উত্তর : উক্ত মাসআলায় সামান্য ইখতিলাফ থাকলেও সংশ্লিষ্ট হাদীছ, আছার ও পরবর্তী প্রায় সকল বিদ্বানের পর্যালোচনার আলোকে রুকূ‘ পেলে রাক‘আত গণ্য হবে। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الصَّلَاةِ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلَاةَ ‘যে ব্যক্তি ছালাতের রাক‘আত পেল সে ছালাত পেল’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/৬০৭; মিশকাত, হা/১৪১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১৩২৮, ৩/১৯৯ পৃ.)। উক্ত হাদীছের ‘রাক‘আত’-এর অর্থ নিয়ে বিদ্বানগণের মাঝে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে অধিকাংশ বিদ্বানের মতে ‘রাক‘আত’ অর্থ রুকূ‘। তাই রুকূ‘ পেলে রাক‘আত হিসাবে গণ্য হবে। অনুরূপ কোন বর্ণনায় ‘সাজদাহ’ উল্লিখিত হয়েছে (ছহীহ বুখারী, হা/৫৫৬; মিশকাত, হা/৬০২; আছ-ছামারুল মুস্তাত্বাব, পৃ. ৯৭)। তাই রাক‘আত বলতে রুকূ। যেমন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) পরিপূর্ণ রুকূ‘কেই রাক‘আত হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং দলীল হিসাবে উক্ত হাদীছ উল্লেখ করেছেন (মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২৩ তম খণ্ড, পৃ. ৩৩২)।
তাছাড়া জুম‘আর ছালাত সম্পর্কে এসেছে, مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الْجُمُعَةِ أَوْ غَيْرِهَا فَقَدْ تَمَّتْ صَلَاتُهُ ‘যে ব্যক্তি জুম‘আ বা অন্য ছালাতে রাক‘আত পাবে, তার ছালাত পূর্ণ হবে’ (নাসাঈ, হা/৫৫৭; ইবনু মাজাহ, হা/১১২৩, সনদ ছহীহ)। উক্ত হাদীছে ‘রাক‘আত’ অর্থ রুকূ। শায়খ মুহাম্মাদ ছালেহ আল-মুনাজ্জিদ বলেন, ‘ইমামের সাথে রাক‘আত না পেলে জুম‘আ গণ্য হবে না। আর রাক‘আত পাওয়া হল, ইমামের সাথে রুকূ‘ পাওয়া। সুতরাং যখন মুক্তাদী ইমামকে দ্বিতীয় রাক‘আতে রুকূ থেকে উঠার আগেই পেয়ে যাবে, তখন সে ছালাত পেয়ে যাবে। অতঃপর ইমামের সালামের পর মুছল্লী তার ছালাত সম্পন্ন করবে। অর্থাৎ মুক্তাদী দাঁড়িয়ে ছুটে যাওয়া রাক‘আত পড়ে নিবে (ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, পৃ. ৮৯৪, প্রশ্ন নং-১২৬০১)।
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘যখন মুছল্লী ইমামের সাথে ছালাত আদায় করে এবং ইমামকে রুকূ অবস্থায় পায় অতঃপর সূরা ফাতিহা না পড়েই রুকূ করে, তবে তার ছালাত ছহীহ হবে’ (ফাতাওয়াউল ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, প্রশ্ন নং-৬৫৫১)। অতঃপর তিনি দলীল হিসাবে পেশ করেছেন, আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الصَّلَاةِ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلَاةَ ‘যে ব্যক্তি ছালাতের রাক‘আত পেল সে ছালাত পেল’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫৮০; ছহীহ মুসলিম, হা/৬০৭; মিশকাত, হা/১৪১২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১৩২৮, ৩/১৯৯ পৃ.)। সালেম (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুম‘আ বা অন্যান্য ছালাতের এক রাক‘আত পেল, সে তার পূর্ণ ছালাত পেল’ (নাসাঈ, হা/৫৫৭; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৯৪)।
শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘রুকূ‘ পেলে রাক‘আত গণ্য হবে। তিনি দলীল হিসাবে নি¤েœর হাদীছটি উপস্থাপন করেছেন।
عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ رضى الله عنه أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ رَاكِعٌ فَرَكَعَ قَبْلَ أَنْ يَّصِلَ إِلَى الصَّفِّ ثُمَّ مَشَى إِلَى الصَّفِّ فَذَكَرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ زَادَكَ اللهُ حِرْصًا وَّلَا تَعُدْ
আবু বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এমন অবস্থায় পৌঁছলেন, যখন তিনি রুকূ অবস্থায় ছিলেন। তিনি কাতারে পৌঁছার পূর্বেই রুকূ করলেন অতঃপর তিনি হেঁটে কাতারে পৌঁছলেন। বিষয়টি নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালে তিনি বলেন, আল্লাহ তোমার (ইবাদতের প্রতি) আকাক্সক্ষা বাড়িয়ে দিন, তবে পুনরায় এরূপ করবে না (ছহীহ বুখারী, হা/৭৮৩; আবু দাঊদ, হা/৬৮৩-৮৪; মিশকাত, হা/১১১০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/১০৪২, ৩/৬৪ পৃ.)।
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে উক্ত ছালাত ক্বাযা আদায়ের নির্দেশ দেননি। তাকে কাতার ছাড়া রুকূ‘তে ফিরে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে মাসবূকের দায়িত্ব হল- কাতারে প্রবেশ না করা পর্যন্ত রুকূ‘তে যাওয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করা। আর এটাই ছহীহ ও জায়েয হওয়া বুঝায়। হাদীছে বর্ণিত ‘রাক‘আত’ অর্থ যে, রুকূ‘ এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করে বলেন, من أدرك الركوع فقد أدرك الركعة ‘যে ব্যক্তি রুকূ‘ পেল সে রাক‘আত পেল’ (শায়খ বিন বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১১/২৪৬ পৃ., ৩০/১৪৭ পৃ.)।
শায়খ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রুকূ পেলে রাক‘আত গণ্য হবে। তিনি নি¤েœর হাদীছ উল্লেখ করেন। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, إِذَا جِئْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ وَنَحْنُ سُجُوْدٌ فَاسْجُدُوْا وَلَا تَعُدُّوْهَا شَيْئًا وَمَنْ أَدْرَكَ الرَّكْعَةَ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلَاةَ ‘তোমরা ছালাতে এসে আমাদেরকে সিজদায় পেলে সিজদায় চলে যাবে। তবে এ সিজদাকে গণ্য করবে না। আর যে ব্যক্তি রাক‘আত পেল সে ছালাত পেয়েছে’ (আবু দাঊদ, হা/৮৮৯, সনদ হাসান)। তিনি উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, হাদীছে রাক‘আত অর্থ হল রুকূ‘। অর্থাৎ যে ব্যক্তি রুকূ‘ পেল সে ছালাত পেয়েছে বলে গণ্য হবে’ (আলবানী, ইরওয়াউল গালীল, হা/৪৯৬, ২/২৬০ পৃ.)। অতঃপর আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) আরো একটি হাদীছ উপস্থাপন করেছেন। আব্দুল আযীয ইবনু রাফে‘ (রাহিমাহুল্লাহ) এক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
إِذَا جِئْتُمْ وَالْإِمَامُ رَاكِعٌ فَارْكَعُوْا وَإِنْ كَانَ سَاجِدًا فَاسْجُدُوْا وَلَا تَعْتَدُّوْا بِالسُّجُوْدِ إِذَا لَمْ يَكُنْ مَعَهُ الرُّكُوْعُ
‘তোমরা যখন ইমামের রুকূ‘ অবস্থায় আসবে, তখন তেমারা রুকূ‘ কর। আর যদি সিজদা অবস্থায় থাকে, তাহলে সিজদা কর। তবে ইমামের সাথে রুকূ‘ না পেলে সিজদা পাওয়ার কারণে রাক‘আত গণ্য করবে না’ (বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, হা/২৫৭৬; সিলসিলা আহাদীছিয যঈফাহ ওয়াল মাওযূ‘আহ, ১০/১৮৬ পৃ.)। উক্ত হাদীছকে তিনি ছহীহ দাবী করে গভীর পর্যালোচনা করেছেন (ইরওয়াউল গালীল, ২/২৬১-৬৬ পৃ., হা/৪৯৬-এর আলোচনা দ্র., সনদ ছহীহ)। তাছাড়া তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/২৬২২; বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা, হা/২৫৮০; ইরওয়াউল গালীল, ২/২৬৩ পৃঃ), যায়েদ ইবনু ছাবেত (মুলতাক্বা আহলিল হাদীছ, ২৬/২২১ পৃ.; ইরওয়াউল গালীল, ২/২৬৩-৬৪ পৃ.), ওছমান ইবনুল আসওয়াদ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, হা/২৬৪৬; ইরওয়াউল গালীল, ২/২৬৪ পৃ.) সহ বিভিন্ন ছাহাবী ও তাবেঈ থেকে অনেক ছহীহ আছারও পেশ করেছেন (ইরওয়াউল গালীল, হা/৪৯৬)।
সঊদী আরবের সর্বোচ্চ ফাতাওয়া বোর্ড ‘আল-লাজনা আদ-দায়েমা’ ফৎওয়া প্রদান করেছে যে, রুকূ‘ পেলে রাক‘আত বলে গণ্য হবে। দলীল হিসাবে তাঁরা আবু বাকরাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এবং এ সম্পর্কে ‘আম হাদীছ দু’টি উল্লেখ করে বলেন, নবী করীম (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে সূরা ফাতিহা পড়তে না পারার কারণে পুনরায় রাক‘আত ক্বাযা করতে আদেশ করেননি। সুতরাং যে ব্যক্তি রুকূ‘ পেল সে রাক‘আত পেল (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমা, ৬/২২১ পৃ., ফৎওয়া নং-১৭৬৬১)।
শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালেহ আল-ওছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) কোন মুছল্লী যখন ইমামের রুকূ‘ অবস্থায় ছালাতে প্রবেশ করে তখন তিনটি হালাত বা অবস্থা বর্ণনা করেছেন। যথা : ক. এ মর্মে নিশ্চিত হওয়া যে, ইমামের রুকূ‘ থেকে উঠার পূর্বে সে রুকূ‘তে পৌঁছেছে, তখন সে রাক‘আত পেয়েছে বলে গণ্য হবে কিন্তু তার সূরা ফাতিহা ছুটে গেছে। ক. এ মর্মে নিশ্চিত হওয়া যে, তার রুকূ‘তে পৌঁছানোর পূর্বে ইমাম রুকূ‘ থেকে উঠে গেছে, তখন তার রাক‘আত ফউত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং তার ক্বাযা আদায় করতে হবে। ৩. এ মর্মে সন্দেহ পোষণ করা যে, সে ইমামকে রুকূ‘ অবস্থায় পেয়েছে অথবা তার রুকূ‘ পাওয়ার পূর্বেই ইমাম রুকূ‘ থেকে উঠে গেছে, তাহলে তার সন্দেহটা বিজয়ী হবে। অর্থাৎ তাকে সাহু সিজদা দিতে হবে (ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারাব, অডিও ক্লিপ-১৭৫, প্রিন্ট পৃ. ১-২)।
অন্যদিকে রুকূ পেলে রাক‘আত গণ্য হবে না মর্মে যে সমস্ত প্রমাণ পেশ করা হয়, সেগুলোকে অনেকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন (ইরওয়াউল গালীল, ২/২৬৫-২৬৬, হা/৪৯৬-এর আলোচনা দ্র.)। তাছাড়া সূরাহ ফাতিহা না পড়ার কারণে রাক‘আত গণ্য হবে না মর্মে যে যুক্তি পেশ করা হয়, তা দলীলের আলোকে প্রমাণিত হয় না। কারণ এখানে রুকূর অবস্থাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। যেমন জনৈক ছাহাবী কুরআন থেকে কোন কিছু মুখস্থ রাখতে অক্ষমতা পেশ করলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে ছালাতে ‘সুবহা-নাল্লাহি, ওয়াল হামদুলিল্লাহি, ওয়ালা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ, ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালা হাউলা ওলা কুউওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ’ পড়তে বলেন (আবূ দাঊদ, হা/৮৩২, সনদ হাসান)। এখানে সূরা ফাতিহা পড়তে না বলার কারণ হল তার অক্ষমতা। এই অক্ষমতার কারণে উক্ত ব্যক্তি সূরাহ আল-ফাতিহা না পড়লেও তার ছালাত হবে বলে সাব্যস্ত হয়। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।
প্রশ্নকারী : যিয়াউর রহমান, টাঙ্গাইল।