উত্তর : তাদের দাবী সঠিক নয়। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, لَا نِكَاحَ إِلَّا بِوَلِيٍّ ‘অভিভাবক ছাড়া কোনো বিয়ে হতেই পারে না’ (আবূ দাঊদ, হা/২০৮৫; তিরমিযী, হা/১১০১; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৮১; মুসনাদে আহমাদ, হা/১৯৫১৮)। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘কোন মহিলা তার অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করলে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল। আর তার স্বামী তার সাথে সহবাস করলে, সে স্বামীর নিকট মোহরানার অধিকারী হবে, তার লজ্জাস্থান হালাল মনে করার জন্য । যদি উভয় পক্ষের (অভিভাবকদের) মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তাহলে শাসক হবেন তার অভিভাবক। কারণ যাদের অভিভাবক নেই তার অভিভাবক শাসক’ (তিরমিযী, হা/১১০২, আবূ দাঊদ, হা/২০৮৩; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৭৯; ইরওয়াউল গালীল, হা/১৮৪০; মিশকাত, হা/১৩৩১)। আবূ হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘কোন মহিলা অপর কোন মহিলাকে বিবাহ দিবে না এবং কোন মহিলা নিজেকেও বিবাহ দিবে না’ (ইবনু মাজাহ, হা/১৮৮২; সনদ ছহীহ, ইরওয়াউল গালীল, হা/ ১৮৪১)। ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উপরিউক্ত হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, বিবাহে ওয়ালী বা অভিভাবক শর্ত। ওয়ালী ব্যতীত বিবাহ সম্পাদিত হবে না’ (নাইলুল আওত্বার, ৬/১৪৯ পৃ.)।
মালিকী, শাফিঈ, হাম্বালী মাযহাব এবং শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) ও অধিকাংশ আলেমের মতানুযায়ী কুমারী অথবা বিধবা উভয়ের ক্ষেত্রেই অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ হালাল হবে না। সালাফে ছালিহীন একই কথা বলেছেন (মুখতাছার খালীল, পৃ. ৯৬; আশ-শারহুল কাবীর, ২/২২০ পৃ.; রওযাতুত্ব ত্বালিবীন, ৭/৫০; তুহফাতুল মুহতাজ, ৭/২১৭; আল-ইক্বনা‘, ৩/১৭১; কাশশাফুল কিনা‘, ৫/৪৮; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনু বায, ২১/৩৯ পৃ.)। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, শা‘বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ওমর ফারূক, আলী, আবূ হুরায়রা, ইবনু মাসঊদ ও শুরাইহ বিন হারিছ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম) অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিবাহকে জায়েয মনে করতেন না। সাঈদ ইবনু মুসাইয়্যব, হাসান বাছরী, ওমর ইবনু আব্দুল আযীয, ইবরাহীম নাখঈ, জাবির ইবন যাযেদ, ক্বাতাদাহ্, সুফিয়ান ছাওরী, আওযায়ী, ইবনু আবী লাইলা, ইবনুল মুবারক, ইমাম শাফিঈ, উবাইদুল্লাহ বিন হাসান, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল, ইসহাক্ব বিন রাহ্ওয়াইহ এবং ক্বাসিম বিন সালাম একই কথা বলেছেন। আর আমার জানা মতে এ বিষয়ে ছাহাবীগণের মধ্যে কোন মতপার্থক্য ছিল না (কিতাবুল আওসাত্ব, ৮/২৬৮ পৃ; তিরমিযী, হা/১১০২)।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এবং যখন তোমরা স্ত্রীদের (রাজয়ী) ত্বালাক্ব দাও এবং তারা তাদের ইদ্দত (নির্দিষ্ট সময়) পূর্ণ করে, তখন তারা যদি বিধিমত পরস্পর সম্মত হয়, তাহলে স্ত্রীগণ নিজেদের স্বামীদেরকে পুনর্বিবাহ করতে চাইলে তাদেরকে বাধা দিও না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২৩২)। শায়খ ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘(তাদেরকে বাধা দিও না) শব্দ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, তারা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিবাহ করতে পারবে না। আর যদি কারোর অভিভাবক না থাকে তাহলে অন্য কেউ তার অভিভাবক হয়ে বিবাহ দেবে’ (লিক্বাউশ শাহরী, লিক্বা নং-৭৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘(ইসলাম ধর্মে) বিশ্বাস না করা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষের সাথে (তোমাদের কন্যার) বিবাহ দিয়ো না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ : ২২১)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘সুতরাং তোমরা তাদেরকে তাদের অভিভাবকের অনুমতিক্রমে বিবাহ কর’ (সূরা আন-নিসা : ২৫)। তিনি আরো বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত তাদের বিবাহ দিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও’ (সূরা আন-নূর : ৩২)। ইমাম কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) ও হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘উপরিউক্ত আয়াতগুলোতে পুরুষ অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান করা হয়েছে। যেন তারা তাদের অধীনস্ত মহিলাদের বিবাহ দিয়ে দেয়। এখানে কোনো মহিলাকে সম্বোধন করা হয়নি’ (তাফসীরে কুরতুবী, ৩/১৬৪ পৃ.; ফাৎহুল বারী, ৯/১৮৭ পৃ.)।
দ্বিতীয়তঃ প্রশ্নে উল্লেখিত হাদীছটি ছহীহ বুখারীর মধ্যে একাধিকবার বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি বর্ণনা করার পূর্বে ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) এক জায়গায় بَاب إِذَا كَانَ الْوَلِيُّ هُوَ الْخَاطِبَ ‘ওয়ালী বা অভিভাবক নিজেই যদি বিয়ের পাত্র হয়’, নামে একটি শিরোনাম বা অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (অধ্যায় নং-৬৭, অনুচ্ছেদ নং-৩৮)। অন্য জায়গায় তিনি (بَابُ السُّلْطَانُ وَلِيٌّ لِقَوْلِ النَّبِيِّ ﷺ زَوَّجْنَاكَهَا بِمَا مَعَكَ مِنَ الْقُرْآنِ ‘সুলতান বা শাসকই তার ওয়ালী, যার কোন ওয়ালী বা অভিভাবক নেই‘-এর প্রমাণে নবী (ﷺ)-এর হাদীছ, ‘কুরআনের যা তোমার জানা আছে, তার বিনিময়ে আমি তাকে তোমার নিকট বিয়ে দিলাম‘ নামে একটি শিরোনাম বা অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (অধ্যায় নং-৬৭, অনুচ্ছেদ নং-৪১)। অতএব প্রমাণিত হল যে, এখানে রাসূল (ﷺ) নিজেই ঐ মহিলার ওয়ালী বা অভিভাবক ছিলেন। কেননা বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার কারণে ঐ মহিলার পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘যাদের অভিভাবক নেই তার অভিভাবক শাসক‘ (তিরমিযী, হা/১১০২; আবূ দাঊদ, হা/২০৮৩)।
(২) এই বিধানের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ﷺ)-এর একটি বিশেষত্ব বর্ণনা করেছেন। যেমন আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
وَ امۡرَاَۃً مُّؤۡمِنَۃً اِنۡ وَّہَبَتۡ نَفۡسَہَا لِلنَّبِیِّ اِنۡ اَرَادَ النَّبِیُّ اَنۡ یَّسۡتَنۡکِحَہَا ٭ خَالِصَۃً لَّکَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
‘এমন মুমিন নারীকে (বৈধ করেছি) যে নবীর জন্য নিজেকে সমর্পণ করে, যদি নবী তাকে বিয়ে করতে চায়, এটা বিশেষ করে আপনার জন্য, অন্য মুমিনদের জন্য নয়...’ (সূরা আল-আহযাব : ৫০)। নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট যদি কোন মহিলা নিজেকে নিবেদন করে এবং তিনি তাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে দেনমোহর ছাড়াই তাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা তাঁর জন্য হালাল ছিল। কিন্তু অন্য মুমিনদের জন্য আবশ্যিক যে, সে (রীতিমত) মোহরানা আদায় করবে, তবেই বিবাহ বৈধ হবে।
(৩) শায়খ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, এ বিষয়ে হানাফীদের উপস্থাপিত দলীলগুলো খুবই দুর্বল। জামহূর আলেমের নিকট তাদের ক্বিয়াসগুলো মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা উছূলে ফিক্বহ্ বা ইসলামী শরী‘আতের স্থিরীকৃত নীতিমালা সমূহের মধ্যে রয়েছে, (لَا اجتهاد مع النص) ‘স্পষ্ট দলীল থাকতে ইজতিহাদ বা ক্বিয়াস চলবে না’। তাই এই প্রকারের ক্বিয়াসকে আলেমগণ ভ্রান্ত, অকেজো ও বিকৃত ক্বিয়াস হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ থেকে এ বিষয়ে অসংখ্য সুস্পষ্ট দলীল পূর্বে বর্ণনা করেছি (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-১৩২৭৮৭; কুয়েতী ফিক্বহ বিশ্বকোষ, ৪১/২৪৮ পৃ.; আরশীফ মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ১১২/৪৯৮ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : সাজ্জাদ, ঢাকা।