছার, ২য় সংস্করণ, ১৩৯৯ হি./১৯৭৯ খ্রি.), ১ম খণ্ড, পৃ. ২৬, ৪০, ৪২, ৪৪)।
ইমাম ইবনে কাছীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) إِشَارَةٌ نَبَوِيَّةٌ إِلَى أَنَّ الْجَيْشَ الْمُسْلِمَ سَيَصِلُ إِلَى الْهِنْدِ وَالسِّنْدِ ‘অচিরেই হিন্দে এবং সিন্ধুতে মুসলিম সেনাবাহিনীর প্রবেশের ব্যাপারে রাসূল (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী’ শিরোনামের অধীনে বলেন, ‘৪৪ হিজরীতে মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে মুসলিমরা সর্বপ্রথম হিন্দুস্তান আক্রমণ করেন। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চারশ’ (৪০০) হিজরী সনের দিকে গজনী ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের মহান অধিপতি সুলতান মাহমুদ সুবুক্তগীনের হিন্দুস্তান-অভিযান ও তাঁর বহুবিধ বীরত্বের কাহিনী সর্বজনবিদিত এবং প্রশংসিত। তিনি সেখানের সোমনাথ নামক মন্দিরের সর্ববৃহৎ মূর্তিটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেন। এরপর তিনি গনীমতের মাল হিসাবে প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিয়ে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে যান (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম, ১২/৩০ ও ৬/২২৩ পৃ.)।
ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) অন্যত্রে الاخْبَارُ عَنْ غَزْوَةِ الْهِنْدِ ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’ সংক্রান্ত হাদীছসমূহ) শিরোনামের অধীনে বলেন, ‘৪৪ হিজরীতে মু‘আবিয়াহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর শাসনামলে মুসলিমরা সর্বপ্রথম হিন্দুস্তানে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত বিবরণ সামনে আলোচনা করা হবে। চারশো (৪০০) হিজরী সনের দিকে গাজনীর সুলতান মাহমুদ সুবুক্তগীনও হিন্দুস্তানে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। সে সকল যুদ্ধে তিনি অনেক মুশরিককে হত্যা ও বন্দি করেন এবং গনীমতের মাল হিসাবে প্রচুর ধন-সম্পদ লাভ করেন। তিনি সোমনাথ মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তি পূজকদের সবচেয়ে বড় মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলেন। এরপর তিনি বিজয়বেশে নিরাপদে হিন্দুস্তান থেকে গাজনিতে ফিরে আসেন (আল-বিদায়াহ্ ওয়ান-নিহায়াহ্ ৪/৬৩১, ১১/৩৫৮ পৃ.)।
আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান কান্নৌজী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আর স্তর বিষয় হল ৯২-৯৩ হিজরী সালে উমাইয়াহ খলীফা ওয়ালিদ ইবনু আব্দুল মালিকের শাসনামলে মুহাম্মাদ ইবনু ক্বাসীম ছাক্বাফীর নেতৃত্বে হিন্দুস্তান বিজয় লাভ করে। ৯৫ হিজরীতে সিন্ধু থেকে কানৌজের শেষসীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় মুসলিমদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর স্তর ক্ষমতায় রদবদল হলেও সিন্ধুতে ধারাবাহিকভাবে উমাইয়াহ এবং আব্বাসী খলীফাদের প্রতিনিধিগণ দাপটের সাথে রাজত্ব করেছেন। ৪র্থ হিজরীর শেষ দিকে সুলতান মাহমুদ গাজনাবী হিন্দুস্তানে আক্রমণ করেন। দফায় দফায় হামলা চালিয়ে তিনি বিজয়লাভ করেন এবং প্রচুর গনীমতের মাল প্রাপ্ত হন।... তখন থেকে ১২০০ হিজরী পর্যন্ত স্তর ক্ষমতা মুসলিম সুলতানদের অধীনেই ছিল (আবজাদুল উলূম, ৩/২১৪ ও ১/৩৪৪-৩৪৫ পৃ.; আল-বিদায়াহ্ ওয়ান-নিহায়াহ, ৯/৭৭, ৯৫, ১১৩; আল-ইক্বদুছ ছামীন, ১/১৪১-১৪২ পৃ.)।
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহ্হাব বুহাইরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছে রাসূল (ﷺ) যে, গাযওয়াতুল হিন্দ ও সিন্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা উমাইয়্যাদের শাসনামলেই সংঘটিত হয়ে গিয়েছে। অতঃপর তিনি বিভিন্ন যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন (বুলূগুল আমানী মিন আসরারীল ফাতহির রাব্বানী, ২২/৪১১ পৃ.)। শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘কিছু বুদ্ধিজীবী মনে করেন যে, শেষ যামানায় ক্বিয়ামতের পূর্ব মুহূর্তে অথবা ঈসা (আলাইহিস সালাম) সময়কালে ভারতবর্ষে পুনরায় আক্রমণ করা হবে, অথচ এই মর্মে কোন প্রমাণ নেই। বরং পূর্বালোচনা থেকে এটাই প্রতিভাত হয় যে, হাদীছে যে যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া হয়েছে তা ঘটে গিয়েছে এবং ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর হাদীছের দু’টি দলকে একই সময়ের সঙ্গে বাঁধা অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক, বরং প্রতিটি দলের সংঘটিত হওয়ার নিজস্ব সময় রয়েছে। আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৪৮৫২৯)।
অতএব শেষ যামানার সঙ্গে অথবা ইমাম মাহদীর সময়কালের সঙ্গে গাযওয়াতুল হিন্দকে সুনির্দিষ্ট করা যুক্তিসঙ্গত নয়। সুতরাং যারা বলছেন যে, ‘গাযওয়াতুল হিন্দ এখনো সংঘটিত হয়নি’ তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের জিজ্ঞাসা, তাহলে ইতিপূর্বে ভারতবর্ষে যতগুলো যুদ্ধে মুসলিম সেনাবাহিনীরা জয়লাভ করেছেন, সেগুলো কি গাযওয়াতুল হিন্দের অন্তর্ভুক্ত নয়? যদি না হয়! তাহলে কেন নয়? কোন্ দলীলের ভিত্তিতে রাসূল (ﷺ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী থেকে এগুলোকে পৃথক করা হচ্ছে? যেহেতু আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীছ ‘হিন্দুস্তানের নেতাদেরকে মুসলিম সেনারা শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় শাম দেশে নিয়ে যাবে। অতঃপর ঈসা (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে সাক্ষাৎ করবে’ যঈফ ও দুর্বল। আর যঈফ হাদীছের আলোকে শরী‘আতের কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হয় না, বা কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। এর পরেও আমরা কিভাবে বলছি যে, গাযওয়াতুল হিন্দ এখনো সংঘটিত হয়নি বরং তা ঈসা (আলাইহিস সালাম) অবতরণ কালে সংঘটিত হবে!?