উত্তর : মৃতপ্রাণীর হাড় ব্যবহার করা যাবে কি-না এবং সেটা পবিত্র, না-কি অপবিত্র? এ ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। যার মাংস খাওয়া জায়েয এমন প্রাণী হোক, কিংবা যার মাংস খাওয়া জায়েয নয় এমন প্রাণী হোক! জামহূর আলিমের অভিমত হচ্ছে এটি নাপাক। হানাফী আলিমগণ এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। তারা এটাকে পবিত্র বলেছেন। ইমাম ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘মৃতপ্রাণীর হাড় নাপাক, সেটি মাংস খাওয়া জায়েয এমন প্রাণীর হাড় হোক, কিংবা মাংস খাওয়া জায়েয নয় এমন প্রাণীর হাড় হোক। এটি কোন অবস্থাতেই পবিত্র হবে না। এটা হচ্ছে ইমাম মালিক, শাফিঈ ও ইসহাকের বক্তব্য। আর ইমাম ছাওরী ও আবু হানীফার বক্তব্য হচ্ছে, এটি পবিত্র। কেননা হাড়ের মৃত্যু ঘটে না, তাই এটি অপবিত্র হয় না, চুলের মত। কেননা মাংস ও চামড়া অপবিত্র হওয়ার হেতু হল এর সাথে রক্ত ও আর্দ্রতা যুক্ত থাকা। হাড়ের মধ্যে এটি পাওয়া যায় না।
এক্ষেত্রে আমাদের দলীল হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী, ‘এবং বলে, অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে, যখন তা পচে-গলে যাবে? বল, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই, যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেক সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত’ (সূরা ইয়াসীন: ৭৯)। আর যেহেতু প্রাণ থাকার আলামত হচ্ছে অনুভূতি ও ব্যথা পাওয়া। হাড়ের মধ্যে গোশতও চামড়ার চেয়ে বেশি ব্যথা পাওয়া যায়। যে জিনিসের মধ্যে প্রাণ আছে সে জিনিসের মৃত্যুও আছে। যেহেতু মৃত্যু মানে প্রাণের বিচ্ছেদ। যে জিনিসের মৃত্যু ঘটে সেটা নাপাক হয়, যেমন গোশত’ (আল-মুগনী, ১/৫৪ পৃ.)। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু ছালিহ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এ অভিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন (আল-শারহুল মুমতি‘, ১/৯৩ পৃ.)।
পক্ষান্তরে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) হানাফী মাযহাবের অভিমতকে নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন, মৃতপ্রাণীর হাড়, শিং ও নখ এবং এ জাতীয় যা কিছু আছে যেমন খুর, চুল, পালক ও পশম ইত্যাদি সব পবিত্র। এটি ইমাম আবু হানীফার অভিমত। মালিকী ও হাম্বালী মাযহাবেও এমন একটি কথা আছে। এই অভিমতটি সঠিক। কেননা এ জিনিসগুলোর মূল বিধান হলো পবিত্রতা, আর এগুলো অপবিত্র হওয়ার পক্ষে কোন দলীল নেই। তাছাড়া এ জিনিসগুলো ভাল শ্রেণীয়, মন্দ শ্রেণীয় নয় যে, হালাল বর্ণনাকারী আয়াতের অধীনে এগুলো অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ আল্লাহ যা কিছুকে মন্দ শ্রেণীয় হিসেবে হারাম করেছেন, সেগুলোর মধ্যে এ জিনিসগুলো পড়বে না, শব্দগত দিক থেকেও নয় এবং মর্মগত দিক থেকেও নয়। শব্দগত দিক থেকে নয়, যেমন আল্লাহর বাণী: حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ (তোমাদের উপর মৃতপ্রাণী হারাম করা হয়েছে) এর মধ্যে চুল ও এ জাতীয় জিনিসগুলো পড়ে না। অর্থাৎ যেহেতু মৃতের বিপরীত জীবিত। জীবন দুই প্রকারের: প্রাণীর জীবন ও উদ্ভিদের জীবন। প্রাণীর জীবনের বৈশিষ্ট্য হল: অনুভূতি ও ইচ্ছাধীন নড়াচড়া। আর উদ্ভিদের জীবনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৃদ্ধি পাওয়া ও পুষ্টি গ্রহণ।
হারামকৃত মৃতপ্রাণী: যাতে অনুভূতি ও ইচ্ছাধীন নড়াচড়া নেই। পক্ষান্তরে, চুল বাড়ে ও পুষ্টিগ্রহণ করে এবং উদ্ভিদের মত লম্বা হয়। উদ্ভিদের কোন অনুভূতি নেই এবং উদ্ভিদ নিজ ইচ্ছায় নড়াচড়া করে না। এর মধ্যে জীবের মত প্রাণ নেই যে, সে প্রাণের বিচ্ছেদে মৃত্যুবরণ করবে। সুতরাং এমন জিনিস নাপাক হওয়ার কোন যুক্তি নেই। যারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন তাদেরকে বলল, আপনারা নিজেরাও তো আয়াতের শাব্দিক ব্যাপকতাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করেন না। কেননা যে সব প্রাণীর রক্ত নেই। যেমন মরা মাছি, বিচ্ছু ও পোকা, এগুলো আপনাদের নিকটেও অপবিত্র নয় এবং জামহুর আলিমের কাছেও অপবিত্র নয়। অথচ এগুলোর মরণ জীবের মৃত্যুর মত। এখান থেকে জানা গেল যে, মৃতপ্রাণী অপবিত্র হওয়ার কারণ হল মৃতপ্রাণীর মধ্যে রক্ত জমাট হয়ে থাকা। আর যে প্রাণীর মাঝে তরল রক্ত নেই সেটা মারা গেলেও তাতে কোন রক্ত জমাট বাধে না, তাই সেটা নাপাক হয় না। তাই এ ধরণের জীবের চেয়ে হাড় ও হাড় জাতীয় জিনিস নাাপাক না হওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত। কেননা হাড়ের ভেতরে কোন তরল রক্ত নাই এবং হাড়ের ইচ্ছাধীন নড়াচড়াও নাই, অন্যকিছুর অনুবর্তী হওয়া ছাড়া। সুতরাং অনুভূতি শক্তির অধিকারী, স্ব-ইচ্ছায় নড়াচড়াকারী পরিপূর্ণ জীবের মধ্যে যদি তরল রক্ত না থাকার কারণে নাপাক না হয় তাহলে হাড়ের ভেতরে তরল রক্ত না থাকার পরেও সেটা কিভাবে নাপাক হবে?
সুতরাং যেহেতু হাড়, নখ, শিং, খুর ইত্যাদির মধ্যে প্রবহমান রক্ত নেই, তাই সেগুলো নাপাক হওয়ার কোন যুক্তি নেই। এটাই অধিকাংশ সালাফের অভিমত। ইমাম যুহ্রী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ উম্মতের উত্তম প্রজন্ম হাতির হাড় দিয়ে তৈরিকৃত চিরুনী দিয়ে মাথা আঁচড়াতেন। হাতির দাঁতের ব্যাপারে একটি পরিচিত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সে হাদীছের ব্যাপারে কিছু মতপার্থক্য আছে। এটি সে আলোচনা করার স্থান নয়। কারণ আমাদের সে হাদীছ দিয়ে দলীল দেয়ার প্রয়োজন নেই। আরও বলা যায়, ‘চামড়া তো মৃতপ্রাণীর অংশবিশেষ। চামড়ার মধ্যে রক্ত আছে, যেমনি ভাবে মৃতপ্রাণীর অন্য সকল অংশে রক্ত রয়েছে। তা সত্ত্বেও নবী (ﷺ) চামড়া দাবাগতকরণকে (প্রক্রিয়াজাত করণ) চামড়ার যব্হ হিসাবে গণ্য করেছেন। কেননা প্রক্রিয়াজাতকরণ চামড়ার আর্দ্রতাকে শুকিয়ে ফেলে। সুতরাং এটি প্রমাণ করে যে, অপবিত্রতার কারণ হল আর্দ্রতা। হাড়ের মধ্যে কোন তরল রক্ত নেই। হাড়ের ভেতরে যা কিছু থাকে সেটা শুকিয়ে যায়। হাড়কে চামড়ার চেয়ে বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়। সুতরাং চামড়ার চেয়ে হাড় পবিত্র হওয়া অধিক উপযুক্ত (আল-ফাতাওয়াল কুবরা, ১/২৬৬-২৭১ পৃ.)।
অতএব যদি এ পাত্রগুলো গোশত খাওয়া জায়েয এমন প্রাণীর হাড় দিয়ে তৈরিকৃত হয় যে প্রাণীকে কোন মুসলিম বা কোন আহলে কিতাব যব্হ করেছেন তাহলে এ সব পাত্র পবিত্র এবং এগুলো ব্যবহার করা হালাল। আর যদি এমনটি না হয়, চীন দেশের ক্ষেত্রে যেটা ঘটার সম্ভাবনাই প্রবল, তাহলে এ পাত্রগুলো মৃতপ্রাণীর হাড় থেকে তৈরি। মৃতপ্রাণীর হাড়ের ব্যাপারে আলিমদের মতভেদ খুবই শক্তিশালী। তাই একজন মুসলিমের জন্য উত্তম হল, এ ধরণের পাত্র ব্যবহার করা থেকে দূরে থাকা। এগুলো ছাড়াও অনেক পাত্র রয়েছে। আর যদি এ পাত্রগুলো মৃতপ্রাণীর ভস্মীকৃত হাড়ের ছাই দিয়ে তৈরি করা হয়, তাহলে সেটা হতে পারে। যেহেতু ছাই নাপাক নয়। যেহেতু রূপান্তরের মাধ্যমে সেটি পবিত্র হয়ে যায় (ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-২৫৮৩১২)।
প্রশ্নকারী : নাসিরুদ্দীন, রাজশাহী।