উত্তর : ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ দু’ভাগে বিভক্ত। যথা : (ক) এমন কিছু ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যেগুলো শরীর থেকে নির্গত হয়, যেমনঃ যৌন মিলন, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা, মাসিক ঋতুস্রাব, শিঙ্গা লাগানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে শরীর থেকে যা বের হয় তা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে ছিয়াম বিনষ্টকারী বিষয় হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। যাতে করে ছিয়াম পালনকারী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং ছিয়াম তার স্বাভাবিক মধ্যম পন্থার সীমারেখা অতিক্রম না করে। (খ) কিছু ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় রয়েছে যেগুলো শরীরে প্রবেশ করার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন খাওয়া-দাওয়া, পান করা ইত্যাদি। একজন ছিয়াম পালনকারী যদি কিছু খায় বা পান করে, তাহলে ছিয়াম পালনের মাধ্যমে উদ্দিষ্ট হিকমাহ অর্জিত হয় না’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া লিইবনি তাইমিয়্যাহ, ২৫/২৪৮)।
দ্বিতীয়তঃ কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আলোকে ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়ের সংখ্যা সাতটি, যা নিম্নে বর্ণনা করা হল : (১) স্ত্রী মিলন : এটি ছিয়াম ভঙ্গের সবচেয়ে মারাত্মক কারণ এবং গুনাহের দিক থেকে সর্বাধিক ভয়াবহ। যে ব্যক্তি রামাযান মাসে দিনের বেলায় ইচ্ছাকৃতভাবে যৌন মিলন করে বীর্যপাত ঘটাক বা না ঘটাক, তার ছিয়াম নষ্ট হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে তার করণীয় হল, (ক) কৃতকর্মের জন্য তওবাহ করা। (খ) সেদিনের বাকী অংশটা ছিয়ামে থেকে যাওয়া। (গ) সেদিনের ছিয়াম ক্বাযা আদায় করা। (ঘ) বড় কাফফারাহ আদায় করা (ছহীহ বুখারী, হা/২৬০০; সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)। উল্লেখ্য, যৌন মিলন ব্যতীত অন্য কোন ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়ের ক্ষেত্রে কাফফারা ওয়াজিব হয় না।
(২) হস্তমৈথুন : এটা যে ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় তার দলীল হল নিম্নের হাদীছে কুদসী। সেখানে ছিয়াম পালনকারী সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اَلصَّوْمُ لِيْ وَأَنَا أَجْزِيْ بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَأَكْلَهُ وَشُرْبَهُ مِنْ أَجْلِي وَالصَّوْمُ جُنَّةٌ
‘ছিয়াম আমার জন্যই, আর আমিই এর যথার্থ প্রতিদান দেব। যেহেতু সে আমারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তার প্রবৃত্তি বা কামাচার, খাদ্য দ্রব্য এবং পানীয় বস্তু পরিহার করেছে। আর ছিয়াম হল ঢালস্বরূপ’ (ছহীহ বুখারী, হা/১৮৯৪)। নিঃসন্দেহে স্বহস্তে বীর্যপাত করা কামনা-বাসনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা একজন ছিয়াম পালনকারীকে পরিত্যাগ করতে হবে। যে রামাযান মাসের দিনের বেলা হস্তমৈথুন করে, তার উপর ওয়াজিব হল : (ক) আল্লাহর কাছে তাওবাহ করা। (খ) দিনের বাকি অংশ ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা এবং (গ) সেদিনের ছিয়ামের ক্বাযা আদায় করা।
(৩) খাওয়া ও পান করা : অর্থাৎ মুখের মাধ্যমে খাদ্য ও পানীয় পাকস্থলীতে পৌঁছানো (সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৭)। একইভাবে যদি নাক দিয়ে পাকস্থলীতে কোন কিছু প্রবেশ করানো হয় তবে তা খাওয়া ও পান করারই সমতুল্য। কেননা নবী (ﷺ) বলেছেন, وَبَالِغْ فِي الْاسْتِنْشَاقِ إِلَّا أَنْ تَكُوْنَ صَائِمًا ‘ওযূর সময় পানি নাকের গভীর পর্যন্ত প্রবেশ করাও যদি না তুমি ছিয়াম পালনকারী না হও’ (তিরমিযী, হা/৭৮৮, সনদ ছহীহ)। তবে যদি নাকের মাধ্যমে পানি পাকস্থলীতে প্রবেশ করা ছিয়ামের উপর প্রভাব না ফেলত, তবে নবী (ﷺ) ওযূর সময় নাকে গভীরভাবে পানি প্রবেশ করাতে নিষেধ করতেন না।
(৪) খাওয়া ও পানের বিকল্প কিছু গ্রহণ করা : আর তা দু’টি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। (ক) ছিয়াম পালনকারীর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবেশ করানো। যেমন, সে যদি রক্তপাতের শিকার হয় তবে ইনজেকশনের মাধ্যমে রক্ত প্রবিষ্ট করা হলে তার ছিয়াম ভেঙ্গে যাবে। কারণ খাদ্য ও পানীয়ের দ্বারা খাবার গ্রহণের সর্বশেষ অবস্থা হচ্ছে রক্ত তৈরি হওয়া। (খ) খাদ্য ও পানীয়ের স্থলাভিষিক্ত হয় এমন খাবার বা প্রোটিন জাতীয় ইনজেকশন। কারণ তা খাদ্য ও পানীয়ের অন্তর্ভুক্ত (মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭০)। তবে যে সমস্ত ইনজেকশন খাদ্য ও পানীয়ের বদলে ব্যবহৃত হয় না, শুধু চিকিৎসার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। যেমন পেনসিলিন, ইনসুলিন ইত্যাদি অথবা শরীরকে তৎপর করার জন্য বা ভ্যাকসিনের জন্য যে ইনজেকশন দেয়া হয়, তাতে ছিয়ামের কোন ক্ষতি হয় না (ফাতাওয়া মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম, ৪/১৮৯)। তবে সর্বাধিক নিরাপদ হল এগুলো রাতের বেলায় করা। তবে কিডনী ডায়ালাইসিস, যা পরিষ্কার করার জন্য রক্ত বের করে তা কেমিক্যাল পদার্থ, পুষ্টি দানকারী উপাদান। যেমন চিনি, লবণ ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে আবারো কিডনীতে প্রবেশ করানো হয়, তা ছিয়াম ভঙ্গকারী বিষয় বলে গণ্য হবে (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/১৯ পৃ.)।
(৫) কাপিং করা বা শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করা : ছাওবান (রাযিয়াল্লাহু আনহু) ও শাদ্দাদ ইবনু আওস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেন, أَفْطَرَ الْحَاجِمُ وَالْمَحْجُوْمُ ‘রক্তমোক্ষণকারী এবং যার রক্তমোক্ষণ করানো হয়েছে, তাদের উভয়ের ছিয়াম নষ্ট হয়ে গেছে’ (আবূ দাঊদ, হা/২৩৬৭-২৩৭০; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৮০-১৬৮১, সনদ ছহীহ)। কাউকে স্বেচ্ছায় রক্তদান করাটাও হিজামাহ বা কাপিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। সেজন্য ছিয়াম থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় রক্ত দান করা জায়েয নয়। কেননা তা কাপিং বা শিঙ্গার মতই শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। তবে হ্যাঁ যদি রোগীর অবস্থা খুবই বিপদজনক হয়, আর সে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ধৈর্যধারণ করতে না পারে এবং ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, ছিয়াম পালনকারী ব্যক্তির রক্ত পেলে রোগী উপকৃত হবে, এবং তার প্রয়োজন পূরণ হবে, সেক্ষেত্রে রক্তদান করা জায়েয। পরে অবশ্যই সে এই দিনের ক্বাযা আদায় করে নেবে (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৪৭৮; মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০৪০৬)। আর যার রক্তপাত হয়েছে, তার ছিয়াম শুদ্ধ হবে। কারণ সে ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/২৬৪)। পক্ষান্তরে দাঁত তোলা বা ক্ষতস্থান ড্রেসিং করা বা রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদির জন্য রক্ত বের হলে ছিয়াম ভঙ্গ হয় না। কারণ তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানোর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা হিজামাহ বা শিঙ্গা লাগানোর ন্যায় শরীরের উপর প্রভাবও ফেলে না (মাজমূঊ ফাতাওয়া লিইবনি বায, ১৫/২৭৪; ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম, পৃ. ৪৭৮; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৫০৪০৬)।
(৬) ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা : নবী (ﷺ) বলেছেন, مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَمَنْ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ ‘যার অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি আসে তাকে ক্বাযা আদায় করতে হবে না, আর যে ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে সে যেন ক্বাযা আদায় করে’ (তিরমিযী, হা/৭২০; আবূ দাঊদ, হা/২৩৮০; ইবনু মাজাহ, হা/১৬৭৬, সনদ ছহীহ)। ইবনুল মুনযির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আলিমগণের মাঝে এ ব্যাপারে ইজমা‘ বা ঐকমত্য রয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে ছিয়াম বাতিল হবে (আল-মুগনী, ৪/৩৬৮; মাজালিসু শাহরি রামাযান, পৃ. ৭১)।
(৭) হায়িয (মাসিক ঋতুগ্রাব) ও নিফাস (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত) হওয়া : নবী করীম (ﷺ) বলেছেন, أَلَيْسَ إِذَا حَاضَتْ لَمْ تُصَلِّ وَلَمْ تَصُمْ ‘আর হায়েয অবস্থায় তারা কি ছালাত ও ছিয়াম হতে বিরত থাকে না?’ (ছহীহ বুখারী, হা/৩০৪, ১৯৫১, ২৬৫৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৯, ৮০)। তাই যখনই কোন নারী হায়েয বা নিফাসের রক্ত দেখবে, তখনই তার ছিয়াম বিনষ্ট হয়ে যাবে, তা সূর্যাস্তের এক মুহূর্ত আগেও হোক না কেন। যদি একজন হায়েযাহ (মাসিক ঋতু¯্রাব ওয়ালী) বা নুফাসা (প্রসব পরবর্তী রক্তপাত ওয়ালী) নারীর রাত্রীতে রক্ত পড়া বন্ধ হয় ও সে ছিয়াম পালনের নিয়ত করে এবং তার গোসল করার আগেই ফজর উদিত হয়, এক্ষেত্রে সকল আলিমের মতানুযায়ী তার ছিয়াম শুদ্ধ হবে (আল-ফাতহ্, ৪/১৪৮ পৃ.)। উল্লেখ্য, একজন নারীর জন্য উত্তম হল তার স্বভাবজাত প্রকৃতির উপর থাকা, আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকা, রক্ত বন্ধ করে এমন কিছু গ্রহণ না করা। কেননা এর মধ্যে নানাবিধ ক্ষতি আছে। সুতরাং তার করণীয় হল, হায়েযের সময় ছিয়াম ভঙ্গ করা ও পরে ক্বাযা আদায় করার যে বিধান আল্লাহ তার জন্য প্রদান করেছেন, তা গ্রহণ করা। এমনই ছিলেন উম্মুল মুমিনীন, পরবর্তী ছাহাবী ও তাবি‘ঈগণের স্ত্রীরা (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ১০/১৫১; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৩৮০২৩)।
প্রশ্নকারী : সেলিম, মাদারীপুর।