উত্তর: প্রথমতঃ তৃতীয় রাক‘আতে বসে আত্তাহিয়্যাতু পড়তে হবে না। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) ও ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, أن ما أدركه المسبوق مع الإمام هو أول صلاته ‘মাসবুক্ব ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে যতটুকু পাবেন সেটাই তার প্রথম ছালাত হিসাবে বিবেচিত হবে’ (ফাৎহুল বারী, ২/১১৮; আল-মাজমূঊ ৪/৪২০ পৃ.)। শাইখ মুহাম্মাদ ছালিহ আল-মুনাজ্জিদ (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন, ‘ইমামের জন্য সেটি তৃতীয় ও চতুর্থ রাক‘আত হলেও কিন্তু মাসবুক্বের জন্য মূলত সেটি প্রথম ও দ্বিতীয় রাক‘আত হিসাবে বিবেচিত হবে এবং সেই হিসাবেই তিনি তার অবশিষ্ট ছালাত শেষ করবেন’ (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৩৪২৬)।
দ্বিতীয়তঃ কয়েকজন মুছল্লী মাসবুক্ব ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে অনুসরণ করে জামা‘আত সহকারে ছালাত আদায় করতে পারবে কি-না? এ ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রথম মত: হানাফী ও মালিকী মাযহাবের মতানুযায়ী ‘মাসবুক্ব ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে অনুসরণ করা জায়েয নয়’। সুতরাং তার পিছনে অনুসরণকারীদের ছালাত বিশুদ্ধ হবে না। (ফাৎহুল ক্বাদীর, ১/২৭৭; আশ-শারহুল কাবীর, ১/৩২৭ পৃ.)। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘ইমাম নির্ধারণ করা হয় তাঁর অনুসরণ করার জন্য। কাজেই সে যখন রুকূ‘ করে তখন তোমরাও রুকূ‘ করবে এবং সে যখন রুকূ‘ হতে মাথা উঠায় তখন তোমরাও মাথা উঠাবে, আর সে যখন বসে ছালাত আদায় করে, তখন তোমরাও সবাই বসে ছালাত আদায় করবে’ (ছহীহ বুখারী, হা/১১১৩, ১২৩৬, ৫৬৫৮; ছহীহ মুসলিম, হা/৪১২, ৪১৮)। এ দলীল থেকে বুঝা যায় যে,
(১) এখানে মুক্তাদীরা শুধু ইমামের অনুসরণকারী, কোন মুক্তাদির নয়। সুতরাং দলীল প্রমাণ করে যে মুক্তাদী একই সঙ্গে ইমাম এবং মুক্তাদী হতে পারে না (তুহফাতুল মুহতাজ, ২/২৮২ পৃ.)।
(২) বিনা কারণে এই ধরনের পরিবর্তন জায়েয নয়।
(৩) ছাহাবীদের ও সালাফে ছালিহীনের যুগে এই ধরণের আমল পরিচিত ছিল না, তাই এটি বিদ‘আত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দ্বিতীয় মত: শাফিঈ ও হাম্বালী মাযহাবের সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী ‘মাসবুক্ব ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে অনুসরণ করা জায়েয’। সুতরাং তার পিছনে অনুসরণকারীদের ছালাত বিশুদ্ধ হবে এবং এই মতটিকেই শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) পসন্দ করেছেন (তুহফাতুল মুহতাজ, ৮/৩৬১; নিহায়াতুল মুহতাজ, ২/২৩৩; আল-মুব’দী, ১/৪২৪; আল-ইনছাফ, ২/৩৬; মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ২৩/৩৮২ পৃ.)।
হাদীছ সম্রাট ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, ‘যদি ইমাম ইমামতির নিয়ত না করেন এবং পরে কিছু লোক এসে শামিল হয় এবং তিনি তাদের ইমামতি করেন’ (অধ্যায় নং ১০, অনুচ্ছেদ নং-৫৯)। অতঃপর তিনি নিম্নোক্ত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইবনু আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন, একদা আমি আমার খালা (মাইমূনা (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট রাত্রি যাপন করলাম। নবী (ﷺ) রাতের ছালাতে দাঁড়ালেন, আমিও তাঁর সাথে ছালাত আদায় করতে দাঁড়ালাম। আমি তাঁর বামপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তিনি আমার মাথা ধরে তাঁর ডানপাশে দাঁড় করালেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬৯৯, ৬৯৮, ৬৯৭; ছহীহ মুসলিম, হা/৭৬৩)। আনাস (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, রামাযান মাসে একদা রাসূল (ﷺ) ছালাত আদায় করছিলেন। আমি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালাম। এরপর অন্য এক ব্যক্তি এসেও তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। এভাবে আমরা এক দল লোক হয়ে গেলাম। এরপর নবী (ﷺ) যখন বুঝতে পারলেন যে, আমরা তাঁর পেছনে আছি, তখন তিনি ছালাত সংক্ষিপ্ত করলেন...’ (ছহীহ মুসলিম, হা/১১০৪)।
উপরিউক্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, একাকী ছালাত আদায়কারী ব্যক্তির জন্য ইমামে রূপান্তরিত হওয়া অনুমোদিত, আর ইমামের সালাম ফিরানোর পর ছুটে যাওয়া ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে মাসবুক্ব একাকী ছালাত আদায়কারীর হুকুমে পরিগণিত হয় (আল-বাবু ফী শারহিল কিতাব, ১/৯৬; মুগনীউল মুহতাজ, ১/২১১ পৃ.)। সাহল ইবনু সা‘দ আস-সা‘ঈদী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, আমর ইবনু আওফ গোত্রের বিবাদ ও মীমাংসার সময় প্রথমে আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর ইমামতিতে ছালাত শুরু হয়, কিন্তু পরবর্তীতে যখন রাসূল (ﷺ) আসলেন, তখন আবূ বাকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) পিছিয়ে গেলেন এবং ক্বাতারের বরাবর দাঁড়ালেন। আর রাসূল (ﷺ) সামনে এগিয়ে ছালাত আদায় করালেন’ (ছহীহ বুখারী, হা/৬৮৪)। উক্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, দু’জন ইমামের ইমামতীতে ছালাত আদায় করা বৈধ (আল-মুগনী, ১/৭৭৯ পৃ.)।
সুতরাং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বা অগ্রাধিকারযোগ্য মতামত হল- দ্বিতীয়টি। শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) দ্বিতীয় মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতানুযায়ী ‘অবশিষ্ট ছালাত আদায়কারী মাসবুক্ব ব্যক্তিকে জামা‘আতের ফযীলত পাওয়ার আশায় ইমাম হিসাবে অনুসরণ করা জায়েয’। কেননা ছালাতের শুরুতে ইমামতির নিয়ত করা শর্ত নয়। অসংখ্য দলীল প্রমাণ করে যে, একাকী ছালাত আদায়কারী ব্যক্তি পরবর্তীতে ইমামতীর নিয়ত করতে পারে’ (মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায, ১২/১৪৮; আশ-শারহুল মুমতি‘, ২/৩০৭-৩১৮ পৃ.)। উল্লেখ্য, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ আল-উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) সতর্কতা অবলম্বন করে বলেন, ‘দলীলের নিকটতম মতামতের ভিত্তিতে এটি জায়েয, তবে এটি সুন্নাতের তুলনায় বিদ‘আতের অধিক নিকটবর্তী। কেননা ছাহাবীরা এরূপ করেননি’ (লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, ১২/১৩ পৃ.)।
অনুরূপভাবে শাইখ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রশস্ততা রয়েছে। যদি আপনি একাকী ছালাত আদায় করেন, তবে এটি অধিক সতর্কতা ও উত্তম হবে, কারণ এর ফলে আলিমদের মতভেদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়। আর যদি আপনার সঙ্গে একাধিক লোক থাকে। তবে এক্ষেত্রে উত্তম ও সর্বোত্তম হল- সকলে মিলে জামা‘আত সহকারে ছালাত আদায় করুন। তবুও মাসবুক্বের সঙ্গে যুক্ত হবেন না পক্ষান্তরে আপনি যদি মাসবুক্ব ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে অনুসরণ করেন, সেক্ষেত্রেও বিশুদ্ধ মতানুযায়ী এতে কোন সমস্যা নেই এবং ছালাত বিশুদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ। তবে উত্তম ও পসন্দনীয় হল- আপনি একাকী ছালাত আদায় করুন, কারণ অনেক আলিম মাসবুক্ব ব্যক্তিকে ইমাম হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ মনে করেন না। কিন্তু যদি আপনি তার সঙ্গে ছালাত আদায় করেন, তবে এতে কোন সমস্যা নেই। যেমন আপনি যদি একাকী ছালাত আদায়কারী কোন ব্যক্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে তাকে ইমাম বানিয়ে ছালাত আদায় করেন, তাহলে তাতেও কোন সমস্যা নেই। এখানে জামা‘আতের ফযীলত পাওয়াটা মূখ্য উদ্দেশ্য’ (ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ র্দাব লি ইবনে বায, ২/৯৬৪ পৃ.)।
প্রশ্নকারী : মীযান, ময়মনসিংহ।