উত্তর : ওয়ালীয়্যুন (وَلِيٌّ) শব্দের অর্থ হল: বন্ধু, মিত্র, প্রিয়জন, ঘনিষ্ঠজন (গারীবুল কুরআন লি ইবনি কুতাইবাহ, পৃ. ২৬৮; মাক্বায়িসুল লুগাহ লি ইবনে ফারিস, ৬/১৪১)। ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, আল্লাহর ওলী বলতে খালিছ মুমিনদের বুঝানো হয়েছে। যেন তাঁরা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন করেছেন তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কথার মাধ্যমে ওলীদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত’ (সূরা ইউনুস : ৬২-৬৩; ফাৎহুল ক্বাদীর লিশ শাওকানী, ২/৫১৯ পৃ.)। ইমাম সানা‘আনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘জেনে রাখুন! আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের মধ্যে আমাদেরকে ওয়ালীর সংজ্ঞা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰہِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡہِمۡ وَ لَا ہُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
‘জেনে রাখ! আল্লাহর ওলীদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’; অতঃপর তিনি ওয়ালীদের ব্যাখ্যা করে বলেন, الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত’ (সূরা ইউনুস: ৬২-৬৩)। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ। এখানে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, ওলী কারা? উত্তরে তিনি বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অবলম্বন করত’। ওলীদের বৈশিষ্ট্যগুলো হল, আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করা, যা তাঁকে খুশি করে তার দিকে ধাবিত হওয়া এবং তিনি ছাড়া অন্য সমস্ত কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া’ (আল-ইনছাফ ফী হাক্বীক্বাতিল আওলিয়া, পৃ. ৪৪-৫০)। ইমাম ইবনু কাছীর (রাহিমাহুল্লাহ) সূরা ইউনুসের ৬৩ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘এখানে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, ঐ সকল লোক তাঁর ওলী বা বন্ধু, যারা ঈমান আনয়ন করে এবং তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি অবলম্বন করে। যেমনটি আল্লাহ নিজেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুতরাং এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যিনি তাক্বওয়াবান তিনিই আল্লাহর ওলী। ক্বিয়ামতের আসন্ন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে তাদের কোন ভয় নেই এবং দুনিয়ায় ফেলে আসা কোন বিষয়ে তাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণও নেই’ (তাফসীর ইবনু কাছীর, ৪/২৭৮, সূরা ইউনুস এর ৬২ ও ৬৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ওয়ালায়াহ বা বন্ধুত্ব হল, ‘আদাওয়াহ বা শত্রুতার বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে ওয়ালায়াহ বলতে বুঝায়, ভালোবাসা, হৃদ্যতা, নিকটত্ব, নৈকট্য, সান্নিধ্য, এবং ঘনিষ্ঠতাকে। বলা হয়ে থাকে, ওলীকে ওলী এই জন্যই বলা হয় যে, তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করতে ভালোবাসে। অর্থাৎ তিনি শরী‘আতের পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুগত হয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন’ (আল-ফুরক্বান বায়না আওলিয়াঈর রাহমান ওয়া আওলিয়াঈশ শাইত্বান, পৃ. ৯)। তিনি আরো বলেন, الوَلايةُ هي الإيمانُ والتَّقوى المُتَضَمِّنةُ للتَّقَرُّبِ بالفرائِضِ والنَّوافِلِ ‘ওয়ালায়াহ বা বন্ধুত্ব হল সেই ঈমান ও তাক্বওয়া যার মধ্যে রয়েছে ফরয ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১০/৪৪০ পৃ.)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহর ওয়ালী বা বন্ধু সেই ব্যক্তি যিনি তাঁর সাথে একমত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করেন ঐ সমস্ত বিষয়ে যা তিনি পসন্দ করেন এবং যা তাঁকে আনন্দিত করে এবং তাঁর নির্দেশিত আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হয়’ (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১১/৬২ পৃ.)। ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘ওয়ালায়াহ বা বন্ধুত্ব হল বন্ধুর পসন্দনীয় এবং অপসন্দনীয় বিষয়ে সহমত পোষণ করা’ (আল-জাওয়াবুল কাফী, পৃ. ১৯৪)। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘আল্লাহর ওলী বলতে বুঝায় সেই ব্যক্তিকে যিনি আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সম্যক অবগত, তাঁর আনুগত্যের ক্ষেত্রে অবিচল, অধ্যবসায়ী, নিরবচ্ছিন্ন এবং তাঁর উপাসনায় আন্তরিক’ (ফাৎহুল বারী, ১১/৩৪২ পৃ.)।
উপরিউক্ত আলোচনায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওয়ালায়াহ বা বন্ধুত্ব পাওয়ার দু’টি শর্ত উল্লেখ করেছেন। যথা: (১) ঈমান আনয়ন করা। (২) তাক্বওয়া অবলম্বন করা অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ভয় করে তাঁর আদেশগুলো মেনে চলা এবং নিষিদ্ধ ও হারাম কর্ম থেকে দূরে থাকা। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ উছাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ‘যিনি মুমিন ও মুত্তাক্বী তিনিই আল্লাহর ওয়ালী। আর যে এমন না সে আল্লাহর ওয়ালী নয়। সুতরাং যার মধ্যে যতবেশি পরিমাণে ঈমান ও তাক্বওয়া থাকবে এবং ঈমানী দৃঢ়তা, পরহেযগারিতা ও আল্লাহর আনুগত্য যত নিখাঁদ ও গভীর হবে তিনি ততবেশি আল্লাহর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হবেন। পক্ষান্তরে যার মধ্যে স্বল্প পরিমাণে ঈমান ও তাক্বওয়া থাকবে তিনি স্বল্প পরিমাণে আল্লাহর ওয়ালায়াহ বা বন্ধুত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবেন (মাজমূঊল ফাতাওয়া লি ইবনে তাইমিয়্যাহ, ১০/৬; ফাতাওয়া মুহিম্মাহ লি ইবনে উছাইমীন, পৃ. ৮৩)।
প্রশ্নকারী : জাহিদ, সুনামগঞ্জ।